এক চ্যাম্পিয়ন ট্যাকটিশিয়ানের গল্প

নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে ওঠা পিএসজির সামনে ছিল শিরোপা ছোঁয়ার হাতছানি। কিন্তু উড়তে থাকা বায়ার্নের সাথে পেরে ওঠেনি তারা। সেবার খালি হাতেই ফিরতে হয়েছিল তাকে। এবার দল বদলালেন, সাথে বদলালেন ভাগ্যও। পিএসজির হয়ে যা করতে পারেননি আগেরবার, এবার অনেকটা আন্ডারডগ হিসেবে খেলতে নামা চেলসিকে নিয়ে তা-ই করে দেখালেন তিনি। কোচ হিসেবে প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা জিতলেন তিনি।

বলা হচ্ছিল চেলসির চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী দলের জার্মান কোচ টমাস টুখেলের কথা। জার্মান ঘরোয়া লিগে নিজের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করা টমাস টুখেল লিগ ওয়ানের পর ইংলিশ লিগের কোনো দলের দায়িত্ব নিয়ে নিজের পরিচিতি সমৃদ্ধ করেছেন আরও। লিগ ওয়ানে স্ট্রাসবুর্গকে ৪-০ গোলে হারানোর পর হঠাৎ পিএসজি থেকে বরখাস্তের খবর আসে তার। আবার এদিকে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের অধীনে খুব একটা‌ সফলতার মুখও দেখছিল না চেলসি। দলের আক্রমণভাগ শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন দল থেকে জিয়েচ-ভের্নারদের মতো স্ট্রাইকারের পাশাপাশি থিয়াগো সিলভার মতো ডিফেন্ডার যোগাড় করা সত্ত্বেও কাজের কাজ হচ্ছিল না কিছুই। আর তাই মৌসুমের মাঝপথেই ল্যাম্পার্ডকে সরিয়ে আনা হয় পিএসজি থেকে সদ্য বরখাস্ত হওয়া সেই টুখেলকে। আর তাতেই বাজিমাত!

Image Credit: UEFA/UEFA via Getty Images

ইনজুরিপ্রবণ হওয়ার কারণে খেলোয়াড়ি জীবনে খুব একটা নাম কুড়াতে পারেননি টুখেল। বারবার ইনজুরি-আক্রান্ত হওয়ার কারণে খেলোয়াড় হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারকে একদমই লম্বা করতে পারেননি তিনি। তবে ফুটবলের সঙ্গ ছাড়েননি একেবারেই; হারমেন ব্যাডস্টাবার ও রাল্ফ রেংনিকের সাহচর্য নিয়ে কোচিং ক্যারিয়ারে নামেন তিনি। তারপর থেকে একের পর এক সাফল্য ধরা দেয় তার। কোচিং ক্যারিয়ারের শুরুতে জার্মানির ঘরোয়া লিগের বিভিন্ন ক্লাবের একাডেমি পর্যায়ের দলগুলোতে কোচিং করান তিনি। প্রথম দায়িত্ব পান ২০০০ সালে স্টুটগার্টের অনূর্ধ্ব-১৪‌ দলে। তবে তার কোচিং দক্ষতার প্রমাণ মেলে ২০০৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সহকারী কোচের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে। দায়িত্ব নেওয়ার পরের বছরই অনূর্ধ্ব-১৯ বুন্দেসলিগায় চ্যাম্পিয়ন হয় তার দল। তারপর অগ্সবার্গের প্রধান কোচের দায়িত্বে আসেন টুখেল। পরবর্তীতে ২০০৮-০৯ মৌসুমে মেইঞ্জের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের দায়িত্ব নিয়ে বুন্দেসলিগা জেতেন তিনি।

একাডেমি পর্যায়ে এমন সাফল্য দেখে বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবে কোচিংয়ের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব আসতে থাকে টুখেলের কাছে। এরপর ২০০৯ সালে মেইঞ্জের প্রধান কোচ জর্ন অ্যান্ডারসনের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। অ্যান্ডারসনের অধীনে ভালো সময় যাচ্ছিল না জার্মান দলটির। নিচের সারির দল লুবেকের কাছে হেরে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে পড়ে তারা। আর এই ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে প্রধান কোচের পদ হারাতে হয় তাকে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ধীরে ধীরে মেইঞ্জের ইতিহাসের সফলতম কোচ হয়ে ওঠেন তিনি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নিজেদের ইতিহাসে ম্যাচপ্রতি গড়ে সর্বোচ্চ ১.৪৩ পয়েন্ট অর্জন করেছিল টুখেলের অধীনেই। তার হাত ধরে ২০১১-১২ মৌসুমে ইউরোপা লিগে প্রথমবারের মতো উত্তীর্ণ হয় মেইঞ্জ। তার অধীনেই জার্মানির ঘরোয়া লিগ বুন্দেসলিগায় নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো উত্তীর্ণ হয় তারা। এর আগে ২০০৪ সালে প্রথমবার বুন্দেসলিগায় আসে জার্মান দলটি। সেবার দলের দায়িত্বে ছিলেন আরেক জার্মান কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ।

