প্রমথ চৌধুরীর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করা যাক। ‘সাহিত্যে খেলা’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন,
“এ পৃথিবীতে একমাত্র খেলার ময়দানেই ব্রাহ্মণ-শূদ্রের ভেদ নেই।”
হয়তো এ কারণেই খেলাপাগল মানুষ সামান্য ফুরসত পেলেই প্রিয় দলের খেলা উপভোগ করতে ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে গিয়ে জড়ো হন। আর খেলার নাম যদি হয় ফুটবল, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ফুটবল বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, এই নির্মল আনন্দলাভের মাধ্যমেও অশান্তির অভিশাপ এসে ভর করেছে। কখনো নিছক দুর্ঘটনা, কখনো উগ্র সহিংসতা- এভাবে বিভিন্ন সময়ে ফুটবল মাঠে নানা কারণে হতাহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সবুজ মাঠের বুকে ঢলে পড়েছে লাল রক্তের হতাশা।
বিশ্বে নানা ধরণের মানুষ রয়েছেন, বর্ণ-মত-ধর্ম-পেশাভেদে মানুষে মানুষে বিভেদের বিশেষ অভাব নেই। তবু সব শ্রেণীর সকল মানুষকে এক ছাদের নিচে আনতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে খেলাধুলা, আরও কিছুটা স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায়, ফুটবল। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা এই ফুটবল, অন্তত ২১০টি দেশে প্রায় নিয়মিতভাবেই এই খেলার চর্চা রয়েছে। তাই এই খেলাতে যেমন উন্মত্ততার পরিমাণ বেশি, দারুণ কিছু মুহূর্তের পাশাপাশি এই খেলা কখনও কখনও ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ও দেখতে বাধ্য করে আমাদেরকে। এমন কিছু ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়েই আমাদের এই লেখাটি।
বার্নডেন পার্ক বিপর্যয়
তারিখ: ৯ই মার্চ, ১৯৪৬
স্থান: বার্নডেন পার্ক, বল্টন, ম্যানচেস্টার, ইংল্যান্ড
আহত: ৪ শতাধিক
মৃতের সংখ্যা: ৩৩ জন
বার্নডেন পার্ক স্টেডিয়াম, বল্টন ওয়ান্ডারার্স আর স্টোক সিটির মধ্যে খেলা চলছে। হঠাৎ করে স্টেডিয়ামের এক পাশের দেয়াল ধ্বসে পড়তে শুরু করলো, দর্শকরা ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড় দিলে ৩৩ জন মানুষ ধ্বসে যাওয়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে মারা যায় এবং প্রায় ৪০০ জনেরও বেশি আহত হয়। মাঠে সেদিন উপস্থিত ছিল প্রায় ৮৫ হাজার দর্শক। বাইরে আঁটকে থাকা আরও ২০ হাজার দর্শক গেট ভেঙ্গে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে দুর্ঘটনাটি ঘটে বলে জানা যায়। ১৯৭১ সালের রেঞ্জার্সের ইব্রোস পার্কে ঘটা দুর্যোগের আগপর্যন্ত এটি ছিল ব্রিটিশ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুঃখজনক ঘটনা।
দ্য হেসেল বিপর্যয়
তারিখ: ২৯শে মে, ১৯৮৫
স্থান: হেসেল স্টেডিয়াম, ব্রাসেলস, বেলজিয়াম
আহত: ১০০ থেকে কিছু বেশি
মৃতের সংখ্যা: ৩৯ জন
খেলা নিয়ে দর্শকদের মারামারিই ছিল এই ঘটনার পেছনে প্রধান কারণ। ১৯৮৪ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল খেলায় লিভারপুল রোমাকে হারালে খেলা শেষে রোমার ভক্তরা স্টেডিয়ামের বাইরে লিভারপুলের ফ্যানদের আক্রমণ করে। এর ফলে দুই দেশের ভক্তদের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। পরের বছর আরেকটি ম্যাচে যখন জুভেন্টাস এবং লিভারপুল মুখোমুখি হয়, তখন ঘটে বড় রকমের দুর্ঘটনা।
১৯৩০ সালে নির্মিত হেসেল স্টেডিয়ামের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না, একপাশের অবস্থা ছিল বেশি গুরুতর। তা সত্ত্বেও ১৯৮৫ সালের ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনাল খেলাটি সেখানেই অনুষ্ঠিত হয়। খেলা শুরুর প্রায় ঘন্টাখানেক আগে হঠাৎ লিভারপুল ভক্তরা বেড়া ভেঙে জুভেন্টাস সমর্থকদের উপর চড়াও হয়। জুভেন্টাসের ভক্তরা তখন পিছু হটতে শুরু করলে এর কিছুক্ষণ পর পেছনের দেয়ালটি তাদের উপর ভেঙে পড়ে। এতে নিহত হয় প্রায় ৩৯ জন মানুষ এবং আহতের সংখ্যা ছিল শতাধিক। জুভেন্টাস সমর্থকরা তখন বিশৃঙ্খলা শুরু করে। পুলিশ এসে তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করলে তারা পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে পাথর আর বোতল নিক্ষেপ করে। এত কিছুর পরও খেলা বন্ধ হয়নি এবং খেলায় জুভেন্টাস শেষমেশ ১-০ গোলের ব্যবধানে জয়লাভ করে। ঘটনার পর ইংলিশ ক্লাবগুলোকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে সকল ইউরোপিয়ান আসর থেকে বহিষ্কার করা হয়, যা ১৯৯০-৯১ সিজন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। বিপর্যয়টিকে ‘উয়েফার ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায়’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
ওর্কনি বিপর্যয়
তারিখ: ১৩ই জানুয়ারি ১৯৯১
স্থান: ওপেনহাইমার স্টেডিয়াম, ওর্কনি, সাউথ আফ্রিকা
মৃতের সংখ্যা: ৪২ জন
ফুটবল নিয়ে ভক্তদের এই ধরণের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পায়নি দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশও। খনি-কেন্দ্রিক শহর ওর্কনির দুটি ক্লাব কাইজার চিফ এবং দ্য অরলান্ডো পাইরেটসের মধ্যে প্রাক-মৌসুম প্রীতি ম্যাচ চলছিল। হঠাৎ পাইরেটসের এক ভক্ত ছুরি নিয়ে চিফসের দর্শকদের উপর আক্রমণ করে। এতে করে সবাই আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করলে পদদলিত হয়ে মারা যায় ৪২ জন মানুষ।
এলিস পার্ক স্টেডিয়াম বিপর্যয়
তারিখ: ১১ই এপ্রিল ২০০১
স্থান: এলিস পার্ক স্টেডিয়াম, জোহানেসবার্গ, সাউথ আফ্রিকা
মৃতের সংখ্যা: ৪৩ জন
গতবারের ঘটনায় শিক্ষা হয়নি দক্ষিণ আফ্রিকানদের। ১০ বছর প্রায় একই ধরণের দুর্ঘটনা ঘটে, কিন্তু ব্যতিক্রমভাবে। আবারও খেলা ছিলো সেই কাইজার চিফস আর অরলান্ডো পাইরেটসের মধ্যে। ৬০ হাজার দর্শকে মাঠ ছিল পরিপূর্ণ, আরও ৩০ হাজার দর্শক ভেতরে ঢোকার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে নিজেদের আসন রক্ষার চেষ্টায় প্রেস বক্স থেকে বেশ কয়েকজন দর্শক ছিটকে নিচে পড়ে যায়।
এতে প্রাণহানি ঘটে ৪৩ জন মানুষের। আনাড়ি কিছু নিরাপত্তা রক্ষী ভিড়ের উদ্দেশ্যে কাঁদুনে গ্যাস ছুড়লে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কী ঘটছে সেটা বুঝে উঠার পর খেলা থামিয়ে দেওয়া হয় এবং দর্শকরা মাঠে নেমে আসেন। এই ঘটনাটি আফ্রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া দুর্ঘটনা হিসেবে ধরা হয়।
কাইসেরি আতাতুর্ক স্টেডিয়াম ট্রাজেডি
তারিখ: ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮
স্থান: কাইসেরি স্টেডিয়াম
আহত: ৬০০ জন
মৃতের সংখ্যা: ৪৪ জন
খেলা চলছিল কাইসেরি আর্সিঅ্যাস্পার বনাম সিভাস্পর তুর্কি ক্লাবের। হঠাৎ করে দুই দলের বেশ কিছু সমর্থকদের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়, যার ফলে নিহত হয় ৪৪ জন মানুষ এবং আহতের সংখ্যা ছিল ৬০০। মারামারির সময় বন্দুক, ছুরিসহ অন্যান্য অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
ব্র্যাডফোর্ড সিটি অগ্নিকাণ্ড
তারিখ: ১১ই মে ১৯৮৫
স্থান: ভ্যালি প্যারেড স্টেডিয়াম, ব্র্যাডফোর্ড, ইংল্যান্ড
আহত: ৪৫০ জন
মৃতের সংখ্যা: ৫৬ জন
তৃতীয় বিভাগীয় ফুটবল লিগের শেষ ম্যাচ, খেলা চলছিল ব্র্যাডফোর্ড সিটি এবং লিংকন সিটির মধ্যে। খেলার মধ্যবিরতির পাঁচ মিনিট আগে মাঠের সাতাত্তর বছরের পুরনো স্ট্যান্ডের পেছন থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যার। তারপর পুলিশ দর্শকদের সেখান থেকে সরিয়ে আনতে শুরু করে। তিন মিনিট পরে সেখানে আগুন জ্বলতে শুরু করলে রেফারি ডন শো খেলা বন্ধ করে দেন। সমর্থকরা মাঠে অবস্থান নেয়। ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে আগুন বৃদ্ধি পায় এবং দুই মিনিটের মাথায় মূল স্ট্যান্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। বেরোবার পথ সংকীর্ণ হবার কারণে বেশ কিছু দর্শক ভেতরে আটকা পড়ে যায়। আগুন খুব দ্রুত স্ট্যান্ডের কাঠের ছাদে ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে গরম তক্তা এবং আলকাতরা গলে নিচের দর্শকদের উপর ছিটকে পড়তে শুরু করে। ভয়ংকর এই অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ৫৬ জন মানুষ এবং আহত হয় ৪৫০ জন।
ধারণা করা হয়, পেছনের সিটের নিচের ফাঁক দিয়ে একজন দর্শক জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিলে সেটি স্ট্যান্ডের নিচের আবর্জনায় গিয়ে পড়ে যা কিনা প্রায় ২০ বছর ধরে সেখানে জমিয়ে রাখা হচ্ছিল এবং সেখান থেকেই আগুনের সৃষ্টি হয়।
ইব্রোক্সের দ্বিতীয় দুর্ঘটনা
তারিখ: ২রা জানুয়ারি ১৯৭১
স্থান: ইব্রোক্স স্টেডিয়াম, গ্লাসগো, স্কটল্যান্ড
আহত: ২০০ জন থেকে কিছু বেশি
মৃতের সংখ্যা: ৬৬ জন
১৯৭১ সালে একটি বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে এই স্টেডিয়ামে। রেঞ্জারস বনাম সেলটিকের মধ্যকার গোলশূন্য ম্যাচের ৮৯ মিনিটের মাথায় সেল্টিক এক গোলে এগিয়ে গেলে রেঞ্জারসের দর্শকরা স্টেডিয়াম থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করে। তারা যখন বের হয়ে যাচ্ছিল, অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে ১৩ নাম্বার সিঁড়ির বাঁধ খুলে গেলে মারাত্মক দুর্ঘটনাটি ঘটে। এতে মারা যায় ৬৬ জন মানুষ এবং আহত হয় ২০০ জনেরও বেশি।
একই স্টেডিয়ামে এরকম দুর্ঘটনা আগেও ঘটেছে, ১৯০২ সালে মাথার উপরের স্ট্যান্ড ভেঙ্গে পড়ায় মারা গিয়েছিল ২৫ জন মানুষ এবং আহতের সংখ্যা ছিল ৫০০ এরও বেশি। পরে আবার ১৯৬১ সালে সিঁড়ি ভেঙে পড়ায় মারা গিয়েছিল ২ জন মানুষ।
দ্য লুজনিকি বিপর্যয়
তারিখ: ২০শে অক্টোবর ১৯৮২
স্থান: লেনিন স্টেডিয়াম, মস্কো, রাশিয়া
মৃতের সংখ্যা: ৬৬ জনেরও বেশি
বর্তমানে লুজনিকি নামে পরিচিতি লেনিন স্টেডিয়ামের এই দুর্ঘটনাটি ঘটে এফসি স্পার্টাক এবং এইচএফসি হারলেমের উয়েফা কাপের খেলার সময়। ম্যাচের জন্য বিক্রি করা টিকেটের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম ছিল, যার ফলে শুধুমাত্র পূর্ব দিকের স্ট্যান্ডটি দর্শকদের জন্য খোলা ছিল এবং নিরাপত্তাজনিত কারণে স্ট্যান্ড থেকে বের হবার জন্যে শুধুমাত্র একটি পথ খোলা ছিল।
খেলায় এফসি স্পার্টাক ১-০ তে এগিয়ে থাকার কারণে শেষ বাঁশি বাজার কিছুক্ষণ আগে থেকেই দর্শকরা গ্যালারি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। তারপর ইনজুরি টাইমে এফসি স্পার্টাক আরেকটি গোল করলে বের হয়ে যাওয়া দর্শকরা আবার ফিরে আসতে শুরু করে। এতে গ্যালারিতে ফিরে আসা দর্শকদের সাথে ঐ সময় স্টেডিয়াম ত্যাগ করা দর্শকদের সংঘর্ষ বাঁধে। তাছাড়া রাশিয়ান রক্ষীবাহিনী বের হয়ে যাওয়া দর্শকদের পুনরায় স্টেডিয়ামে ঢুকতে না দিলে বড় রকমের দাঙ্গা শুরু হয়। এর এক পর্যায়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড় শুরু করে, যার ফলে প্রায় ৬৬ জন মানুষ মারা যায়। তবে নিহতদের আত্মীয়দের মতামত অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৪০ জন।
সোভিয়েত সরকার দুর্ঘটনার ব্যাপারটি প্রথম দিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল এবং পরে দুর্ঘটনার দোষ চাপিয়ে দেয় সমর্থকদের উপরেই। দুর্ঘটনার প্রায় ১৩ দিন পরে নিহতদের সমাহিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। উয়েফার দেয়া তথ্য অনুযায়ী এই দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা যদি আসলেই ৩৪০ এর বেশি হয়ে থাকে, তাহলে এটি ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হওয়ার কথা।
পুয়ের্তা ১২ ট্রাজেডি
তারিখ: ২৩শে জুন ১৯৬৮
স্থান: এস্তাদিও মনুমেন্টাল, বুয়েন্স আয়ার্স, আর্জেন্টিনা
আহত: ১৫০ জনেরও বেশি
মৃতের সংখ্যা: ৭১ জনেরও বেশি
এই দুর্ঘটনাটি নিয়ে কয়েকটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এর একটিতে বলা হয়, রিভার প্লেট বনাম বোকা জুনিয়র্সের ম্যাচ শেষে মাঠ থেকে কিছু দর্শক ভুলক্রমে বন্ধ একটি পথের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় পেছনের দর্শকদের চাপে সামনের দর্শকরা মারা যায়! আবার আরেকটি তথ্যে ঘটনাটির কারণ হিসেবে জানানো হয় যে, বোকা জুনিয়রের সমর্থকরা রিভার প্লেটের জ্বলন্ত পতাকা ছুঁড়ে মারলে তা নিজেদের সমর্থকদেরই নিচের সারিতে পড়লে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড় দিলে প্রাণহানির ঘটনাটি ঘটে।
অন্য আরেকটি তথ্যে এই দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী করা হয় রিভার প্লেটের সমর্থকদের। তারা বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকদের সেকশনে হাঙ্গামা করলে নাকি দুর্ঘটনাটি ঘটে। তবে রিভার প্লেটের সাবেক প্রেসিডেন্ট ঘটনাটির বিরোধীতা করে বলেন যে, আসলে এর পেছনে মূল অপরাধী ছিল স্টেডিয়ামের পুলিশ বাহিনী। তারা বোকা জুনিয়র্সের সমর্থকদের থামানোর জন্যে তাদের দিকে প্রস্রাব ছুড়ে মারার কারণে দর্শকরা এভাবে ছুটোছুটি শুরু করে। কয়েকজন সাক্ষীর মতামত অনুযায়ী বের হবার রাস্তা একটি বিশাল লৌহদণ্ড দিয়ে বন্ধ করা ছিল। দর্শকরা না জেনে সে দিকেই ছুটে গেলে পেছনের দর্শকদের প্রচণ্ড চাপে সামনের দর্শকরা মারা যায়।
অবশ্য তিন বছর তদন্তের পরও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এ ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আজও প্রকৃতভাবে জানা যায়নি; কেউ বলে ৭১ জন, কেউ ৭২ জন, আবার কেউ বা ৭৪ জন।
পোর্ট সাইড স্টেডিয়ামে মারামারি
স্থান: পোর্ট সাইড স্টেডিয়াম, মিশর
হতাহতের সংখ্যা: নিহত ৭৯ জন এবং আহত ১ হাজারেরও বেশি
দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। খেলা চলছিল মিশরের চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল আল-মাসরি এবং আল-আহলির মধ্যে। এই দু’দলের মধ্যকার দ্বৈরথটা অনেক দিনের।সেই কারণে তাদের সমর্থকদের মাঝে প্রায়ই সংঘর্ষ বাঁধতো।
সেদিনের খেলায় আল-মাসরি ৩-১ গোলে জয়লাভ করে। বিপত্তিটা বাধে খেলা শেষ হওয়ার পর। রেফারি ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজানোর পর আল-মাসরির সমর্থকরা তীব্র উল্লাস করতে করতে স্ট্যান্ড থেকে বের হয়ে এসে আল-আহলির সমর্থক ও খেলোয়াড়দের উপর নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করে। অস্ত্র হিসেবে তাদের কাছে ছিল ছুরি, মুগুর, বোতল, আতশবাজি, এমনকি তলোয়ারও! এই সংঘর্ষে কমপক্ষে ৭৯ জন মানুষ মারা যান এবং আহত হন এক হাজারেরও বেশি।
কাঠমান্ডু বিপর্যয়
স্থান: জাতীয় স্টেডিয়াম, কাঠমান্ডু, নেপাল
হতাহতের সংখ্যা: নিহত ৯৩ জন এবং আহত শতাধিক
১৯৯৮ সালের মার্চ মাসের ১২ তারিখ। বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যকার খেলা চলছিল। খেলার তখনও শেষ বাঁশি বাজেনি, হঠাৎ করেই স্টেডিয়ামে উপস্থিত প্রায় ৩০ হাজার দর্শকের উপর শিলাবৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর দর্শকরা চিৎকার করতে করতে স্টেডিয়ামের ৮টি বহির্গমন দরজার দিকে ছুটে যায়, কিন্তু খোলা পায় মাত্র একটি। তখন সবাই একসাথে বের হবার চেষ্টা করলে ২ পুলিশ অফিসার সহ ৭০ জনেরও বেশি মানুষ পদদলিত হয়ে অথবা দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। সরকারি টেলিভিশনের ভাষ্যমতে, ৭৩ জন মানুষ মারা যায় এবং পরে আরো ২০টি মৃতদেহ স্বজনেরা উদ্ধার করে। একপর্যায়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ জনে এবং আহত হন ১০০ জনেরও বেশি।
সেদিন জীবন বাঁচাতে পালানোর চেষ্টা করা মানুষগুলো যদি সবগুলো রাস্তা খোলা পেতেন, তাহলে হয়তো পুরো গল্পটাই ভিন্নভাবে বলা যেতো।
হিলসবরো দুর্ঘটনা
স্থান: হিলসবরো স্টেডিয়াম, শেফিল্ড, ইংল্যান্ড
হতাহতের সংখ্যা: নিহত ৯৬ জন এবং আহত ৭৬৬ জন
১৯৮৯ সালের ১৫ এপ্রিল, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই শেফিল্ডের হিলসবরো স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে লিভারপুল বনাম নটিংহাম ফরেস্টের মধ্যকার এফ. এ কাপের সেমিফাইনাল খেলা। খেলা শুরু হওয়ার আগে প্রবেশমুখের ঘূর্ণায়মান দরজাগুলোর সামনে জড়ো হন অসংখ্য দর্শক। চারদিকে মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে ভক্তরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ভেতরে প্রবেশের পথ মানুষের ঢলে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এমনকি যারা ভেতরে ছিলেন, তারাও এক পা নড়তে পারছিলেন না পেছনের মানুষের চাপে পিষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয়ে। কয়েকজনকে বের করে দেওয়ার জন্য নিরাপত্তকর্মীরা অন্য একটি দরজা খুলে দিলে সেটার মধ্য দিয়েই আরও প্রায় ২০ জন মানুষ ঢুকে পড়ে। ধারণা করা হয়, তখন প্রায় ৫,০০০ মানুষ ওই ঘূর্ণায়মান দরজাগুলো দিয়ে ভিতরে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন এবং ঠিক সেই সময় পুলিশ বহির্গমন দরজা হিসেবে ব্যবহারের জন্য আরেকটি দরজা খুলে দিলে কিছু দর্শক ওগুলো দিয়েই উল্টো দিক থেকে প্রবেশের চেষ্টা করে।
এর ফলে ঘটনাস্থলে ভক্তদের মধ্যে এতোটাই আঁটসাঁট অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, অনেকেই শ্বাসকষ্টের শিকার হয়ে মারা যায়। এছাড়া দু’দিকের চাপাচাপিতে মোট ৯৫ জন মারা যায় এবং আরও ৭৬৬ জন আহত হয়। মৃতের সংখ্যা ৯৬তে পৌছায় যখন ঐ দুর্ঘটনায় আহত এক ব্যক্তি ৪ বছর কোমায় থাকার পর মৃত্যুবরণ করে।
ঘানার বিপর্যয়
স্থান: আক্রা ক্রীড়া স্টেডিয়াম, আক্রা, ঘানা
হতাহতের সংখ্যা: নিহত ১২৬ জন
এই দুর্ঘটনাটি ঘটে ২০০১ সালের মে মাসের ৯ তারিখ এবং এর সূত্রপাত হয় আক্রা ক্রীড়া স্টেডিয়ামে দুই প্রিমিয়ার লিগ প্রতিদ্বন্দ্বী হার্টস অফ ওকস বনাম আসান্তে কোটোটোর মাঝে ম্যাচ শেষে। খেলা শেষে দু’দলের সমর্থকেরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে ১২৬ জন মৃত্যুবরণ করে। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া উগ্র ভক্তদের উপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করলে ৭০,০০০ দর্শক একসাথে বের হওয়ার চেষ্টা করলে অগণিত মানুষ আহত হয়। ঘানার এক সাংবাদিক আশিয়েতেই ওদান্তন বলেন যে, ঘটনার সময় স্টেডিয়ামের সকল গেট বন্ধ রাখা হয়েছিল বলে জানা গেছে এবং পুলিশ বেশি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
“ওখানে ধোঁয়া এবং জঞ্জাল ছিল, এবং আমি কমপক্ষে ১৫ জনকে স্টেডিয়ামের একাংশে পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। কয়েকজন আহত ছিল এবং কয়েকজন ছিল মৃত।”
অনেক আগে থেকেই এই দু’দলের মাঝের খেলাগুলো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল বলে সেদিনের ম্যাচ পুলিশের নজরদারিতে ছিল। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি, পুলিশের উপস্থিতি বরং অবস্থা আরও বেগতিক করে দিয়েছিল। হার্টস অফ ওকসের প্রধান নির্বাহী হ্যারি জাকোরপরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কর্মরত পুলিশের আচরণের সমালোচনা করে বলেন যে, “মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য একটি শেলই যথেষ্ট ছিল, এটা অত্যন্তই দুঃখজনক একটি ঘটনা।”
এস্তাদিও নাসিওনাল দুর্যোগ
স্থান: এস্তাদিও নাসিওনাল, লিমা, পেরু
হতাহতের সংখ্যা: নিহত ৩১৮ জন এবং আহত ৫০০ জনের বেশি
১৯৬৪ সালের ২৪ মে পেরুর জাতীয় স্টেডিয়ামে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে আখ্যায়িত করা হয় ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই ঘটনা সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই জানা যায়নি। অলিম্পিকের বাছাইপর্বের খেলায় সেদিন আর্জেন্টিনা মোকাবিলা করছিল স্বাগতিক পেরুকে। দু’দেশের মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরাজমান ছিলো, তাই খেলার একপর্যায়ে আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে এগিয়ে গেলে পেরুর সমর্থকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়।
সেদিন ড্র করলেই মূল পর্বে উত্তীর্ণ হয়ে যেতো পেরু জাতীয় দল। তাই দর্শকরা চিৎকার করে তাদের খেলোয়াড়দের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছিল। রেফারি বাঁশিতে শেষবারের মতো ফুঁ দেওয়ার ঠিক দুই মিনিট আগে যখন পেরু গোল দিলে রেফারি সেই গোলটি বাতিল করে দেন, তখনই পেরুর বিক্ষুব্ধ জনতা সেটার তীব্র প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে এবং খুব শীঘ্রই সেটা পূর্ণাঙ্গ দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই সহিংসতায় নিহত হয় প্রায় ৩১৮ জন মানুষ এবং গুরুতর আহত হয় ৫০০ জনেরও বেশি।
ফুটবল যেমন কোটি মানুষের আনন্দের কারণ, তেমনি কখনো কখনো সেটি হয়ে উঠেছে অনেক হতাশা দুর্ঘটনার কারণও। পৃথিবীর এতো ধরনের খেলার মাঝে ফুটবলের দর্শকদের যেন আবেগ একটু বেশিই। তাই হয়তো বিল শ্যাঙ্কলি বলে গেছেন,
“কিছু মানুষ মনে করে যে ফুটবলের উপর জন্ম-মৃত্যু নির্ভর করে। তাদের সেই মনোভাব নিয়ে আমি খুবই হতাশ। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি যে ফুটবল এর চেয়েও অনেক বেশি গুরুতর।”
– বিল শ্যাঙ্কলি (সানডে টাইমস, ৪ অক্টোবর ১৯৮৪)