গত ১৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনাতে উবারের একটি চালকবিহীন গাড়ি (Autonomous Vehicle) একজন পথচারীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আহত পথচারীটি ৪৯ বছরের একজন মহিলা ছিল। স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাকে সেখানে মৃত ঘোষণা করা হয়। আরিজোনার টেম্পের পুলিসের বরাতে এই খবর জানা যায়। তদন্ত করে দেখা যায় যে গাড়িটিতে একজন অপারেটর ছিল, কিন্তু কোনো যাত্রী ছিল না। সংঘর্ষের সময় অপারেটর উপস্থিত ছিল, কিন্তু গাড়িটি অটোমোটেড মোডে থাকার কারণে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে নি। তাছাড়া নিহত পথচারী নির্দিষ্ট ক্রসিং ব্যবহার না করে রাস্তার মাঝে দিয়ে নিয়ম না মেনে পার হওয়ার সময় এই দুর্ঘটনাটি ঘটে।
চালকবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানোর প্রকল্প শুরু হওয়ার পর এই প্রথম এর কারণে কোনো পথচারী নিহত হলো। এর আগে অস্ট্রেলিয়াতে স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সামনে এসে পড়া এক ক্যাঙ্গারুকে শনাক্ত করতে না পেরে তার সাথে সংঘর্ষ হয়। কিন্তু মানুষের সাথের ঘটনা এই প্রথম। তবে এখানে পথচারীরও দোষ আছে। কারণ সে নির্দিষ্ট ক্রসিং ব্যবহার করেছিলো না। আর স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়িগুলো অনেকটা রোবটের মতো কাজ করে। নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো পরিপক্বতা এখনও তাকে দেয়া সম্ভব হয়নি, তবে কাজ চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখন পরিবহন গবেষণার সিংহভাগ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সেফটি নিয়ে গবেষণায়। যা-ই হোক, এই দুর্ঘটনার পর উবার দুঃখ প্রকাশ করেছে, তদন্তের স্বার্থে সব ধরনের সাহায্য করতে তারা রাজি হয়েছে। ফিনিক্স, পিটসবার্গ, সান-ফ্রান্সিস্কো এবং টরন্টোতে তাদের যেসব স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি চলাচল করছে সেগুলোও বন্ধ আছে। US National Highway Traffic Safety Administration এবং The National Transport Safety Board দুর্ঘটনার জায়গা তদন্ত করার জন্য একটি দল পাঠিয়েছে।
চালকবিহীন গাড়ি তৈরির রীতিমত একটি হিড়িক পড়ে গিয়েছে চারিদিকে। এর কারণ হচ্ছে এখন সারা পৃথিবীতে যত সড়ক দুর্ঘটনা হয় তার জন্য ৯০ ভাগ দায়ী চালক নিজে। চালকের অন্যমনস্কতা, ক্লান্তি, অবসাদ, গাড়ি চালনায় শুধু শুধু ঝুঁকি নেয়ার প্রবণতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে চালক নিজেই এসব দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলে। সেজন্য চালকদের ত্রুটি কমানোর জন্য এখন চালকবিহীন গাড়ির প্রতি গবেষকদের নজর পড়েছে।
উবার সবাইকে ছাড়িয়ে খুব দ্রুত গতিতেই এগোনোর চেষ্টা করছে। কিন্তু এমন দুর্ঘটনার পর প্রশ্ন হচ্ছে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টার জন্যই কি এমন দুর্ঘটনা ঘটে গেলো? এখান থেকে কি কোনো বিষয় নিয়ে আরও গভীরভাবে সতর্ক হবার আছে? উবারের জলদি জলদি স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি রাস্তায় নামানো কি ঠিক হচ্ছে?
চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে এত গবেষণা হচ্ছে যে গবেষকদের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস চলে এসেছে এই গাড়ির জন্য যে যে প্রযুক্তির দরকার এবং যতটুকু দক্ষ এলগরিদম দরকার সেগুলো তৈরি করা হয়েছে। তাই এখন উবারের মতো আরও প্রায় ডজনখানেক প্রযুক্তি সংস্থা এবং স্টার্টআপ কোম্পানি চালকবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামানোর জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে।
এমআইটিতে চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে গবেষণা করেন ব্রায়ান রেইমার। এই দুর্ঘটনার পরে তিনি বলেন, রাস্তায় মানুষের মাঝে এ ধরনের গাড়ি নামানোর জন্য এখনও এই শিল্প পুরোপুরি তৈরি নয়। এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু আরও উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন এখানে প্রয়োজন। এছাড়া এ ধরনের গাড়ির জন্য কিছু আইন প্রণয়ন প্রয়োজন। যেসব প্রতিষ্ঠান চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করবে তাদেরকে সেসব আইন মেনে চলে এরপর যেকোনো জায়গায় গাড়ি নামাতে হবে। স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি আইনের আওতায় আনার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন।
ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কেলো বলেছেন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নির্ভর এই গাড়িগুলোর জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। বিশেষ করে এসব গাড়ি চলাচল করার পর মানুষের সাথে যদি কোনো কারণে সংঘর্ষ হয় তাহলে সেখানে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আইন কেমন হবে এবং স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির জন্য কোম্পানিগুলো কী ধরনের নীতিমালা প্রয়োগ করবে এসব নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
এ ধরনের অতি উন্নত প্রযুক্তির নৈতিক নীতিমালার একটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির জন্য একটি কঠিন প্রশ্ন হচ্ছে ট্রলি সমস্যা। এর মানে হচ্ছে যদি একটি চালকবিহীন গাড়ির সামনে দুটি সম্ভাব্য বাঁধা থাকে তাহলে এটা কী করবে? দুটির যেকোনো একটির সাথে এর সংঘর্ষ অবশ্যই হবে। সেক্ষেত্রে গাড়ি কিন্তু গুলিয়ে ফেলবে। এমন ক্ষেত্রে এলগরিদম কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে কাজ করতে না-ও পারতে পারে। তবে আরিজোনাতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছে তার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সম্ভবত সেন্সর ঠিকভাবে পথচারী শনাক্ত করতে পারেনি এবং এলগরিদমও ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি যে এটা সামনে কী দেখছে।
ওয়েমো বলে গুগলের একটি চালকবিহীন গাড়ির প্রজেক্ট ছিল যেটা কিছুদিন আগে ঘোষণা দিয়েছে যে এই বছরের মধ্যে তারা এমন চালকবিহীন গাড়ি তৈরি করবে যার মধ্যে কোনো নিরাপত্তা চালক বা অপারেটর থাকবে না। উবারের যে দুর্ঘটনা ঘটে গেল সেখানে কিন্তু একজন অপারেটর ছিল। তবুও দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু ঘটে গেল। এমন অবস্থায় যখন স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি নিজেই প্রশ্নের মুখে তখন ওয়েমো কতটুকু তাদের ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটা দেখার বিষয় এবং চিন্তারও বিষয়। উল্লেখ্য, ওয়েমো তাদের এই গাড়ি ট্যাক্সি হিসেবে ফিনিক্সের রাস্তায় নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দুর্ঘটনার আগের দিন উবার, ওয়েমো এবং আরও কিছু প্রতিষ্ঠান কংগ্রেসে একটি আইনের পাসের জন্য সুপারিশ করেছে যেটা পাস হয়ে গেলে চালকবিহীন গাড়ি রাস্তায় প্রয়োগের ব্যাপারটি অনেক সোজা হয়ে যাবে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পর এই বিল পাস আদৌ হবে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
২০১৬ সালের মে মাসে টেসলা মডেল এস এর একটি স্ব-নিয়ন্ত্রিত গাড়ির সাথে একটি ট্রাকেরসংঘর্ষ হয়। তখনও গাড়িটি অটোপাইলট মোডে ছিল। এই দুর্ঘটনায় টেসলার গাড়িতে থাকা চালক নিহত হন। এই ঘটনার পর কিন্তু চালকবিহীন গাড়ি নিয়ে গবেষণা থেমে থাকেনি। আরও বেশী করে গবেষণা হয়েছে যে কীভাবে এর ত্রুটিগুলো সারিয়ে তোলা যায়।
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহার দিনকে দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে চালকবিহীন গাড়িই হবে মূল পরিবহনের মাধ্যম। বিশেষ করে মালামাল পরিবহনের জন্য চালকবিহীন গাড়ির বিকল্প থাকবে না। কিন্তু যাত্রী নিয়ে বিপদমুক্তভাবে চলাচলের জন্য আরও দক্ষ গাণিতিক অ্যালগরিদম এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ প্রয়োজন। এছাড়া চালকবিহীন গাড়ির সাথে পথচারী খাপ খেয়ে চলতে পারবে কিনা সেটাও এখন দেখার বিষয়। কারণ চালকবিহীন গাড়ির কারণে যদি পথচারীরা বিপদের সম্মুখীন হয়, তাহলে ব্যাপারটি সত্যিই চিন্তার উদ্রেক ঘটায়।
ফিচার ইমেজ সোর্স: newscientist.com © Kristoffer Tripplaar/ Alamy Stock Photo