মেইঞ্জের হয়ে নিজের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন টুখেল ©Getty Images

মেইঞ্জের হয়ে পাঁচটি সফল মৌসুম কাটানোর পর ২০১৫ সালে বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের দায়িত্ব নেন টুখেল। সেখানেও দেখান তার কোচিং ক্যারিশমা। বুন্দেসলিগায় ক্লপের অধীনে আগের মৌসুমে সপ্তম স্থানে থেকে শেষ করা এ দলটি টুখেলের দায়িত্ব নেওয়ার বছরেই দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসেন। সে মৌসুমে গোলসংখ্যার দিক দিয়ে সবার ওপরে ছিল বাভারিয়ানরা (৮২)। ঐ মৌসুমের ইউরোপা লিগে নকআউট পর্বে ইংলিশ লিগের দল টটেনহ্যাম ও পর্তুগিজ দল পোর্তোকে হারায় তারা। অবশ্য লিভারপুলের কাছে হেরে শেষ আটেই থামে তাদের যাত্রা।

মেয়াদের শেষ বছরে আগের তিন মৌসুমে ফাইনাল খেলেও জার্মানির ঘরোয়া আসর ডিএফবি পোকালে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা বাভারিয়ানদের শিরোপা পাইয়ে দিয়েছিলেন টুখেল। আর আগের মৌসুমে দ্বিতীয় স্থানে থাকার সুবাদে ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিরে আসে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড। সে মৌসুমে স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। শেষ আটে মোনাকোর কাছে হেরে থামে তাদের সেবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ যাত্রা।

শুধুমাত্র দলীয় সাফল্যই নয়, হালের অনেক তারকা ফুটবলার তুলে আনতেও টুখেলের ভূমিকা অসামান্য। অবামেয়াং, ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিচ, ম্যাথাইস ব্রান্টসহ আরও অনেকেই উঠে এসেছেন তার হাত ধরেই।

পুলিসিচের মতো বর্তমান সময়ের অনেক তারকা ফুটবলারের উত্থান হয়েছে টুখেলের হাত ধরে © Bundesliga

দলের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে ক্লাব ম্যানেজম্যান্টের সাথে বনিবনা না হওয়ায় তাদের সাথে সম্পর্কে কিছুটা ফাটল দেখা দেয় টুখেলের। গুন্দোয়ান, হামেলসদের মতো দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের ছেড়ে দেওয়া, প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলোয়াড় না পাওয়াসহ ক্লাবের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে অসন্তুষ্ট হন তিনি — যার ফলে চুক্তি নবায়ন করা থেকেও পিছু হটেন। দুই বছরের মাথায় বরুশিয়া ডর্টমুন্ডের দায়িত্বে ইতি টানেন তিনি।

এক বছর বিরতি দিয়ে ২০১৮ সালে টুখেল দায়িত্ব নেন ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট জার্মেইর। তবে প্রথম মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি তিনি। রাউন্ড অফ সিক্সটিনে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে হেরে বিদায় নেয় তার দল। তবে লিগ ওয়ানের পাশাপাশি ট্রফি দেস চ্যাম্পিয়নসের ট্রফিও ঘরে তোলে তারা। প্রথম মৌসুমের সেই সাফল্যের ধারা দ্বিতীয় মৌসুমেও ধরে রাখেন টুখেল। এবার লিগ ওয়ান, ট্রফি দেস চ্যাম্পিয়নস, কোপা দে লা লিগ ও কোপা দে ফ্রান্স — ঘরোয়া ফুটবলের এই চারটি আসরে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সাথে সাথে পিএসজিকে ২০১৯-২০ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ট্রফির একেবারে দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান তিনি। চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠলেও সেবার ফর্মের তুঙ্গে থাকা বায়ার্ন মিউনিখের সাথে পেরে ওঠেনি তারা।

পিএসজিতে এসেও দুটি সফল মৌসুম কাটান তিনি © Getty Images

তবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে ক্লাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে খুব একটা ভালো সম্পর্ক যাচ্ছিল না টুখেলের। ২০১৯-২০ মৌসুম শেষে দলে বেশ কিছু খেলোয়াড়ের ঘাটতি আছে বলে ক্লাব কর্তৃপক্ষকে জানান তিনি। কিন্তু ক্লাবের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এক পর্যায়ে কোচের পদ থেকে বরখাস্ত হন তিনি।

শুধু তিনিই নন, তার সাথে বরখাস্ত হন তার সহকারী কোচ সল্ট লো-ও। ক্লাবের এ সিদ্ধান্তে হতবাক হন লো। তিনি বলেন,

