বছরখানেক আগে সিএনএন নিউজের খবর পড়তে গিয়ে মজার একটি প্রতিবেদন নজর কেড়েছিল। প্রতিবেদনটি লেখা হয়েছিল একটি রেলওয়েকে ঘিরে। অনন্য সুন্দর, স্বতন্ত্র একটি রেলওয়ে। রেলওয়ে সার্ভিসটির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশ্বের নামীদামী পত্রিকায় একে নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। আগ্রহের কারণে গুগলে সার্চ দিয়ে আরও কিছু তথ্য জানা হয় রেল সার্ভিসটি সম্পর্কে। পৃথিবীর বুকে কত সুন্দর সুন্দর রেলওয়েই তো মানুষ তৈরি করেছে! পাহাড়-পর্বত ঘেরা সবুজ অরণ্যের মাঝ দিয়ে মনোরম সব রেলওয়ে সারা পৃথিবীতেই তো ছড়িয়ে আছে! তবু এ রেল সার্ভিসটির কথা জেনে মনে হয়েছে, আসলেই অসাধারণ আর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এ রেলওয়ে সার্ভিসটি। চলুন পাঠক, আজ জেনে নেয়া যাক বিশেষ এই রেলওয়ে সার্ভিসটি নিয়েই।
পূর্ব ইউরোপের দেশ হাঙ্গেরীর রাজধানী বুদাপেস্ট। এই বুদাপেস্টেরই পাহাড়ি এলাকা বুদা-হিলস এর পাহাড়-অরণ্যের বুক চিড়ে তৈরি হয়েছে জায়ারমেকভেসাট (Gyermekvasut) নামের ছোট্ট একটি রেলওয়ে। মাত্র ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ সেই রেলওয়ে। এখানে চলে যে লাল-নীল-সাদা রঙের চকচকে ছোট ছোট ট্রেনগুলো, সেগুলোর ভেতরে দুই ধরনের বগি রয়েছে, সাধারণ আর প্রথম শ্রেণী। সাধারণ বগিতে বসার জন্য আছে সুন্দর কাঠের বেঞ্চ, আর প্রথম শ্রেণীর বগিগুলোতে আছে সবুজ ভেলভেটের নরম সিট। সব বগিতেই সুন্দর অলঙ্করণ করা। আর ট্রেনগুলোর চেয়েও বেশি চমৎকার সেই মানুষগুলো, যারা এগুলো পরিচালনার সাথে যুক্ত রয়েছে।
তারা কারা জানেন? বুদাপেস্টের ১০-১৪ বছর বয়সী ছোট, স্কুলপড়ুয়া, চমৎকার কিছু ছেলেমেয়ে। বয়সের দিক থেকে শিশু বলা যায় যাদের, তারাই কি না আস্ত একটি রেললাইন পরিচালনার বেশিরভাগ কাজের সাথে যুক্ত। ভাবা যায়! সাদা-কালো ইউনিফর্ম পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো যখন রেললাইনের নানা কাজে ছুটে বেড়ায়, বড়দের মতো ভাব ধরে কাজ করে, মনের ভুলে থেকে থেকে খুনসুটিতে মেতে ওঠে- তখন এই জায়ারমেকভেসাট রেললাইনটিই হয়ে ওঠে দুনিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেলওয়ে।
হাঙ্গেরিয়ান শব্দ ‘জায়ারমেকভেসাট’ শুনতে বদখত মনে হলেও এর ইংরেজী অনুবাদটা কিন্তু সুন্দর- ‘দ্য চিলড্রেনস রেলওয়ে’; বাংলায়- শিশুদের রেলওয়ে। জায়ারমেকভেসাট রেলওয়েকে অনেক সময় ‘দ্য গ্রেটেস্ট চাইল্ড টয় ট্রেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ও ডাকা হয়। তবে কথাটি কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। কারণ, বাচ্চারা কাজ করলেও এ রেলওয়েটি মোটেও খেলনা ধরনের নয়। বরং একেবারেই অন্যান্য সব রেলওয়েগুলোর মতোই এর সার্ভিস। এটি পরিচালনার ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মকানুন অনুসরণ করা হয়। হাঙ্গেরির অন্যসব রেলওয়েতে যে নিয়ম-কানুনগুলো মানতে হয়, জায়ারমেকভেসাটেও সেসব নিয়মকানুন পইপই করে মেনে চলতে হয়।
খেলনা তো নয়ই, জায়ারমেকভেসাট রেলওয়ে সত্যিকার রেলওয়ের থেকে কোনোদিক দিয়েই খুব একটা আলাদাও নয়। পৃথিবীর অন্য সব রেলওয়ে সার্ভিসের মতো এ রেলওয়েতেও নিয়মিত যাত্রী আনা-নেওয়া করা হয়। এ রেলওয়ে নিয়ন্ত্রণের জন্যও কর্মচারীদের দরকার পড়ে। টিকিট বিক্রি, ট্রেনের সিগন্যাল দেওয়া, স্টেশন মাস্টারের কাজ করা, টিকিট চেকিংসহ বিভিন্ন কাজের জন্য দরকার হয় মানুষের। পার্থক্য কেবল মানুষের বয়সে আর আকারে। অন্য রেলওয়েতে এই কাজগুলো করে প্রাপ্তবয়স্করা, আর জায়ারমেকভেসাটে কাজ করে ছোট বাচ্চারা।
ও ভালো কথা! বাচ্চারা টিকিট বিক্রি, সিগন্যাল কন্ট্রোল, টিকিট চেকিং এমন সব কাজ করলেও যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে ট্রেন চালানোর জন্য চালক হিসেবে এবং তত্ত্বাবধানের জন্য ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কিন্তু প্রাপ্তবয়স্কদেরই নিয়োগ দেওয়া হয় জায়ারমেকভেসাটে। তাছাড়া, রেললাইনের কাজকর্ম সম্পাদনের জন্য যেসকল বাচ্চাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদেরকে মেধার ভিত্তিতে বাছাই করে, ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা হয়, যাতে তারা ঠিকঠাক মতো যাত্রীদের সেবা দিতে পারেন। বাচ্চাগুলোও দায়িত্বশীল, তারা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকঠাক মতোই পালন করে। এরপরও প্রাপ্তবয়স্কদের কঠোর নজরদারিতে থাকে বলে বাচ্চাগুলো ভুল তেমন করে না বা করার সুযোগ পায় না বললেই চলে। মোটকথা, অনেকটা বাচ্চাদের দ্বারাই সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয় জায়ারমেকভেসাট রেলওয়েটি।
জায়ারমেকভেসাটের ইতিহাস ৭০ বছরের পুরনো। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট শাসনের যুগে ১৯৪৮ সালে, হাঙ্গেরি যখন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণে, সেসময় নির্মাণকাজ শুরু হয় এই রেলওয়ের। নির্মাণ শেষ হয় ১৯৫০ সালে। প্রথমদিকে নামটা আলাদা থাকলেও শুরু থেকেই এ রেলওয়ে সার্ভিসটি বাচ্চাদের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। অল্প বয়সেই ছেলে-মেয়েদের টিমওয়ার্ক আর দায়িত্ববোধ, কমিউনিস্টদের নীতি শিক্ষা এবং কায়িক শ্রমের শিক্ষা দেওয়াই ছিল এ রেললাইন পরিচালনার উদ্দেশ্যে। সেই কমিউনিস্ট শাসনের সময় থেকে আজ অবধি টিকে আছে ছোট্ট মানুষদের এই ছোট্ট রেলওয়েটি। এখনো এখানে টিমওয়ার্ক আর দায়িত্ববোধের শিক্ষা দেওয়া হয় বাচ্চাদের, তবে কমিউনিস্টদের নীতি শিক্ষার ব্যাপারটা বাদ পড়েছে হাঙ্গেরি স্বাধীন হবার পর থেকেই।
প্রায় সারাবছরই চালু থাকে জায়ারমেকভেসাট রেলওয়ে। কেবল সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিলের সোমবারগুলোতে রেল চলাচল বন্ধ থাকে এখানে। শীতের দিনে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা এবং গরমে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৭টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল অব্যাহত থাকে। পুরো জায়ারমেকভেসাট রেললাইন ঘুরে আসতে একটি ট্রেনের সময় লাগে ৪০-৫০ মিনিট। ট্রেনের টিকিটের মূল্য কয়েকশ’ ফরেন্ট (হাঙ্গেরির মুদ্রা) বা ২-৩ ডলার। এই ২-৩ ডলার খরচ করে জায়ারমেকভেসাটের ট্রেনে উঠলে অর্থের চেয়ে বেশি বিনোদন পান অভিযাত্রীরা। এই ট্রেনগুলোতে করেই ঘুরে আসা যায় বুদাপেস্টের সর্বোচ্চ বিন্দু এলিজাবেথ লুকআউট, যেখান থেকে পুরো বুদাপেস্ট শহরটাকেই দেখতে পাওয়া যায়। শুধু শিশুদের কারণেই নয়, জায়ারমেকভেসাট রেলওয়েটি প্রাকৃতিকভাবেও নয়নাভিরাম। ট্রেনে ওঠার পর যাত্রীরা ইচ্ছে করলে পুরো রুটটাই ট্রেনে করে ঘুরে আসতে পারে, আবার কেউ ইচ্ছে করলে মাঝখানে পাহাড়ে-জঙ্গলে রোমাঞ্চকর অভিযানের আশায় নেমেও পড়তে পারে।
ট্রেন ভ্রমণ ছাড়াও বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে এই রেলস্টেশনে আছে একটি জাদুঘর। কমিউনিস্ট আমলের পুরনো জিনিসপত্র, যন্ত্রপাতি, লোহালক্কসহ নানা জিনিস রাখা আছে সেই জাদুঘরে, যেগুলো হাঙ্গেরিতে কমিউনিস্ট শাসনের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে আজও। বাচ্চাদের মনোরঞ্জনের জন্যও সেই জাদুঘরে রাখা আছে নানা জিনিসপত্র।
হাঙ্গেরিতে আসা টুরিস্টদের কাছে এই জায়ারমেকভেসাট রেলওয়ে অন্যতম আকর্ষণীয় টুরিস্ট স্পট হিসেবে বিবেচিত। রেলওয়েতে ট্রেন আসলে কচিকন্ঠের চিৎকারে যখন প্লাটফর্ম সচকিত হয়ে ওঠে, গম্ভীর মুখের বাচ্চা কোনো গার্ড যখন ট্রেন আসার সিগন্যাল দেয় হাতের রঙিন পতাকা নেড়ে, টিকিট কাউন্টারে বড় মানুষের ভাব ধরা কোনো ছোট্ট ছেলে যখন টিকিট দেয় যাত্রীদের, বা যখন ছোট ছোট টিকিট চেকাররা বড় বড় যাত্রীদের টিকিট চেক করে গম্ভীর মুখে, তখন সত্যিই অনেক বেশি দর্শনীয় হয়ে ওঠে বুদাপেস্টের সেই পাহাড়-বন ঘেরা ছোট্ট রেলওয়েটি।