গত মার্চ মাসের শেষে প্রযুক্তি দুনিয়ায় একটি গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। দ্যা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি রিপোর্টে, জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম ডিসকর্ড কিনে নেয়ার ব্যাপারে মাইক্রোসফটের আগ্রহের কথা প্রকাশ করা হয়। রিপোর্টে জানানো হয়, মাইক্রোসফটের নির্বাহী কর্মকর্তারা ডিসকর্ডের সাথে একটি চুক্তি সম্পন্ন করার চেষ্টা করছেন। টিকটক ও পিন্টারেস্ট কিনতে ব্যর্থ হওয়ার পরে এটি মাইক্রোসফটের সর্বশেষ লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকটক, পিন্টারেস্ট ও ডিসকর্ড তিনটি ভিন্ন ধরনের কোম্পানি হলেও এদের তাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, মাইক্রোসফট প্রধানত সেই ব্যাপারটাতেই আগ্রহী। সেটি হচ্ছে, এদের সবাই বিশাল সংখ্যক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও কম্যুনিটির উৎস।
এই সার্ভিসগুলোর জন্য মাইক্রোসফট বিশাল অংকের টাকা খরচ করতে চায়, কারণ এক্সবক্সের বাইরে তাদের বড় কোন ভোক্তা কম্যুনিটি নেই, যেরকমটা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য বড় প্রযুক্তি কোম্পানির রয়েছে। ইউটিউব কেনার পরে গুগল এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিডিও প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, অ্যামাজন টুইচ কেনার পরে স্ট্রিমিং সার্ভিসে আধিপত্য অর্জন করেছে। ফেসবুক কিনেছে ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ। এখন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কর্তৃত্ব চালাচ্ছে বলা যায়। অ্যার অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর থেকে শুরু করে ল্যাপটপ, স্মার্টফোনের বিশাল একটি বাজার রয়েছে। ডিসকর্ডের মাধ্যমে মাইক্রোসফট সেরকমই ১৪০ মিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী পেতে চায়, যেই সংখ্যাটি বেড়েই চলেছে।
Creation, creation, creation — the next 10 years is going to be as much about creation as it is about consumption and about the community around it, so it’s not creating alone. If the last 10 years has been about consumption — we’re shopping more, we’re browsing more, we’re binge watching more — there is creation behind every one of those.
ব্লুমবার্গের একটি সাক্ষাৎকারে মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা এভাবে কম্যুনিটির উপরে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। সিইও হওয়ার পরে প্রথম বছরেই তিনি কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ও কম্যুনিটির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। মাইক্রোসফটের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। এই বিশাল অর্থ তারা অন্যান্য সম্ভাবনাময় কোম্পানি কিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জনের চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের এ রকম একটি বড় অধিগ্রহণ ছিল মোজ্যাং কোম্পানি, জনপ্রিয় মাইনক্র্যাফট গেম নির্মিত হয়েছিল যে স্টুডিওতে। মাইনক্র্যাফটের ১৩১ মিলিয়নের বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। পরবর্তীতে, নাদেলার নেতৃত্বে মাইক্রোসফট লিঙ্কডইন ও গিটহাব কিনেছিল যথাক্রমে ২৬.২ বিলিয়ন এবং ৭.৫ বিলিয়ন ডলারে। গিটহাব কেনার পেছনে একটি বড় কারণ ছিল, ডেভেলপারদের কম্যুনিটিতে আধিপত্য অর্জন করা। অন্যদিকে, লিংকডইন মাইক্রোসফটকে ব্যবসাভিত্তিক কম্যুনিটির প্রতি সংযুক্ত করেছে।
গত বছর ৭.৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে জেনিম্যাক্স মিডিয়া কেনার মধ্য দিয়ে মাইক্রোসফট তাদের গেমিং ব্যবসাকে আরো শক্তপোক্ত করেছে। জেনিম্যাক্স মিডিয়া বেথেসডা সফটওয়ার্কসের প্যারেন্ট কোম্পানি, যারা দ্যা এল্ডার স্ক্রলস, ফলআউট, ডুমের মতো জনপ্রিয় ভিডিও গেম সিরিজের পাবলিশার।
মাইক্রোসফট যে এ রকম কম্যুনিটি ভিত্তিক আরো প্ল্যাটফর্ম খুঁজে চলেছে, সেটি পরিষ্কার। নাদেলা সিইও হয়ে আসার পরে, মাইক্রোসফট বিম নামের একটি স্ট্রিমিং সার্ভিস কিনে সেটিকে মিক্সার নামের নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে প্রকাশ করেছিল। টুইচের সাথে সেটি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারেনি, কারণ এটির ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল অনেক কম। ব্যর্থ হয়ে, গত বছর মিক্সার বন্ধ করে দিয়েছিল তারা। ফলে, মিক্সারের অনেক স্ট্রিমার ফেসবুক গেমিংয়ে জয়েন করেছে।
ডিসকর্ড মাইক্রোসফটের জন্যে একটি বড় ও সক্রিয় কম্যুনিটির উৎস হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানত গেমারদের যোগাযোগ মাধ্যম হলেও, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার জন্য এটি চমৎকার একটি প্ল্যাটফর্ম। গত বছর মহামারি শুরুর পর থেকে গেমার ছাড়াও অন্য ধরনের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে, ডিসকর্ডে প্রতিদিন ৬.৭ মিলিয়ন সক্রিয় সার্ভার রয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই উত্তর আমেরিকা মহাদেশের বাইরের। অনলাইন মুভি নাইট, স্ট্রিমড গেমসের জন্যে এটা ব্যবহৃত হয়। আবার, ব্যবহারকারীরা একসাথে গেম খেলে থাকে। গেম খেলার সময়ে ডিসকর্ড বন্ধুদের আড্ডা এবং চ্যাট করার প্রধান মাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
ডিসকর্ড প্রধানত একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে বন্ধু ও বিভিন্ন কম্যুনিটির সাথে হ্যাংআউট কিংবা আড্ডা দেয়া যায়। এখানে একইসাথে টেক্সট চ্যাট, ভয়েস চ্যাট, ভিডিও চ্যাট করা যায় এবং তা ফোন এবং কম্পিটারের মধ্যে নির্বিঘ্নে সংযুক্ত করা যায়। এখানে একইসাথে গেম খেলা, হোমওয়ার্ক এমনকি অনলাইন বইয়ের ক্লাব, ক্যারিওকি নাইট আয়োজন করার মতো ব্যাপারও ঘটে।
ডিসকর্ডের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম থেকে একেবারেই ভিন্ন। ডিসকর্ড অ্যাপটি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে দিয়ে মানুষ বিভিন্নরকম কাজ করতে পারে। যেমন, কেউ যদি স্পটিফাইতে গান শুনে, তার নামের পাশে গানের নাম ভেসে উঠবে এবং অন্যরা তা দেখতে পাবে। এ রকমভাবে, গেম খেললে সেটার নামও দেখা যাবে। এই ব্যাপারটি কথোপকথন শুরু করার জন্যে একটি সাবলীলতা নিয়ে আসে। ভয়েস চ্যানেল যুক্ত করার মাধ্যমে পুরো অভিজ্ঞতাটি এমন যে, ব্যবহারকারী যেকোনো জায়গায় বসে বন্ধুর সাথে হ্যাংআউট করতে পারছে। ধরা যাক, দুইজন বন্ধু ভয়েস চ্যানেলে অডিও চ্যাট করছে, তৃতীয় আরেকজন এসে সেটি দেখতে পারলো এবং সহজেই সেখানে প্রবেশ করে ফেললো। চায়ের দোকান কিংবা ডর্ম রুমে আড্ডার ব্যাপারটি যেমন নির্বিঘ্ন হয়, ঠিক সে ব্যাপারটিকেই ডিসকর্ড ভার্চুয়াল দুনিয়ায় নিয়ে এসেছে।
ডিসকর্ডের আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, এখানে কোনো বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয় না, যেমনটি ইউটিউব, ফেসবুক কিংবা টুইটারে দেখা যায়। এই ব্যাপারটি একটা বড় সংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করছে। ডিসকর্ডের সিইও এই ব্যাপারে বলেছেন, তারা মানুষের প্রাইভেসিকে অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখেন। বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হলে, তাদেরকে মানুষের মেসেজ কিংবা অডিও চ্যাটগুলোতে নজর দিতে হবে এবং এটা তাদের কোম্পানির দর্শনের সাথে মেলে না। তাদের মুনাফা আসে বিভিন্ন প্রিমিয়াম সার্ভিস বিক্রির মাধ্যমে।
We do not scan peoples’ messages. We do not read them. However, Discord does not have end-to-end encryption. So if you break our community guidelines, we will go investigate. And if we do find that you are doing that, we will ban you, so that we take privacy very seriously. But we also have a trade-off where we also take safety very seriously.
কম্যুনিটি ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম- শুধু এটাই ডিসকর্ডের প্রতি মাইক্রোসফটের আগ্রহের একমাত্র কারণ নয়। প্রযুক্তি জায়ান্টটির আরেকটি উচ্চাকাঙ্খা হলো, তাদের ক্লাউড কম্পিউটিং সার্ভিস এজিউর বড় পাবলিক সার্ভিসগুলোর চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে মাইক্রোসফট তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অন্যদিকে, ডিসকর্ড গুগল ক্লাউডের সেবা ব্যবহার করে। ডিসকর্ডকে এজিউরে সংযুক্ত করতে পারলে ক্লাউড প্রতিযোগিতায় তারা কিছুটা হলেও এগিয়ে যেতে পারবে।
মাইক্রোসফট মাইনক্র্যাফট গেমকে অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস থেকে সম্প্রতি এজিউরে স্থানান্তর করেছে। কোম্পানিটি আউটলুকের আইওএস ভার্সন অনেক আগেই সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। ডিসকর্ড, টিকটক কিংবা পিন্টারেস্টের মতো বড় প্ল্যাটফর্ম এজিউরে সংযুক্ত করলে, তা মাইক্রোসফটের এই সেবাটির প্রচারণা ও বিক্রির জন্যে ভালো রকমের প্রভাব হিসেবে কাজ করবে।
ক্লাউডের বাইরেও ডিসকর্ডের সম্ভাবনা রয়েছে বিশালাকারের। ডিসকর্ড গত বছর ১০০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে, যেন গেমিংয়ের বাইরের কম্যুনিটিগুলোতেও যেমন, আর্ট কম্যুনিটি, স্পোর্টস নেটওয়ার্ক, স্কুল ক্লাব ইত্যাদি সবধরনের মানুষকে সমানভাবে আকর্ষণ করতে পারে। অনেকটা মাইক্রোসফট টিমসকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে যেভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে তার মতো। কোম্পানিটি স্কাইপি দিয়ে জুমের সাথে প্রতিযোগিতা করতে ব্যর্থ হয়ে টিমসকে ফোকাস করেছে।
মাইক্রোসফটের ডিসকর্ড কেনার সাথে আরেকটি লাভও জড়িত রয়েছে। তাদের গেমিং কম্যুনিটি এক্সবক্সের সাথে ডিসকর্ডের সংযুক্তি তখন অনিবার্য হয়ে উঠবে। এক্সবক্সের প্রধান ফিল স্পেন্সার ডিসকর্ডের গুরুত্ব অনেক আগেই আলোচনা করেছিলেন। মিক্সারকে তারা এক্সবক্সের সাথে সেভাবে সমন্বয় করতে চেয়েছিল, কিন্তু মিক্সার প্রজেক্টটিই ব্যর্থ হয়েছে।
এতক্ষণ ধরে ডিসকর্ড মাইক্রোসফটের কী ধরনের সম্ভাবনার পথ খুলে দিতে পারে, সে ব্যাপারে আলোচনা হলো। কিন্তু, সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, মাইক্রোসফটের প্রস্তাব থেকে ডিসকর্ড বের হয়ে এসেছে। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকদের ধারণা হচ্ছে, ডিসকর্ড নিজেদের ক্রমোন্নতি ধরে রেখে পরবর্তীতে শেয়ারগুলো পাবলিক করে দিতে চায়। অর্থাৎ, অন্যসব বড় কোম্পানির মতোই তারা পাবলিক কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে ইচ্ছুক। এ কারণে কোম্পানিটি স্বাধীন হিসেবে পরিচালনা করা খুবই প্রয়োজনীয়। রিপোর্ট বলছে, আলোচনা সমাপ্তির আগে মাইক্রোসফট ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ করতে ইচ্ছুক ছিল।
দ্যা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের রিপোর্ট অনুযায়ী, ডিসকর্ড এখন স্বাধীন কোম্পানি হিসেবেই নিজেদের অবস্থাটি বজায় রাখতে চাইছে। টেকক্রাঞ্চের রিপোর্ট বলছে, ডিসকর্ড যে পুরোপুরি স্বত্বাধিকার বিক্রির জায়গা থেকে সরে এসেছে, এমন না। কোম্পানিটি আপাতত নিজেদের সেবার দিকে নজর দেবে। তারা সম্প্রতি চিফ ফিন্যানশিয়াল অফিসার নিয়োগ দিয়েছে, যেন পাবলিক শেয়ার উন্মুক্ত করার জন্যে নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে পারে।
ডিসকর্ডের জন্যে বর্তমানে স্বাধীন থাকাটাই সবচেয়ে লাভজনক বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কারণ, ছোট কোম্পানিগুলো বিক্রি হয়ে গেলে প্রাথমিক পরিকল্পনা বা কোম্পানির দর্শনের সাথে বড় কোম্পানির আগ্রহ অনেকসময়েই মিলে না। মাইক্রোসফট স্কাইপি কিনে নেয়ার ঘটনাটি এ রকম একটি উদাহরণ। যদিও, ১০ বিলিয়ন ডলার খুবই বড় একটি সংখ্যা, কিন্তু ডিসকর্ডের নিজস্ব বেশ ভালো পরিকল্পনা রয়েছে। যেমন, সম্প্রতি তারা জনপ্রিয় অ্যাপ ক্লাবহাউজের মতো নিজেদের অডিও কনফারেন্স সিস্টেম চালু করেছে। যেটা ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকারীকে অনেক বেশি কার্যকারিতা এনে দেবে, আগ্রহও তৈরি করবে।
সহজভাবে বললে, ডিসকর্ড মাইক্রোসফটের মতো বড় কোম্পানি ছাড়াই যথেষ্ট ভালো করছে এবং তাদের উত্তরোত্তর ভালো করার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।