২০২০ সালে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর, পিএসজির হয়ে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জনের পর, চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্ব পার করার পর এবং পূর্ণ উদ্যম নিয়ে লিগ পার করার এ সময়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমার একেবারেই বোধগম্য নয়।

তবে নতুন সন্ধান পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি টুখেলকে। বরখাস্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যেই চেলসিতে ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। তারপর তার হাতের জাদুতে পরিবর্তন হতে থাকে চেলসির অবস্থান। মৌসুমের মাঝপথে এসে দায়িত্ব গ্রহণের পর ইংলিশ লিগে নবম স্থানে থাকা চেলসিকে তুলে আনেন চতুর্থ স্থানে। আর তার সাথে নিশ্চিত হয় ২০২১-২২ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার যোগ্যতা। দায়িত্ব গ্রহণের পর সব ধরনের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩১ ম্যাচের ২০টিতে জয়লাভ করে টুখেলের অধীনে থাকা চেলসি।

ল্যাম্পার্ডের স্থলাভিষিক্ত হয়ে চেলসিকে ভালো অবস্থানে নিয়ে আসেন তিনি © Getty/Goal

ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের অধীনে এ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে গ্রুপ পর্বের গণ্ডি পার হওয়ার পর টুখেলের অধীনে নকআউট পর্ব শুরু করে চেলসি। তারপর একে একে রাউন্ড অফ সিক্সটিনে চলতি মৌসুমের লা লিগা চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, কোয়ার্টার ফাইনালে পোর্তো ও সেমিতে আরেক স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়ালকে হটিয়ে নিজেদের চ্যাম্পিয়নস লিগ ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো ফাইনালে ওঠে তারা। এর আগে ২০০৭-০৮ ও ২০১১-১২ মৌসুমে ফাইনাল খেলে চেলসি, যার মধ্যে ২০১১-১২ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখকে হারিয়ে প্রথমবার শিরোপা ঘরে তোলে তারা। আর এবার ফাইনালে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় চ্যাম্পিয়নস লিগের অন্যতম হট ফেভারিট ম্যানচেস্টার সিটিকে, যারা কি না এই মৌসুমের ইংলিশ লিগের চ্যাম্পিয়ন।

বিগত কয়েক মৌসুম ধরে ইংলিশ লিগে শীর্ষ তিনে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছিল ম্যানসিটি। গার্দিওলার অধীনে থাকা ম্যানসিটি আগের মৌসুমে ইংলিশ লিগে শিরোপা ধরে রাখতে না পারলেও এবার সেই শিরোপা পুনরোদ্ধার করে। চ্যাম্পিয়নস লিগেও তারা ধরে রেখেছিল সেই আধিপত্যের ধারা। গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলোতে প্রতিপক্ষকে একেবারে উড়িয়ে দিয়ে নকআউট পর্বে জায়গা করে নেয় তারা। তারপর মনশেনগ্লাডবাখ, বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ও আগের মৌসুমের রানারআপ পিএসজিকে হারিয়ে ফাইনালে ওঠে সহজেই।

এমন দুর্দান্ত ছন্দে থাকা ম্যানসিটিকে চোখ বন্ধ করেই এবারের চ্যাম্পিয়ন ধরে নিয়েছিলেন অনেকে। তবে চেলসির সে সময়কার পারফরম্যান্স বিবেচনা করলে চেলসিকেও একেবারে ফেলনা ভাবার জো ছিল না। বিশেষ করে টুখেলের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের পারফরম্যান্সই ম্যানসিটির যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবাতে বাধ্য করেছিল।

চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে টুখেল-গার্দিওলার দ্বৈরথ দেখার অপেক্ষায় ছিলেন অনেকে ©Getty Images

আর সেই পারফরম্যান্সের ধারা অব্যাহত থাকে ফাইনালেও। বল দখলের দিক দিয়ে ম্যানসিটির চাইতে পিছিয়ে থাকলেও তারা মোট শট নেয় আটবার, যেখানে ম্যানসিটি শট নেয় সাতবার। তার মাঝে ৪২ মিনিটে ম্যানসিটি গোলরক্ষক এডারসনকে পাশ কাটিয়ে কাই হাভার্টজের করা গোলে এগিয়ে যায় চেলসি। বস্তুত, এই গোলই গড়ে দেয় ম্যাচের ভাগ্য। আর তার সাথে চেলসিকে তাদের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা পাইয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের কোচিং ক্যারিয়ারেও প্রথমবার চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা হাতে নেন টুখেল। মূলত টুখেলের ট্যাকটিকসের কাছেই একপ্রকার হেরে গিয়েছিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা এই স্প্যানিশ ম্যানেজার।

চেলসির সাথে ২০২৪ সাল পর্যন্ত থাকার চুক্তি আছে টুখেলের। আগত দিনগুলোতে কোচিং দক্ষতার প্রমাণ দেখিয়ে নিজেকে নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়- এ প্রত্যাশা করা-ই যায়।

Related Articles

Exit mobile version