কাঞ্চনজঙ্ঘা: দেশের সীমানা পেরিয়ে আসা এক অপরূপার গল্প

কাঞ্চনজঙ্ঘা। হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত ভয়ংকর সুন্দর এক পর্বতশৃঙ্গের নাম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৮৫৮৬ মিটার। উচ্চতার দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। তবে ১৮৫২ সাল পর্যন্ত মনে করা হতো, কাঞ্চনজঙ্ঘাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন এই শুভ্র অপরূপা আবার একইসাথে পৃথিবীর অন্যতম দুর্গম এবং ভয়ংকর পর্বতশৃঙ্গও। সুন্দরের সাথে ভয় না মিশলে নাকি নান্দনিক আবহ তৈরি হয় না। সে হিসেবে কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নান্দনিকতার বিশেষ মাত্রা বলা যেতে পারে। এত বেশি দুর্গম আর প্রতিকূল এর যাত্রাপথ, যে এর চূড়ায় পৌঁছাতে প্রতি পাঁচজনের একজনকে ব্যর্থ হতে হয়। আক্ষরিক অর্থে যদিও এর চূড়ায় কেউ পা রাখতে পারেনি কোনোদিন। সে নিয়ে আছে আরেকটা গল্প।

Photograph: Mueeb Monon
কাঞ্চনজঙ্ঘা; Image Credit: Mueeb Monon

 

নেপাল আর সিকিমের অনেক মানুষ এই পর্বতকে পূজা করে। তারা বিশ্বাস করে, কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় পবিত্র আত্মারা থাকে; তাই এর চূড়ায় পা রাখলে এর পবিত্রতাকে অবমাননা করা হবে। তাই এই পর্বতশৃঙ্গে আরোহণ করতে দেয়া হত না কাউকে। পরে ১৯৫৫ সালে জো ব্রাউন ও জর্জ ব্যান্ড সিকিমের রাজার কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, তারা এর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখবেন না, শুধুমাত্র আরোহণ করবেন। এ শর্ত মেনেই তারা যাত্রা করেন। এটিই ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রথম মনুষ্য পদচারণা। সে থেকে এখন পর্যন্ত সকল অভিযাত্রী দল এই নিয়মটি মেনে এসেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘাকে নিয়ে অনেকরকম মিথ প্রচলিত আছে। যেমন এর নিচে বাস করা লেপচা জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে, এ পর্বতে ইয়েতি থাকে। এর চূড়ার বরফের মধ্যেই এই পৃথিবীর প্রথম নারী এবং প্রথম পুরুষের সৃষ্টি হয়েছে, এমন বিশ্বাসও প্রচলিত আছে তাদের মধ্যে। কেউ কেউ মনে করে, অমরত্বের রহস্যও নাকি লুকানো আছে কাঞ্চনজঙ্ঘাতে।

শেরপা তেনজিংয়ের বই ‘ম্যান অভ এভারেস্ট’ অনুযায়ী, কাঞ্চনজঙ্ঘা নামের অর্থ ‘বরফের পঞ্চরত্ন’। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাঁচটি চূড়া থেকেই এই নামকরণ। পাঁচটি চূড়ার প্রতিটিরই উচ্চতা ৮,৪৫০ মিটারের উপরে। দু’টি চূড়ার অবস্থান নেপালে এবং বাকি তিনটির অবস্থান ভারতের উত্তর সিকিম ও নেপালের সীমান্তবর্তী এলাকায়। দৃষ্টিনন্দন এই পাহাড়ের অপার্থিব সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সাদা বরফে আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় প্রথম সূর্যের আলো পড়ার সাথে সাথেই এক অপূর্ব মাদকতার সৃষ্টি হয়। সূর্যের আলোর ক্রমাগত আলিঙ্গনে কালচে, লাল, সোনালি, কমলা, হলুদ এবং সাদা বর্ণ ধারণ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা। সৌন্দর্যের এই বৈচিত্র্যকে নিংড়ে নিতে চাইলে তাই সারাদিনই তার দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়।

Photograph: Mueeb Monon
পবিত্রতা আর শুভ্রতার কাঞ্চনজঙ্ঘা; Image Credit: Mueeb Monon

 

কাঞ্চনজঙ্ঘার এ সৌন্দর্য উপভোগের জন্য কেউ ছুটে যান সিকিমে, কেউ কালিম্পং, আবার কেউ কেউ ছুটে যান দার্জিলিংয়ে। দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা চূড়ার দূরত্ব ৮০ কিলোমিট্রা। ২,৫৭৩ মিটার উঁচু টাইগার হিল থেকে এর সৌন্দর্য অবলোকন করতে যান অজস্র দর্শনার্থী, বিশেষ করে বাঙালিরা। কারণ, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আবেগ এবং অনুভূতির অনেক উপাদান আছে এসব জায়গায়। বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভালো দেখতে পাওয়া যায় অক্টোবর মাসে। সূর্য একটু দক্ষিণে হেলে থাকার কারণে বেশি পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় এ সময়ে। যদিও আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সৌন্দর্য পূজারীদেরকে পুরো মাত্রায় হতাশ হতে হবে। তবে সুন্দরের স্পর্শ পেতে এটুকু কষ্ট সহ্য করাই যায়, ঠিক যেমন গোলাপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলে কাঁটার সম্মুখীন হতে হয়।
Photograph: Mueeb Monon
পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা হাইওয়ে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা; Image Credit: Mueeb Monon

