ইমেজ প্রসেসিং নামে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শাখাটিতে মূলত ডিজিটাল ছবি নিয়ে কাজ করা হয়। হয়তো কোনো ইমেজের গুনগত মান বাড়ানোর জন্যে তার উপর কোনো অ্যালগরিদম চালানো হয় অথবা কোনো ছবি থেকে কোনো তথ্যাদি বের করে নেওয়া হয়। যেমন আপনার মোবাইল-ক্যামেরা যে আপনার চেহারা চিহ্নিত করতে পারে এটিও ইমেজ প্রসেসিং-এর কারসাজি। বর্তমানে ক্যামেরার সহজলভ্যতার যুগে ইমেজ প্রসেসিংও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সাধারণ মোবাইল ফোনের ছবি কিংবা মেডিক্যাল ইমেজ থেকে শুরু করে মহাকাশ গবেষণা পর্যন্ত সবক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়।
আপনি যদি ইমেজ প্রসেসিং বিষয়ে কোনো বই, জার্নাল পেপার কিংবা কোনো টিউটোরিয়ালও দেখা শুরু করেন তবে অল্প সময়ের মধ্যেই একটি মজার বিষয় চোখে পড়বে আপনার। দেখবেন অনেক জায়গায়ই ঘুরেফিরে আসছে একটি ছবি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, ক্যামেরার দিকে পাশ ফিরে বেশ আবেদনময়ী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন একজন তরুণী। মাথার পালকযুক্ত সান-হ্যাটটি যেন আরো কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে তার আবেদনকে।
রসকষহীন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বই অথবা গবেষণাপত্রে এ ছবি যেন অনেকটাই বেমানান। কিন্তু বিভিন্ন অ্যালগরিদমের ফলে সৃষ্ট ছবির তুলনা করতে এ ছবি এত বেশি ব্যবহৃত হয়েছে যে, এ নিয়ে আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য। কেন ও কীভাবে এ ছবি ইমেজ প্রসেসিংয়ের দুনিয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সে গল্পই এখানের আলোচনার বিষয়।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (ইউ.এস.সি)-তে, ১৯৭৩ সালের জুন অথবা জুলাইর দিকে। একজন ইঞ্জিনিয়ার ব্যতি-ব্যস্ত হয়ে একটি ভালো ইমেজ খুঁজছিলেন। ইমেজ প্রসেসিং বিষয়ে তার এক সহকর্মীর গবেষণাপত্রে ব্যবহার করার জন্যে একটি ছবির প্রয়োজন পড়েছিল। আগে থেকে যেসব ছবি ছিল, সেগুলো পছন্দ হচ্ছিল না তার। সেই ষাটের দশকের শুরুর দিকের সাদামাটা সব ছবি। তিনি আকর্ষণীয় একটি ইমেজ খুঁজছিলেন, যা তার গবেষণার ফলাফলকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারবে এবং সেটি কোনো মানুষের ছবি হতে হবে।
ঠিক এ সময় কেউ একজন প্লে বয়ের সাম্প্রতিক একটি সংখ্যা নিয়ে হাজির হয় ল্যাবে। ইঞ্জিনিয়ার মহাশয় তো যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন। একসাথে এর চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছবির সম্ভার আর কোথায় পাবেন তিনি? তড়িৎগতিতে ম্যাগাজিনটির মাঝের পাতাটি ছিঁড়ে নিয়ে স্ক্যানার মেশিনের সামনে হাজির হলেন তিনি।
একটি 512 বাই 512 ইমেজ প্রয়োজন ছিল তাদের। তাই মাপমতো প্রচ্ছদে থাকা মডেলের কাঁধ পর্যন্ত কেটে নেওয়া হলো। তাদের গবেষণাপত্রের শোভা বর্ধন করলো প্লে-বয় মডেলের লাস্যময়ী ছবিটি। তাদের সে গবেষণাপত্রটি, বর্তমানে আমাদের অতিপরিচিত JPEG ও MPEG ফরম্যাটের ইমেজের ভিত্তি তৈরি করেছিল।
