দক্ষিণ মেক্সিকোর ওসাকায় বসবাসরত এক উপজাতিগোষ্ঠীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন। যারা নিজেদের পরিচয় দেন ‘মুশে’ (muxe) বলে। ‘মুশে’ এক স্বতন্ত্র লিঙ্গের মানুষ, যারা হাজার হাজার বছর ধরে নিজেদের এই ‘স্বতন্ত্র’ পরিচয় টিকিয়ে রেখেছেন। মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলের ওসাকা অঙ্গরাজ্যের ইশতমো দে তেঅনতেপেক (Istmo de Tehuantepec) নামক অঞ্চলে বাস করেন যারা, লিঙ্গবৈচিত্র্যের দিক থেকে তারা তিন ধরনের নারী, পুরুষ এবং মুশে।
মুশে! নিশ্চয়ই ভাবছেন, সে আবার কী? মুশে হলো, ওসাকার ’ইশতেমো দে তেঅনতেপেক’ অঞ্চলে বসবাসকারী ’জেপোটেক’ উপজাতি গোষ্ঠীর সেই সকল পুরুষ যারা নারীর বেশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। অর্থাৎ পুরুষ হয়ে জন্মালেও নারীর বেশে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন।
জেপোটেক সংস্কৃতির মানুষেরা সবাই একই ভাষায় কথা বলেন। তাদের ভাষার যেমন বৈচিত্র্য নেই, তাদের ভাষায় লিঙ্গবৈচিত্র্যও নেই বলা যায়। ইংরেজি, বাংলা বা অন্যান্য ভাষায় যেমন আলাদা আলাদা লিঙ্গের জন্য আলাদা বিশেষ্য-বিশেষণের দরকার পড়ে, জেপোটেক ভাষায় তেমনটা নেই। তাদের ভাষায় সবাই-ই মানুষ। তারা কি পুরুষ, নাকি নারী কিংবা তৃতীয় লিঙ্গ? এ নিয়ে তাদের সংস্কৃতির মানুষদের খুব বেশি মাথা ব্যাথা নেই।
মুশেরা নারীদের বেশে জীবনযাপন করে বলেই তাদের মধ্যে নারীদের মতো বৈচিত্র্য দেখা যায়। পোশাক-আশাক, সাজগোজ, স্টাইল সবকিছুতেই বৈচিত্র্য। কেউ হয়তো সেখানকার নারীদের মতো ঐতিহ্যবাহী পোশাকে থাকে, কেউ আবার পাশ্চাত্যের নারীদের অনুকরণ করেন, কেউ আবার স্বতন্ত্র সাজে সাজেন। আবার অনেক সময় নারীদের মতো চালচলন হলেও ছেলেদের স্বাভাবিক পোশাকেও থাকেন কোনো কোনো মুশে।
মুশে কী বা কারা? এ প্রশ্নের উত্তর সঠিকভাবে কখনোই জানা সম্ভব নয় যদি তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকে। আমাদের ভাষায় বলতে গেলে হয়তো বলা যায়, মেয়েলি পুরুষ বা সমকামী পুরুষ বা হিজড়া পুরুষ। তবে এই শব্দগুলো মুশেদের ব্যাখ্যা করার জন্য যথেষ্ট নয়। মুশে একটি জেপোটেক শব্দ। তাই জেপোটেক সংস্কৃতিতেই এ শব্দের বা গোত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
পুরো পৃথিবীতে কেবল মেক্সিকোর এই ইশতোমো দে তেঅনতেপেক অঞ্চলেই এই মুশেদের বসবাস দেখতে পাওয়া যায়। এখানে মুশেদেরকে জেপোটেক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিংবদন্তী অনুসারে, ‘জুসিটান ধর্মগুরু ভিসেন্তে ফেরারকে প্রভু একব্যাগ ভর্তি সমকামীতার বীজ দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। পৃথিবী জুড়ে যে দেশেই এই ধর্মগুরু ভ্রমণ করেন, সেই দেশেই একটি করে বীজ ফেলে আসেন। কিন্তু এ্ই জেপোটেকদের জুসিটান শহরে এসে তার ব্যাগ ফুটো হয়ে যায় এবং ব্যাগ থেকে সব বীজ মাটিতে পড়ে। একারণেই এই অঞ্চলে এত বেশি মুশে’দের বসতি।’