 

মনোরম এই সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশ থেকেও। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে মেঘমুক্ত আকাশে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের যেকোনো খোলা জায়গা থেকেই এই কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়। বছরের অন্যান্য সময়ে টুকটাক দেখা গেলেও এই সময়টাতে সবচেয়ে পরিস্কার দেখা যায়। সবচেয়ে স্পষ্ট দেখা যায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা থেকে। কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে তেঁতুলিয়া শহরের দূরত্ব মাত্র ১৩৭ কি.মি। মহানন্দা নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা তেঁতুলিয়া শহর। কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্যের টানেই প্রতি বছরই তেঁতুলিয়ার ঐতিহাসিক ডাকবাংলোয় ছুটে আসছেন অসংখ্য মানুষ। হেমন্তের পাকা ধানের রঙ, শীতের আগমনী গান, তেঁতুলিয়ার সমতল ভূমির চা বাগান আর কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য; সবমিলিয়ে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরছেন দর্শনার্থীরা। তেঁতুলিয়া শহরে রয়েছে অজস্র চা বাগান৷ বাংলাদেশে সমতল ভূমিতে চা চাষ হয় একমাত্র এই পঞ্চগড় জেলাতেই।
Photograph: Mueeb Monon
পঞ্চগড়ের সমতল ভূমির চা বাগান; Image Credit: Mueeb Monon

 

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে পঞ্চগড় শহরে যেতে যেতেই চোখে পড়বে কাঞ্চনজঙ্ঘা। করতোয়া ব্রিজ থেকে সকালের সূর্যের আলোয় লালিমাযুক্ত সৌন্দর্য দেখলেই মন ভরে যাবে। পঞ্চগড়-বাংলাবান্ধা হাইওয়ে ধরে সেই অপরূপাকে তাড়া করতে করতে চলে যেতে পারেন বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত। এর মধ্যে অনেকবারই তার রংবদল দেখতে পারবেন। প্রশাসনের অনুমতি যোগাড় করলে পারলে থাকতে পারবেন মহানন্দার তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোয়। এছাড়াও তেঁতুলিয়া শহরে থাকার জন্য ৫০০ টাকার মধ্যে আবাসিক হোটেলে সিঙ্গেল রুম পেয়ে যাবেন। আবার চাইলে পঞ্চগড় শহরেও বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে থাকতে পারবেন। ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে পঞ্চগড় শহর থেকে বাসে চড়ে দেড় ঘণ্টার মধ্যেই পৌছাতে পারবেন তেঁতুলিয়া শহরে। সারাদিনই বাস পাওয়া যায়। বাসে জানালার পাশের সিটে বসবেন। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে দেখতেই পৌছে যাবেন তেঁতুলিয়ায়।
 
তেঁতুলিয়া শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য উপভোগ করবেন। সময় থাকলে ঘুরে আসবেন শালবাহানের দিকে। ডাকবাংলো, চা বাগান আর সীমান্তের মনোমুগ্ধকর কিছু জায়গায় সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে পারেন। তেঁতুলিয়া শহরে বাংলা খাবারের বেশ কিছু ভালো হোটেল আছে। খাবার-দাবারে কোনো অসুবিধা হবে না। চা বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোনো একটা নদীর পাড়ে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে থাকলে কিছুক্ষণ পরপর দেখবেন, আপনার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে অজস্র পাখি, যাদের সচরাচর দেখা যায় না। অনেক অচেনা পাখির সাথে পরিচয় হয়ে যাবে এভাবেই। এ পাখিদের কাউকেই ওই কাঁটাতার বা সীমান্ত দিয়ে আটকে রাখা যায়নি, যেমন আটকে রাখা যায়নি কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্যকে।
Photograph: Mueeb Monon
পঞ্চগড়ের সর্বস্তরের জীবনের সাথে মিশে যাওয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা; Image Credit: Mueeb Monon

 

বিকাল পেরিয়ে যখন গোধূলীর আলো নামবে, তখন সীমান্তবর্তী একটা টঙ দোকানে যেয়ে এক কাপ চা খেতে পারেন। আপনার পাশে বসে যে লোকটা চা খাচ্ছেন, হতে পারে তিনি একজন পাথরশ্রমিক। তার সাথে একটু গল্প করবেন। রুমে ফেরার সময় শিশিরের ঘ্রাণ নেবেন। সন্ধ্যায় কুয়াশার চাদর আপনার সঙ্গী হবে। উত্তরের শীতের আলতো স্পর্শ পেয়ে যাবেন এভাবেই। এছাড়াও আপনাকে সঙ্গ দেবে সীমান্তের সোডিয়াম আলো। মহানন্দা সহ আরো বেশ কয়েকটি নদীর অদ্ভুত ছুটে চলা আপনাকে বিস্মিত করবে। নো ম্যানস ল্যান্ডে বেঁচে থাকা কিছু অসহায় জঙ্গল আর সেইসব জঙ্গলকে শাসন করে বেঁচে থাকা কিছু পাখিকে দেখতে পাবেন। পাহাড়ের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, পাখির ডাকের সঙ্গে কয়েকদিনের ছুটি কাটিয়ে এক বুক তৃপ্তি নিয়েই ঘরে ফিরতে পারবেন।

Related Articles

Exit mobile version