ছবিটি ছিল লেনা সোডারবার্গ নামের একজন মডেলের। লেনা সুইডেনের নাগরিক, কাজের খাতিরে থাকতেন আমেরিকার শিকাগোতে। ১৯৭২ সালে প্লে-বয়ের মিস নভেম্বর মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। পরে অবশ্য সুইডেনে ফিরে গিয়েছিলেন, বিয়ে থা করে স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন সেখানেই। তিনি জানতেনও না তার ছবিটি নিয়ে কী ঘটে চলছে এদিকে।
ইউ.এস.সির ইঞ্জিনিয়ারদের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর, অনেকেই তাদের কাছে ছবিটি চায়। তারাও খুশিমনে দিয়ে দেন, যাতে অন্যরা একই ছবির ওপর তাদের কাজের ফলাফলকে তুলনা করতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যেই অধিকাংশ গবেষকরাই ছবিটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। প্রথমদিকে তো স্ক্যানার তেমন সহজলভ্য ছিল না, তাই সবাই নিজেদের ইচ্ছেমতো ছবি তৈরি করে নিতে পারতেন না। তখন মানসম্পন্ন ছবি হিসেবে এটিকে ব্যবহার করার একটি কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।
কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে স্ক্যানার সহজলভ্য হয়ে উঠার পরেও, এটি একই হারে ব্যবহৃত হতে থাকে। এটি যেন ইমেজ প্রসেসিং ঘরানার আদর্শ মানদণ্ডে পরিণত হয়। এর একটা কারণ হচ্ছে, গবেষকদের কাছে এ ইমেজটি এতটা পরিচিত হয়ে পড়ে যে, এর ওপর চালানো হলে যেকোনো অ্যালগরিদমকে তারা সহজে মূল্যায়ন করতে পারতেন। তবে সবচেয়ে বড় কারণটি সম্ভবত লেনার ভীষণ আকর্ষণীয় চেহারাটিই হবে।
তবে টেকনিক্যাল দিক থেকেও ছবিটির বৈশিষ্ট্য বেশ চমৎকার। এতে একইসাথে, আলো ও আঁধারের মিশ্রণ আছে, আছে ঝাপসা ও স্পষ্ট অঞ্চল, সবমিলিয়ে ইমেজ প্রসেসিংয়ের ফলাফলকে বেশ ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলে এটি। পরবর্তীতে আরো অনেক উন্নত ইমেজ তৈরি হলেও, লেনা অনেকদিন ধরেই গবেষকদের প্রথম পছন্দ ছিল। অবশ্য ছবিটিকে নিয়ে যে স্রেফ গবেষণাই হয়েছে তেমনটা নয়, গত চল্লিশ বছরের ব্যবধানে তার প্রচুর পরিমাণ ভক্ত সৃষ্টি হয়েছে। কেউ তাকে নিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করছেন, কেউ লিখছেন কবিতা, কেউবা অন্য কোনোভাবে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়েছে তার প্রতি।
পরবর্তীতে লেনাও জেনেছিলেন, তার ছবি নিয়ে জ্ঞানীদের জগতে এই উন্মাদনার সম্পর্কে। ১৯৯৭ সালে ইমেজ প্রসেসিং বিষয়ক একটি কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তাকে। বোস্টনের সে কনফারেন্সে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কথা বলেছেন নিজের সম্পর্কে, অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন আগত গবেষকদের, তার সাথে ফ্রেমবন্দি হয়ে অনেকে স্মরণীয় করে রেখেছিলেন দিনটিকে। এ কনফারেন্সে ‘দ্য ফার্স্ট লেডি অব দ্য ইন্টারনেট’ খেতাবও দেওয়া হয়েছিল তাকে।
