“ভারতে দেখার মতো জায়গা কী কী আছে?”
আমার প্রশ্ন শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে এক বন্ধু গড়গড়িয়ে বলতে থাকল, “তাজমহল, কুতুবমিনার, জামে মসজিদ, মানালি, দার্জিলিং, ভিক্টোরিয়া পার্ক…”
“ব্যস, ব্যস!” আমি থামিয়ে দিলাম।
বন্ধুরা ৯ জন মিলে বেড়াতে যাবো ভারতে, কোথায় যাবো এই নিয়ে ভোটাভুটি চলছিল। খুব আজগুবি কিছু জায়গা ভোটে জিতে যাচ্ছিল, আন্দামান-নিকোবর থেকে শুরু করে সান্দাকফু, সিক্কিম- কী ছিল না তালিকায়! শেষে কেউ একজন প্রস্তাব দিল উত্তরখণ্ড যাওয়ার, খুব একটা ঝামেলা না করে সবাই সাগ্রহে রাজি হয়ে গেলাম।
লাফিয়ে পড়ে উত্তরখণ্ডে ভোট দেবার পর বাসায় ফিরে মনে হলো, জায়গাটা কেমন একটু ঘেটে দেখা দরকার। গুগলে একটু ধস্তাধস্তি করে যা দেখলাম তাতে জিভের টাকরায় আপনাতেই সন্তুষ্টির আওয়াজ বেরিয়ে এল। ভারতের উত্তরখণ্ডের তিনদিক বেষ্টিত উত্তরপ্রদেশ, হিমালয় কন্যা নেপাল আর তিব্বতের বর্ডার। হিমালয় পর্বতমালা উত্তরখণ্ডকে অতিক্রম করে গেছে, তার মানে ঢাকার এপ্রিল মাসের উত্তাপ থেকে কিছুদিনের জন্য স্বস্তি মিলবে আমাদের। মোটামুটি ১০-১১ দিন সময়, এর মাঝে উত্তরখণ্ড যতদূর দেখা যায় দেখে ফেলবো। ৮ জন বাকসো-পেটরা গুছিয়ে এপ্রিলের ২৫ তারিখ রাতের বাসে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, একজন বন্ধুর বোনের বিয়ে থাকায় দুদিন পর এসে পৌঁছাবে- এমন ব্যবস্থা রইলো।
উত্তরখণ্ড যাওয়া সোজা কিছু ব্যাপার নয়, বাসে করে কলকাতা পার হয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে দিল্লি, দিল্লি থেকে ফের বাস/ট্রেন কিছুতে করে উত্তরখন্ড। আসলে আমাদের কাছে খুব বেশি পয়সা ছিল না, নাহলে প্লেনে গেলে হয়তো আরো সহজে কম সময়ে ঘোরাঘুরি সেরে ফেলা যেত। যা-ই হোক, ২৬ তারিখ সকালে কলকাতা নেমে বিকেল ৪:৩০ এর দিল্লি এক্সপ্রেস ধরার উদ্দেশ্যে রেল স্টেশনের পথে এগোলাম।
বন্ধুদের সাথে এই জীবনে কোনোদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ নাটকীয়তা ছাড়া ট্রিপের বাস/ট্রেন ধরতে পারিনি। এবারেও বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কে একজন খবর দিল ট্রেন নাকি ৪টায়। ব্যস‚ সবাই মিলে ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে দে-দৌড়! কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে একটা বগিতে উঠে পড়লাম আর ট্রেনও সাথে সাথে চলা শুরু করল। ভারতের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন এই দিল্লি এক্সপ্রেস, কোথাও থামে না। একটু পর পর খাবার দিয়ে যায়, স্লিপিং কোচে আরামের ঘুম দিয়ে পরদিন সকালে উঠে দেখি “দিল্লি আগ্যায়া ভাইসাব!”
ঠিক করেছিলাম আরেকটা ট্রেন ধরে দেহরাদুন চলে যাব কি না। ও হ্যাঁ, দেহরাদুন হলো উত্তরখণ্ড প্রদেশের রাজধানী ও সবচাইতে বড় শহর। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে সবাই ঠিক করলাম, কোনো একটা ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে একবারে গাড়ি, হোটেল সব বুক করে নেব। সেই মতো একটা এজেন্সির অফিসে ঢুকে আমরা তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, উত্তরখণ্ডের মাসৌরি, নৈনিতাল, কৌসানি আর ভিমতাল- এই চার জায়গায় যাব। আমার খুব ইচ্ছে ছিল ঋষিকেশ যাবার, কিন্তু সময় স্বল্পতায় এ জায়গাটা তালিকা থেকে বাদ দিতে হল।
একটা সাদা রং এর বারো সিটের মাইক্রোবাস জাতীয় গাড়ি এসে থামল এজেন্সি অফিসের সামনে। গায়ে হলুদ কালিতে বড় করে লিখা ‘টেম্পো ট্র্যাভেলার্স’, মানে কী কে জানে! আমি লাফ দিয়ে সামনের সিটে বসে পড়লাম, ড্রাইভারের একেবারে পাশে। উত্তরখণ্ডের পথে যাত্রা শুরু হলো।
দলের বাকিদের কথা জানি না, তবে আমি উত্তরখণ্ড সম্পর্কে মোটামুটি কিছুই জানি না। গাড়িতে বসে দিল্লি দেখার পাশাপাশি গুগলে একটু খোঁজ নেবার চেষ্টা করলাম। জানলাম, উত্তরখণ্ডকে বলা হয় ‘ল্যান্ড অফ গডস’, কারণ একটু বাদে বাদেই এখানে বিভিন্ন দেবতার মন্দির। এখানে আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত পবিত্র হরিদ্বার শহর।
জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক রয়েছে উত্তরখণ্ডেই, কুমায়ুনের সেই কুখ্যাত চিতাবাঘকে শিকারি করবেট এখানেই মেরেছিলেন, যেটি সর্বমোট ১২৫ জন মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল। চোখ পড়লো উত্তরখণ্ডের নদীমালার নামের তালিকায়, কী সুন্দর সব নাম! বাউর, গোরি গঙ্গা, পুষ্পবতী, সারদা, বাসুকীগঙ্গা, অলকানন্দা… জয় গোস্বামীর কবিতার লাইন মনের অজান্তে আউড়ে নিলাম,
অতল, তোমার সাক্ষাৎ পেয়ে চিনতে পারিনি বলে
হৃদি ভেসে গেল অলকানন্দা জলে
“বেহেনজি (বোন), এই দেখুন আপনার ডানে লাল কিলা (কেল্লা)।”
ড্রাইভার সাহেবের কথায় অলকানন্দার কল্পনায় ভাটা পড়ল।
“ভাই, আমি তো ছবি তুলতে পারলাম না। একটু পেছাবেন?”
“চিন্তার কিছু নেই, দিল্লির অলিতে গলিতে কিলা”, দাঁত বের করে হাসলেন ড্রাইভার সাহেব।
দিল্লি আসার আগে বন্ধুদের কাছ থেকে দু-তিনটা কথা বেশ কয়েকবার শুনে ফেলেছিলাম। এক, দিল্লি পার হলেই আর আমিষ কপালে জুটবে না। দুই, দিল্লির আনাচে কানাচে ভরা কেল্লা আর পুরনো মসজিদ। দ্বিতীয় কথাটা একটু পরেই টের পেলাম, যখন ড্রাইভার সাহেব গড়গড়িয়ে এটা সেটা দেখিয়ে বলতে লাগলেন, “এদিকে গেলে কুতুব মিনার” “এইমাত্র হুমায়ূনের কবর পার হলাম” “ডানেই নেহেরু প্ল্যানেটারিয়াম” “মোড়ে গুরুদোয়ারা বাংলা সাহিব, এর মিনার খানিকটা স্বর্ণ দিয়ে বানানো শুনেছি”… আমার মনে হলো, বাসে-ট্রেনে না এসে ওনার সাথে এসেই ভাল করেছি, বেশ দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।
উত্তরখণ্ডের কথা বলতে গিয়ে দিল্লির কীর্তন গাওয়া শুরু করলাম, রোড ট্রিপগুলো আসলে এরকমই হয়। একটা জায়গায় যাওয়ার নাম করে বের হয়ে রাস্তার সব দেখা হয়ে যায়। একসময় রুক্ষ দালানকোঠা আর ফ্লাইওভার দৃষ্টিসীমা থেকে বেরিয়ে গেল, সুবিশাল হাইওয়ে ধরে দিল্লি পার হয়ে এগোতে লাগলাম। হাইওয়ের পাশে একটা ছোট টং দোকানের সামনে গাড়ি থামিয়ে চা-পানি খেয়ে সন্ধ্যে নামা পর্যন্ত বসে রইলাম চেয়ারেই। আমাদের পাশ কেটে বড় বড় গাড়ি সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছিল, আর আমরা সবাই নিজেদের ‘দিল চাহতা হ্যায়’ সিনেমার নায়ক-নায়িকা ভেবে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ছিলাম।
আড়াইটার সময় রওনা দিয়ে প্রায় ৭-৮টা নাগাদ উত্তরখণ্ডে ঢুকলাম। “দেহরাদুন এসে গেছি”, ঘোষণা দিলেন ড্রাইভার সাহেব। এতক্ষণে আমরা ওনার নাম জেনে গেছি, রাজু। কিন্তু তবু আমি ওনাকে ভাইসাব ডাকতাম আর বাকিরা দাদা বলে ডাকত। আমার হেডফোনে বাজছিল Porcupine Tree, স্টিভেন উইলসনের গলা আমার মনকে আশ্চর্য রকমের শান্ত করে দেয়। এসময় মনে হচ্ছিল, দিনের বেলা হলে দেহরাদুন শহরকে বেশ একটু দেখে নেয়া যেত।
“ভাইসাব, ভাল খিদে পেয়ে গেল। ডিনার কোথায় করা যায়?”
“যেখানেই করতে চান গাড়ি আমি পাহাড়ে ওঠার আগে থামাচ্ছি না।”
“কিন্তু খিদের কী হবে?”
“সে আমি জানি না। সমতল রাস্তা বলে টের পাচ্ছেন না বেহেনজি, একটু পর যখন পাহাড়ি রাস্তায় উঠব দেখবেন কত সময় লাগে।”
গান শুনে আর ঘুমিয়ে তিন ঘন্টা পার করে দিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমরা সমতল রাস্তায় আর নেই, ক্রমেই উঁচুতে উঠছি। পাহাড়ের উপর আস্তে আস্তে যত উঠছি, উপর থেকে নিচের দৃশ্য তত বেশি পরাবাস্তবময় লাগছে। পাহাড়ের প্রতিটা খাঁজে খাঁজে বাড়িঘর, টিমটিম করে লাইট জ্বলছে। রাস্তা আস্তে আস্তে বেপরোয়া রকমের উঁচু-নিচু হয়ে যাচ্ছিল, একটু পর পর বিপজ্জনক রকমের তীক্ষ্ণ বাঁক। এই অন্ধকারে ড্রাইভার সাহেব কী করে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সে চিন্তার ধারে কাছেও গেলাম না, নিজেদের জীবন স্রষ্টা আর ওনার হাতে সঁপে দিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইলাম।
“খিদেয় তো মারা গেলাম, আর কতক্ষণ পরে খেতে পাব?”
“আর বেশি নেই বেহেনজি, একটু সবুর করতে হবে।”
বলতে বলতেই গাড়ি আচমকা বাঁক নিয়ে পাহাড়ের খোলা এক দিকে চলে এল, আমরা খিদে ভুলে সামনের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলাম। আমরা রয়েছি একটি উঁচু পাহাড়ে, তার দ্বিগুণ উঁচু একটি পাহাড় সামনে। সমস্ত পাহাড়ের গায়ে মরিচবাতির মতন আলো জ্বলছে, তার উপর শামিয়ানার মতন আকাশে হাজার-কোটি তারা। ড্রাইভার জানালেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় আমরা খেতে নামবো। এই পাথরের দেবতার চূড়ায় উঠবার লোভেই বাকি রাস্তা আর খাওয়ার নামটি নিলাম না কেউ।
অনেক ঘুরে শেষে আমাদের ক্ষণস্থায়ী গন্তব্যে পৌঁছলাম। রাত প্রায় দেড়টা বাজে তখন। ছাপড়া একটা দোকান পাহাড়ি রাস্তার পাশেই, গাড়ি থেকে নামতেই ম্যাগি নুডুলস আর ম্যাকারনির গন্ধে পেট মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু এটুকু দোকানের কোথায় বসব আর কোথায় খাব? তাছাড়া সুন্দর একটা ভিউ দেখব আশা করে এসেছিলাম, এখান থেকে মনে হচ্ছে কিছুই দেখা হবে না। আমার চেহারা যেন পড়ে ফেললেন ড্রাইভার সাহেব, মুচকি হাসলেন।
“বেহেনজি, এপাশ দিয়ে নেমে সামনে চলে যান। চেয়ার-টেবিল পাবেন।”
খুব সংকীর্ণ একটা রাস্তা দিয়ে সাবধানে নেমে একটু সামনে যেতেই আনন্দে আর বিস্ময়ে অস্ফুট শব্দ করে উঠলাম নিজের অজান্তেই। যে দৃশ্য দেখব ভেবেছিলাম, তা-ই দেখতে পাচ্ছি! সামনে বিস্তৃত পাহাড়, পুরো দেহরাদুন শহর উপর থেকে দেখা যাচ্ছে নিচে। ক্যামেরায় হাজার চেষ্টা করেও এই দৃশ্য ধরে রাখতে পারলাম না। চেয়ার নিয়ে পাহাড়ের কিনারে চুপচাপ বসে রইলাম, এত শান্তিপূর্ণ মঙ্গলময় পরিবেশ আর কবে পাব তার ঠিক নেই। যতটা পারলাম আশপাশ থেকে রাতের পাহাড়ের এই সৌন্দর্য নিজের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করলাম। শেষে ধোঁয়া ওঠা ম্যাকারনি আর ঠান্ডা এক বোতল ‘মাজা’ ম্যাঙ্গো জুস পান করে পেট ভরিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
আরো প্রায় দুই ঘন্টার জার্নি করে সবাই যখন অসুস্থ হয়ে যায়-দশা, তখন, ভোর সাড়ে তিনটায় ড্রাইভার ঘোষণা দিলেন, আমাদের প্রথম গন্তব্য মাসৌরিতে পৌঁছে গেছি। দিল্লির ভ্যাঁপসা গরম থেকে বাঁচতে একটা ফিনফিনে গেঞ্জি আর ঢোলা সালোয়ার পরে গাড়িতে উঠেছিলাম, তার ফল হাতেনাতে টের পেলাম। গাড়ি থেকে নেমে শীতে জমে প্রায় শক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম, সাথের এক বন্ধু পথ দেখিয়ে হোটেলে নিয়ে গেলো। দুই চোখ ভর্তি ঘুম থাকায় আমি টেরও পেলাম না জায়গাটা কেমন, আদৌ হোটেল না অন্য কিছু। যে অবস্থায় রুমে ঢুকলাম, সেভাবেই ধপাস করে বিছানায় পড়ে ঘুমিয়ে গেলাম। বাকিদের কী হলো, পরদিন কী হবে- এসব কোনো ভাবনা আমাকে স্পর্শ করতে পারলো না। কেবল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুনলাম বন্ধুরা প্ল্যান করছে‚ পরদিন সকালে উঠে কেম্পটি ফলস‚ গোসল সেরে পিক পয়েন্ট‚ তারপর শহরে… জিপ লাইনিং… মাসৌরি লাইব্রেরি…
ফিচার ইমেজ ©️ রিফাত ইবনে আজাদ তানিম