ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে একদিকে যেমন মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুব সহজ হয়, অন্যদিকে এর ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে। আর এই বিশেষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবল দুই কাতারে ফেলা যায়।
এর মধ্যে একদল এসব প্রযুক্তির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান, যারা ব্যবহারকারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইন্টারনেট বেশি বেশি ব্যবহারের মাধ্যমে। অন্য দলটি একটি দেশের সরকার ব্যবস্থা, যারা ব্যবহারকারীর উপর নজরদারির পাশাপাশি ক্ষেত্র-বিশেষে পরিস্থিতি সাপেক্ষে পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা থেকেই বিচ্ছিন্ন রাখতে চায়।
২১ জুন, ২০১৯, মিয়ানমার। টেলিকম কোম্পানি টেলিনরের কাছে সু-কি সরকারের একটি জরুরি নির্দেশ আসে যা প্রকাশ না করতে কড়াভাবে হুশিয়ারি দেয়া হয়, দেশজুড়ে তাদের ইন্টারনেট সেবা বন্ধের নির্দেশ। এর প্রায় ২৫০ দিন পর এখন পর্যন্ত দীর্ঘসময় ধরে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন থাকা দেশের তালিকায় নাম লেখায় মিয়ানমার। সম্প্রতি সেনা অভ্যুত্থানের পর জান্তা সরকার পুনরায় বিচ্ছিন্ন করেছে ইন্টারনেট সেবা।
মিয়ানমারে ইন্টারনেট বন্ধের প্রায় দুই সপ্তাহ পরেই জাম্মু-কাশ্মিরকে ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভারত সরকার। গতবছরের ফেব্রুয়ারিতে মোবাইল ইন্টারনেট অফ রেখে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পুনরায় চালু করা হলেও নেটওয়ার্ক থ্রটলিং এর মাধ্যমে এর গতি ২জি করে দেয়া হয় যা এখন পর্যন্ত বলবৎ আছে। এর ফলে কোনো ছবি শেয়ার, ভিডিও স্ট্রিমিং এমনকি কিছু ওয়েবসাইট লোড হওয়া একরকম অসম্ভব। এছাড়াও বন্ধ রাখা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
২০১১ এর আরব বসন্তের উত্তাপ মিশরে ছড়িয়ে পড়লে প্রথম সরকারি আদেশে ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনমতো জনগণকে ইন্টারনেট সেবা থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। বেশিরভাগ সময়ই জনগণের নিরাপত্তা এবং গুজব রটানো বন্ধ করা কারণ হিসেবে দেখানো হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসল চিত্র রাজনৈতিক অস্থিরতার চলমান অবস্থা থেকে জনগণকে আড়ালে রাখা, নির্বাচন কারচুপি এবং চলমান আন্দোলনকে স্তমিত করা।
করোনা মহামারীর এই ক্রান্তিকালেও ২০২০ সালে ২৯টি দেশে মোট ১৫৫ বার ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, এর আগের বছর সে সংখ্যাটি ছিল ৩৩টি দেশে প্রায় ২১৩ বার। আপেক্ষিকভাবে মহামারীর কারণে গতবছর এই সংখ্যা কম ছিল বলে ধারণা করা যায়।
বিভিন্ন সময়ে একদিকে যেমন পাকিস্তানে নির্ধিষ্ট কিছু অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করা হয়েছে, অন্যদিকে ইরাকে দিনের কিছু অংশে ইন্টারনেট কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন- দিনের একটা অংশ ইন্টারনেট সেবা বিচ্ছিন্ন রেখে ব্যবসায়িক বিবেচনায় তা দিনের আরেক অংশে চালু রাখা হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে ভেনেজুয়েলায় দীর্ঘ সময় ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখা হয়েছে। অতীতে এবং সম্প্রতি বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ এবং ইন্টারনেট গতি ধীর করে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
টেলিকম কোম্পানিগুলো বা সার্ভিস প্রোভাইডাররা সরকারি আদেশ পালনে একরকম বাধ্য থাকেন। খুব সামান্য ক্ষমতা তাদের হাতে থাকে সরকারি আদেশ অমান্য করার। এসব কোম্পানির ট্রেডমার্ক লাইসেন্স থাকে সরকারের হাতে। মাল্টিন্যাশনাল টেলিকম কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স খোয়ানোর ভয় বা দেশের আইন অমান্যের ভয়ে আদেশ ফিরিয়ে দিতে পারে না।
চাইলে তারা দেশের পুরো ইন্টারনেট ব্যবস্থা বা নির্দিষ্ট কিছু ওয়েবসাইট বা অ্যাপ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এলাকাভিত্তিক সেবা বন্ধ করে দিতে পারেন, যাকে বলা ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট বা কিল সুইচ। বন্ধ করা ছাড়াও আরেকটি উপায় হলো গতি কমিয়ে দেয়া। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় নেটওয়ার্ক থ্রটলিং। যেমন, কোনো দেশে ৪জি সেবা থাকলেও দেশ বা অঞ্চলভেদে গতি ২জি বা তার চেয়েও কম করে দেয়া সম্ভব।
তাহলে কি ইন্টারনেট সেবা বন্ধের জন্য কোনো ‘অফ সুইচ’ আছে?
কীভাবে এই ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয় সেই বিষয়ে খুব অল্প কথায় সহজে কিছু ধারণা নেয়া যাক।
ব্রাউজারের সার্চ বা অ্যাড্রেস বারে কোনো ওয়েবসাইট ভিজিটের জন্য লিংক লিখে এন্টার চাপলেই একটি সার্ভার রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয় ব্রাউজার। আর এই রিকোয়েস্ট সবার প্রথমে যায় আপনার ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান বা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি)-এর কাছে।
এরপর আইএসপি সেই রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেয় ডিএনএস সার্ভার বা ডোমেইন নেম সিস্টেম সার্ভারের কাছে। এই ডিএনএস সার্ভার অনেকটা ফোনবুক ডিরেক্টরির মতো কাজ করে। যেমনটা প্রতিটি নামের পাশে তার ফোন নম্বর থাকে।
প্রতিটি ওয়েবসাইটের এড্রেস যা আমরা টাইপ করি সেগুলোকে বলা ডোমেইন নেম। এসব ডোমেইন নেমের জন্য নির্দিষ্ট কিছু সংখ্যা থাকে যাকে বলা হয় আইপি এড্রেস। এসব আইপি এড্রেসই কাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইটগুলোর সার্ভারের আসল ঠিকানা। ডিএনএস সার্ভারের কাছে সেই সকল আইপি এড্রেস সংরক্ষিত থাকে।
আমাদের বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। যেহেতু প্রতিটি রিকোয়েস্ট আগে আইএসপি-র কাছে যায়, তাই সেসব রিকোয়েস্ট ডিএনএস সার্ভারে না পাঠিয়ে অন্য কোনোভাবে বাইপাস করে দিলেই কাঙ্ক্ষিত ওয়েবসাইট ভিজিট করা আর সম্ভব হয় না। এভাবে যেকোনো অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের অ্যাক্সেস বন্ধ করতে পারে প্রতিষ্ঠানগুলো।
অনেক সময় বিশেষ কোনো ওয়েবসাইট ব্লক না করে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবস্থাই নিশ্চল করে দিতে পারে আইএসপি-গুলো।
দেশি-বিদেশি এমন অনেক সার্ভিস প্রোভাইডার ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকেন যার মাধ্যমে তারা ব্যবহারকারীর লোকেশন, ব্রাউজিং হিস্টোরিসহ আরও অনেক বিষয়েই অ্যাক্সেস থাকে। এবং সরকারের আদেশ মতো তারা যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় সেবা বন্ধ করতে পারেন।
আর সরকারের এসকল আদেশ জনসম্মুখে প্রকাশ করার অনুমতি তাদের থাকে সীমিত। অর্থাৎ ঠিক কোন তথ্য সরকারকে সরবরাহ করা হচ্ছে, কোন সেবা কেন বন্ধ করা হয়েছে সেই বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেন না তারা। খুব কম সংখ্যক প্রতিষ্ঠানই সামান্য কিছু তথ্য প্রকাশ করে থাকে।
“সরকারের কোন নির্দেশ আমরা গ্রহণ করছি সেটা সবার কাছে প্রকাশের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময়ই আমরা আইনের কাছে আটকা। তবুও আমরা চেষ্টা করি যাতে বৈধ উপায়ে সেসব তথ্য তুলে ধরতে পারি“, ওয়ালস্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধনে জানিয়েছেন যুক্তরাজ্য ভিত্তিক টেলিকম কোম্পানি ভোডাফোন এর সিনিয়র হিউম্যান রাইটস ম্যানেজার লরা ওকোনেন।
অন্যদিকে যুক্তিরাষ্ট্রের এটিএন্ডটি এবং ভেরিজন সরকারের অনুরোধের সংখ্যা ও বিষয়ের ওপর অল্প কিছু তথ্য প্রকাশ করে। কিন্তু ইন্টারনেট শাটডাউনের যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয় না তার নজরদারির জন্য কাজ করছে কিছু নেটওয়ার্ক মনিটরিং গ্রুপ। তারা নির্ভর করেন নেটওয়ার্ক ট্রাফিক এক্টিভিটিজ এবং ডায়াগনস্টিক টুলসের উপর। এর মধ্যে প্রথম সারির দুটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান অ্যাক্সেস নাও এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নেটব্লক্স।
ইন্টারনেট বন্ধের আদেশের আইনগত বৈধতা কতটুকু
ইন্টারনেট বন্ধের কারণের উপর ভিত্তি করে এর বৈধতা বিবেচনায় আনা সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ইন্টারনেট শাটডাউন অন্যতম এক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। সাময়িকভাবে জনগণের এক বড় অংশকে ডিজিটালভাবে অন্ধকারে রাখার মাধ্যমে ঘটনার মোড় ভিন্নদিকে ঘুরিয়ে দেয়া সম্ভব।
“ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করার ঘটনার এমন উর্ধ্বমুখীতার পেছনে নির্দিষ্টভাবে আমি রাজনৈতিক কারণই দেখছি“, জানিয়েছেন জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের বিশেষ দূত ডেভিড কায়।
বিভিন্ন দেশের সরকারের ক্ষমতা আছে জরুরি মুহুর্তে, যেমন- সাইবার টেরোরিস্ট হামলা, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা অন্য দেশের থেকে রক্ষা করতে কিংবা বাস্তবিক অর্থে জনগণের নিরাপত্তার জন্য ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা এমন নয়।
আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে একরকম ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন করে বাক ও তথ্য-স্বাধীনতার হরণ আফ্রিকায়, ইরাকে, ভারতে বা মিয়ানমারে এর আগেও ঘটেছে। এই তালিকার শীর্ষে থাকা ভারতে ২০১৯ সালের ১২১ বার ইন্টারনেট শাটডাউনের ঘটনার প্রায় ৯০%-ই ছিল জাম্মু-কাশ্মিরের। জনগণের নিরাপত্তার অযুহাত দেখিয়ে বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরিদের। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি মিয়ানমারে কিংবা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আফ্রিকার উগান্ডা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাকে কেন্দ্র করে তানজানিয়া, উগান্ডার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্লক করে দেয়া।
অর্থাৎ একটি বিষয় স্পষ্ট যে যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণে এই স্বেচ্ছাচারিতা ঘটানো হচ্ছে না কোনো দেশেই। অন্যদিকে যেখানে সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও হাত-পা বাধা, সেখানে করণীয় কী?
চাইলে যেকোনো নাগরিক এই স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন। তবে বাস্তবে এমন ঘটনা খুব কম ঘটে। এমনকি চাইলে আইএসপিগুলোও একই পথে হাঁটতে পারে।
২০১৬ সালে জাতিসংঘের ল্যান্ডমার্ক রেজল্যুশনে “ইচ্ছাকৃতভাবে অনলাইনে প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করা“-কে মানবাধিকার লংঘনের অন্তর্ভুক্ত করে। বিগত বছরগুলোতে সুদান, পাকিস্তান, ভারত এবং জিম্বাবুয়েতে সরকারি নির্দেশের বিরুদ্ধে কোর্ট চ্যালেঞ্জে জয়লাভ করেছেন অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবীরা।
২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ বার্মিংহামের এথিসিস্ট ও ফিলোসফার মারটেন রেলিজ একটি কম্প্রিহেনসিভ কেস স্টাডিতে উল্লেখ করেন, একবিংশ শতাব্দীতে ইন্টারনেট কেবল এখন বিলাসিতা নয়, শাসনতন্ত্রের এই নীতি নাগরিকদের মৌলিক অধিকারে কণ্ঠরোধ করে।
তবে শেষ করার আগে আরও একটি বিষয় জানিয়ে যাওয়া যাক, ইন্টারনেট জগতে বিচরণের সুযোগ পুরোপুরিভাবে দেয়া হলেও সম্প্রতি নজরদারি এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্যগত সেন্সরশিপের জন্য চাপ প্রয়োগও কি স্বাধীনতার অন্তরক হিসাবে কাজ করছে? ফিলিপাইন, ভেনেজুয়েলা, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশে এই সম্পর্কিত আইনও পাশ হয়েছে যাতে ইন্টারনেট জগতের অবাধ বিচারণ, বাক স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সরকার। সেই উভয় দলের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ব্যবহারকারীর স্বাধীনতার মূল্য তাহলে কতটুকু?