এ ছবিটিকে এভাবে ব্যবহার করাটা কিন্তু আইনগতভাবে বৈধ ছিল না। কারণ ছবিটির মূল স্বত্ব প্লে-বয় ম্যাগাজিনের। তাদের কাছ থেকে কোনো অনুমতি ছাড়াই, এস.আই.পি.আই এ ছবিটির অবাধ বন্টন করে আসছিল। অবশ্য গবেষণাখাতে কী চলছে, তা প্লে-বয় কর্তৃপক্ষের নজরে আসতে দেরী হওয়াটা স্বাভাবিক বলতে হয়। তারা প্রথমবারের মতো এটি লক্ষ্য করেন প্রায় আঠারো বছর পরে। ততদিনে বহু জার্নালে, বইয়ে লেনার ছবিতে সয়লাব।
১৯৯১ সালের জুলাই মাসে অপটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং জার্নাল তাদের জুলাই মাসের প্রচ্ছদে লেনার ছবিটি ছাপিয়েছিল। কেউ একজন বিষয়টি প্লে-বয়ের নজরে আনে। প্লে-বয় কর্তৃপক্ষ অভিযোগ পাঠায় জার্নাল প্রকাশকদের কাছে। তবে শেষতক প্লে-বয়ের সাথে তারা সমাঝোতায় আসতে সক্ষম হয়। স্রেফ গবেষণার জন্যে হলে ছবিটি ব্যবহরের অনুমতি দেয় প্লে-বয়। এ ঘটনাটি গবেষক মহলে ছবির স্বত্ত্বাদিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়।
তবে লেনাকে নিয়ে গবেষকদের এ উৎসাহকে যে সবাই ইতিবাচকভাবে দেখেছেন তেমনটি নয়। অনেকে আরো ভালো মানের ছবি থাকতেও, এ ছবিটি মানদণ্ড হয়ে উঠার সমালোচনা করেছেন। অভিযোগ এসেছে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকেও। কারণ লেনা স্রেফ একজন নারীর ছবি নয়। এটি প্লে-বয় ম্যাগাজিন থেকে কেটে নেওয়া ছবি, এই ম্যাগাজিন কর্তৃপক্ষ নারীদের স্রেফ যৌনতার প্রতীক হিসেবে ফুটিয়ে তোলে। লেনার ছবিটিও সেই প্রতীকী অর্থই বহন করে। তাই অনেক নারী গবেষক তীব্র সমালোচনা করেছেন এর। তারা লেনার বিখ্যাত হয়ে উঠাকে পুরুষ গবেষকদের যৌন ফ্যান্টাসির ফল বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ ছবিটির এমন বহুল ব্যবহার তাদের কাছে বেশ অস্বস্তিকর ঠেকেছিল।
এমনকি ফটোনিকস জার্নালের সম্পাদক সানি বেইনস তার সম্পাদনা করা গবেষণাপত্রগুলো থেকে লেনার ছবিকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন। এজন্য অনেক নারী গবেষকদের কাছ থেকে ধন্যবাদসূচক বার্তা পেয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। তার এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেনি কেউ, কারণ এর জন্যে কারো কাজ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি। তারা অন্য ছবি ব্যবহার করে খুব সহজেই কাজ চালাতে পারতেন। সম্প্রতি বিখ্যাত জার্নাল নেচারও নিষিদ্ধ করে লেনার ছবিকে। আই ট্রিপল ই (IEEE)-এর ইমেজ প্রসেসিং জার্নালের সম্পাদকের কাছেও অনেকে আবেদন জানিয়েছিলেন লেনার ছবিকে নিষিদ্ধ করার জন্যে। তিনি তাকে নিষিদ্ধ না করলেও, একটি সম্পাদকীয়তে গবেষকদের অন্য ছবি ব্যবহার করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
এসব কারণ ও অন্যান্য ছবির প্রচুর সহজলভ্যতার কারণে, ধীরে ধীরে এ ছবির বহুল ব্যবহার কিছুটা কমে আসতে থাকে। তারপরেও এটি এখনো ইমেজ প্রসেসিংয়ের দুনিয়ায় সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি। ইমেজ প্রসেসিং এর বইয়ে, জার্নালে এখনো নজর কাড়ে লেনার লাস্যময়ী চেহারা। গত প্রায় অর্ধ-শতক ধরে, এ ইমেজটি অসংখ্য গবেষকের গবেষণার সঙ্গী হয়েছে, পুঙ্খানুপুঙ্খানু বিশ্লেষণ হয়েছে এর প্রতিটি পিক্সেলের। হয়তো ভিঞ্চির মোনালিসার পর লেনার ছবিটি নিয়েই সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে।