থাইল্যান্ডে ঘুরতে যাওয়ার বিষয় উঠলে প্রথমে এর রাজধানী ব্যাংককের কথাই পর্যটকদের মাথায় আসে। আর এরপরেই ভিন্নধর্মী প্রাচীন ও ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির এবং নিদর্শন দেখতে বেশিরভাগ পর্যটকই ভিড় জমায় সুখোথাই শহরে। ব্যাংকক থেকে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরেই অবস্থিত আরেকটি প্রাচীন শহর আইয়ুত্থায়া। অসাধারণ ইতিহাস ও নিদর্শনে পরিপূর্ণ থাকা সত্ত্বেও শহরটি অনেকটাই উপেক্ষিত। আবার অনেকেই এর বেশি কিছু সম্পর্কেই জানেন না। তবে ১৯৯১ সালে ঐতিহ্যবাহী এই পুরনো শহরটিকে ইউনেস্কো ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং বিলুপ্তপ্রায় নগরীকে বাঁচাতে সরকারের উপর চাপও প্রয়োগ করা শুরু করে।
ঐতিহাসিক শহর আইয়ুত্থায়া ১৩৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সিয়ামিজ রাজত্বের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল। ১৪ থেকে ১৮ শতকে এই শহর বেশ উন্নতি লাভ করে। আর একসময় এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং অসাম্প্রদায়িক শহুরে এলাকায় পরিণত হয়। বিশ্ববাণিজ্য এবং কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও আইয়ুত্থায়া পরিচিতি লাভ করে। এর একদিক গ্রেট চাও ফ্রায়া নদী, পূর্বদিক প্যাসাক নদী এবং উত্তরদিক দিয়ে একটি খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। এটি একটি আদর্শ আত্মরক্ষামূলক অবস্থান। প্রাকৃতিকভাবে এই অবস্থানের কারণে আইয়ুত্থায়ার অধিবাসীরা যেমন বহিরাগতদের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে সফল হয়, তেমনি ব্যবসা বাণিজ্য করতেও বেশ সুবিধা পায়। এমনকি সিয়ামিজের আমলে একে রাজধানী করার পেছনেও এই একই কারণ ছিল। তাছাড়া সেই সময়ে শহরটি সিয়াম উপসাগর থেকে উপরে অবস্থান করায় সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটার সম্ভবনাও কম ছিল। তবে বর্তমানে এখানে প্রায়ই বন্যা দেখা যায়, যা নগরীর অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সিয়াম উপসাগরে ভারত ও চীন থেকে একই পরিমাণ দূরে ছিল এই শহর। এছাড়া আরব ও ইউরোপবাসীদের আক্রমণ থেকে তারা নিরাপদ দূরত্বেই ছিল। তাছাড়া, ঐদিক থেকে আইয়ুত্থায়ার দিকে আসার সমুদ্রপথ তাদের জন্য উল্টো বা প্রতিকূল ছিল। ১৬ শতকের দিকে আইয়ুত্থায়ার চীন, জাপান, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। থাইল্যান্ডের উর্বর জমিতে ধানের চাষ খুব ভালো হত। যার জন্যই অন্যান্য দেশ আইয়ুত্থায়া তথা থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানি করা শুরু করে। একদিকে উপযুক্ত ভৌগলিক অবস্থান এবং অন্যদিকে ব্যবসা ক্ষেত্রে উন্নতির দরুণ আইয়ুত্থায়া তথা থাইল্যান্ড অ্যাংকরের পতনের ফলে যে আধিপত্য হারিয়েছিল তা পুনরুত্থানের চেষ্টায় লেগে পড়ে।
এই ব্যবসা থেকে অধিবাসীরা যে অর্থ উপার্জন করতেন তা তারা প্রাসাদ এবং মন্দির নির্মাণে খরচ করতেন। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং আধিপত্যের দিক থেকে বেশ স্বচ্ছল হয়ে উঠছিল এই পুরনো শহরটি।
তবে আইয়ুত্থায়ার দুর্ভাগ্যের আরম্ভ ঘটে ১৭৬৭ সালে, যখন পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) সাথে তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের একপর্যায়ে বার্মিজ আর্মি শহরটিকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। তারা পুরো আইয়ুত্থায়াকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় এবং বাসিন্দাদের জোরপূর্বক শহর থেকে বিতাড়িত করেন। বছরের পর বছর এত কষ্ট করে নির্মিত মন্দির ও প্রাসাদগুলো অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এই শহরটি আর পুনর্নির্মাণ করা হয়নি। বর্তমানে এই স্থানটি শুধুমাত্র একটি বিস্তীর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবেই পরিচিত।
আইয়ুত্থায়ার বর্তমান অবস্থান ফ্রা নাখোন সি আইয়ুত্থায়া জেলায়। এই বৈশ্বিক ঐতিহ্য সম্পদের আয়তন ১.১১৫ বর্গ মাইল। ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটিতে এখন কিছু স্মৃতিচিহ্নবিশিষ্ট টাওয়ার, বৌদ্ধ মন্দিরের কয়েকটি স্তম্ভ ও বাকি ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যা শহরটির পূর্বের আকার ও স্থাপত্যশিল্প সম্পর্কে ধারণা দেয়।
ব্যাংককের ইউনেস্কোর সংস্কৃতি ডিপার্টমেন্টের প্রধান টিম কার্টিস শহরটি সম্পর্কে বলেন,
এটি (আইয়ুত্থায়া) একটি বহুজাতিক শহর ছিল। কারণ এখানে বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরাও থাকতেন। শহরের খালগুলো দিয়ে একস্থান থেকে অন্য স্থানে খুব জলদি যাতায়াত করা যেত। ১৭ শতকের দিকেও এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহরগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা প্যারিসের আয়তনের প্রায় সমান ছিল।
তার মতে, শহরটির ঐতিহাসিক মন্দিরগুলো সেই সময়ের রাজাদের মানসম্মানই নয়, বরং পুরো সম্প্রদায়ের সম্মান বাড়িয়ে দেয়। কেননা, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগুলো নির্মাণ করা সম্ভবপর হয়। তবে প্রাচীন শহরটি সংরক্ষণে থাই সরকার মনোযোগী না হওয়ায় ইউনেস্কো রাষ্ট্রপক্ষের সাথে এ বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করার চেষ্টা করছে। আইয়ুত্থায়াকে সংরক্ষণ করা গেলে তা অবশ্যই একটি সম্পদে পরিণত হবে। তাছাড়া পুরো শহর খাল-বিলে ভরে থাকার ব্যাপারটি ইতিবাচক বিষয় হিসেবেই কাজ করবে। কার্টিস বলেন,
আমরা পুরনো এবং আধুনিক শহরের মধ্যে অন্যরকম একটি মেলবন্ধন দেখতে চাই। এছাড়া আরেকটি ‘ওয়াটার সিটি’ ভেনিস এক্ষেত্রে একটি ভালো উদাহরণ হিসেবে কাজ করতে পারে।
আইয়ুত্থায়ার অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা একে থাইল্যান্ডের অন্যান্য শহরের তুলনায় আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
বোট মিউজিয়াম
আইয়ুত্থায়ায় এখনও থাইল্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের সংস্কৃতির দেখা মেলে। আর এর কিছু নমুনা পাওয়া যায় সেখানে অবস্থিত বোট মিউজিয়াম থেকে, যেখানে কানক খাওমালা এবং তার পিতা পাইথুন পুরনো দিনগুলোর ঐতিহ্যবাহী জলযান, তথা কাঠের নৌকা থাই হস্তশিল্পের উদাহরণ হিসেবে এখনও ধরে রেখেছেন। নৌকা তৈরির এত প্রাচীন কৌশল ধরে রাখার উদ্দেশ্যে খাওলামা এই মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব নেন। তিনি শিক্ষকতার পেশা থেকে অবসরের পর এই কাজ শুরু করেন। থাইল্যান্ডের ট্রপিক্যাল কাঠের গাছ কমে যাওয়ায় নৌকা তৈরির এই কলাকৌশল আজ বিলুপ্তির পথে।
খাওলামার মিউজিয়ামটি ছোট হলেও বেশ গোছানো। কাঠের নৌকা ছাড়াও এখানে রয়েছে বিশালাকারের এবং বিভিন্ন ধরনের চমৎকার রাজকীয় রণতরী। প্রত্যেকটি রণতরী বানাতে সময় লাগে প্রায় এক বছর।
স্যাক ইয়ান্ট
পুরনো এই শহরটির আরেকটি আকর্ষণ হলো স্যাক ইয়ান্ট, যার অর্থ পবিত্র ট্যাটু বা নকশা। আর এজন্য আপনাকে যেতে হবে শহরটির উত্তর-পশ্চিম দিকে অ্যাজার্ন কবের দোকানে। অ্যাজার্ন এই ট্যাটু আঁকতে অত্যন্ত পারদর্শী একজন ব্যক্তি। থাইবাসী যুগের পর যুগ নিজেদের শরীরের বিভিন্ন ধরনের ট্যাটু আঁকান। তাদের বিশ্বাস, এসকল প্রাচীন ট্যাটু তাদেরকে বিপদ থেকে রক্ষা করবে।
পূর্বে আইয়ুত্থায়ায় থাই সম্রাটদের সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা যুদ্ধে কখনই এসব ট্যাটু না এঁকে যেতেন না। কবের মতে, এসব জটিল ট্যাটু কারো শরীরে কীভাবে খোদাই করে তা শেখাই যথেষ্ট নয়। একটি আদর্শ স্যাক ইয়ান্ট আঁকার জন্য একজন শিল্পীকে রহস্যময় পবিত্র শক্তিরও সঞ্চার করতে হবে। স্যাক ইয়ান্ট আসলে বৌদ্ধ ধর্মের অংশ নয়। বৌদ্ধ ধর্ম এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য স্থানে বিস্তার লাভ করার ফলে তা বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে। একইভাবে, থাইল্যান্ডে পুরাতন ঐতিহ্যের একটি অংশ ছিল স্যাক ইয়ান্ট, যা থাইল্যান্ডে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তনের পরও বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ধারণা করা হয়, এই পবিত্র ট্যাটু শামানিস্টিক ঐতিহ্যেরই একটি খণ্ড।
হাতির ব্যবহার
আইয়ুত্থায়া শহরের সম্রাটদের ক্ষমতা যখন তুঙ্গে, তখন তারা প্রায় হাজারখানেক হাতি পুষতে শুরু করেন। এসব হাতি ভারী বস্তু তোলার কাজে কিংবা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালামাল নিয়ে যাওয়ার কাজে ব্যবহার করা হতো। তাছাড়া হাতিগুলোকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে, এরা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করারও সক্ষমতা অর্জন করতো। আধুনিক যুগে যুদ্ধে হাতি ব্যবহারের ব্যাপার না থাকলেও যাতায়াতের ক্ষেত্রে এখনও রয়েছে। তবে তা মূলত বিনোদনের জন্যই ব্যবহৃত হয়। কারণ আধুনিক যানবাহনও এই শহরে রয়েছে। মূলত পর্যটকদের জন্য এখনও অনেকে হাতি পোষেন।
অপরিকল্পিত আধুনিকায়নের ফলে ঐতিহ্যবাহী আইয়ুত্থায়ায় অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং যানজট দেখা যায়। তবে এর অর্থনৈতিক পরিবর্তন এর বাসিন্দাদের জীবনমান আরও উন্নত করেছে। বর্তমানে শহরটিতে দু’হাজারের বেশি কারখানা রয়েছে, যেখানে প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক কর্মরত। এর মধ্যে একটি কারখানা চালাচ্ছে হোন্ডা কোম্পানি। গাড়ি উৎপাদানের দিক থেকে এটি কোম্পানির ষষ্ঠতম বড় শাখা।
বছরে প্রায় তিন লক্ষ গাড়ি এখানে উৎপাদিত হয়। হোন্ডার ভাইস প্রেসিডেন্টের মতে, আইয়ুত্থায়ার কারখানায় নির্মিত গাড়িগুলোর মান জাপানে নির্মিত হোন্ডা গাড়ির মানের সমতুল্য। তাই আইয়ুত্থায়ার হোন্ডা গাড়ির চাহিদাও বেশি। তবে গত বছর ভয়াবহ বন্যার কারণে বিপাকে পড়তে হয় হোন্ডাসহ বাকি কোম্পানিগুলোকে। ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের বিপদে পড়তে না হয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি না হয়, সেজন্য সরকার পুরো শহরকে ঘিরে ৭৭ কিলোমিটার উঁচু দেয়াল নির্মাণ করছে। আর হোন্ডাসহ আরও কিছু কোম্পানি নিজ স্বার্থের জন্যই এই কাজের তদারকি করছে। তবে সরকারের উচিত এসবের পাশাপাশি পুরনো নগরটির সংস্কৃতি এবং নিদর্শন ধরে রাখার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া। তাছাড়া আইয়ুত্থায়াকে সংরক্ষণ করা গেলে আরও পর্যটকের আগমন ঘটবে শহরটিতে, যা অবশ্যই এর অর্থনেতিক উন্নতির ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করবে।