শহুরে ব্যস্ততায় কিছুক্ষণের জন্য হলেও শহরের বাইরে যেতে পারলে মন ভালো হয়ে ওঠে। বিশুদ্ধ বায়ু সেবন যেন প্রাণশক্তি বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। কিন্তু হুটহাট শহর ছেড়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়াও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, এত সময়ই বা কই? ফলে আমরা অনেকেই ঢাকার আশেপাশে একদিনের ভেতর ঘুরে আসা যায়, এমন জায়গার খোঁজ করি। ঠিক এমনই এক চমৎকার জায়গা মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ার বালিয়াটি প্রাসাদ এবং পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। সকালে রওনা দিয়ে সারাদিন ঘুরেফিরে দিব্যি রাতের ভেতর ঢাকায় ফিরে আসতে পারবেন এখান থেকে।
রুট প্লানের খসড়াটা আগে করে নেয়া যাক, ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে প্রথমে যাওয়া হবে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়ার বালিয়াটি প্রাসাদে, সেখানে দুপুর পর্যন্ত পার করে এরপর আধাঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি, সেখানে দিনের বাকি সময়টুকু পার করে সন্ধ্যার দিকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতি যাত্রা। রওনা দিতে পারেন গুলিস্তান থেকে, বেশ কিছু বাস গুলিস্তান থেকে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে মানিকগঞ্জে যায়, গুলিস্তান থেকে উঠলে ভাড়া পড়বে ৮০ টাকার মতো । বাসে উঠে মানিকগঞ্জের আগেই সাটুরিয়া নামক স্থানে নেমে পড়তে হবে। এবার এখান থেকে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক বা সিএনজিতে করে বালিয়াটি প্রাসাদ, জনপ্রতি ভাড়া ৩০/৪০ টাকার মতো। বালিয়াটি প্রাসাদ ঘোরা শেষে প্রাসাদের সামনে থেকে সিএনজি নিয়ে যেতে পারবেন পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে, আধাঘণ্টার মতো সময় দরকার হবে, জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকার আশেপাশেই।
বালিয়াটি জমিদার বাড়ি
বালিয়াটি প্রাসাদের সবচেয়ে দারুণ ব্যাপারটি হলো, প্রায় একই ধাঁচের দেখতে চারটি প্রাসাদ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে, হঠাৎ দেখলে মনে হতে পারে, কেউ বোধহয় অন্য কোথা থেকে চারটি আলাদা ভবন উঠিয়ে এনে পাশাপাশি বসিয়ে রেখেছে! আসলে এই সব প্রাসাদ একই সময়ে স্থাপিত হয়নি, জমিদারদের বিভিন্ন উত্তরাধিকারের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এখন গিয়ে দেখলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা চারটি প্রাসাদ দেখলে বেশ বিস্মিতই হতে হয়।
গোবিন্দ রাম সাহা নামে একজন জমিদার আঠার শতকের মাঝামাঝি সময়ে এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তন করেন। তিনি ছিলেন একজন লবণ ব্যবসায়ী। এই জমিদার বংশের গোড়াপত্তনের পর থেকে এই পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকার পরবর্তীতে একে একে উনিশ শতকের শুরুর দিকে এই প্রাসাদগুলো নির্মাণ করেন। দধি রাম, পণ্ডিত রাম, আনন্দ রাম, গোলাপ রাম নামে এই চার পুত্রকে রেখে মারা যান গোবিন্দ রাম সাহা। ধারণা করা হয়, তারাই এই প্রাসাদগুলো নির্মাণ করেন। উত্তরাধিকারদের মধ্যে কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ও রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী শিক্ষা বিস্তারে অনেক অবদান রাখেন। তাদের ভেতরে কিশোরীলাল রায় চৌধুরী ঢাকায় তার পিতার নামে জগন্নাথ কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন, সেটিই বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। রায়বাহাদুর হরেন্দ্র রায় চৌধুরী জমিদার বাড়ির খুব নিকটেই ১৯১৯ সালে তৈরি করেন ‘ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়’। ঘুরতে গিয়ে চমৎকার এই স্কুলটির শতবর্ষী ভবনগুলো দেখে আসতে পারেন।
পুরো কমপ্লেক্সের ভেতর মোট আটটি ভবন আছে। প্রবেশমুখে সামনের চারটি ভবন হলো প্রাসাদ, যেগুলোতে জমিদারেরা প্রশাসনিক কাজকর্ম করতেন। প্রত্যেকটি প্রাসাদের পিছনে রয়েছে অন্দরমহল বা স্ব স্ব জমিদারের মূল বাস ভবন। উত্তরদিকে রয়েছে লম্বাটে গড়নের একটি ভবন, যেটি চাকরদের থাকার জায়গা, ঘোড়া রাখার আস্তাবল ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হতো। অন্দরমহলগুলোর শেষে আছে একটি দ্বিতল ভবন, যেটি রান্নাঘর ছিল। পুরো কমপ্লেক্সের শেষ মাথায় রয়েছে একটি পুকুর, যেটিতে রয়েছে ছয়টি শান বাধাঁনো চমৎকার ঘাট, প্রত্যেকটিতেই রয়েছে বসার ব্যবস্থা। আরেকটি জিনিস দেখে মজা পাবেন, তা হলো পুকুরের অপর প্রান্তে কমপ্লেক্সের শেষ মাথায় সারি ধরে টয়লেট, আগেকার দিনে টয়লেটগুলো এভাবেই মূল ভবন থেকে অনেক দূরে দূরেই বানানো হতো।
প্রাসাদ চারটির মাঝখানের একটির নাম রং মহল, এই রং মহলেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি জাদুঘর আছে। জাদুঘরের নিচ তলায় আছে জমিদারদের ব্যবহৃত অনেকগুলো সিন্দুক, দ্বিতীয় তলায় রয়েছে জমিদারদের ব্যবহৃত অনেক দ্রব্য, যেমন- ইংল্যান্ড থেকে আনা হারিকেন, আসবাব, বন্দুক রাখার তাক, বেশ কিছু বাহারি লন্ঠন ও ঝাড়বাতি। পুরো জমিদার বাড়িতে প্রায় দুইশ’র বেশি কক্ষ রয়েছে, পুরো বাড়ি ৫.৮৮ একর জমির উপর অবস্থিত। প্রাসাদগুলোর সামনে থাকা সারি সারি কোরিনথিয়ান কলাম, লোহার পেঁচানো সিঁড়ি- সব কিছু মিলিয়ে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি সত্যিই এক জমজমাট জায়গা!
যদি সকালে গিয়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই পুরো জমিদার বাড়ি ঘুরে শেষ করতে দুপুর হয়ে যাবে। দুপুরের খাওয়া-দাওয়াটা জমিদার বাড়ির ঠিক সামনের বাজারে সেরে নিতে পারেন। তবে এখানে খুব বড় কোনো রেস্টুরেন্ট নেই। দুই-একটা ছোট ভাতের হোটেল, কয়েকটি বেকারি আর চায়ের দোকান আছে।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি
দুপুরের খাবার দ্রুত সেরে ফেলুন, কেননা এখন আপনার পরবর্তী গন্তব্য হলো পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি প্রাঙ্গণেই রয়েছে সিএনজি ষ্ট্যান্ড, একটি সিএনজি ভাড়া করে রওনা দিন পাকুটিয়ার উদ্দেশ্যে, জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ৫০ টাকার মতো। এখানে বলে রাখা দরকার, পর্যটনের জায়গা বলে এখানে এরা অনেক কিছুরই দাম চড়িয়ে রাখে, ফলে যেকোনো কিছুতেই ভালো মতো দরদাম করে নিতে হবে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে প্রায় ৩০-৪০ মিনিটের ভেতর পৌঁছে যাবেন পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি।
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতা থেকে আগত রামকৃষ্ণ সাহা মণ্ডল নামে একজন ধন্যাঢ্য ব্যবসায়ী ইংরেজদের কাছ থেকে এই এলাকার জমিদারী কিনে নেন। তার দুই ছেলে বৃন্দাবন ও রাধা গোবিন্দ। রাধা গোবিন্দ ছিলেন নিঃসন্তান এবং বৃন্দাবনের ছিল তিন ছেলে- ব্রজেন্দ্র মোহন, উপেন্দ্র মোহন আর যোগেন্দ্র মোহন। নিঃসন্তান রাধা গোবিন্দ তার ভাইয়ের মেঝ ছেলে উপেন্দ্রকে দত্তক নেওয়ায় কাকার সম্পত্তি পরবর্তীতে উপেন্দ্র পায়। পরবর্তীতে এদের তিনজনের নামেই তিনটি ভবন তৈরি হয়। ১৯১৫ সালের ১৫ এপ্রিল এই ভবনগুলো উদ্বোধন করা হয়।
কারুকার্য ও নকশার দিক দিয়ে পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি খুবই দারুণ। মোট তিনটি বাড়ি বা মহল রয়েছে পাশাপাশি, যে কারণে একে তিন মহলাও বলা হয়ে থাকে। তিনটি ভবনের প্রত্যেকটির উপরে রয়েছে দুটি কারুকার্যমণ্ডিত নারীমূর্তি, সাথে আছে নানারকম লতাপাতার অলংকরণ। প্রত্যেকটি বাড়ির প্রবেশমুখে তিন ভাইয়ের মধ্যে যেটি যার বাড়ি, তার নাম ও উদ্বোধনের তারিখ নকশা করে লেখা আছে। বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় কাঠের নানা কারুকার্য দেখা যায়। প্রত্যেকটি বাড়ির সাথে রয়েছে পাতকুয়া।
বাড়ির সামনে বিশাল মাঠের মাঝখানে আছে বিশাল এক নাচঘর। নাচঘরের পাশে আছে একটি নাটমন্দির, শত বছর পরেও যার সৌন্দর্য সেই যুগের শিল্পীদের মুন্সিয়ানাকে তুলে ধরে। মন্দিরের গায়ে হাতে তৈরি নকশাদার টাইলসের ব্যবহার রয়েছে। দেশ ভাগের পর এই সম্পত্তি সরকারের হাতে এলে তৎকালীন সরকার জমিদারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ১৯৬৭ সালে এই ভবনগুলোতে ‘বিসিআরজি ডিগ্রী কলেজ’ নামে একটি কলেজ গড়ে তোলে। জমিদারদের ফেলে যাওয়া এসব সম্পত্তি এখন কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখাশোনা করে।
পাকুটিয়া জমিদার বাড়ির ঠিক গা ঘেঁষেই আছে বাজার ও বাস ষ্ট্যান্ড, এখান থেকেই ঢাকার গাবতলীগামী বাস পেয়ে যাবেন। ঘোরাফেরা শেষে সন্ধ্যা নাগাদ এখান থেকেই বাস ধরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেন। একদিনের ঘোরাফেরার জন্যে বালিয়াটি আর পাকুটিয়া এই দুই জায়গা হতে পারে আদর্শ, ছুটি পেলে বন্ধুদের সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারেন বছরের যেকোনো সময়েই।