ভুটান: সৌন্দর্য কিংবা শান্তির উপাখ্যান

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি। অটো থেকে নেমেই পড়িমরি করে দৌড়ে যখন জয়গাঁ ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে এসে উঠলাম, তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে পাঁচ মিনিট। কঠিন চেহারার ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসার বারবার হাত নেড়ে, ঘড়ি দেখিয়ে, মুখস্থ করা কড়া কড়া ইংরেজিতে যা বললো, তার সহজ ভাবানুবাদ দাঁড়ায়,“আর হ্যাপা করো না তো বাপু, ইমিগ্রেশন ছয়টা বাজে বন্ধ, তো বন্ধ। এইবেলা সোজা মানে মানে বিদেয় হও এখান থেকে।” আমাদের মতো বাজেট ট্রাভেলারদের এই এক ঝামেলা।

যতই ইচ্ছে করুক, বাংলাদেশ বর্ডার থেকে সোজা ভুটান বর্ডার পর্যন্ত পাঁচ হাজার রুপিতে জিপ ভাড়া করে যাবার সঙ্গতিও নেই। অগত্যা বুড়িমারি থেকে অটোতে চ্যাংড়াবান্ধা, তারপর লোকাল বাসে ময়নাগুড়ি বাইপাস। কিন্তু সেখানে একঘন্টা রোদে পুড়ে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাস না পেয়ে উল্টো পথে ফের লোকালে ময়নাগুড়ি-ফালাকাটা হয়ে জয়গাঁ। এই জয়গাঁতেই ইন্ডিয়া-ভুটান বর্ডার, ৫ মিনিটের ঐ দেরির জন্য সেদিন যা আর পার হওয়া হয়ে ওঠেনি।

তবে এমনিতে ইন্ডিয়া-ভুটান ওপেন বর্ডার, যখন ইচ্ছা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঢোকা যায়, কোনো বাধা নিষেধ নেই। সকালের জন্য আর তর সইছিল না, হোটেলে চেক-ইন করেই এক ছুটে ভুটান গেট পার হয়ে গেলাম। ওপাশে ভুটানের ছোট্ট শহর ফুন্টসোলিং। গেট পার হয়ে ওখানে যেয়েই হোঁচট খেতে হয়, এ কোথায় চলে এলাম রে বাবা! এ যেন নিছক এক কংক্রিটের দরজা নয়, বরং কোনো এক যাদুবলে আপনাকে সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে নিয়ে আসা হয়েছে! কয়েক ফুটের মাত্র ব্যবধান, অথচ কত তফাৎ। ঐ পাশের হইচই-কোলাহল-গাড়ির তীব্র শব্দ-ময়লা আবর্জনা-দুর্গন্ধ-দূষিত বাতাস, কিছুরই বিন্দুমাত্র চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাবে না ফুন্টসোলিংয়ে। ঝাঁ চকচকে পরিষ্কার রাস্তা,চারদিকের নীরব শান্ত-সমাহিত পরিবেশ, দূরের আবছায়া পাহাড় আর রাস্তার উপর ঠিকরে পড়া পাশের ওয়াইন শপের এক চিলতে লাল আলো যেন অস্ফুটেই আপনাকে বলবে, “শান্তির দেশে স্বাগতম।”

ভুটান গেইট। collected from:https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/e/e4/Gate_at_Chuzom,_Bhutan_01.jpg
ভুটান গেইট © লেখক

তবে হোঁচট খেতে পারেন খাবার টেবিলেও! ভুটানীদের সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার ‘থুপকা’। এ এক অদ্ভুত জিনিস; ভাত-নুডলস-মাছ-মাংস-সবজি-তরকারি-ঝোল সবকিছু একসাথে ঘ্যাঁট পাকিয়ে বানানো হ-য-ব-র-ল এক খাবার। পর্ক এখানে খুবই কমন, মাংস বলতে সাধারণত এরা পর্কটাকেই বোঝে, তাই খাবার নিয়ে বাছবিচার থাকলে চাওমিন বা শুধুমাত্র সবজির থুপকা খাওয়াই সবচেয়ে ভালো অপশন। পরদিন সকাল সকাল ইমিগ্রেশন শেষ করেই এইট সিটার বলেরো জিপ রিজার্ভ করে ছুটলাম থিম্পুর পথে।

ছয় ঘণ্টার এই জার্নি ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা রোড জার্নি, তা বলতেই পারি। সমতল-পাহাড়-জঙ্গল-উপত্যকা-নদী- কী নেই পথে! পথে আরো পাবেন প্রতি দুই-এক কিলোমিটার পরপরই ভুটান সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত রসিক কিছু জনসচেতনতামূলক সাইনবোর্ড। এই সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিরাপদ ড্রাইভিং। ভুটানে এই জিনিসটিকে খুবই গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়, কারণ একে তো প্রায় সব রাস্তাই খাড়া পাহাড় কেটে তৈরী, তীক্ষ্ণ সব বাঁক তো রয়েছেই; পাশাপাশি খুব জরুরি এবং ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র বাদে এই দেশে গাড়ির হর্ন বাজানো সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ! এরকম অদ্ভুত আরো কিছু নিয়ম এবং লোকজ আচারের দেখা মেলে ওখানে। যেমন, অ্যালকোহল বৈধ হলেও সমগ্র ভুটানেই ধূমপান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

মূলত, পরিবেশ দূষণ রোধ করতেই এই ব্যবস্থা। একই কারণে ভুটানে তেমন ভারি মাপের কোনো শিল্প গড়ে ওঠেনি। এই একুশ শতকেও দেশটি বিশ্বের একমাত্র ‘কার্বন নেগেটিভ’ দেশ। ভারত আর চীনের মতো শিল্পপ্রবণ দুই ‘এশিয়ান দানব’ এর মাঝে থেকে দেশটি প্রাকৃতিক সমতা রক্ষা করে যাচ্ছে সুনিপুণ ভাবে। তবে অর্থনৈতিকভাবে ভুটান সম্পূর্ণই ভারতের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার পরিমাণ এতটাই যে, দেশটিতে তার নিজের মুদ্রা ‘গুলট্রাম’ এর চেয়ে ভারতীয় রুপিই বেশি চলে!

থিম্পু পর্ব

শীতের শেষদিকেও সন্ধ্যার পর থিম্পুতে তাপমাত্র নেমে আসে দুই বা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসে, রাত বাড়ার সাথে সাথে যা নামতে থাকে হিমাঙ্কের নিচে। তাই থিম্পু পৌঁছে হোটেল ঠিক করে যখন বের হলাম, তখন রাস্তাঘাটে মানুষজন তেমন নেই। থিম্পু, হিসাবে একটা রাজধানী শহর হলেও কলেবরের দিক থেকে আমাদের যেকোনো একটি জেলা শহরের মতো হবে বড়জোর। কিন্তু সারা রাস্তা জুড়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে পার্ক করে রাখা শত শত গাড়ি আর রাস্তার দুই পাশের অদ্ভুত সুন্দর সব রঙ-বেরঙের এর ভবন জানান দেয় এখানকার মানুষের প্রাচুর্যতার।

একটা রাজধানী শহর যে এত নীরব-নিস্তব্ধ ও শান্ত হতে পারে, থিম্পুতে না এলে কেউ বুঝতে পারবে না। কোনো ব্যস্ততা নেই, হুড়োহুড়ি নেই, হই-হট্টগোল নেই। সমগ্র ভুটানেই অবশ্য খুব বেশি দরকার না হলে কেউ একজন আরেকজনকে জোরে ডাকাডাকি-হাঁকাহাঁকি করে না, জোরে জোরে হাসাহাসি বা ছোটাছুটি করে না। শহর, শহরের মানুষ সবাই শান্ত সমাহিত এমন একটা ভাবে থাকে, যেন গভীর আধ্যাত্মিকতায় ডুবে আছে। অবশ্য যে দেশে মানুষের উন্নতি টাকা-পয়সা বা অর্থনৈতিক কোনো সূচক দিয়ে মাপা হয় না, বরং মাপা হয় মনের শান্তি দিয়ে, সেই দেশের রাজধানীর তো এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক!

থিম্পু ভিউ পয়েন্টে লেখক, নিচে পাহাড়ের কোলে থিম্পু শহর। ছবির সোর্সঃ ট্যুরমেট নুরেন ইফতেখার এর তোলা।
থিম্পু ভিউ পয়েন্টে লেখক, নিচে পাহাড়ের কোলে থিম্পু শহর © নুরেন ইফতেখার

রাতের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস আর তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাইট ক্লাব কিংবা কারাওকে থেকে ভেসে আসা সফট মিউজিকের সাথে তাল মিলিয়ে হাটঁতে হাটঁতেই দেখে আসি দ্রুক গ্যালারি আর ক্লক টাওয়ার। বলে রাখা ভাল, গোটা বিশ্বে ভুটান তার ‘ব্রিউ’ এর গুণগত মান আর সুলভ মূল্যের জন্য বিখ্যাত। বড় বড় দোকানপাটের কথা নাহয় বাদই দিন, এমনকি রাস্তার পাশের মুদি দোকানেও তেল, নুন, সাবান না-ও পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রং-বেরং এর বোতল মিলবেই! এভাবে হেঁটেই চলে যেতে পারেন ন্যাশনাল আর্চারি গ্রাউন্ড। ভুটানের জাতীয় খেলা এই তীরন্দাজি। রাতের বেলায় কেবলমাত্র কয়েকটি বাল্বের আলোতে ৫০/৬০ মিটার দূরে রাখা টার্গেটে একের পর এক বুলস আই হিট করে যায় এখানের তীরন্দাজেরা, যা প্রতি মুহূর্তে আপনাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে যাবে। থিম্পুতে আমরা আরো ঘুরেছিলাম বুদ্ধ পয়েন্ট, তাশিজো জং, সিমতোখা জং, কিংস মেমোরিয়াল ছর্টেন, কিংস প্যালেস, একটা মিউজিয়াম, শহরের অলিগলি, অনিন্দ্যসুন্দর দোচু-লা পাস আর টাকিন রিজার্ভ জু।

অনিন্দ্যসুন্দর দোচু-লা পাস। ছবির সোর্সঃ https://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/8/8e/Dochula_Pass.jpg
অনিন্দ্যসুন্দর দোচু-লা পাস; Image Source: travel india

বুদ্ধ পয়েন্ট থিম্পুর কিছুটা বাইরে পাহাড়ের উপর এক বিশাল বুদ্ধমূর্তি। এখান থেকে পাখির চোখে গোটা থিম্পু শহর নজরে আসে, আর তার সাথে বিশালাকায় সোনালী বুদ্ধদেব মিলে মনের গভীরে পরাবাস্তব এক ক্ষুদ্রতার অনুভূতির জন্ম দেয়। তাশিজো জং ভুটানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সিমতোখা জং সবচেয়ে প্রাচীন জং। জং বলতে বোঝায় এমন এক স্থাপনা, যেখানে একই সাথে মন্দির এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস বা মন্ত্রণালয়ের কাজ চালানো হয়।

টাকিন রিজার্ভ জু আসলে নামেই জু, বাস্তবে ওখানে এক ‘টাকিন’ ছাড়া আর কিছুই নেই। এই ‘টাকিন’ হল অনেকটা আমাদের রামছাগলের মত দেখতে, একই স্বভাবের এক তৃণভোজী প্রাণী, যা কিনা ভুটানের জাতীয় পশু। আগে থেকে আসল কথা না জেনে “ক্ষেতের মধ্যে ছাগল ঘুরছে,ঘাস খাচ্ছে”– এই জিনিস দেখার জন্য আমরা একেকজন ৭৫ রুপির টিকেট কেটে গিয়েছিলাম, যতবার ভাবি ততবারই নিজেদের নতুন করে ছাগল মনে হয়!

বুদ্ধ পয়েন্ট। ছবির সোর্সঃ ট্যুরমেট আজহার দীন।
বুদ্ধ পয়েন্ট  © আজহার দীন

পুনাখা পর্ব

পুনাখা, ভুটানের সাবেক রাজধানী। সারাদেশের তাপমাত্রা যখন শূন্যের আশেপাশে কিংবা তারও নিচে, পুনাখায় তখন, পুনাখায় তখনও ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরম। মূলত এই তাপমাত্রার কারণেই শীতের সময়ও পুনাখা এত বৈচিত্র্যময়। চারদিকের বড় বড় সব পাহাড়ের মাঝে অপার্থিব সুন্দর এক সবুজ উপত্যকা,সাথে সবুজাভ নীল পানির স্বচ্ছ খরস্রোতা নদী- কমপ্লিট প্যাকেজ! ভুটানের সবচেয়ে বড় জং এই পুনাখাতেই। এত্ত সুন্দর-সমাহিত-বিভোর একটা পরিবেশ ভেতরে। যদিও দেশটি পুরোটাই এমন যে, মনে হয় সবকিছুই গভীর ধ্যানমগ্ন একটা অবস্থায় আছে, তার মাঝেও পুনাখা জং যেন আরও বেশি কিছু; আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য আর সদ্য-সন্ন্যাসব্রত নেওয়া বাচ্চা বাচ্চা সন্ন্যাসীদের কণ্ঠে “ওম নমঃ পদ্মে হেম” যেন প্রকৃতই অন্য এক জগত, সত্যিকারের সাংগ্রিলা!

পুনাখা জং © লেখক

‘বিল গেটস’ বা ‘কার্লোস বাফেট’ এর মতো লোকজনকেও যদি এর ভেতরে এক সপ্তাহ রেখে দেওয়া হয়, তারাও মনে হয় দিন-দুনিয়া-ব্যবসা-বাণিজ্য সব ভুলে গিয়ে“নির্বাণ পরম সুখ,নির্বাণ পরম শান্তি” জপতে জপতে চোখ মুখ বন্ধ করে পদ্মাসনে পড়ে থাকবে! পুনাখাতে নদী আছে দুইটি – মো-চু (ফিমেইল রিভার) আর ফো-চু (মেইল রিভার)। মো-চু’র ওপরেই আছে পুনাখা ব্রিজ-পৃথিবীর দীর্ঘতম সাসপেনশন সেতু। সেতুটি এত্ত অস্বাভাবিক রকম সুন্দর- বলে বোঝানো যাবে না। মনে হবে শুধু সেতুর ওপরে দুনিয়া উড়িয়ে নেওয়া বাতাসের মাঝে বসে থেকেই যেন সারাদিন পার করে দেয়া যায়! আসলেও যে সারাদিন কীভাবে কেটে যাবে ঐ সেতু আর নদীর পানিতেই, টেরও পাবেন না একদম।

পুনাখা ব্রিজ, যেন বাস্তব আর পরাবাস্তবের এক মেলবন্ধন! ছবিঃ লেখক।
পুনাখা ব্রিজ, যেন বাস্তব আর পরাবাস্তবের এক মেলবন্ধন! © লেখক

এদিন বিকেল আর সন্ধ্যাটা হয়ে যেতে পারে ভুটানে আপনার সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত। ঐ পাহাড়ি টেরেইনে হিমালয়ের বরফ গলা উল্টাপাল্টা স্রোতের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি নদীতে রাফটিং করতে পারেন পুরোটা বিকেল। ভাগ্য ভালো হলে আমাদের মতো হয়তো পেয়ে যেতে পারেন এমন এক ইন্সট্রাক্টর, যার ধ্যানজ্ঞান সবই কেবল দুনিয়ার সবচেয়ে বিপদজনক জায়গাগুলোতে ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া! তার কমান্ডের সাথে সাথে যখন একেকটা বাঁক ঘুরে ডাউনফলস-এর দিকে যাবেন, আর প্রমত্তা স্রোত আপনার ভেলাকে আক্ষরিক অর্থেই শূন্যে ছুঁড়ে দেবে খানিক পরপর- কথা দিতে পারি, সারাজীবন মনে রাখার মতো একটি স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরবেন।

পারো পর্ব

পারো ভুটানের সবচেয়ে ঠাণ্ডা জায়গাগুলোর মাঝে একটি। শীত শেষ হয়ে গেলেও মাইনাস চার/পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এখানে স্বাভাবিক। পারোর মূল আকর্ষণ চেলালা পাস আর টাইগার্স নেস্ট। চেলালা পাস ভুটানের সবচেয়ে উঁচু মটোরেবল রোড, উচ্চতা সাড়ে ১২ হাজার ফিট প্রায়। ঠান্ডার তীব্রতায় ছবি তোলার জন্য ৫/৭ সেকেন্ডের বেশি হাত গ্লাভস ছাড়া করলেই এক-দেড় মিনিট দু হাতের তালু ঘষে করে আবার সার ফিরিয়ে আনা লাগছিল! তবে এই চেলালা পাস যাওয়ার রাস্তাটা ছিল প্রায় স্বর্গীয়, যেতে যেতে একটু পরপরই ‘গড’স্‌ রে’ আর জমে বরফ হয়ে যাওয়া ঝর্ণার দেখা পাওয়া যাচ্ছিল। সেদিন ছিল ২১ ফেব্রুয়ারি; এই উপলক্ষে হঠাৎ গাড়ির ড্রাইভারের ভুটানী গান পাল্টিয়ে এফএম-এ ‘বাংলাদেশ বেতার রংপুর’ ধরার কথা মনে থাকবে অনেকদিন।

চেলালা পাস, ভুটানের সর্বোচ্চ মটোরেবল রোড। ছবির সোর্সঃ নিজের তোলা
চেলালা পাস – ভুটানের সর্বোচ্চ মটোরেবল রোড, এর পাশেই ঐতিহ্যবাহী হিমালয়ান প্রেয়ারফ্ল্যাগ © লেখক

পরদিন ছোটখাট একটা ট্রেকিং করে ফেলতে পারেন টাইগার্স নেস্ট-এ। প্রায় সাড়ে ১০ হাজার ফিটের মত উচ্চতায় অদ্ভুত সুন্দর একটা মনাস্ট্রি বা সাধু-সন্তদের আশ্রম এটি। আক্ষরিক অর্থেই একটা ক্লিফের গায়ে ঝুলছে যেন গোটা স্থাপনাটি! ভুটানের সবচেয়ে প্রাচীন মনাস্ট্রিগুলোর একটি। ৩৩০ বছর আগে এত উঁচুতে প্রায় ৯০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়ের গায়ে এই জিনিস বানিয়েছিল কীভাবে- ভাবতে ভাবতেই পুরা ট্রেক শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু ভাবনার শেষ হবে না! তাই ভাবতে ভাবতেই শেষের একটুখানি আগে এসে পথ ভুল করে উঠে যেতে পারেন পাশের আরেকটি পাহাড় চূড়ায়। তবে সেই এক ঘণ্টা বাড়তি হাঁটার ক্লান্তি দূর হয়ে যাবে ঐ চূড়ার ওপর থেকে ‘টাইগার্স নেস্ট’-এর অসম্ভব সুন্দর এক বার্ড’স আই ভিউ পেয়ে। তো, এই দুর্লভ অ্যাঙ্গেল থেকে সহস্রাব্দ প্রাচীন মনাস্ট্রিটির একটা ছবি কিংবা সুউচ্চ চূড়া থেকে নিচের সমগ্র উপত্যকা মন ভরে দেখে নেওয়ার জন্য হলেও অন্তত পা দিতেই পারেন এই ইচ্ছাকৃত ভুলের ফাঁদে।

দ্যা ম্যাজেস্টিক টাইগার্স নেস্ট, ভুটানিজ নির্মাণশৈলীর এক অসাধারণ বিষ্ময়! ছবির সোর্সঃ ট্যুরমেট আজহার দীন।
দ্য ম্যাজেস্টিক টাইগার্স নেস্ট, ভুটানী নির্মাণশৈলীর এক অসাধারণ বিস্ময়! © আজহার দীন

এরপর শুধুই ফিরে আসা- পারো থেকে থিম্পু। থিম্পু যেতে যেতেই পড়বে ভুটানের একমাত্র এয়ারপোর্ট। সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি দিয়ে ঘেরা এই এয়ারপোর্টটি বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক এয়ারপোর্ট, যাতে কিনা সারা দুনিয়ার হাতে গোনা কিছু পাইলট আর দ্রুক এয়ারওয়েজ-এর কয়েকটি মাত্র বিমান ছাড়া অন্য কোনো পাইলট বা বিমানের অবতরণ করার মতো প্রয়োজনীয় দক্ষতা নেই! হাতে সময় থাকলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখে নিতে পারেন এয়ারপোর্টে বিমান অবতরণ করার সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য। তারপর আবার ছুটে চলা- থিম্পু থেকে ফুন্টসোলিং। ফের জয়গাঁর ইমিগ্রেশন শেষে লোকালে করে চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারি হয়ে ঢাকা। ফিরবেন, কিন্তু মনের গভীরে ঠিকই গেঁথে থাকবে ভুটানের অপূর্ব বুনো সৌন্দর্যের কথা; এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশের মানুষদের কথা- যাদের মনে ওভাবে নেই তেমন উচ্চাশা, জীবন নিয়ে নেই কোনো বাড়াবাড়ি রকম প্রতিযোগিতা বা হতাশা, অদ্ভুত যাদের জীবন দর্শন, অসামান্য যাদের ভদ্রতা; আপনার শত অযাচিত কিংবা ভুল আচরণেও যারা মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে বলবে ‘থ্যাংক ইউ’।

অফুরন্ত ধৈর্য দেখিয়ে যারা গাড়ি থামিয়ে রাখবে আপনি জেব্রা ক্রসিং পার হওয়ার আগ পর্যন্ত, যত সময়ই লাগুক না কেন, বিরক্তিতে ছোট্ট একটা হর্ন পর্যন্ত দেবে না। আপনি ফুটপাত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সম্মান জানিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে আপনার সামনে, তবু মুখ ফুটে সরতে বলবে না- পাছে আপনি কষ্ট পান! যাদের সারাটা জীবন জুড়ে চাওয়া-পাওয়া শুধু একটাই- শান্তি, বিশুদ্ধ শান্তি।

This is a Bengali travel-story on the 'Land of Peace' Bhutan. This focuses on the peaceful condition in bhutan. The author has a very positive view about the whole journey and all of the positivity is poured into the article.

Featured Image: andbeyond.com

Related Articles

Exit mobile version