একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। ২০০৭ সালের গ্রীষ্ম চলছে তখন। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশ পায় এক বিড়ালের কথা, নাম অস্কার।সাদা-কালো সে বিড়ালটি তখন বনে যায় তদানিন্তন মেডিকেল সায়েন্সের আলোচনার কেন্দ্র। কারণ মৃত্যুর একেবারে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে চিকিৎসা চলতে থাকা রোগীদের মৃত্যুর আগাম খবর জানিয়ে দিতো সে! চিকিৎসকেরা যেখানে কোনো ধরনের অনুমান করতে পারতেন না বা করলেও প্রায় সময়ই দেখা যেত যে তা ভুল।
আমেরিকার রোড আইল্যান্ডের একটি নার্সিং হোমে অস্কার এমন প্রায় পঞ্চাশজন রোগীর মৃত্যু সম্পর্কে আগাম বার্তা দিয়েছিলো সেখানকার ডাক্তারদের। আনুমানিক দুই থেকে চার ঘন্টা আগেই বিড়ালটি জেনে যেত মৃত্যুর খবর আর পায়চারী করতো রোগীর কেবিন জুড়ে। কখনও বা রোগীর বিছানায় উঠে শুয়ে পড়তো কোলের কাছে। সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তারগণ তখনই জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করতেন, আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিতেন কিংবা বড় কোনো হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন।
কেউ জানে না, অস্কার কীভাবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতো। হয়তো, রোগীর দেহের মরে যেতে থাকা কোষগুলো থেকে কোনো গন্ধ এসে পৌঁছাতো তার নাকে। হয়তো সেখানে মানুষের জন্য দুর্বোধ্য কোনো সংকেত ছিলো। কিন্তু এমন যদি হতো, কোনো কম্পিউটার অ্যালগরিদম মৃত্যুর আগাম খবর দিচ্ছে? আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার এ যাত্রায় মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদেরকে বাঁচবার আরেকটি সুযোগ দেয়া কিংবা মৃত্যুপূর্ব সময়টুকু আরেকটু আরামে স্বাচ্ছন্দে কাটানোর ব্যবস্থা করার ভয়াবহ চ্যালেঞ্জিং এবং খানিকটা অস্বস্তিকর কাজটি করেছেন মার্কিন মুলুকের প্রখ্যাত স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। তারা এমন এক কম্পিউটার প্রোগ্রাম ডিজাইন করেছেন যা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মাঝে কারো মৃত্যু সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবে।
এই গেমচেঞ্জিং গবেষণাটির গুরুত্বপূর্ণ একজন আনন্দ আভাতি। ভারতে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েট শেষ করে তিনি স্ট্যানফোর্ডে যান উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার কাজে। সেখানে ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ তিনি এবং মেডিকেল সায়েন্সের সাথে সম্পর্কিত ছোট একটি দল একটি কম্পিউটার অ্যালগরিদমকে অসংখ্য ডাটা সেট বিশ্লেষণ করে শেখাতে সক্ষম হন মৃত্যুর পূর্বের বিভিন্ন লক্ষণ থেকে মৃত্যুর আগাম খবর দেওয়ার উপায়। এখানে কম্পিউটারকে শেখানোর বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা জানি যে, কম্পিউটার নিতান্তই মূর্খ একটি যন্ত্র। সে নিজে নিজে কিছুই করতে পারে না বা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। এখন কম্পিউটার সায়েন্সের একটি শাখায় এই মূর্খ কম্পিউটারকে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো বুদ্ধিমত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে শাখাটিকেই বলে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কম্পিউটার তখন পরিস্থিতির সাপেক্ষে নিজ থেকেই সিদ্ধান্তে আসতে পারে। আর কম্পিউটারের কাছে পরিস্থিতির সকল চলকই হচ্ছে পূর্বের সকল ডাটা বা তথ্যের ভিত্তিতে নতুন তথ্যের বিচার।
গবেষকগণ একটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স তৈরি করেছেন যা কিনা ৯০ শতাংশ সময় সঠিকভাবে মৃত্যুর আগাম বার্তা দিতে পারবে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে এই এআই। নানা মহলের আলোচনার কেন্দ্রে এখন এই নতুন আবিষ্কার।
আমেরিকায় সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ জীবনের শেষ সময়টুকু বাড়িতে কাটাতে চায়, কিন্তু সেই সৌভাগ্য হয় মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের। অন্যদিকে ৬০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয় জটিল সব মেডিকেল ট্রিটমেন্টের মাঝে। অনেক চিকিৎসকের মাঝে এ প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা তাদের রোগীদের মৃত্যুর ব্যাপারে একেবারেই কথা বলতে চান না কিংবা কারো মৃত্যু নিকটবর্তী সময়ে ঘটতে পারে এমনটি বোঝা গেলে মৃত্যু পূর্ববর্তী অপ্রিয় কথাবার্তায় যেতে বিব্রত বোধ করেন।
