গুগল কী? প্রাথমিকভাবে আমরা একে একটি সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে জানি, যেখানে যেকোনো কি-ওয়ার্ড সার্চ দিয়ে আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল খুঁজে বের করতে পারি। কিন্তু গুগলের কার্যক্রম কি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ? না। বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেইল সার্ভিস প্রোভাইডার জিমেইল থেকে শুরু করে স্মার্টফোনের জন্য সর্বাধিক ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম অ্যান্ড্রয়েড, সবই কিন্তু গুগলের সৃষ্টি। আবার ভিডিও দেখতে বা সংরক্ষণ করতে সচরাচর যে ইউটিউব আমরা ব্যবহার করি, কিংবা সহজে অনলাইনে বিচরণের জন্য ব্যবহার করি যে ক্রোম ব্রাউজার, সেগুলোও কিন্তু গুগলেরই পণ্য। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, অনলাইনে আমাদের ব্যবহৃত বেশিরভাগ পণ্যের সাথেই কোনো না কোনোভাবে যোগসাজশ রয়েছে গুগলের। তাই তো প্রযুক্তি দুনিয়ায় গুগল বিস্তার করতে পেরেছে এক ঈর্ষণীয় আধিপত্য।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া দরকার: গুগল কিন্তু কিং মাইডাস নয় যে সে যা স্পর্শ করবে, সেটিই সোনা হয়ে যাবে। আমরা গুগলের সফল পণ্যগুলোর ব্যাপারেই জানি, এবং সেজন্য গুগলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হই। তবে তার মানে এই না যে গুগলের সব পণ্যই সফল। বরং গুগলের এমন অনেক পণ্যও রয়েছে, যেগুলো চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, এবং একপর্যায়ে গুগল সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। চলুন পাঠক, আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিই গুগলের সেরকমই কিছু ব্যর্থ পণ্যের সাথে, যার অনেকগুলোর ব্যাপারে আপনি হয়তো আজকের আগে কোনোদিন শোনেনইনি!
গুগল প্লাস
ফেসবুক-টুইটারের সাথে পাল্লা দিতে ২০১১ সালে গুগল নিয়ে আসে তাদের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম, গুগল প্লাস। অবশ্য তাদের ভাষ্যমতে এটি ছিল তাদেরই মেসেজিং সার্ভিস গুগল বাজের একটি সম্প্রসারিত সংস্করণ। তবে সে যা-ই হোক, গুগল প্লাসের ব্যবহারকারী বাড়ানোর জন্য কম চেষ্টা করেনি গুগল। জিমেইল অ্যাকাউন্ট খুললে গুগল প্লাসের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে হালে পানি পায়নি তারা। বরং ২০১৮ সালে যখন দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয় যে থার্ড-পার্টি ডেভেলপারদের কাছে পাঁচ লাখ গুগল প্লাস ব্যবহারকারীর তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে, তখন রীতিমতো বাধ্য হয়েই গুগল প্লাসকে ডিজিটাল গোরস্থানে পাঠিয়ে দিয়েছে গুগল।
গুগল বাজ
গুগল প্লাসের এক বছর আগে, ২০১০ সালে আগমন ঘটে গুগল বাজের, যেটি ছিল মূলত সামাজিক যোগাযোগ আর মেসেজিংয়ের একটি সংমিশ্রণ। তবে গুগল বাজ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার আগে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি গুগলের তরফ থেকে। পরে দেখা যায়, এটি মূলত টুইটার ও ফেসবুকেরই ক্লোন সংস্করণ, যেখানে ব্যবহারকারীরা স্ট্যাটাস আপডেট, ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতে পারে, পাশাপাশি সরাসরি মেসেজ আদানপ্রদানও করতে পারে। কিন্তু গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতায় ২০১২ সালে সমাপ্তি ঘটে সেবাটির।
গুগল নোটবুক
