মধ্য এশিয়ার যে কয়টি শহর ইতিহাসের টুকরো স্মৃতি লালন করে টিকে আছে, তার মধ্যে বুখারা অন্যতম। এ অঞ্চলের ইতিহাসের নানা পালাবদলের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বুখারা শহরটি।
প্রাচীন যুগ থেকেই নানা রাজবংশের শাসকদের পছন্দের জায়গা ছিল বুখারা।নানা সময়ে নানা শাসক তাই এর সৌন্দর্যবর্ধন ও সমৃদ্ধির দিকে নজর দিয়েছেন। তবে বুখারা সবদিক থেকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে মধ্যযুগে। এই সময়ে স্থাপিত মোহনীয় অসংখ্য স্থাপনা এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান
ঐতিহাসিক সিল্করোডের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর হওয়ায় এটি ছিল সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্র। এছাড়া শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চায় এগিয়ে ছিল বুখারা। সভ্যতায় বুখারার দান নেহায়েত কম নয়।
বুখারায় জন্মগ্রহণ করেছেন হাদিসশাস্ত্রের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হাদীসগ্রন্থ বুখারী শরীফের রচিয়তা ইমাম বুখারী, চিকিৎসাশাস্ত্রের স্বনামধন্য পন্ডিত ইবনে সিনা, বিখ্যাত সুফীসাধক বাহাউদ্দীন নকশবন্দী। ইতিহাসে বুখারা মুসলমানদের পবিত্র শহর বলে খ্যাত।
বুখারা উজবেকিস্তানের বুখারা প্রদেশের রাজধানী এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহরটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জারাফশান নদী। ঐতিহাসিক শহর সমরকন্দ থেকে ২২৫ কি.মি. পশ্চিমে অবস্থিত এই শহরটি।
পুরাণে বুখারা
বুখারাকে নিয়ে প্রচলিত আছে নানা পৌরানিক কাহিনী। ইরানের বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামা অনুসারে, রাজা কায়কাউসের পুত্র সিয়াভাশ বুখারা প্রতিষ্ঠা করেছলেন। পুরাণ বলে, সিয়াভাশ তার সৎমায়ের শ্লীলতাহানীর অভিযোগে আগুনে নিক্ষিপ্ত হন। সেই সময়ে প্রচলিত প্রথা ছিল অভিযুক্তকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। যদি সে নির্দোষ হয় তাহলে বেঁচে যাবে। তো সিয়াভাশ আগুন থেকে বেঁচে গিয়ে আমুদরিয়া পার হয়ে তুরান চলে যান। সেখানে সমরকন্দের রাজা তার মেয়ে ফারানজিসের সাথে তার বিয়ে দেন এবং তাকে বুখারার মরুদ্যানে এক টুকরো রাজ্য প্রদান করেন। সিয়াভাশ সেখানে দুর্গ নির্মাণ করেন এবং একে ঘিরে প্রাচীর দেন । এভাবেই বুখারা শহরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
বুখারার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
পারস্য সাম্রাজ্যের একটি রাজ্য হিসেবে বুখারার পথচলা শুরু হয় সেই খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দে।
পরবর্তীতে এটি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের দখলে আসে। আরবদের অধিকারে এসে মুসলিম সভ্যতায় সমৃদ্ধ হওয়ার আগে বুখারায় দুটি ধর্মীয় আন্দোলন সংঘটিত হয়। একটি সাসানি সাম্রাজ্যের শাসনামলে ম্যানিকাশিনিজম, আরেকটি অ্যাসিরিয়ান চার্চ অব ইস্টের নেস্টেরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি। এই ঘটনাগুলোর সাক্ষী হিসেবে বেশকিছু কয়েন ও ক্রুশ পাওয়া গেছে বুখারায়। নবম শতাব্দীতে বুখারায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৮৫০ খ্রিস্টাব্দে এটি সামানিদদের রাজধানীর মর্যাদা পায়৷ সামানিদদের স্বর্ণযুগে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে বুখারা। ইমাম বুখারী এই সময়ে জন্মলাভ করেন। সামানিদরা ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি রাজবংশ কারাখানিদদের কাছে পরাজিত হয়। তারপর বুখারা খারেজম শাহের রাজ্যের অন্তর্গত হয়। ১২২০ সালে বুখারা শিকার হয় চেঙ্গিস খানের নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের। পরে অবশ্য শহরটি পুনর্নির্মিত হয়। তৈমুর লংয়ের উত্থানের আগপযন্ত চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরীরাই বুখারা শাসন করে। এরপর বুখারা পরিণত হয় শায়বানী শাসকদের রাজধানীতে। তারপর উত্থান ঘটে আমিরাত অব বুখারার। রাশিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় রেড আর্মি আমিরাত অব বুখারা দখল করে নেয়। এরপর আসে বুখারান পিপলস রিপাবলিকের যুগ। এই সময় বুখারা উজবেক সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের অঙ্গীভূত হয়। এরপর ১৯৯১ সালে উজবেকিস্তান স্বাধীন হলে বুখরা হয় বুখারা প্রদেশের রাজধানী।
বুখারার ঐতিহ্য ও স্থাপনা
বুখারা স্থাপত্যশিল্পে ভীষণ সমৃদ্ধ। একে বলা হয় জাদুঘরের শহর। এই শহরটি ছোট-বড় মোট ১৪০টি স্থাপত্য ধারণ করে আছে। বুখারায় কমপক্ষে ২০০ মসজিদ ও শতাধিক মাদ্রাসা আছে। ঐতিহ্যবাহী নানা মসজিদ-মাদ্রাসার অবস্থানের কারণে ইউনেস্কো বুখারাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মর্যাদা দিয়েছে। এই পর্যায়ে পরিচিত হওয়া যাক বুখারার বিখ্যাত কিছ স্থাপনার সাথে।
আর্ক দূর্গ
বর্তমান বুখারার উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত এই দুর্গটি। মোটামুটি চতুর্ভূজ আকৃতির এই দুর্গ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বিস্তৃত। পঞ্চম শতকে এটি নির্মিত হয়। নির্মাণের পর থেকে ১৯২০ সালে রাশিয়ান আগ্রাসনের আগপর্যন্ত সুদীর্ঘকাল এটি টিকে ছিল।
রেড আমি বোম মেরে দুর্গের একটা বড় অংশ উড়িয়ে দিলেও আর্কের জৌলুস খুব একটা কমেনি। এখনো আর্ক দেখতে কম আকর্ষণীয় নয়। মজবুত প্রাচীরের ভেতর অবস্থিত শক্তিশালী এই দুর্গকে বলা হয় ‘শহরের ভেতরে শহর’।
আর্ক মূলত বুখারার আমিরদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সুদৃশ্য এই স্থাপত্যের প্রবেশমুখেই রয়েছে একটি জামে মসজিদ। তারপর শুরু হয়েছে কোয়ার্টার।
কালয়ান মিনার
বুখারার সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনা পোই কালয়ান মসজিদ কমপ্লেক্সের একটি মিনার হচ্ছে কালয়ান মিনার। এটি তৈরি করেন কারাখানিদ শাসক মোহাম্মাদ আরসালান খান। রোদে শুকানো ইট দিয়ে তৈরি গোলাকৃতির এই মিনারটি উপরের দিকে ক্রমশ সরু হয়ে উঠে গেছে। এর উচ্চতা প্রায় সাড়ে পঁয়তাল্লিশ মিটার।
মিনারের অভ্যন্তরে রয়েছে উপরে ওঠার জন্য প্যাঁচানো সিঁড়ি। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠে গোলাকার গম্বুজ আচ্ছাদিত ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দিত মুয়াজ্জিন। যুদ্ধের সময় ওয়াচ টাওয়ার হিসেবেও ব্যবহৃত হতো এটি। বিশ শতকে অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে মিনারের উপর থেকে ফেলে দেওয়া হতো বলে মিনারটি ‘মৃত্যু টাওয়ার’ হিসেবেও পরিচিত। এই মিনারটির ইতিহাসে সৌন্দর্য ও মৃত্যু অদ্ভুতভাবে জড়িয়ে আছে।
চার মিনার
চার মিনার বুখারার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ।
এটি নির্মাণ করেন খলিফা নিয়াজ কুল। তিনি ছিলেন জানিদ রাজবংশের শাসক। মসজিদের নামানুসারে এখানে যথারীতি চারটি মিনার আছে, তবে আযান দেওয়ার জন্য মিনার হিসেবে ব্যবহৃত হয় না কোনোটাই। তবে নীল রঙের কাজ করা মিনারগুলো মসজিদের সৌন্দর্য যে বাড়িয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কালান মসজিদ
কালান মসজিদ বুখারার অন্যতম সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। প্রত্মতাত্ত্বিক খনন থেকে জানা যায়, কারাখানিদ শাসনামলে এখানে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।
তবে তা মঙ্গোলদের আক্রমণে ধ্বংস হয়। পরে পঞ্চদশ শতকে এখানে ঐ মসজিদের ধ্বংসাবশেষের উপর আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই মসজিদটি কালান মসজিদ নামে পরিচিত। কালান মসজিদের গঠন মধ্য এশিয়ার আর দশটা মসজিদের মতোই। মসজিদের সামনে রয়েছে চতুর্ভূজাকৃতির আঙিনা। রয়েছে পিলারনির্মিত গ্যালারি। মসজিদের উপরিভাগে রয়েছে কারুকাজ করা নীল মিনার।
মির-ই-আরব মাদ্রাসা
দুটি ঝকঝকে নীল গম্বুজে সজ্জিত মির-ই-আরব মাদ্রাসা বুখারার আরেকটি অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা।
নান্দনিক এই ভবনটি নির্মিত হয়েছিল ষোল শতকে। শায়বানী শাসকদের ধর্মীয় গুরু শায়খ আবদুল্লাহ ইয়েমেনীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই মাদ্রাসার সাথে। মির-ই-আরব মাদ্রাসার চোখধাঁধানো নকশায় স্থান পেয়েছে মোজাইকের কাজ, জ্যামিতিক কারুকার্য এবং ক্যালিগ্রাফির পরিমিত ব্যবহার।
লাব-ই-হাউজ
প্রাচীন বুখারার পানির উৎস ছিল কিছু উন্মুক্ত পুকুর। পানি সহজলভ্য হলেও রোগজীবাণু ছড়ানোর জন্য পুকুরগুলোর কুখ্যাতি ছিল। এজন্য ১৯২০ এর দশকে প্রায় সবগুলো পুকুর ভরাট করে ফেলা হয়।
লাব-ই-হাউজ বেঁচে যায় এর তিনপাশে তিনটি মনোহর স্থাপত্য থাকার কল্যাণে। পুকুরটির একপাশে আছে কুকেলদাশ মাদ্রাসা, নাদির দিওয়ানবাগী মাদ্রাসা ও নাদির দিওয়ানবাগী খানকা।
ইসমাঈল সামানি মাজার
ইসমাঈল সামানি মাজার বুখারার অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। ইসমাঈল সামানি ছিলেন সামানিদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা।
ইটের তৈরি ঘনকাকৃতির এই স্থাপনাটি মধ্য এশিয়ার প্রাচীন ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন।