ভরা ক্যাফেটেরিয়ায় প্রচণ্ড শব্দের মধ্যে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠেছেন, এমন সময় একটি লেজার রশ্মি আপনার কানে প্রবেশ করতেই শুনতে পেলেন জরুরী কোনো বার্তা। বার্তা পেয়েই ছুটে গেলেন সেই জরুরী কাজে এবং বাকি সবাই তখনও আড্ডায় মজে আছে। হ্যাঁ, আর কেউ না, শুধু আপনিই শুনতে পেয়েছেন। তাছাড়া কেউ তেমন একটা অবাকও হয়নি আপনার এমন ছন্দপতন করে উঠে যাওয়ায়। কারণ না শুনলেও তারা জানেন, আপনি একটি জরুরী বার্তা পেয়েছেন।
সবকিছু কেমন উদ্ভট ঠেকছে, তাই না? আসলে এমআইটি’র (MIT) বিজ্ঞানীরা এমন একটি লেজার সিস্টেম তৈরি করেছেন, যা লেজারের মাধ্যমে শব্দ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বহন করে নিয়ে যেতে পারে এবং এটি শুনতে কোনো ধরনের অতিরিক্ত যন্ত্রেরও প্রয়োজন নেই। পদ্ধতিটি অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন এখনও।
যদিও, লেজার ব্যবহার করে শব্দ প্রেরণ করার ব্যবস্থা এটিই প্রথম নয়, তবে এখন পর্যন্ত এটিই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় শব্দ তরঙ্গ বহন করতে সক্ষম। এই পদ্ধতিতে শব্দ কারো কানে পৌঁছানোর জন্য বাতাসে থাকা পানির অণুগুলোকে কাজে লাগানো হয়, যেখানে একটি অণু বাতাসের আরেকটি অণুর সাথে ধাক্কা খায় এবং শব্দ সংকেত উৎপন্ন করে ও পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট দুরত্বে। গবেষকরা এই পদ্ধতির নাম দিয়েছে ‘ফটোঅ্যাকুস্টিক কমিউনিকেশন’ (Photoacoustic Communication)।
পদ্ধতিটি নতুন মনে হলেও, এই ধারণার উৎপত্তি প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি পুরনো। টেলিফোনের উদ্ভাবক গ্রাহাম বেল তার সহকারী চার্লসের সামার টেইন্টারের সাথে ১৮৮০ সালে ‘ফটোফোন’ (Photophone) নামের একটি ডিভাইসের ধারণা পেটেন্ট করেছিলেন, যা আলোর মাধ্যমে শব্দ প্রেরণ করবে। বেল ও টার্নার চেয়েছিলেন, উজ্জ্বল আলোকরশ্মির মাধ্যমে বার্তা প্রেরণ করতে যা একটি নির্দিষ্ট যন্ত্র গ্রহণ করবে এবং প্রেরিত আলোকরশ্মি শব্দ উৎপন্ন করবে। যাকে ‘ফটোফোন ট্রান্সমিটার’ (Photophone transmitter) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল।
সহজ কথায়, কোনো কিছুর মধ্য দিয়ে আলোর পাঠানো হবে এবং তা শব্দ উৎপন্ন করবে। এই পদ্ধতিতে অবশ্য এমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি যে, কোনো কিছুর সাহায্য ছাড়াই উৎপন্ন শব্দ বা বার্তা একজন ব্যবহারকারী বা গ্রাহক তা সরাসরি শুনতে পারবেন।
এমআইটির গবেষকদের পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে নিখুঁত লেজার রশ্মি এবং রিসিভার বা গ্রাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বাতাসে থাকা পানি। গবেষকদের দাবি, এই পদ্ধতি অনেক বেশি পানির প্রয়োজন নেই। অত্যন্ত শুষ্ক স্থানেও এটি কাজ করবে। কারণ বাতাসে সবসময় অল্প হলেও পানি থাকে। লেজার রশ্মিতে বার্তা যুক্ত করে দেওয়ার পর এটি ফটোঅ্যাকুস্টিক কমিউনিকশনের মাধ্যমে গ্রাহকের কানে পৌঁছে যাবে।
একটি ১.৯ মাইক্রোমিটার থিউলিয়াম লেজার সর্বোচ্চ শব্দ চাপে প্রেরণ করা হয়, যা পরিবেশে থাকা পানির সাথে মানানসই। এক্ষেত্রে এটাও মাথায় রাখা প্রয়োজন যে, প্রেরণকৃত লেজার রশ্মি যেন চোখের জন্য ক্ষতিকারক না হয়। বেল ও টার্নারের মূল ধারণার সাথে এমআইটির গবেষক দলের ধারণার তেমন কোনো পার্থক্য নেই, শুধুমাত্র যন্ত্রপাতি ও পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যতীত।
লেজার রশ্মিতে যুক্ত বার্তা বা তথ্য ফটোঅ্যাকুস্টিকের মাধ্যমে শ্রবণযোগ্য বার্তায় রূপান্তর করা হয়। ফটোঅ্যাকুস্টিক রূপান্তরের মাধ্যমে লেজার রশ্মির বার্তা গ্রহণ করতে পারে বাতাসে থাকা পানির বাষ্প এবং তখন তা শ্রবণযোগ্য সিগনালে পরিবর্তিত হয়, বাতাসের পানি দ্বারা গ্রহণকৃত সেই সিগনাল শব্দ তরঙ্গ আকারে পৌঁছে যায় গ্রাহকের কানে। বদ্ধ পরিবেশে কার্যকর পদ্ধতিটি এখন পর্যন্ত খোলা পরিবেশে বলার মতো সফলতা অর্জন করেনি। তবে লেজার ইনক্লুডেড প্লাজমা ইফেক্ট (Laser included plasma effect, LIPE) নামের আরও একটি পদ্ধতি নিয়ে কাজ চলছে, যেখানে মাধ্যম হিসেবে বাতাস ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই পদ্ধতিতে বাতাসকে লেজারের মাধ্যমে আয়নিত করা হবে এবং প্লাজমা তৈরির পর সর্বশেষ গ্রাহকের নিকট শব্দ প্রেরণ করা হবে। যা-ই হোক, গবেষণাপত্রে দুটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে লেজার ব্যবহার করে ০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি ও ২.৫ মিটার দূরে শব্দ পাঠানো সম্ভব হয়েছে। দুটি ভিন্ন পদ্ধতি হলেও, উদ্দেশ্য ও ফলাফল প্রায় অভিন্ন। সীমিত সক্ষমতার এই পরীক্ষায় তেমন কোনো জটিল বার্তা বা তথ্য প্রেরণ করা হয়নি। কাজ করা হয়েছে, শ্রবণযোগ্য সাধারণ শব্দ নিয়ে।
প্রথম পদ্ধতিতে, অ্যাকুস্ট-অপটিক মডুলেটর (Acousto-optic modulator, AOM) ১.৯ মাইক্রোমিটারের থিউলিয়াম লেজারকে বর্ধিত করে এবং তৈরি করে ধারাবাহিক তরঙ্গ (Continuous Wave, CW) এবং বাতাসে থাকা পানির দ্বারা আলো শোষিত হলে এই তরঙ্গ শ্রবণযোগ্য সংকেতে পরিবর্তিত হয়। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে, আয়নার মাধ্যমে লেজারকে নির্দিষ্ট দূরত্বে পাঠানো হয়। এতে তৈরি হয় অ্যাকুস্টিক তরঙ্গ এবং তৈরি হয় অ্যাকুস্টিক সংকেত। এই পদ্ধতিটি ফটোঅ্যাকুস্টিক স্পেক্ট্রোস্কোপির মতো বিস্ফোরক সনাক্ত করার কাজে ব্যবহৃত হয়।
লেজারের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্ধারণের ব্যাপারে বেশ কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। দীর্ঘ পরিসীমা ও দূরত্বে বার্তা প্রেরণের ক্ষেত্রে লেজারের বিপরীতে চোখ কতটা নিরাপদ থাকবে, এই বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। অ্যাকুস্টিক চাপ সরাসরি আলোর শোষণের সমানুপাতিক। চোখ এবং ত্বকের জন্য ক্ষতিকর নয় কিন্তু কার্যকর মাত্রার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্ধারণও একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অংশ।
তাছাড়া পানি কাছাকাছি থাকা অবলোহিত রশ্মি (Infra Red) শোষণে দারুণ পারদর্শী। সবকিছু বিবেচনা করে গবেষক দল ১.৯ মাইক্রোমিটারের লেজার ব্যবহার করেছেন। এই পদ্ধতিতে গান, মানুষের রেকর্ডকৃত কথাসহ স্পষ্ট বার্তা পাঠানোর জন্য প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন। তবে গবেষকরা দেখিয়েছেন, এই পদ্ধতিতে বিশাল পরিসরে শব্দ প্রেরণ করা গেলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সম্ভব, যেখানে প্রেরণকৃত শব্দ শোনার জন্য খুব বেশি বাড়তি যন্ত্রের প্রয়োজন নেই।
এই পদ্ধতি ব্যাপক পরিসরে সফল হলে, জনতার সমাবেশ বা ভিড়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে বার্তা পাঠাতে উচ্চস্বরের মাইক বা লাউডস্পিকার ব্যবহার করতে হবে না। নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের লেজার দিয়েই সহজে এবং সরাসরি অত্যন্ত শব্দ দূষণের স্থানে হাজার-হাজার মানুষের মধ্যেও নির্দিষ্ট একজনের কাছে বার্তা প্রেরণ সম্ভব। হয়তো শব্দ দূষণ ও আশেপাশের মানুষজনকে বিরক্ত না করেও অনেক কাজ সম্পন্ন করে ফেলা যাবে এই ফটোঅ্যাকুস্টিক কমিউনিকেশনের মাধ্যমে।
সংগত কারণেই এই প্রযুক্তি নিয়ে সামরিক বাহিনীর আগ্রহ থাকবে। বলা বাহুল্য, সামরিক বাহিনীতে এধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ চলছে অনেক আগে থেকে। যেমন, আলোচিত গবেষণাটির অর্থায়ন করেছে বিমান বাহিনীর আসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ।