তারবিহীন প্রযুক্তির সহায়তায় বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান কোয়ালকম থ্রি-জি (3G) এবং ফোর-জি (4G) প্রযুক্তিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এখন তারা ফাইভ-জি অর্থাৎ ফিফথ জেনারেশনের তারবিহীন প্রযুক্তি বাজারে নিয়ে আসতে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, এই ফাইভ-জি ওয়্যারলেস প্রযুক্তি দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব মনে হওয়া যেকোনো কিছুকে বাস্তবে পরিণত করা সক্ষম। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফাইভ-জি বর্তমান প্রযুক্তি জগতকে এক বিরাট নাড়া দিতে যাচ্ছে। অটোমোবাইল এবং বিদ্যুৎ শক্তি যেরকম সভ্যতার বিবর্তনকে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়েছিলো, এবং এই দুটির কারণে মানুষের জীবন যেভাবে বদলে গিয়েছিল, ফাইভ-জিও সেরকম কিছু করতে সক্ষম।
আমরা আমাদের সেলফোনে যে নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে আসছি, সেটি ক্রমাগত উন্নত হয়ে আজকের আধুনিক পর্যায়ে এসেছে। প্রথমে প্রযুক্তি বাজারে আবির্ভাব হয় টু-জির, যেটা ১৯৯১ সালের দিকে এসেছিল। এরপর ২০০১ এর থ্রি-জি এবং সর্বশেষ ২০০৯ এর ফোর-জি। নেটওয়ার্কের ক্ষমতা এবং তথ্য আদান-প্রদানের দ্রুততা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এই ক্রমাগমনে সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে ফাইভ-জি, যা আজকের আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয়।
এখন আমরা যে ফোর-জি সেবা পাচ্ছি, সেটা থেকে ফাইভ-জি অনেক বেশি দ্রুতগতির হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। একটি ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের ফোন কোনো একটি ফাইভ-জি শহরে এখনকার তুলনায় প্রায় ৯-২০ গুণ দ্রুত কাজ করবে। ফাইভ-জি এর ল্যাটেন্সি (Latency) অর্থাৎ ডাটা আদান-প্রদানের সময় বর্তমানের তুলনায় প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে নেমে আসবে।
ফাইভ-জি আসার সাথে সাথেই যে ডাটা রক্ষণাবেক্ষণ এবং ধারণক্ষমতা বেড়ে যাবে সেটা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়। প্রতিটি মোবাইল ফোন এই নেটওয়ার্কের আওতায় সীমাহীন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে। কোয়ালকমের ডিরেক্টর শেরিফ হান্নার দাবি হচ্ছে, মানুষের ফোন যদি ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাহলে ওয়াই-ফাই রেঞ্জের বাইরে থাকলেও তারা ফাইল ডাউনলোড বা আদান-প্রদান করতে পারবে। নেটওয়ার্ক বা স্পিডের কথা আগেই বলা হয়েছে। এছাড়া ফাইভ-জি’র কারণে আমাদের ফোনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।
এখন সেল ফোনগুলোতে যে ধরনের প্রসেসর ব্যবহার করা হয়, তাতে তাপধারণ ক্ষমতার একটি নির্দিষ্ট সীমা আছে। আবার ব্যাটারির কার্যক্ষমতারও একটি নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। কিন্তু আমাদের ফোন ৫-জিতে যুক্ত থাকলে এ ধরনের সমস্যাই হবে না। বরঞ্চ কোয়ালকম থেকে বলা হচ্ছে, ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের কারণে এত দ্রুত ফোনগুলো কাজ করবে যে, ব্যবহারকারীর কাছে মনে হবে মোবাইলের ভেতর বাড়তি কোনো প্রসেসর হয়তো আছে।
শুধু তা-ই না। ফাইভ-জি’র ফলে পৃথিবীর সবধরনের যন্ত্রকে একত্রিত করা সম্ভব হবে। একটি মেশিনের কার্যকলাপের সাথে আরেকটি মেশিনের কাজের যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হবে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের গ্যাজেট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেশিনারি, এমনকি গাড়িগুলোর মধ্যে যোগাযোগ তৈরি হবে। উদাহরণস্বরূপ, প্রকৌশলীদের একটি মাথাব্যথার বিষয় হচ্ছে কীভাবে দুটো গাড়ির মধ্যকার সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া যায়। এরকম ব্যবস্থার জন্য সবার আগে প্রয়োজন গাড়ি দুটোর মধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী তথ্য আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা, যেটা ফাইভ-জি অনায়াসে করতে পারবে। এর ফলে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি তৈরির যুগের বড় ধরনের প্রাপ্তি ঘটবে বলে বিশ্বাস করছেন বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ফাইভ-জি এতসব কাজ করতে সক্ষম হবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে? কী থাকবে এই ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে? এককথায় উত্তর হচ্ছে, মিলিমিটার ওয়েভ বা তরঙ্গ। এখন তথ্য প্রেরণের জন্য রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি বা রেডিও কম্পাঙ্ক ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু মিলিমিটার তরঙ্গ যখন ব্যবহার করা হবে, সেটা হবে আরও শক্তিশালী। তবে এই তরঙ্গ ব্যবহার করা একটু জটিল, তবে অসম্ভব নয়। এখন যে ওয়াই-ফাই ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেগুলোর কম্পাঙ্ক ২.৪-৫.৮ গিগাহার্জ ব্যান্ডের মধ্যে হয়। অপরদিকে মিলিমিটার ওয়েভে এই ওয়াই-ফাই যখন শুরু হবে, তখন সেটার ব্যান্ড ২৪ গিগাহার্জ বা তার থেকেও বেশি হবে।
এই ছোট্ট একটি তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তথ্য আদান-প্রদানের দ্রুততা কী বিপুল পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। মিলিমিটার ওয়েভের টাওয়ারগুলোর উচ্চতা হতে হবে এখনকার টাওয়ারগুলোর তুলনায় আরও উঁচু। কমপক্ষে ৫০০ ফুট উঁচু হতেই হবে। মোবাইল ফোন এবং যেসব যন্ত্র রিসিভার হিসেবে কাজ করে সেগুলোকে আরও উন্নত করতে হবে। বিশেষ করে মোবাইলের ভিতর ছোট ছোট যেসব সেল ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে নতুন করে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নতুন করে ডিজাইন করতে হবে।
শুধুমাত্র এই একটি বিষয়ের জন্যই মিলিমিটার ওয়েভ এবং ফাইভ-জি নিয়ে প্রযুক্তিবিদদের এত আগ্রহ। সুপারফাস্ট কভারেজ যাকে বলে, ফাইভ-জি আমাদেরকে সেটা দিতে সক্ষম। তবে জনসংখ্যার ঘনত্ব যেসব অঞ্চলে বেশি, যেমন- ঢাকা, নিউইয়র্ক, দিল্লি, হংকং, চীন ইত্যাদি অঞ্চলে বা দেশে ফাইভ-জি’র আসল রুপ এবং সুযোগসুবিধা সম্পর্কে বোঝা যাবে। গ্রামাঞ্চল কিংবা মফস্বল এলাকাগুলোতে এই সুযোগসুবিধা না-ও পাওয়া যেতে পারে। এসব জায়গায় ফাইভ-জি-তে তথ্য আদান-প্রদানের দ্রুততা ফোর-জি’র তুলনায় হয়তো বেশি হবে, কিন্তু শহরাঞ্চলে এই দ্রুততা আরও বেশি হবে বলে মনে করছেন প্রযুক্তিবিদগণ।
যেকোনো প্রযুক্তির ভালো এবং খারাপ- দুটো দিকই আছে। ফাইভ-জিও এই সত্যের বাইরে নয়। এটি এমন এক প্রযুক্তি যেটা বাজারে আসবেই, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করার জন্য অনেকগুলো পাওয়ার স্টেশনের প্রয়োজন পড়বে। হয়তো ফাইভ-জি আসলে রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টগুলোর আশেপাশে আরও বেশি বেশি আয়তাকার বাক্স দেখা যাবে। এই নেটওয়ার্কের জন্য প্রচুর তার লাগবে যা ইউটিলিটি পোলগুলোর একটি আরেকটির সাথে সংযোগ রক্ষা করবে। তবে মিলিমিটার ওয়েভের বর্ণালী নিয়ে কাজ করা এক বিরাট প্রতিযোগিতা এবং চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। কাজটি কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা দিনের পর দিন এটা নিয়ে কাজ করেই যাচ্ছেন। তবে কোয়ালকম নিজেই স্বীকার করছে, ফাইভ-জি ব্যবহার করাটা হবে কঠিন। ফাইভ-জি’র দামও হবে বেশি। প্রথম প্রথম এই নেটওয়ার্ক সবাই ব্যবহার না-ও করতে পারে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।
কিন্তু একবার এই প্রযুক্তি চলে আসলে সকল ইলেকট্রনিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক নির্ভর ব্যাটারি, চিপ এবং অন্যান্য যন্ত্রাংশ তৈরির দিকে চলে আসবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। জনগণ সবসময় দ্রুত যোগাযোগ করার মাধ্যম খুঁজতে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, ফাইভ-জি নির্ভর মোবাইল বাজারে আসতে পারে ২০১৮ এর শেষের দিকে বা ২০১৯ এর প্রথম দিকে। প্রথম যখন ফাইভ-জি’র ধারণা নিয়ে আসা হলো, তখন কেউ ভাবেনি যে এই প্রযুক্তি ২০২০ এর আগে বাজারে আসতে পারে। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব হচ্ছে।
অ্যাপল তাদের ফাইভ-জি আইফোন বের করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে সেটা ২০১৯ এ না-ও হতে পারে। স্যামসাং তাদের গ্যালাক্সি এস-১০ প্লাসে ভেরিজোনের সাথে মিলে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। লেনোভো তাদের মটোরোলা মটো জেড ৩ ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় বাজারে নিয়ে আসছে। এলজি ঘোষণা দিয়েছে, তাদের মোবাইল ফাইভ-জি নেটওয়ার্কভুক্ত থাকবে, যেটা হবে অত্যন্ত দ্রুতগতির। তারা কিন্তু ইতোমধ্যেই ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক ধরতে পারে এমন যন্ত্র তৈরি করে বাজারে ছেড়েছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ফাইভ-জি হটস্পট রাউটার এবং ভেরিজোন ফাইভ-জি ব্রডব্যান্ড সেবা চালু করেছে, যা কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে সেবা দিচ্ছে।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক আসার ফলে মানুষের জীবনযাত্রায় কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক হবে অনেক বেশি দ্রুতগতির। যোগাযোগ হবে অনেক দ্রুত। এমনকি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফাইভ-জি ব্যবহার করে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করা যাবে। প্রথমদিকে খরচ হয়তো বাড়বে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন সমস্যার সমধান হবে বলেও বিশ্বাস করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইতোমধ্যে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক অনুমোদিত যন্ত্রাংশ তৈরির দিকে নজর দিয়েছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরি করেও ফেলেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৯ সাল ফাইভ-জি’র মাধ্যমে পুরো পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যোগ করবে।