সকল মানুষই স্বভাবতই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করবে। কিন্তু চিকিৎসকদের এমন হলে যে রোগীদের অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং কষ্টদায়ক ট্রিটমেন্টর মধ্য দিয়ে যেতে হয়, শেষ সময়ে হয়তো এমন অভিজ্ঞতা পরিবার কিংবা রোগী কারোরই কাম্য না। বরং বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের পাশে থেকে জীবন শেষ করার মাঝে একধরনের স্বস্তি থাকে।
স্ট্যানফোর্ডের গবেষক দলটি গবেষণার মূল বিষয়টি ছিলো এমনই। তারা মূলত দুটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণাটি পরিচালনা করেন। প্রথমত, পেলিয়াটিভ কেয়ার বা মৃত্যুপূর্ব জটিল, ব্যয়বহুল এবং যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসা থেকে রোগীদের মুক্তি দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, ইচ্ছুক রোগী সম্পর্কে পেলিয়াটিভ কেয়ার টিমকে মৃত্যু সম্পর্কিত সকল প্রকার তথ্য এবং পূর্বাভাস দিয়ে সহায়তা করা।
এখন পেলিয়াটিভ কেয়ার সম্পর্কে আমাদের ধারণা একটু পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। মুমূর্ষূ রোগীর জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তে যে ট্রিটমেন্ট বা চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়, তাই হলো পেলিয়াটিভ কেয়ার এবং এ কাজের জন্য চিকিৎসক, নার্সসহ বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের নিয়ে গঠন করা হয় পেলিয়াটিভ কেয়ার টিম। এই দলটি কর্তব্যরত মেডিকেল টিমের কাছ থেকে শেষ সংকেত পাওয়ার পর তাদের কাজ শুরু করে। এ গবেষণার লক্ষ্যের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলো এই পেলিয়াটিভ কেয়ারের উন্নয়ন ঘটানো, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একটি বিশেষায়িত শাখা ডিপ লার্নিংয়ের মাধ্যমে।
আনন্দ আভাতি বলেন, প্যালিয়াটিভ কেয়ার টিমের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এখন যদি আমরা তিন থেকে বারো মাসের একটি সময়সীমার মাঝে আমাদের রোগীদের মৃত্যুর একটি সম্ভাব্য ক্ষণ ঠিক করতে পারি, তবে এই প্যালিয়াটিভ কেয়ারকে আমরা আরো সময়োপযোগী উপায়ে ব্যবহার করতে পারবো। এখন এ গবেষণা শুরুর গল্পটি জেনে আসা যাক।
মেডিসিনের চিকিৎসক এবং স্ট্যানফোর্ড হেল্প কেয়ারের পেলিয়াটিভ কেয়ার সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা মেডিকেল ডিরেক্টর স্টিফেনি হারম্যানের মাথায় এ চিন্তা সর্বপ্রথম আসে। হারম্যান তার এই আইডিয়া স্ট্যানফোর্ডেরই মেডিসিন অ্যান্ড বায়োমেডিকেল ইনফরমেট্রিক্সের এক সহযোগী অধ্যাপক নিগাম শাহের কাছে নিয়ে যান।
নিগাম শাহ বেশ আগে থেকেই মেডিকেল সায়েন্সের সাথে কিভাবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের একসাথে ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে আলাপ করছিলেন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কিংবদন্তীতুল্য শিক্ষক অ্যান্ড্রিউ এনজির সাথে। তারা পেলিয়াটিভ কেয়ার নিয়ে একটি প্রজেক্ট করতে সম্মত হন যেখানে মেডিকেল সায়েন্স এবং আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এই দুই ক্ষেত্রের জ্ঞানকে একীভূত করা হবে; সেই ছিল শুরু।
দলটি এআই অ্যালগরিদম দাঁড় করিয়েছিলো ডিপ লার্নিংয়ের ভিত্তিতে, মেশিন লানিংয়ের একটি জনপ্রিয় টেকনিক যেখানে নিউরাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশাল বিশাল ডাটা সেট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ফিল্টার করে মেশিন নিজে নিজেই শিখে নেয়। গবেষকগণ এক্ষেত্রে স্ট্যানফোর্ড হাসপাতাল এবং লুসিল প্যাকয়ার্ড শিশু হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রায় বিশ লক্ষ প্রাপ্ত বয়ষ্ক এবং শিশুর ইএইচআর বা ইলেক্ট্রনিক হেলথ রেকর্ড ব্যবহার করেন। এই ডাটা সেট থেকে ১৩,৬৫৪ মাত্রার ভেক্টর থেকে কম্পিউটারকে শেখানো হয় নতুন কোনো রোগীর ইএইচআর এর ভিত্তিতে আগামী ৩-১২ মাসের মধ্যে তার মৃত্যুর সম্ভব্যতা। ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত আইইইই ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন বায়োইনফরমেট্রিক্স অ্যান্ড বায়োমিডিসিনে প্রকাশিত এ গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ স্টুডেন্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।
ইতোমধ্যে ইন্সটিটিউশনাল রিভিউ বোর্ডের অনুমোদন সাপেক্ষে পরীক্ষামূলকভাবে বেশ কিছু হাসপাতালে ডিপ লার্নিংয়ের এই প্রযুক্তিটি নিয়ে সফলতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে এবং খুব দ্রুতই তা ছড়িয়ে যাবে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বে, এমনটিই আশা গবেষকদের।
ফিচার ইমেজ: The Sun