২০০৬ সালে যাত্রা শুরু হওয়া গুগল নোটবুক ছিল একটি অ্যাপ্লিকেশন, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা ব্রাউজার থেকে বিভিন্ন টেক্সট তাদের ব্যক্তিগত নোটবুকে কপি-কাট-পেস্ট করতে পারত। কিন্তু ২০০৯ সালে গুগল এটির উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়, এবং ২০১২ সালে পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটে এটির। অবশ্য এর বিকল্প হিসেবে ২০১৩ সালের গুগল নিয়ে আসে নতুন একটি নোট নেয়ার অ্যাপ, গুগল কিপ। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস এবং ওয়েবে পাওয়া যায় অ্যাপটি।
গুগল হেল্পআউটস
২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু হয় গুগল হেল্পআউটসের। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক টিউটোরিয়াল ভিডিও লাইভ স্ট্রিমিং করতে পারত। এই সেবাটির মূল লক্ষ্য ছিল রিয়েল-টাইমে মানুষকে তাদের পিসি ও মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে সহায়তা করা। এখানে ব্যবহারকারীদের জন্য একটি হেল্পআউট ক্যালেন্ডারেরও ব্যবস্থা ছিল, যেটি গুগল ক্যালেন্ডার্সের সাথে সিঙ্ক করে টেক্সট, ইমেইল কিংবা ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে নোটিফিকেশন পাওয়া যেত। উল্লেখযোগ্য সাড়া জাগাতে না পারায় ২০১৫ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় এর কার্যক্রম।
গুগল সাইট সার্চ
ইতিপূর্বে সকল ওয়েবসাইটে গুগল সাইট সার্চ নামক একটি বিশেষ সুবিধা চালুর সুযোগ ছিল, যার মাধ্যমে সেসব ওয়েবসাইটে গিয়ে ব্যবহারকারীরা গুগল পরিচালিত কাস্টম সার্চকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে যেকোনো কন্টেন্ট খুঁজে বের করতে পারত। তবে ধীরে ধীরে প্রায় সকল ওয়েবসাইটেই নিজস্ব সার্চ অপশন চালু হতে শুরু করলে, গুগল সাইট সার্চের আবেদন হ্রাস পেতে থাকে। শেষমেষ ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গুগল ঘোষণা দেয় এই সেবাটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার। একটি ব্যক্তিগত মেইলের মাধ্যমে গুগল তাদের সকল ভোক্তা ও অংশীদারদের জানায় যে তারা গুগল সাইট সার্চের নতুন কোনো লাইসেন্স বিক্রি করবে না, আর পূর্বের কোনো লাইসেন্সও নবায়ন করবে না।
পিকাসা
পিকাসা ছিল অনলাইনে ছবি সংগ্রহের একটি অ্যাপ্লিকেশন, যা ২০০৪ সালে কিনে নেয় গুগল। তবে ২০১৫ সালে যখন গুগল তাদের সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তির গুগল ফটোস নিয়ে আসে, তখন পিকাসাকে অবসরে পাঠিয়ে দেয় তারা। তবে এতে করে পিকাসা ব্যবহারকারীদের খুব বেশি ঝামেলায় পড়তে হয়নি, কেননা তাদের সকল ছবিই স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্থানান্তরিত হয়ে যায় গুগল ফটোসে।
জাইকু
জাইকু ছিল একটি মাইক্রো-ব্লগিং সাইট, যেখানে ব্যবহারকারীরা সীমিত পরিসরে তাদের মনের ভাব ব্যক্ত করার সুযোগ পেত। ২০০৭ সালের অক্টোবরে এটি কিনে নেয় গুগল। কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারি নাগাদই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, জাইকুর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় প্রতিদ্বন্দ্বী টুইটারের সাথে পেরে ওঠা, কারণ গুগল যখন জাইকুর প্রচারণা শুরু করে, ততদিনে টুইটার একটি প্রতিষ্ঠিত সাইটে পরিণত হয়ে গেছে। তাই একটু প্রতিষ্ঠিত সাইট ছেড়ে ব্যবহারকারীরা একই রকম নতুন সাইট ব্যবহার করবে, এমনটা আশা করা অমূলক। তাই ২০১১ সালের শেষদিকে গুগল ঘোষণা দেয় চিরতরে জাইকুর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার।
সার্চ উইকি, নল ও সাইড উইকি
উইকিপিডিয়ার বিকল্প হিসেবে এসব সেবাও নিয়ে এসেছিল গুগল। সার্চ উইকি ছিল একটি এক্সটেনশন, যেখানে গুগলের ব্যবহারকারীরা উইকিপিডিয়ার আর্টিকেল সার্চ দিয়ে সংশ্লিষ্ট টীকা দেখতে পারত। এছাড়া নল ছিল সাধারণ ব্যবহারকারীদের রচিত আর্টিকেলসমূহের একটি কালেকশন। আর সাইড উইকি ছিল প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত টীকার সমাহার। কিন্তু ২০০৮ সালের গ্রীষ্মে চালু করা এসব প্রকল্পে ২০১২ সালেই ইতি টানতে বাধ্য হয় গুগল।
গুগল রিডার
অনলাইনে সংবাদ পাঠ করে যারা, তাদের এ অভিজ্ঞতাকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করার লক্ষ্যে গুগল রিডার অ্যাপটি ডেভেলপ করে গুগল। এই অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন নিউজ সাইট কিংবা ব্লগ থেকে সংবাদ নিয়ে এসে এ অ্যাপে সংরক্ষণ করা যেত, এবং পরবর্তীতে অফলাইনেও সেগুলো পড়া যেত। কিন্তু ২০১৩ সালের মার্চে এ সেবাটি বন্ধের ঘোষণা দেয় গুগল, এবং সে বছর জুলাইতেই স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায় গুগল রিডার। এখন অবশ্য গুগল নিউজ নামক আরেকটি অ্যাপ রয়েছে গুগলের, যেটি দিয়ে গুগল রিডারের চেয়েও সহজে সংবাদ পড়া সম্ভব হচ্ছে।
গুগল গ্লাস
বিশেষভাবে ফ্যাশন সচেতনদের কথা মাথায় রেখে ২০১২ সালে গুগল বাজারে এনেছিল গুগল গ্লাস। ধারণা করা হয়েছিল, ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে রাজত্ব করবে এটি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কখনোই সাধারণ মানুষকে খুব বেশি আকৃষ্ট করতে পারেনি ১,৫০০ মার্কিন ডলার মূল্যের এ পণ্যটি। তার উপর এতে ছিল সফটওয়্যার জটিলতা, গোপনীয়তা সংক্রান্ত সমস্যা প্রভৃতিও। তাই ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে গুগল বন্ধ করে দেয় তাদের গ্লাস এক্সপ্লোরার প্রোগ্রাম, যেখানে ডেভেলপাররা গুগল গ্লাসের জন্য অ্যাপ তৈরি করত। ওই বছরই তারা গুগল গ্লাসের নতুন প্রোটোটাইপ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। তবে ২০১৭ সালে তারা এ প্রকল্পে আবারো কাজ শুরু করে, এবং এন্টারপ্রাইজ এডিশন বাজারে আনারও ঘোষণা দেয়।
বাম্প অ্যান্ড ফ্লক
বাম্প একটি অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস মোবাইল শেয়ারিং অ্যাপ, যার মাধ্যমে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা একে অন্যের ডিভাইস থেকে ছবি, ভিডিওসহ অন্যান্য বিভিন্ন ফাইন আদানপ্রদান করতে পারত। ২০১৩ সালে এটি কিনে নেয় গুগল। এছাড়া গুগল নিজেদের দখলে নেয় গ্রুপ শেয়ারিং ফটো অ্যাপ, ফ্লকও। কিন্তু ২০১৪ সালের শেষদিকে দুটি অ্যাপই বন্ধ করে দেয় গুগল, এবং ব্যবহারকারীরা ৩০ দিন সময় পায় তাদের ডেটা উদ্ধার করার জন্য।
গুগল ভিডিও
এখন ইউটিউবের মালিকানা রয়েছে গুগলের দখলে। তবে একসময় গুগলের নিজস্ব একটি ভিডিও স্ট্রিমিং সেবাও ছিল, ২০০৫ সালে যেটির সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে আবির্ভূত হয়েছিল ইউটিউব। পরবর্তীতে গুগলই ইউটিউব কিনে নেয়, এবং তারা তাদের নিজস্ব ভিডিও স্ট্রিমিং সেবাটির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ২০০৯ সাল নাগাদ গুগল ভিডিওতে নতুন ভিডিও আপলোড বন্ধ করা হয়, এবং ২০১২ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় সেবাটি।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/