‘আজ্জুরি’বিহীন কাতার বিশ্বকাপের নেপথ্যে

রেফারি ক্লেমেন্ত টার্পিন যখন শেষবার হাতে থাকা বাঁশিতে ফুঁ দিলেন, তার সাথে সাথেই পিনপতন নীরবতা নেমে আসে রেনজো বারবেরায়। শুধু স্টেডিয়ামে থাকা দর্শক কেন, পুরো বিশ্বই বিশ্বাস করতে পারছিল না যেটা মাত্র হয়ে গেল মাঠে। সর্বশেষ ৪১টি খেলার মাত্র ১টি খেলায় হারা র‍্যাংকিংয়ে ছয়ে থাকা দলটাকে হারিয়ে দিল ৬৭ নাম্বারে থাকা পুঁচকে উত্তর মেসিডোনিয়া! এই আফসোস আরো বাড়িয়ে দিল তুলনামূলক শক্তিশালী দলটার তৈরি করা ৩২টি গোলের সুযোগ, যার মধ্যে কেবল ৫টিকেই তারা গোলমুখী রাখতে পেরেছিল তারা, অথচ এর মধ্য থেকে গোল হয়নি একটিও! অন্যদিকে মেসিডোনিয়া মাত্র ৪টি সুযোগ থেকে ২টি গোলমুখী শট নিয়ে আদায় করে নেয় একটি গোল। এই একটি গোল শুধু ম্যাচের ভাগ্যই নির্ধারণ করেনি, নির্ধারণ করেছে দলটার বিশ্বকাপভাগ্যও। এতদিন নিজেদের ভুলে কফিনে বানানোর প্রক্রিয়া চললেও সেই কফিনে শেষ পেরেক মারেন আলেক্সান্ডার ত্রাইকোভস্কি, ৯২ মিনিটে একমাত্র গোলটি করে।

বুঝতে নিশ্চয়ই বাকি নেই, শক্তিশালী দলটার নাম ‘ইতালি’।  

প্লে-অফের প্রথম ম্যাচে ইতালিকে বিদায় করে দিয়ে উত্তর মেসিডোনিয়ার খেলোয়াড়দের উল্লাস; Image Credit: DeFodi Images

 

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের জন্য এই প্লে-অফের ড্র হয় প্লে-অফ ম্যাচের ৪ সপ্তাহ পূর্বে। সেই তখন থেকেই অন্তহীন আলোচনা চলছিল পর্তুগাল ও ইতালির মধ্যকার খেলা নিয়ে। সেই খেলার পরিস্থিতি এমন ছিল যে পর্তুগাল হারলে সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নিজের শেষবার বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হারাবেন।

আবার অন্যদিকে যদি ইতালি হারে, তবে বর্তমান ইউরো শিরোপাধারী ও চারবারের বিশ্বকাপজয়ীদের টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ মাঠের বাইরে থেকেই দেখতে হবে। কিন্তু এত সব সমীকরণ পরবর্তীতে চলে যায় হিসেবের বাইরে, এবং পর্তুগাল ইতালির মুখোমুখি না হয়েই চলে যায় বিশ্বকাপে। সেমিফাইনালে তুরস্ককে হারায় পর্তুগাল। কিন্তু অন্য সেমিফাইনালের উত্তর মেসিডোনিয়ার হাতে অঘটনের শিকার হন রবার্তো মানচিনির শিষ্যরা।

পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয় ব্যাপারটি। ইতালি এক বছর আগেও যেমন ফর্মে ছিল, তাতে এমন কিছু যে হবে, তা কেউই আশা করেনি। প্লে-অফে ইতালি যখন নর্থ মেসিডোনিয়ার মুখোমুখি হয়, তখনো হয়তো বা তাদের কারোর মনেই এমন চিন্তা আসেনি যে তারা বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারবে না। ইতালির বর্তমানের স্কোয়াডে যারা রয়েছেন, তাদের মধ্যে কেবল ৮ জনই ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন ভেঙে যাওয়া দলের সদস্য ছিলেন। ৫ বছর আগে যেভাবে তাদের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল, সেইভাবে আবারও আজ্জুরিরা একই পথে পা বাড়ায়।

অবশ্য তারা কেনই বা হেরে যাওয়ার চিন্তা করবে? এই দলটাই তো টানা অপরাজিত ছিল। এই দলটাই তো ইংল্যান্ডকে তাদের উঠোন ওয়েম্বলিতে হারিয়ে ইউরোপ-সেরার মুকুট মাথায় পড়েছে। তারা তো চিন্তা করবে বিশ্বকাপ জয়ের, বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার নয়! পুরো টুর্নামেন্টজুড়েই ইতালির খেলা ছিল একদম মাখনের মতো মসৃণ। ইউরো ২০২০-এ সর্বোচ্চ ১৩টি গোল করেছে দু’টি দল – একটা স্পেন, অন্যটি ইতালি। অন্যদিকে রক্ষণভাগে ইতালির খেলোয়াড়েরা ২৯১ বার বল রিকভারির পাশাপাশি ৯৯টি ট্যাকল করেছে। তো বুঝতেই পারছেন, তারা সব বিভাগেই তাদের সেরাটা দেয়ারই চেষ্টা করেছে।

কিন্তু এর ১০ মাস পর ইতালি পালের্মোর মাঠে যে খেলা দেখাল বিশ্বকে, তাতে সবাই তাদের ইউরো জয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ইউরোতে তাদের যেমন আক্রমণাত্মক মনোভাব, হাই প্রেসিং, মধ্যমাঠে আধিপত্য বজায় রাখা দিয়ে তারা বিশ্বকে মনোমুগ্ধ করেছিল, এরপর এই প্লে-অফে তাদের খেলা দেখে দর্শক হয়েছে বিরক্ত। এমন না যে তারা বোরিং ফুটবল খেলছিল; তারা ঠিকই আক্রমণে যাচ্ছিল, কিন্তু আক্রমণগুলো এতটাই জঘন্য ছিল যে তাতে গোল হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। একে তো প্রচুর গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে শট, সেই সাথে এদিন তারা হারায় মিডফিল্ডের কন্ট্রোলও। গত ইউরোর আগ থেকে তারা ছিল অপরাজিত একটি দল। ইউরো জয়ের পর তাদের ভাবা হচ্ছিল কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম শিরোপাপ্রত্যাশী দল, সেই দলটির এরপর বিশ্বকাপ খেলার জন্য খেলতে হয় প্লে-অফ। কিন্তু সেখানেও স্বপ্নভঙ্গ হয়ে তাদের কাতার অভিযান ৮ মাস আগেই সমাপ্ত করতে হয়।

টানা ৩৭ টি খেলায় ইতালির অপরাজিত থাকার রেকর্ড; Image Credit: The Stats Zone

 

প্লে-অফের ফিক্সচার দেয়ার পর সবচেয়ে বেশি কথা হচ্ছিল এই নিয়ে যে বিশ্বকাপে যাবে কারা – পর্তুগাল না ইতালি? কিন্তু ইতালির ভাগ্যে আসলে প্লে-অফ ফাইনালও ছিল না। আলেক্সান্ডার ত্রাইকোভস্কি ছিলেন পালের্মোর সাবেক খেলোয়াড়। ইতালি ও উত্তর মেসিডোনিয়ার খেলা অনুষ্ঠিত হয় এই পালের্মোর মাঠেই। চেনা-পরিচিত সেই মাঠে ৯২ মিনিটে গোল করে ইতালিকে বিদায় করে দেন ত্রাইকোভস্কি।

আমরা যদি ইতালির এমন বিদায়ের কারণ অনুসন্ধানে নামি, তাহলে তাদের সিস্টেমে প্রচুর ফাঁক দেখতে পাব। এতদিন অপরাজিত থাকায় এই জিনিসগুলো সামনে আসেনি।

ইতালি ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালের বেলজিয়ামের বিপক্ষের খেলা পর্যন্ত তাদের টানা ১৩টি জয়ের একটি ধারা ছিল। এই ধারা চলাকালীন তারা করেছিল ৩৬টি গোল্, আর খেয়েছিল মাত্র ২টি। ইউরোর ফাইনালে ইংল্যান্ডকে হারানোর পর ইতালি কেবল দু’টি ম্যাচ জিতেছিল। সেগুলো হচ্ছে লিথুয়ানিয়ার সাথে ৫-০ গোলে এবং বেলজিয়ামের সাথে ২-১ গোলে। বাদবাকি খেলাগুলোর ফলাফল ছিল বুলগেরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র, সুইজারল্যান্ডের সাথে ০-০ গোলে ড্র, স্পেনের কাছে ১-২ গোলে হার, আবার সুইজারল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র, এবং শেষে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ০-০ গোলে ড্র। শেষ খেলাটি হারতেই হতো, যদি না লিওনার্দো বোনুচ্চি একদম শেষ মিনিটে গোল লাইন ক্লিয়ারেন্স করতে না পারতেন।

ইতালির ইউরো-পরবর্তী খেলাগুলো দেখে আপনি বুঝবেন যে তাদের খেলার মান আস্তে আস্তে কত নিচে নামছিল। স্পেনের বিপক্ষে ১-২ গোলে হারার ম্যাচটি ছিল নেশন্স লিগের সেমিফাইনাল। সেই সাথে এটি ছিল তাদের সর্বশেষ ৪১টি ম্যাচ বাদে প্রথম পরাজয়। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করা ম্যাচে জিতে গেলে কিন্তু ইতালির আর এই প্লে-অফের কঠিন সমীকরণের মুখোমুখি হতে হয় না। সেই খেলায় ৯০ মিনিটে পেনাল্টি মিস করেন জর্জিনহো। একেই বলে কপাল! আর নিজেদের পারফরম্যান্সের এমন ধ্বসের জন্য কোচ মানচিনি দায়ী করেন চলমান ক্লাব মৌসুমের জন্য ট্রেইনিংয়ে পর্যাপ্ত সময় না পাওয়াকে।

মানচিনি দায়িত্ব নেয়ার পর ইতালির খেলার ধরনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। আক্রমণগুলো দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু ইউরোর পর থেকেই আক্রমণের ধার নষ্ট হতে থাকে। মানচিনির অধীনে ইতালির দুই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন লিওনার্দো স্পিনাৎজোলা ও ফেদেরিকো কিয়েসা। এই দুইজনের দীর্ঘমেয়াদী ইনজুরির ফলে পরিবর্তন আনতে হয় ইতালির খেলার ধরনে। তাতেই একদম ধ্বসে পড়ে দলটি।

বামে অ্যাকিলিস টেন্ডন ছিড়ে মাটিতে শুয়ে আছেন স্পিনাৎজোলা, আর ডানে এসিএল ছিঁড়ে মাঠে কাতরাচ্ছেন কিয়েসা; Image Credit: ESPN ও Giuseppe Bellin

 

দেখা যায় ইতালির সিস্টেমের আরেকটি ফাঁক – ইউথ সিস্টেম থেকে তাদের পর্যাপ্ত খেলোয়াড় উঠে না আসা। গত কয়েকবছর সেভাবে ইউথ সিস্টেম উন্নতি না করায় প্রায় বুড়োদের দলে পরিণত হয়েছে ইতালি।

সিরি-আ’র দলগুলোর একাদশগুলো নিয়ে যদি দেখি, তবে দেখব যে সেখানে মাত্র ১৮ জন ইতালির জাতীয় দলের খেলোয়াড় আছে, যারা নিয়মিতভাবে প্রধান একাদশে খেলার সুযোগ পান। জাতীয় দলের স্কোয়াডে এর বাইরে যে ৫-৮ জন থাকেন, তারা নিজ নিজ ক্লাবেও অনিয়মিত খেলোয়াড়। এই মাত্র ১৮ জন নিয়মিত খেলোয়াড় নিয়ে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা হচ্ছে, যখন আপনি কোনো প্রয়োজনে একজনের পরিবর্তে আরেকজনকে খেলাবেন, তখন নিয়মিত খেলার মধ্যে না থাকায় হুট করে নেমে দলের ট্যাকটিক্সের সাথে তাল মিলাতে পারেন না অনেকেই। এর আগে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল গত এক দশকের আর্জেন্টিনা দল। তাদের প্রধান গোলরক্ষক সার্জিও রোমেরোও ক্লাবে ছিলেন একজন বেঞ্চ গরম করা গোলরক্ষক।

