রাস্তার পাশ দিয়ে সুশোভিত ফুলের গাছ, পথচারীদের চলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা, দারুণ সব কারুকার্য করা সু-উচ্চ মসজিদের মিনার এবং বিলবোর্ডে সুলতানের বড় বড় ছবি আপনাকে বলে দেবে এটি ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ান। প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়ার মতো ব্রুনাইয়ে নেই আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, কোলাহলপূর্ণ নগর-চত্বর বা ব্যস্ততম রাজপথ। তবে এই দেশে আছে শান্তিময় নগর, প্রকৃতির ছোঁয়া এবং সমুদ্র পাড়ের খোলা হাওয়া।
দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে গড়ে উঠা বন্দর সেরি বেগাওয়ান পৃথিবীর সবচেয়ে শান্ত ও নিরাপদ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। পুরো শহরটাই যেন ফুলে ফুলে সাজানো। এ শহরের সবকিছুই চলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। নিয়মমাফিক জীবনযাত্রা যেন এখানকার মানুষের দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ব্রুনাই দেশটি ছোট হলেও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি মোটেও ছোট নয়। দেশটিতে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ, গুরুত্বপূর্ণ বন্দর এবং বিশ্বের বিখ্যাত কিছু স্থাপনা। সবমিলিয়ে এদেশের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ান পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম, গুরুত্বপূর্ণ, শান্তিপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক শহরগুলোর মধ্যে একটি।
ইতিহাস
ধারণা করা হয় এই অঞ্চলে মানব বসতি শুরু হয়েছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের দিকে। এখানে একটি মালয় বাণিজ্য কেন্দ্র এবং মৎস্য আড়ৎ হিসেবে মানব বসতির সূচনা হয়েছিল। এরপর ব্রুনাই নদীর তীরে মানব বসতির অস্তিত্ব পাওয়া যায় অষ্টম শতকে। অনুরূপভাবে মানব বসতির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায় ক্যাম্পং আয়ারেও। ক্যাম্পং আয়ার বর্তমানে বন্দর সেরি বেগাওয়ানে ব্রুনাই জাদুঘরের পাশেই অবস্থিত।
১৫ শতকে ব্রুনাই সাম্রাজ্যের সময় ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সম্পূর্ণটাই বোর্নিও সালতানাতের অধিকারে ছিল। এটি শহরের নিকটে জল-ব্যবস্থার পাশাপাশি সালতানাতের তৃতীয় প্রশাসনিক অঞ্চল ছিল। আঠারো শতকে ব্রিটিশ, ড্যানিশ এবং স্প্যানিশদের আগমনের ফলে সালতানাতের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। সে সময় জনসংখ্যাও বেশ কমে আসে। তখন বোর্নিও সালতানাতের মোট জনসংখ্যা ছিল মাত্র ২০ হাজারের কাছাকাছি।
১৮৮৭ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত ব্রুনাই ছিল ব্রিটিশদের সংরক্ষিত রাজ্য। ১৯০৬ সালে ব্রিটিশরা সালতানাতের অধিবাসীদের দ্বীপের পশ্চিম উপকূলে যেতে বাধ্য করে এবং এই অঞ্চলে ভূমি উন্নয়ন কাজ শুরু করে। কারণ, মাত্র কয়েক বছর আগে ১৮৯৯ সালে বন্দর সেরি বেগাওয়ানের ক্যাম্পুং কাসাতের নিকট আয়ার বেকুঞ্চি নামক স্থানে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম তেলকুপের সন্ধান পায়। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো, ব্রিটিশরা সে সময় অনেক খোঁজাখুঁজি করে, ৮৫০ ফুট গভীর কূপ খননের পরেও তেলের অস্তিত্ব পায়নি। পরবর্তীতে ১৯২৪ সালে তেল অনুসন্ধানের জন্য সেরিয়া ও বেলাইত জেলায় খনন কাজ শুরু করে।
সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ জামালুল আলম ব্রিটিশদের থেকে উৎসাহিত হয়ে ১৯০৯ সালে পশ্চিম তীরে একটি রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। সে বছরই বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণে বন্দর সেরি বেগাওয়ানে আগমন ঘটে চীনাদের। ১৯২০ সালে পশ্চিম তীরে গড়ে উঠে একটি মসজিদ এবং সরকারি বেশ কিছু ভবন। একই বছর নতুন বসতিস্থলকে নগর এলাকা ঘোষণা করে ব্রুনাইয়ের রাজধানী করা হয়। তখন থেকেই বন্দর সেরি বেগাওয়ান বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে জাপানিরা বন্দর সেরি বেগাওয়ানসহ পুরো বোর্নিও দ্বীপ দখল করে নেয়। এরপর ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তি কর্তৃক পুনরায় শহর উদ্ধার হয়। কিন্তু এই কয়েক বছরের যুদ্ধে পুরো শহর একটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রত্যেকটি বাড়িঘর এবং স্থাপনা বোমার আঘাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালের শেষ ভাগ থেকে ব্রিটিশরা আইন পুনঃপ্রণয়ন ও বিদ্যালয় খোলার মাধ্যমে বোর্নিওতে পুনর্নির্মাণ কাজ শুরু করে।
১৯৫০ সালে ব্রুনাই সাম্রাজ্যের সিংহাসন দখল করেন সুলতান তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিন। সিংহাসনে বসার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি ব্রিটিশদের সাথে বাণিজ্য কর ১০% থেকে বৃদ্ধি করে ৩০% এ উন্নীত করেন। ১৯৫৩ সালে ১০০ মিলিয়ন মালয় ডলারের একটি পাঁচ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়, যার মধ্যে ৮০% অবকাঠামোগত উন্নয়নে ও বাকি অংশ সামাজিক প্রকল্পে ব্যয় হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দর সেরি বেগাওয়ান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠতে থাকে আধুনিকতার বলয়ে।
তেল ও গ্যাস শিল্পের ব্যাপক বিস্তারের জন্য ব্রুনাইয়ের বাণিজ্যিকীকরণ বৃদ্ধি পায়। যার কারণে শহরেও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। লোকসমাগম এবং বাণিজ্যিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে শহরের আয়তন বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ সময় শহরের সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে অনেক নতুন ভবন এবং শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। পাশাপাশি ১৯৭০ ও ৮০ এর দশকে কেন্দ্রীয় বাণিজ্য জেলার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। ২০০৭ সালের ১ আগস্ট সুলতান হাসান আল বলকিয়া শহরের আয়তন ১২.৮৭ বর্গ কিলোমিটার থেকে ১০০.৩৬ বর্গ কিলোমিটারে বৃদ্ধির জন্য সম্মতি প্রদান করেন।
নামকরণ
‘বন্দর সেরি বেগাওয়ান’ শব্দটি প্রমিত মালয় থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘সেরি বেগাওয়ান নগর’। ‘সেরি বেগাওয়ান’ শব্দটি আবার এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শ্রী ভগবান’ থেকে যার অর্থ হলো ঈশ্বরের অলৌকিক আভা। ব্রুনাইয়ের সুলতান তৃতীয় ওমর আলি সাইফুদ্দিন ১৯৬৭ সালে যখন ছেলের হাতে সিংহাসন ছেড়ে দেন তখন রাজকীয় উপাধি হিসেবে সেরি বেগাওয়ান নামটি গ্রহণ করেন। তখন শহরটির নাম ছিল বন্দর ব্রুনাই বা ব্রুনাই টাউন। ১৯৭০ সালে ব্রুনাইয়ের উন্নয়ন, বিশেষ করে ২০ শতকে ব্রুনাইয়ের আধুনিকায়নে সাবেক সুলতানের অবদানের কথা স্মরণ করে শহরটি তার নামে পুনঃনামকরণ করা হয়। অর্থাৎ, ব্রুনাইয়ের বর্তমান সুলতান হাসান আল বলকিয়া তার পিতার স্মরণের শহরটির নামকরণ করেন বন্দর সেরি বেগাওয়ান।
ফুলে ফুলে সাজানো এই শহরটি শাসিত হয় ব্রুনাইয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বন্দর সেরি বেগাওয়ান পৌর বিভাগের অধীন ‘বন্দর সেরি বেগাওয়ান পৌরসভা বোর্ড’ কর্তৃক। মজার ব্যাপার হলো, ১৯২১ সালে যখন এই বোর্ড গঠিত হয় তখন এটি ছিল একটি পরিচ্ছন্নতা বোর্ড। যাদের মূল দায়িত্ব হলো শহর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং সাজিয়ে রাখা। বর্তামানেও এই বোর্ডের প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি প্রধান দায়িত্ব হলো শহরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সৌন্দর্যের প্রতি লক্ষ্য রাখা। এ কারণেই এই শহরটি এত সুন্দর। রাস্তাঘাট, বাজার, বন্দর, মসজিদ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি অফিস-আদালত, পার্ক, রিসোর্ট সবকিছুতেই রয়েছে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। নিয়মমাফিক চলা সৌন্দর্যময় এই শহরটি ঠিক এই কারণে পর্যটকদের কাছে দিন দিন স্বপ্নের গন্তব্য হয়ে উঠছে।
ছোট্ট এই শহরে রয়েছে এমন কিছু স্থাপনা যা সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। অসাধারণ কারুকার্য খচিত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, নিবিড় ছায়াঘেরা সরকারি অফিস-আদালত, অবসর সময় কাটানোর জন্য রিসোর্ট কিংবা সমুদ্রের পাড় ধরে গড়ে উঠা পুরনো রাজপ্রসাদ সবকিছুতেই রয়েছে এক রহস্য ও মায়া। পর্যটকদের খোরাক মেটাতে এখানে রয়েছে প্রায় সবধরনের বিনোদন ব্যবস্থা। তবে শরিয়া আইন চালু থাকার কারণে বেশকিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যেমন এখানে মদ বা অ্যালকোহল জাতীয় কোনো পানীয় পাওয়া যায় না। যেকোনো ধরনের নেশা বা মাদক দব্য এবং শুকুরের মাংস সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে ভ্রমণ পিপাসুরা অবশ্য থেমে নেই। পাশের দেশ মালয়েশিয়া থেকে খুব সহজেই অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় বহন করে নিয়ে আসা যায়।
ইসতানা নুরুল ইমান
ব্রুনাই নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রাসাদ ব্রুনাইয়ের বর্তমান সুলতান হাসান আল বলকিয়ার বাসস্থান। এর পাশাপাশি এই প্রাসাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবাসিক ভবন। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের মানদণ্ড অনুযায়ী এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আবাসিক বাসভবন। বিখ্যাত এ প্রাসাদটিতে শুধুমাত্র সাধারণ কক্ষ রয়েছে ১৭৮৮টি। শুধুমাত্র গোসলখানাই আছে ২৫৬টি। এর মাঝে ভোজনসভার কক্ষটিতে একই সাথে পাঁচ হাজারেরও বেশি অতিথি আপ্যায়ন সম্ভব। প্রাসাদের মসজিদে প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রার্থনার ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রুনাইয়ের সুলতানের ২০০টি পোলো পনির জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আস্তাবলের পাশাপাশি প্রাসাদে রয়েছে ১১০টি গাড়ির গ্যারেজ। এছাড়া এই প্রাসাদের অভ্যন্তরের রয়েছে পাঁচটি সুইমিংপুল। রাজকীয় এই প্রাসাদের মেঝের মোট আয়তন ২,১৫২,৭৮২ বর্গফুট।
রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানের কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাসাদটি রাজকীয় আতিথেয়তা এবং রাজ্যের আনন্দ-উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৮৪ সালে নির্মিত এই রাজপ্রাসাদটির তৎকালীন নির্মাণ ব্যয় ছিল ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মালয় ও ইসলামী কারুকার্য খচিত এই প্রাসাদটি ভূগর্ভস্থ মেঝেসহ ১৭ তলা বিশিষ্ট।
প্রাসাদের নাম ‘ইসতানা নুরুল ইমান’ এসেছে মালয় ভাষার ‘ইসতানা’ ও আরবি শব্দ ‘নূর-ওল ইমান’ শব্দ জোড়া থেকে। আরবি ‘নূর-ওল ইমান’ শব্দের অর্থ ‘বিশ্বাসের আলো’। ফিলিপাইনের বিখ্যাত স্থাপত্য প্রকৌশলী লেওনার্দো ভি লোকসিন এই প্রাসাদের নকশা করেন। ব্রুনাইয়ের ইসলামী ভাব-মর্যাদা ও মালয় প্রভাব তাঁর নকশায় প্রাসাদের সোনালী গম্বুজে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাসাদের আভ্যন্তরীণ নকশায় নিয়োজিত ছিলেন নকশাবিদ খুয়ান চ্যু। এই নকশাবিদ দুবাইয়ের ‘বুর্জ আল আরব’ নকশার জন্য বিখ্যাত।
ব্রুনাইয়ের সুলতান তার আনুষ্ঠানিক অতিথিদের এই প্রাসাদেই আপ্যায়ন করেন। এছাড়া ব্রুনাই সরকার রাজ্যের কর্ম সম্পাদনেও এই প্রাসাদ ব্যবহার করে থাকেন। উল্লেখ্য, ইসতানা নুরুল ইমান প্রাসাদে ব্রুনাই-এর প্রধানমন্ত্রীর কর্মক্ষেত্র এবং এখান থেকে ব্রুনাই সরকার পরিচালিত হয়। সাধারণ মানুষের অবশ্য এই প্রাসাদে প্রবেশাধিকার নেই। তবে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা উপলক্ষে প্রাসাদটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। তিনদিন পর্যন্ত ঈদ উপলক্ষে এই প্রাসাদটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সে সময় প্রায় ১,১০,০০০ এর বেশি দর্শনার্থী এখানে প্রবেশ করে এবং সবার জন্য রাজকীয় খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয়, রাজ পরিবার কর্তৃক তাদেরকে বিশেষভাবে আপ্যায়নও করা হয়। এছাড়াও কমবয়সী বাচ্চাদের ঈদ উপলক্ষ্যে সবুজ প্যাকেটে ঈদ সালামি দেয়া হয়। ঈদ ছাড়াও রমজান মাসের শেষের দশদিন তাহাজ্জুদের নামাজ ও তারাবীর নামাজের জন্য এই প্রাসাদ উন্মুক্ত থাকে।
সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ
এটি ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানে অবস্থিত একটি রাজকীয় মসজিদ। প্রশান্ত মহাসাগরীয় এশিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর এই মসজিদের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে হাজার হাজার দর্শনার্থী পাড়ি জমান বন্দর সেরি বেগাওয়ানে। পানির উপর ভাসতে থাকা এ মসজিদটি রাতের ঝলমলে রঙিন আলোয় সবচেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর লাগে। ব্রুনাইয়ের জনগণ এটিকে তাদের দেশের অন্যতম দর্শনীয় স্থান মনে করেন। ব্রুনাইয়ের ২৮তম সুলতান ওমর আলি সাইফুদ্দিনের নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে। আধুনিক ইসলামী স্থাপত্যের অপূর্ব এই নিদর্শনটির নির্মাণকাজ ১৯৫৮ সালে সমাপ্ত হয়। মসজিদের ডিজাইন করেন বিখ্যাত ইতালিয়ান স্থপতি ক্যাভালিয়ের রুডলফ নোলি।
অসাধারণ কারুকার্যখচিত সোনালী গম্বুজের মসজিদটি বর্তমানে বিশ্বের দরবারে বন্দর সেরি বেগাওয়ানের প্রতিনিধিত্ব করে। ধর্মীয় উপাসনালয়ের পরিচয় ছাড়িয়ে এই মসজিদটি হয়ে উঠেছে স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। মসজিদটির সর্বোচ্চ মিনারের উচ্চতা ৫২ ফুট। এই মিনারটি সম্পূর্ণই স্বর্ণ দিয়ে আচ্ছাদিত। এছাড়া পাশের অন্যান্য ছোট গম্বুজগুলোও স্বর্ণ দ্বারা আচ্ছাদিত। ৩ হাজার মানুষের ধারণক্ষমতা বিশিষ্ট এর মূল নামাজ ঘরের প্রতিটি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ ইতালিয়ান শ্বেত মার্বেলে। ‘ক্যাম্পং আইয়ার’ গ্রামের কৃত্রিম হ্রদের ধারে নির্মিত বিখ্যাত এই মসজিদটি। অন্যদিকে হ্রদ থেকে মসজিদের প্রবেশপথ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে মনোরম একটি বজরা। পুরো মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে আছে মনোরম বাগান ও ফোয়ারা। দূর থেকে কোনো দর্শনার্থী যদি মসজিদের গম্বুজ লক্ষ্য না করেন, তাহলে মসজিদটিকে একটি রাজদরবারও মনে করতে পারেন! অনুপম নির্মাণ শৈলীর এই মসজিদের নির্মাণ খরচ ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি হিসেবে সাড়ে ৮৫ কোটি টাকা।
এছাড়াও ব্রুনাইয়ে রয়েছে অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। তারমধ্যে জামে আসর’ হাসানিল বলকিয়া মসজিদ অন্যতম। এটি ব্রুনাইয়ের বৃহত্তম মসজিদ। সুলতানের সিংহাসনে আরোহণের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এটি নির্মিত হয়। স্থানীয়ভাবে এটি কিয়ারং মসজিদ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া সৌদি আরবের মসজিদে নববীর আদলে বন্দর সেরি বেগাওয়ান তৈরি করা হয়েছে ‘আশ শালিহিন মসজিদ’। বন্দর সেরি বেগাওয়ানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশেই এটি অবস্থিত।
ক্যাম্পং আয়ার
ক্যাম্পং আয়ারের নাম তো নিশ্চয় শুনেছেন। হ্যাঁ, এটি বন্দর সেরি বেগাওয়ানে অবস্থিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভাসমান গ্রাম। ব্রুনাই নদীর ৮ কিলোমিটারের মধ্যে ‘ক্যাম্পং আয়ার’ বা ‘পানির গ্রাম’ অবস্থিত। পুরো গ্রামটা খুঁটির উপর পানিতে ভাসছে। এই গ্রাম পরিদর্শন করে ফ্লোরেন্সের বিখ্যাত নাবিক অ্যান্তেনিও পিগাফেত্তা এর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যের ভেনিস’ বা ‘ভেনিস অফ দ্য ইস্ট’। এই গ্রামটি বন্দর সেরি বেগাওয়ানের শহরতলীর সাথেই সংযুক্ত। এই গ্রামে রয়েছে প্রায় দু’হাজার ঘরবাড়ি, যেখানে বসবাস করে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ। শহরের কেন্দ্রীয় বাণিজ্য জেলার ঠিক পূর্বে এই ভাসমান গ্রামটি অবস্থিত। অধিবাসীদের অধিকাংশ মানুষই মৎস্যজীবী।
এখানে রয়েছে কিছু সরকারি ভবন এবং অফিস। আরো আছে স্কুল, হসপিটাল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট, মসজিদ এবং পেট্রল স্টেশন। বর্তমান আধুনিক সভ্যতার সব সুযোগ-সুবিধাই এখানে রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানে পানিতে চলাচলের জন্য রয়েছে ওয়াটার বাস বা ওয়াটার ট্যাক্সি। এই ট্যাক্সিতে করে ভাসতে ভাসতে পৌঁছানো যায় যেকোনো ঘরের দরজায়। ধারণা করা হয়, প্রায় ১০০০ বছর আগ থেকে এখানে মানুষ বসবাস করে আসছে।
ব্রুনাই জাদুঘর
বিখ্যাত এই জাদুঘরটি ব্রুনাইয়ের জাতীয় জাদুঘর। জাদুঘরটিতে ইসলামী কারুশিল্প, ষোড়শ শতাব্দীর ঐতিহাসিক সময়কালের প্রত্নতত্ত্ব ও নৃবিদ্যা প্রদর্শন করা হয়। বন্দর সেরি বেগাওয়ানের নিকটবর্তী কটা বাটুতে অবস্থিত এই জাদুঘরটি ব্রুনাইয়ের সবচেয়ে বড় জাদুঘর। অসাধারণ এই জাদুঘরটি একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত, যেখান থেকে ব্রুনাই নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দুচোখ ভরে অবলোকন করা যায়। জাদুঘরটি ১৯৬৫ সালে স্থাপিত হলেও এর বর্তমান ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৭২ সালে। ব্রুনাইয়ের অন্যান্য স্থাপনার মতো এটিও ফুলে ফুলে সাজানো, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং ছায়ানিবিড় পরিবেশে ঘেরা। দিন দিন পর্যটকদের কাছে ব্রুনাই জাদুঘরটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
ইসতানা দারুসসালাম
এটি ব্রুনাইয়ের একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। ব্রুনাই নদীর তীরে অসাধারণ কারুকার্যখচিত এই প্রাসাদটি ছিল তৃতীয় ওমর আলী সাইফুদ্দিনের আবাসস্থল। ব্রুনাইয়ের বর্তমান সুলতান হাসান আল বলকিয়া এই প্রাসাদের জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এটি ব্রুনাইয়ের অন্যতম প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ‘ইসতানা’ শব্দের অর্থ হলো ‘প্রাসাদ’এবং ব্রুনাই এর সম্পূর্ণ নাম হলো ‘ব্রুনাই দারুসসালাম’। এই দুটো শব্দ মিলিয়ে প্রাসাদটির নামকরণ করা হয়েছিল ইসতানা দারুসসালাম। মনোরম স্নিগ্ধ পরিবেশে অবস্থিত এই রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক পাড়ি জমান বন্দর সেরি বেগাওয়ানে।
এ সমস্ত স্থাপনা ছাড়াও বন্দর সেরি বেগাওয়ানে রয়েছে অসংখ্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, প্রসাদসহ অসংখ্য রাজকীয় সব স্থাপনা। স্নিগ্ধ, শান্ত, নিরিবিলি এই শহরটি দিন দিন বিশ্ব পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পর্যটক বন্দর সেরি বেগাওয়ানের সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেতে পাড়ি জমান ব্রুনাইয়ে। আধুনিকতা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিশেলে গড়া এ শহর ভ্রমণের এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে যান নিজ দেশে। চাইলে আপনিও এ সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য চলে আসতে পারেন বন্দর সেরি বেগাওয়ানে।