মরুভূমি; শব্দটি শুনলেই হয়তো জনশূন্যতা, উত্তপ্ত বাতাস, একাকিত্ব, একরাশ ধূলো কিংবা নির্জনতার কথা মনে হয়। কিন্তু, মরুভূমির বুকে স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন হাজার বছরের পুরনো হলেও, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে আধুনিক স্থাপত্যশিল্প বর্তমানে ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। সেই অর্থে, মরুভূমি এখন শুধু বিরান ভূমি নয়। তাছাড়া জেনে অবাক হবেন, প্রায় এক বিলিয়নের বেশি মানুষের বসবাস মরু অঞ্চলেই। অর্থাৎ, পৃথিবীর সাত ভাগের এক ভাগ মানুষের বসবাস এখানে। তাই, প্রযুক্তির ছোঁয়ায় উত্তপ্ত মরুভূমির জনজীবন আরও বেশি বসবাসযোগ্য ও আকর্ষণীয় হিসেবে গড়ে ওঠা ছিল সময়ের ব্যাপার। স্থানীয় উপকরণ, আধুনিক প্রযুক্তি ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে মরুর বুকে গড়ে ওঠা স্থাপত্যশিল্পগুলো থেকে ভবিষ্যতের মরুভূমির বদলে যাওয়া চেহারা কেমন হতে পারে, সেই আভাস অবশ্য কিছুটা হলেও পাওয়া যায়। মরু প্রান্তরে গড়ে ওঠা তেমন’ই কিছু অনিন্দ্য সুন্দর স্থাপত্যশিল্প নিয়ে আজকের আয়োজন।
আমানগিরি রিসোর্ট, উটাহ (যুক্তরাষ্ট্র)
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ উটাহর ক্যানিয়ন পয়েন্টে অবস্থিত এই রিসোর্টটির নকশা প্রণয়ন করেছে আই-১০ স্টুডিও। মরুর অসীম নির্জনতাকে ভেদ করে ৬০০ একর জমির উপরে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক এই রিসোর্টটি। কনক্রিট ও বেলেপাথর ব্যবহার করে তৈরি করা এই স্থাপত্যশিল্পটি মরুভূমিতে পর্যটকদের জন্য দারুণ সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
এখান থেকে যেমন নির্জন মরুর রাতের আকাশ উপভোগ করা যায়, তেমনি রয়েছে ন্যাশনাল পার্ক ও লেক পাওয়েল ভ্রমণ করার সুযোগ। সেই সাথে, রিসোর্টের চারপাশের থাকা অসীম সৌন্দর্য চষে বেড়ানো ও নাভাহো সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের পাশাপাশি পাথুরে পাহাড়ে চড়ার ব্যবস্থাও রেখেছে কর্তৃপক্ষ। সারাদিন ঘুরে বেড়ানোর পর যদি, ক্লান্ত শরীর ও মন দুটোই চাঙ্গা করতে চান, তাহলে ব্যবহার করতে পারেন রিসোর্টের ২৫,০০০ স্কয়ার ফিটের আমান স্পা।
ফোর আই’স হাউজ, ক্যালিফোর্নিয়া (যুক্তরাষ্ট্র)
ক্যালিফোর্নিয়ার কোচেলা ভ্যালিতে অবস্থিত এই অবকাশযাপন কেন্দ্রটি মরুভূমিতে স্থাপত্যশিল্পের দারুণ একটি নিদর্শন। চারটি টাওয়ার নিয়ে গঠিত এই কেন্দ্রটি এমন এক জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে, যেখান থেকে উপভোগ করা যায় প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
টাওয়ারগুলোতে ঘুমানোর সুযোগের সাথে রয়েছে মাথার উপরের তারাভরা আকাশ, পূর্বের সূর্যোদয়, পশ্চিমে সন্ধ্যার শহুরে আলো এবং দক্ষিণের পর্বতমালা অবলোকনের দারুণ ব্যবস্থা। এডওয়ার্ড অগোস্তা আর্কিটেকচার প্রতিষ্ঠানের নকশায় তৈরি এই সাদা রঙের কাঠামোটি তৈরি করা হয়েছে ২০১২ সালে এবং অনন্য নকশার ও বৈশিষ্ট্যের দরুন এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি পুরষ্কারও জিতে নিয়েছে এটি।
সানসেট হাউজ, আগাদেজ (নাইজার)
সুইস শিল্পী ও ভাস্কর নট ভাইটালের অনন্য কীর্তি নাইজারের আগাদেজের মরুভূমিতে স্থাপিত সানসেট হাউজটি। এটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়েছে স্থানীয় মাটির তৈরি ইট ও খড়। সাধারণ গড়নের এই স্থাপনাটিতে ফুটে উঠেছে স্থানীয় ঐতিহ্য, যেটি ২০০৫ সালে গড়ে তোলা হয়। চারতলার এই হাউজটির প্রতিটিতে শুধু একটি কক্ষ বিদ্যমান।
মজার ব্যাপার হলো, সানসেট হাউজের প্রতিটি তলা বা কক্ষে যাওয়ার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সিঁড়ি, অর্থাৎ প্রতিটি সিড়ি একটি নির্দিষ্ট কক্ষের সাথে সংযুক্ত। নাইজারে স্যান্ডস্টর্ম হাউজ, মুন হাউজ, টেনথ হাউজ নামের নট ভাইটালের আরও বেশ কয়েকটি দারুণ কাজ রয়েছে।
এনকুয়েন্ত্রো গুয়ালুপে, গুয়ালুপে (মেক্সিকো)
সনোরান মরুভূমির মেক্সিকান অংশের ভ্যালে দে গুয়ালুপেতে অবস্থিত এনকুয়েন্ত্রো গুয়ালুপেতে রয়েছে পৃথক কেবিন ও ভিলার সুবিধা, যা প্রায় ৯৯ হেক্টর জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত স্থাপনাটিতে রয়েছে ২০ বর্গ মিটারের পৃথক ২০টি কক্ষ, যেগুলোর প্রতিটি তৈরি করা হয়েছে যতটা সম্ভব প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে।
স্টিলের কাঠামোর উপরে তৈরি করা ছোট কক্ষগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ইকোলফট এবং এগুলো অতিথিদের প্রায় প্রতিটি চাহিদা পূরণের পাশাপাশি যথাসম্ভব তাদেরককে প্রকৃতির সংস্পর্শে নিয়ে আসে। গার্সিয়া স্টুডিওর ডিজাইনে ২০১১ সালে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
ডেজার্ট নোমান্ড হাউজ, আরিজোনা (যুক্তরাষ্ট্র)
ক্যাকটাসে ঢাকা আরিজোনার রুক্ষ মাটির বুকে গড়ে তোলা হয়েছে ডেজার্ট নোমান্ড হাউজ, যেগুলোর নকশাপ্রণেতা রিক জয়। স্টিল ও কাচের তৈরি ছোট এই ঘরগুলোতে রয়েছে একটি বেডরুম, ছোট বাথরুম, অফিসকক্ষ এবং ডাইনিং রুম।
শহরের কোলাহল ছেঁড়ে মরুভূমির নির্জনতা উপভোগ করার প্রায় সব সুবিধা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এগুলো। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার ব্যবস্থার পাশাপাশি রয়েছে রুক্ষ মরুভূমির ও দূরের পাহাড়ের নির্জনতা উপভোগের অসাধারণ সুযোগ।
গার্ডেন হাউজ, পারবনেহ (ইরান)
পারবনেহ গ্রামের গার্ডেন হাউজটি তৈরি করা হয়েছে ইরানের ইশফাহান প্রদেশের রাজধানী ইশফাহানের এক বাসিন্দার জন্য, যিনি চেয়েছিলেন শহরের ব্যস্ত কোলাহল ছেড়ে নির্জনতায় বসবাস করতে। বিএএম স্টুডিও আর্কিটেক্ট অফিসের ডিজাইনে নির্মিত এই বাড়িটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বালি, সিমেন্ট, খড় ও স্থানীয় উপকরণ। স্থানীয় ঐতিহ্যের আদলে নির্মিত এই বাড়িটিতে রয়েছ ১৮ শতকের নির্মাণ কৌশলের ছোঁয়া।
বাইরের দিক থেকে এটি দেখতে অন্যান্য স্থানীয় বাড়ি-ঘরের মতো হলেও, ভিতরে রয়েছে আধুনিকতার স্পর্শ। নির্মল আলো ও বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রেখে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে এটির, শহরে এই ধরণের বেশ কয়েকটি কাজ করলেও, শহরের বাইরে বিএএম আর্কিটেক্টের এটিই প্রথম কাজ।
সেফচভিচ রেসিডেন্স, আরিজোনা (যুক্তরাষ্ট্র)
২০১১ সালে নির্মিত সেফচভিচ রেসিডেন্স অবস্থিত আরিজোনার মরু অঞ্চলে এবং অসাধারণ এই বাড়িটির চারপাশ ঘিরে রয়েছে শুধু মরুভূমির ক্যাকটাস। পাঁচ বেডরুমের বাড়িটিতে রয়েছে শুষ্ক মরুভূমির ধুসর সৌন্দর্য উপভোগের দারুণ ব্যবস্থা।
সম্পূর্ণ এই প্রকল্পের কাজে বেশিরভাগ স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে। ভেতরের সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠ, পাথর, নীল কাচ এবং ছাঁদে সূর্যের আলো প্রতিফলনের জন্য রয়েছে কপার প্যাসনেল। বাড়িটিতে রয়েছে খোলা ফায়ারপ্লেস ও বিশাল কাঁচের দেয়াল, যেন দূরের পাহাড় অনায়াসে উপভোগ করা যায়। বিলাসবহুল বাড়িটির নকশা করেছে টেট স্টুডিও আর্কিটেক্টস।
ভিলা ডি, মারাকেশ (মরক্কো)
ফ্রান্সের স্টুডিও কেও’র মরক্কোর মারাকেশে তৈরি করেছে ভিলা ডি, যেখানে তারা ব্যবহার করেছে রোদে শুকিয়ে তৈরি করা মাটির ইট। স্থানীয় উপকরণ ও নির্মাণ কৌশল ব্যবহার করে ভিলা ডি’র নির্মাণের পেছনে তাদের যুক্তি ছিল, আধুনিকতা মানেই শুধুমাত্র প্রযুক্তির ব্যবহার নয়, বরং অতীতের দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কৃতির সাথে বর্তমানের একটি সেতুবন্ধন তৈরি করা।
তাদের উদ্দেশ্য ছিল, স্থানীয় নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহারে উৎসাহিত করার পাশাপাশি সেখানকার নির্মাণ কৌশল সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। সেই লক্ষ্যে ভিলা ডি’র ভেতর এবং বাহির সাজানো হয়েছে সম্পূর্ণ ঐতিহ্যের আদলে। বাসিন্দারা যেন প্রকৃতির সন্নিকটে কাটাতে পারে, তা মাথায় রেখেই সাজানো হয়েছে গোটা বাড়ি। দোতলা বাড়ির জানালাগুলো খুব বেশি খোলামেলা ও বড় না হলেও সামনে রয়েছে খোলা চত্বর। নির্মাতারা আশা করছেন, ভিলা ডি স্থাপত্য বিদ্যায় নতুন একটি ভাষা বা ধারা তৈরিতে নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দেবে।