অবশ্য এতবেশি বলা হলেও, এ অঞ্চলে যে মুশেদের সংখ্যা অত্যাধিক তা কিন্তু নয়। এখানে তাদের সামাজিক স্বীকৃতি আছে। তাই তারা স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারেন। জেপোটেকদের মধ্যে মুশেরা স্বাভাবিক সামাজিক মানুষদের মতো জীবনযাপন করতে পারে। তাদের আছে নিজস্ব আত্মীয় পরিমন্ডল, নিজস্ব আচার অনুষ্ঠান।
জেপোটেক নারীদের কঠোর স্বভাব আর আত্মমর্যাদাবোধ তাদের সমাজের অনন্য একটি দিক। জেপোটেক সমাজের নারী, পুরুষ আর মুশেরা সবাই মিলেমিশে বাস করেন। তবু এ সমাজকে অনেকে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বলে থাকেন। কেননা, পরিবারের টাকা পয়সা বা কতৃত্বপরায়ণ দিকগুলো নারীদের দখলে থাকে। পুরুষরা ঘামে-শ্রমে উপার্জন করেন। আর নারীরা তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন। পুরুষরা কৃষিকাজ ও মৎস উৎপাদন করে আর নারীরা সেসব বাজারে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন। সেই অর্থ বাজার করতে এবং পরিবারের সকল প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহার করেন।
জেপোটেক সমাজের নারীরা যখন বাজারে এবং পুরুষরা মাঠে ফসল বোনেন বা সাগরে মাছ ধরে সেসময় গৃহস্থালী দেখাশোনার ভার পরে মুশে’দের হাতে। ঠিক সেই সময়ই মুশে’দের উপযোগীতা বোঝা যায়। জেপোটেক সমাজে তো অনেক মায়েরা একজন মুশে সন্তান থাকাকে নিজেদের সৌভাগ্য বলে মনে করেন। তাতে মায়েদের সাহায্য করার একটা মানুষ পাওয়া যায় ঘরে, ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্যও একজন লোক থাকে ঘরে। মুশে’রা অবশ্য অন্য নারীদের মতো দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কে জড়াতে পারেন না কারো সাথে। বিয়ে করে ঘর বাঁধারও অনুমতি নেই তাদের। যাতে বৃদ্ধ বয়সে তারা মা-বাবার দেখাশোনায় কাজে আসেন এ কারণেই এমন নিয়ম বেঁধে দিয়েছে সমাজ তাদের জন্য।
মুশেদের মধ্যে অনেকেই আবার সমাজের এসব ঘরে বেঁধে রাখার নিয়ম মানতে নারাজ। তারা নিজ উদ্যোগে জীবিকা অর্জনে বেরিয়ে পড়েন। আজকাল তো মুশেদের সব ধরনের কাজেই অংশ নিতে দেখা যায়। তারা বাজারে দোকান সাজিয়ে বসেন, বিউটি সেলন খুলে বসেন। বিভিন্ন সামাজিক-ধর্মীয় উৎসব অনুষ্ঠানের পোশাক ডিজাইন ও তৈরি করেন। এমনকি তারা শিক্ষকতা, অভিনয় এবং পরিচালনায়ও অংশগ্রহণ করেন। তারা তাদের সমাজে নিজেদের একটা স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানই গড়ে নিয়েছেন।
ধর্মীয় ক্ষেত্রেও মুশেদের অংশগ্রহণ আছে। স্থানীয় ক্যাথলিক চার্চের ডেকোরেশন সবসময়ই তাদের দায়িত্ব। ঐতিহ্যগতভাবেই মেক্সিকোর এ অঞ্চলের তিন লিঙ্গের (নারী, পুরুষ এবং মুশে) মানুষেরা সহযোগীতা এবং সহমর্মিতার অপূর্ব মেলবন্ধনে আবদ্ধ। মুশেদের নিজস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠানও আছে। তারা প্রার্থনালয়ে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন,
“প্রভু সৃষ্টি করছেন নারী ও পুরুষ এবং তিনিই সৃষ্টি করেছেন তাদের চরিত্র। ক্ষমা করো প্রভু, যদি আমি তোমার ক্রোধের কারণ হই। সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে স্বভাব সৃষ্টি করেছেন তা-ই নির্ধারণ করে দেয় আমরা কেমন মানুষ।”
মুশেরা এমনই বিশ্বাস করে। আর তাদের সমাজে সমকামীতাকে স্বাভাবিকভাবে নেয়া হয়।
ঐতিহ্যবাহী উৎসব ভেলায় মুশেরা আয়োজকের ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও তারা সেজে ওঠেন নানা রঙে আর ঢঙে। তাদের বৈচিত্র্যময় সাজে অংশগ্রহণ, উৎসবগুলোকে রঙিন করে তোলে। হাতে ফুল, বেলুন আর নানা রঙের পোশাক আর মেকাপে সেজে ওঠেন মুশেরা। উৎসবের রাতে শহরের বাইরে কোনো জায়গায় আয়োজন করা হয় বড় ধরনের পার্টির। সেই পার্টিতে অংশ নেয় জেপোটেক সংস্কৃতির নারী, পুরুষ, শিশু সব ধরনের মানুষ।
রাতের পার্টিতে স্টেজ সাজানো হয়। আর সেই স্টেজে দাঁড়িয়ে সকলকে অভ্যর্থনা জানান একজন মুশে তার সঙ্গীকে সাথে নিয়ে। পশ্চিমা অনেক দেশেই সমকামীতা স্বাভাবিক ঘটনা। তবে সেসব দেশের সমকামী এবং মেক্সিকান মুশেদের মধ্যে পার্থক্য হলো, সমকামীতায় পুরুষের সাথে একজন পুরুষের যৌনসম্পর্ক হয়। কিন্তু মুশেদের সমাজে মুশেরা নিজেদের পুরুষদের থেকে আলাদাভাবে।
তারা নিজেদের স্বতন্ত্র একটি লিঙ্গ হিসেবে দাবী করেন। নিজেদের নারীর বেশে প্রদর্শন করেন। পুরুষ বেশে থাকেন না। এবং তারা এমন পুরুষের সাথে প্রেম করতে চান যারা মুশেদের প্রতি আগ্রহী। যে পুরুষরা নিজেদের সমকামী দাবী করে তাদের প্রতি মুশেরা আগ্রহী নয়। মুশেরা অন্য মুশেদের সাথেও সম্পর্কে জড়ান না। মোটকথা, জেপোটেকরা মুশেদের সাথে সম্পর্কে জড়ায় এমন পুরুষদের গায়ে সমকামীতার ট্যাগ জোর করে চাপান না। তারা মনে করেন, ওরাও স্বাভাবিক মানুষ, শুধু তাদের পছন্দ আলাদা। সব মানুষেরই যেমন রুচি ও পছন্দ আলাদা, তেমন।
মুশে’দের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, সকল মুশেই যে শুধু পুরুষদের প্রতি আকৃষ্ট হন তা নয়। কিছু কিছু মুশে নারীদের প্রতিও আকর্ষণ বোধ করেন। আবার কেউ কেউ নারী-পুরুষ কারো প্রতিই আকৃষ্ট নয়। জেপোটেকদের মতে, মুশেরা সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আশীর্বাদ। মুশেরা হলো পুরুষের শরীরে নারীর আত্মা।
যদিও মেস্কিকোর এই অঞ্চলটাকে সমকামীদের স্বর্গ বলা হয়। তবু এখনো রয়ে গেছে নানা বৈষম্য। শিক্ষা, চাকরি বা রাজনৈতিক ক্ষে্ত্রে এখনো মুশেদেরকে বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়। তাছাড়া মেস্কিকোর ওসাকা অঙ্গরাজ্যের জেপোটেকদের মধ্যে মুশেদের সামাজিক স্বীকৃতি থাকলেও, সে দেশের অন্যান্য স্থানে এখনো তাদেরকে ভালো চোখে দেখা হয় না। তবুও মুশে’রা সেদেশে হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র জাতিস্বত্ত্বা।