ইতালি ভোগা শুরু করল মূলত কখন থেকে? ওই যে স্পিনাৎজোলা আর কিয়েসার ইনজুরির পর থেকে। যে ১৮ জন খেলোয়াড় নিয়মিত খেলেন, তার মধ্যে ৭ জনই সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার (বোনুচ্চি, কিয়েল্লিনি, বাস্তোনি, মানচিনি, তোলোই, আচের্বি)। এখন ৪ জনের ডিফেন্স লাইন নিয়ে খেলা ইতালি দলে সুযোগ পাবেন মাত্র ২ জন। বাকি ৫ জন হয় বেঞ্চে, নাহলে স্কোয়াডেরই বাইরে থাকবেন। এই একই সমস্যা মিডফিল্ডেও। মিডফিল্ডে মানচিনি খেলান ৩ জনকে; এই ৩ জনের মধ্যে ২ জন আবার অটো চয়েজ। তারা হলেন জর্জিনহো আর ভেরাত্তি। এই দুইজন বাদে আর মিডফিল্ডার থাকেন ৫ জন (তোনালি, লোকাতেল্লি, বারেলা, ক্রিস্তান্তে, বোনাভেঞ্চুরা)। এই ৫ জনের লড়াই হয় শুধু একটা পজিশনের জন্য।

১৮ জনের বাদবাকি ৬ জনের মধ্যে একজন রাইটব্যাক (ডি লরেঞ্জো), একজন লেফটব্যাক (বিরাঘি), তিনজন উইঙ্গার (জাক্কাইনি, পলিতানো, ইনসিনিয়ে), এবং একজন স্ট্রাইকার (ইমোবিলে)। এই ১৮ জনের মধ্যে আবার ৭ জনের বয়স ৩০ বছরের উপরে। এইরকম পরিসংখ্যানই বলে দেয়, ইতালির ক্লাবগুলো তরুণ খেলোয়াড় তৈরি করার দিক দিয়ে বর্তমানে ইংল্যান্ড এবং স্পেনের ক্লাবগুলোর থেকে বহু বর্ষ পিছিয়ে রয়েছে।

এহেন পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় ইতালির ক্লাবগুলোর দিকে আঙুল তুলেছেন অনেকেই। তারা যদি তাদের তরুণ খেলোয়াড়দের উন্নয়নে আরো সচেষ্ট হত, তাহলে হয়ত জাতীয় দলের মাত্র ১৮ জন ক্লাব ফুটবলে নিয়মিত মুখ হতেন না। আর পাইপলাইনেও যথেষ্ট খেলোয়াড় থাকত ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের মতো।

তরুণ খেলোয়াড়দের সিরি-আ’তে কীভাবে দেখা হয়, আর ইপিএল বা লা লিগায় কীভাবে? আপনি কখনোই দেখবেন না, ইপিএল বা স্পেনের কুলীন ক্লাবগুলো তাদের বয়সভিত্তিক দল থেকে উঠে আসা খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত নিচু ক্লাবে লোনে পাঠাচ্ছে। তারা পারলে নিজেদের লিগেই লোনে দেয়, না পারলে অন্য দেশের টপ লেভেলের লিগে; এটাও না হলে নিজেদের দেশেই দ্বিতীয় বিভাগে পাঠায়। কিন্তু ইতালিতে পুরোপুরি এমন নয় বিষয়টা। ইতালির খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট বাকিদের মধ্যে অধিকাংশই ঘরকুনো। এতে অসুবিধা যা হয়েছে, ইতালির খেলোয়াড়েরা বাইরের দেশের লিগগুলোতে খেলার সুযোগ পায় না। না খেলায় অন্যান্য দেশের প্লেয়িং কন্ডিশন, পরিবেশ, খেলোয়াড়দের শক্তিমত্তা দুর্বলতা নিয়ে ধারণা খুব কমই থাকে। আবার এই ঘরকুনো স্বভাবের জন্যও অন্য দেশের ক্লাবগুলো ইতালির খেলোয়াড়দের নিতে আগ্রহ তেমন দেখায় না।

রিয়াল মাদ্রিদ থেকে লোনে এসে আর্সেনালের হয়ে মার্টিন ওডেগার্ড ও দানি সেবায়োস। টানা দুই বছর এখানে লোনে থাকা সেবায়োস সদ্যসমাপ্ত মৌসুমের শুরুতে ফিরে গিয়েছিলেন মাদ্রিদে। কিন্তু ৬ মাসের লোনে আসা ওডেগার্ড পরবর্তীতে এখানেই চলে আসেন পাকাপকিভাবে; Image Credit: Getty Image

 

তরুণ খেলোয়াড়দের নিয়ে যেহেতু কথা হচ্ছিলই, তবে সেখানে একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ইতালির ইতিহাসের অন্যতম সেরা দল জুভেন্টাস। তাদের দলে রয়েছেন ২১ বছর বয়সী এক তরুণ মিডফিল্ডার – নিকোলো ফ্যাজিওলি। এই ফ্যাজিওলি জুভেন্টাসের যুবদলের সাথে যুক্ত রয়েছেন সেই ২০১৫ সাল থেকে। সিরি-সি’তে খেলা জুভেন্টাসের অনুর্ধ্ব-২৩ দলের একজন নিয়মিত সদস্য ছিলেন তিনি। সেখানে তার পারফরম্যান্স এতই ভাল ছিল যে জুভেন্টাসের তৎকালীন কোচ আন্দ্রে পিরলো তাকে ২০২০-২১ মৌসুমের জন্য মূল দলেই রাখেন। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে মূল দলের হয়ে তার অভিষেকও হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কোচের মন জয় না করতে পারায় তাকে লোনে পাঠানো হয় সিরি-বি’র দল ক্রেমোনেসে। সেখানে মিডফিল্ড থেকে তিনি ৩ গোলের পাশাপাশি গোল করান ৭টি, যা ওই দলে সর্বোচ্চ। ক্রেমোনেস মাত্র ২ পয়েন্টের ব্যবধানে লিগে দ্বিতীয় হয়। কিন্তু এইভাবে উপরের স্তরে উঠে এসেও পরে নিচের স্তরে নেমে যাওয়া নিয়ে ফ্যাজিওলি যে খুশি নন, তা প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন।

ক্রোতোনের বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে ফ্যাজিওলি; Image Credit: Jonathan Moscrop

 

আপনি হয়তো বলতে পারেন যে ফ্যাজিওলি এখনো জুভেন্টাসের মিডফিল্ডে খেলার উপযোগী নন। কিন্তু গত ৩ বছর ধরে আপনি যদি জুভেন্টাসের খেলা দেখেন, তবে তাদের মিডফিল্ড নিয়ে আপনার ভালো একটা ধারণা থাকার কথা। কতটা অপব্যবহার হলে অ্যারন রামজির মতো মিডফিল্ডারকে লোনে পাঠানো হয়!

আচ্ছা, ধরেই নেওয়া যাক যে ফ্যাজিওলি মূল দলের উপযোগী নন। কিন্তু জুভেন্টাসের নিচে টেবিলে যেসব দল রয়েছে, সেগুলোতে খেলার উপযুক্তও কি নন তিনি? চাইলেই তো তাকে রেলিগেশন জোনে লড়াই করা দলগুলোতে পাঠানো যেত তাদের সাহায্য করার জন্য। ঐ টেবিলের নিচের দলগুলোও আসলে আগ্রহ দেখায়নি। অন্যান্য ইতালিয়ানদের মতো তারাও কোনো তরুণের উপর বিশ্বাস রাখতে পারেনি।

এই বিশ্বাসের অভাবটাই জাতীয় দলেও প্রতীয়মান হচ্ছে। ৩০ বছর বয়সের উপরে যে ৭ জন খেলোয়াড় রয়েছেন, তারা মোট ৩৮৩টি খেলায় নেমেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে। এর নিচে ১৮ জনের মধ্যে বাকি যে ১১ জন রয়েছেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৩ জন (বারেলা, ক্রিস্তান্তে ও লোকাতেল্লি) কেবল ২০টির বেশি খেলায় ছিলেন। পার্থক্যটা ধরতে পেরেছেন এখানে? তাহলে বলুন, তরুণেরা উঠবে কী করে?

প্রসঙ্গত, এখানে আমরা আরো একটি কথা বলতে পারি যে ইতালি আসলে হেরে যাওয়াটাই ভুলে গিয়েছিল। ইউরোর আগ অব্দি বেশিরভাগ খেলাই ছিল রক্ষণাত্মক। রক্ষণাত্মক খেলার ফলে কোনো ম্যাচে শুরুতে গোল খেয়ে গেলে কী করবে, তা নিয়ে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তাদের এমন ‘সেফ গেম’-এর সুযোগ নিয়ে যখন অন্য দল এগিয়ে গিয়েই বাস পার্ক করত, তখন ইতালির ঘাম ছুটে যেত ম্যাচ বের করতে। ইংল্যান্ডের ইউরোর ফাইনাল, কিংবা বিশ্বকাপ বাছাইয়ে সুইজারল্যান্ড কিংবা স্পেনের কাছে নেশন্স লিগে সবগুলো খেলাতেই ইতালির এই দুর্বলতা দেখা গিয়েছিল। এইরকম খেলার জন্য অনেকেই ইতালির ইউরো জেতাটা একরকম ‘অঘটন’-এর চোখে দেখেছিল। ১-২ গোলে জেতাই ছিল তাদের সাফল্য। এরপর যখন দেখা গেল কিয়েসার ইনজুরির পর থেকে সেই ১-২ গোল আসার স্রোতটা থেমে গেছে, তখনই পালটে যায় পাশার দান।

পরিসংখ্যানটাও পালটে যায় এর পরই। সেমিফাইনাল ও ফাইনাল – দুটো খেলাতেই তারা জেতে টাইব্রেকারে। আর উত্তর মেসিডোনিয়ার কাছে ধরাশায়ী হওয়া পর্যন্ত তারা ৯টি ম্যাচ খেলে; জেতে মাত্র ২টিতে, ড্র করে ৬টি, হারে ১টি। এই ৯টি খেলায় তাদের কাছ থেকে গোল আসে মাত্র ১৩টি। আবার এই ১৩টি গোলের ৫টিই আসে দুর্বল লিথুয়ানিয়ার বিরুদ্ধে ঐ এক ম্যাচেই।

***

অনেক তো সিরিয়াস কথা বলা হলো এতক্ষণ। শেষ করছি একটি হাস্যোরসাত্মক তত্ত্ব দিয়ে।

লুইস সুয়ারেজের কামড় খাওয়ার পর থেকে ইতালি আর বিশ্বকাপ খেলতে পারেনি। জ্বী, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বে লুইস সুয়ারেজ কামড় দেন জর্জিও কিয়েল্লিনিকে। এটাই বিশ্বকাপে ইতালির শেষ খেলা। এখন আপনি যদি একে সুয়ারেজের শাপ হিসেবে দেখেন, তবে ভাবতেই পারেন এই কারণে ইতালি আর আসতে পারছে না। 

ইয়ে, আবারও বলছি, স্রেফ মজা করেই বলা কথাটা। 

কামড় দেয়ার পর দাঁত ধরে ব্যথা পাওয়ার ভান ধরছেন সুয়ারেজ, পাশেই কামড় খেয়ে রেফারির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন কিয়েল্লিনি; Image Credit: Ricardo Mazalan

 

তবে ‘মন্দের ভালো’ বলেও একটা কথা রয়েছে। ৩০ বছরের উপরে যারা রয়েছেন, তাদের অনেকেই যার যার ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে রয়েছেন। কিয়েল্লিনি, বোনুচ্চি, ইনসিনিয়ে, ইমোবিলে প্রত্যেকেই আস্তে আস্তে তাদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ইস্তফা দিচ্ছেন। তাদের বদলি হিসেবে যদি বাস্তোনি, রাসপাদোরি, স্ক্যামাচ্চাকে উঠিয়ে এনে সুযোগ দিয়ে দলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তবে তা হবে রবার্তো মানচিনির জন্য একটি সাহসী পদক্ষেপ।

ইতালির জন্য পরবর্তী বড় প্রতিযোগিতা হবে ২০২৪ সালের ইউরো, এর আগে নেশন্স লিগ থাকলেও এটিকে বড় প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি হিসেবেই দেখে বেশিরভাগ দেশ। সেই হিসেবে বলা যায়, ইতালি যদি চায়, তাদের সামনে আরো ২ বছর রয়েছে দল গোছানোর জন্য। তবে জন্য ক্লাব ও কোচদের সদিচ্ছা থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে এখন। নতুবা ঝুঁকি না নেয়ার ভয়ে হয়তো বা আবারও মুখ থুবড়ে পড়তে পারে তারা।

Related Articles

Exit mobile version