ঝর্ণার অবিরাম স্রোতধারা আর নয়নাভিরাম দৃশ্য আমাদের ক্লান্ত শরীর ও মনকে জুড়িয়ে দেয়। পাহাড় আর সবুজ বুনো জঙ্গলের মাঝে আঁকা বাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে ঝর্ণা জল। কবি বলেছেন –
“বাংলারে তোর সিগ্ধসুধার এসেছি পর্বতপাড়ে ,ঝর্ণা!
সে তুই ভেজালি আমায় সিক্ত বর্ষাধারে!”
না, পাঠক কবির এ আকুতি মিথ্যে নয়। আজ আমরা জানবো বাংলাদেশের কিছু মনোমুগ্ধকর ঝর্ণা ধারা সম্পর্কে। অপরুপ সেই ঝর্ণা ধারার মধ্যে খৈয়াছড়া, তৈদুছড়া, জাদিপাই, বাকলাই, হামহাম ও মাধবকুন্ড অন্যতম।
খৈয়াছড়া ঝর্ণা
খৈয়াছড়া ঝর্ণা চট্টগ্রামের মিরসরাই পাহাড়ে অবস্থিত। মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের বড়তাকিয়া বাজারের উত্তর পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ৪.২ কিলোমিটার পূর্বে এই ঝর্ণার অবস্থান। খৈয়াছড়া এলাকার পাহাড়ে অবস্থান বলে এর নামকরণ করা হয়েছে খৈয়াছড়া ঝর্ণা। একে বাংলাদেশের ‘ঝর্ণা রানী’ বলা হয়।
কীভাবে যাবেন
আপনি যদি ঢাকার থেকে যান তাহলে ঢাকার যেকোনো বাস কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী বাসে উঠবেন। চট্টগ্রামের মিরসরাই পার হয়ে বারতাকিয়া বাজারের আগে খৈয়াছড়া আইডিয়াল স্কুলের সামনে ঢাকা চট্টগ্রাম রোডে নামবেন । ঢাকা চট্টগ্রাম রোড থেকে ঝিরি পর্যন্ত আপনি সি.এন.জি নিয়ে যেতে পারবেন।
তৈদুছড়া ঝর্ণা
অসাধারণ এই ঝর্ণাটি ‘শিবছড়ি ঝর্ণা’ নামেও পরিচিত। তৈদুছড়া ঝর্ণা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় অবস্থিত। ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পড়ছে পাথুরে ভূমিতে। অন্য সকল ঝর্ণার মত এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পড়ছে না। পাহাড়ের গায়ে সিড়ির মত তৈরি হওয়া পাথুরে ধাপগুলো অতিক্রম করে নিচে পড়ছে। অবর্ণনীয় এই সৌন্দর্য দেখতে তৈদুছড়া যাবেন ভরা বর্ষায়। এখানে মূলত দুটি ঝর্ণা দেখতে পাবেন। কয়েকবছর আগে এখানে দুটি ঝর্ণা আবিষ্কৃত হয়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে শ্যামলী, হানিফ ও অন্যান্য পরিবহনের বাসে খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। এরপর আপনি বাসে করেও দীঘিনালায় যেতে পারবেন। যাবার জন্য দীঘিনালা হতে সামনে এগিয়ে চাপ্পাপাড়া পর্যন্ত যাওয়া যায়। এরপর আর গাড়ী চলার কোন পথ না থাকায় বাকী পথটুকু হেঁটেই যেতে হয়। দীঘিনালা হতে সব মিলিয়ে তৈদুছড়ি পর্যন্ত পৌছতে প্রায় ৪ ঘন্টা সময় লাগে।
মাধবকুন্ড
বাংলাদেশের সুউচ্চ জলপ্রপাত মাধবকুন্ড। সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা নামক উপজেলায় এই সুন্দর নয়নাভিরাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। যে পাহাড়টির গা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে এ পাহাড়টি সম্পূর্ণ পাথরের যা পাথারিয়া পাহাড় নামে পরিচিত। এই পাহাড়ের উপর দিয়ে গঙ্গামারা ছড়া বহমান। বর্ষাকাল এলে মূল ধারার পাশেই আরেকটা ছোট ধারা তৈরি হয় এবং ভরা বর্ষায় দুটো ধারাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় পানির তীব্র তোড়ে।
কীভাবে যাবেন
যদি ট্রেনে যেতে চান তাহলে প্রথমেই আপনাকে যেতে হবে সিলেটের কুলাউড়া জংশনে। সেখান থেকে মাধবকুন্ডের দূরত্ব প্রায় ৩৫ কি.মি। আপনি সেখান থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে সরাসরি মাধবকুন্ড যেতে পারেন ।
এছাড়া বাসেও যাওয়া যাবে। এর মধ্যে শ্যামলী, রূপসী বাংলা, হানিফ, সোহাগ, এনা,ইউনিক উল্যেখযোগ্য। সরাসরি বাসে আসলে বড়লেখার একটু আগে “কাঠাঁলতলী” নামক জায়গায় নামবেন। তবে আপনাকে মাধবকুন্ড চূড়ার কাছে যেতে হলে এখান থেকে অবশ্যই সিএনজি বা রিক্সা নিতে হবে।
হামহাম
হাম হাম কিংবা হামহাম বা চিতা ঝর্ণা, বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত বা ঝরণা। শ্রাবনের প্রবল বর্ষনে যখন পুরো জঙ্গল ফিরে পায় তার চিরসবুজ, হয়ে উঠে সতেজ আর নবেযৌবনা। হামহাম ঝর্না তখন ফিরে পায় তার আদিরূপ। অপরুপ সৌন্দর্য। হাম হামের কাছে যাওয়া যতটা সহজ ভাবছেন কাজটা কিন্তু ততটা সহজ নয়। এর গভীর জঙ্গলে রয়েছে সাপ, কুমির আর বিশেষত জোঁকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে যায় অভিযাত্রিক দল। কিন্তু সকল বাধা পেরিয়ে আপনি যখন হাম হামের কাছে পৌছাবেন তখন অভিযাত্রিক ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে।
কীভাবে যাবেন
প্রথমেই আপনাকে যেকোন স্থান হতে গিয়ে পৌছতে হবে সিলেট, শ্রীমঙ্গল কিংবা সরাসরি মৌলভীবাজার। সেখান হতে কমলগঞ্জ। যেকোন ভাবেই আপনি পৌছে যেতে পারেন কমলগঞ্জ। কমলগঞ্জ হতে আদমপুর বাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া পড়বে ১০ টাকা। সেখান থেকে যেতে হবে আদিবাসী বস্তি তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন বস্তি পর্যন্ত। সেখান থেকে আরও প্রায় ৮ কিঃমিঃ পথ পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে কাংখিত সেই হামহাম জলপ্রপাতের।
জাদিপাই ঝর্ণা
বান্দরবান এর জাদিপাই পাড়ায় অবস্থিত এই ঝর্ণা। ঝর্ণার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে এক মাদকতাময় পাগল করা সুন্দর রুপ। প্রায় ২৫০ফুট উপর থেকে অবিরাম ঝরে পড়া পানির তিনটি ধাপে সূর্যকিরণ পড়তেই তৈরি হয় বর্ণিল রংধনু। সবার চোখের আড়াল করে বান্দবানের গহীন অরণ্যে বয়ে চলা এই ঝর্ণার নাম জাদিপাই।
কীভাবে যাবেন
বান্দরবান শহর থেকে আপনাকে প্রথমে কইখ্যাংঝিরি যেতে হবে। লোকাল বাস বা চান্দের গাড়িতে ঘন্টা দুয়েক সময় লাগবে। কইখ্যাংঝিরি থেকে নৌকায় করে সাঙ্গু নদী দিয়ে রুমা বাজার পৌছাবেন। রুমা বাজার থেকে ঝিরিপথে হেঁটে অথবা চান্দের গাড়িতে করে বগালেক যেতে হবে। সাথে অবশ্যই গাইড নিয়ে নিবেন। বগা লেকে রাতে থেকে পরদিন ভোরে জাদিপাইর উদ্দেশ্যে রওনা দিবেন। বগালেক থেকে চিংড়ি ঝর্ণা, দার্জিলিংপাড়া, কেওক্রাডং, পাসিংপাড়া, যাদিপাই পাড়া পার হয়ে ১৩ ঘন্টা ট্রেকিং করে অবশেষে পৌছাবেন জাদিপাই ঝর্ণা।
বাকলাই ঝর্ণা
বাকলাই ঝর্ণা সম্ভবত দেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা। বান্দরবানের পাহাড়ের গভীরে বাকলাই গ্রামে অবস্থিত এই ঝর্ণাটি প্রায় ৩৮০ ফুট উঁচু। বহু বছর ধরে ট্রেকারদের সুপরিচিত ক্যাম্পিং এই বাকলাই । এর সবচেয়ে বড় কারণ এখানে আছে আর্মি ক্যাম্প, যা অভিযাত্রীদের নিরাপদ। যাই হোক এই বাকলাই -এর পথে পাহাড়ী ছোট নদীও সবার চোখে পরে পথে। কিন্তু এর থেকে নীচে নয়নাভিরাম- বিস্ময়কর এই বাকলাই ঝরনা ।
কীভাবে যাবেন
বাকলাই ঝর্ণা থানচিতে অবস্থিত হওয়ায় আপনাকে প্রথমেই বান্দরবানে যেতে হবে। ঢাকা থেকে সড়কপথে বান্দরবানে যেতে প্রায় ৭ ঘণ্টা সময় লাগবে।বান্দরবান থেকে বাস অথবা চান্দের গাড়িতে করে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টায় প্রায় ৭৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত থানচিতে পৌছাতে পারবেন। থানচি বাজার থেকে বাকলাই ঝর্ণায় যেতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে এবং এসময় আপনাকে বেশকিছু পাড়া অতিক্রম করতে হবে যেমনঃ টুটংপাড়া, বোর্ডিং হেডম্যানপাড়া, কাইতনপাড়া ইত্যাদি। ঝর্ণার উপরে উঠতে চাইলে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগবে।