বিশ্বের কয়েকটি ঐতিহাসিক ক্লক টাওয়ার

মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে
মন আমার দেহ ঘড়ি
ও একখান চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ধইরা চলতে আছে

গানটির রচয়িতা সুফি-বাংলার ভাবদর্শনের প্রসিদ্ধ লোকসঙ্গীত শিল্পী প্রয়াত আবদুর রহমান বয়াতী। বাংলাদেশের বিখ্যাত এই দেহতাত্ত্বিক গানের কথায় অত্যন্ত সুচারু রূপে মানবদেহকে ঘড়ির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, আজ আমরা এমন একটি জিনিস সম্পর্কে জানবো যে বস্তুটির কথা বর্তমান হাল ফ্যাশানের যুগে এসে নিত্য নৈমিত্তিক বহু প্রয়োজনীয় জিনিসের মাঝে উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো- ঘড়ি।

কথায় আছে, ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। এই সময়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারার বোধ জন্মানোর বহু কাল আগেই কে বা কারা এই ঘড়ি নামক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ বস্তুটি আবিষ্কার করেছেন তার সঠিক কোনো সন্ধান মেলে না। তবে আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে কোনো রকম মিনিট বা সেকেন্ডের কাঁটা বিহীন গোলাকার চাকতিতে একটি মাত্র নির্দেশক কাঁটা ও সময়ের ঘরের ছক নিয়ে প্রাচীন মিশরীয় এবং ব্যাবিলনীয় সভ্যতায় যে ঘড়ির প্রচলন শুরু হয় তার নাম ছিল ‘সূর্যঘড়ি’।

ধারণা করা হয় মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম প্রকৃতি নির্ভর সূর্য ঘড়ির প্রচলন শুরু করে যা কিনা ১৪ শতাব্দীতে এসে ইউরোপীয়রা যান্ত্রিক ঘড়িতে রূপদানে সক্ষম হয়। অবশেষে ১৬৫৭ সালে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড এর কাঁটা সম্বলিত উন্নতমানের যান্ত্রিক ঘড়ির নকশা তৈরি করে মানব জাতির উন্নয়নে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া যোগ করে দিতে সক্ষম হন।

যে সময় নির্ধারক যন্ত্রটি ছাড়া আমরা একদম অচল, স্কুলের রুটিন থেকে অফিসের টাইম টেবিল সর্বত্র যে বিষয়ের উপস্থিতি আবশ্যক, বিশ্বব্যাপঈ সেই ঘড়ির রয়েছে অনন্য বৈশিষ্ট্য, সঙ্গে রয়েছে অনেক অজানা তথ্য। এর নানা বৈচিত্রের মধ্যে পড়ে হাতঘড়ি থেকে ঐতিহ্যবাহী দেয়ালঘড়ি সবই। কিন্তু সারা বিশ্বে যে বেশ কিছু বহু চর্চিত ঘড়ি রয়েছে তা কি জানা আছে কারো? অত্যন্ত জনপ্রিয় কিছু ঘড়ি ও ক্লক টাওয়ার দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে।

মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ার হোটেল; মক্কা, সৌদি আরব

মক্কা রয়্যাল ক্লক টাওয়ার হোটেল, মক্কা, সৌদি আরব

পুণ্যভূমি সৌদি আরবের মক্কা শরীফে প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমানের যাতায়াত হলেও অনেকেই এখনও জানেন না যে, পৃথিবীর বৃহত্তম এবং নতুনত্বে শ্রেষ্ঠ ঘড়িটি কিন্তু রয়েছে সেখানেই। মক্কা মসজিদ থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরেই ‘আবরাজ-আল-বাইত’ হোটেলের উপর দণ্ডায়মান টাওয়ারেই ঘড়িটি স্থাপিত যা কিনা লন্ডনের বিখ্যাত বিগ বেনের চেয়েও ছয় গুণ বড়।

এই ঘড়ির আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘড়ি হিসেবে পরিচিত ছিল ইস্তাম্বুলের সিবাহির মলের ঘড়িটি, যার ব্যাস ৩৬ মিটার। সেই ঘড়িটিকে টপকে ২০১২ সালে ৬০১ মিটার উচ্চতার মক্কা টাওয়ারের ৪৩ মিটার ব্যাস সম্পন্ন ঘড়িটি প্রথম স্থান দখল করে নিয়েছে। চতুর্মুখী ঘড়িটির চারপাশে অসাধারণ শৈল্পিক কারুকার্যে বড় মোজাইকের শিলালিপির উপরে অলঙ্করণ করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দ গুচ্ছ। ঘড়িটির ডিজাইন করেছেন সুইস এবং জার্মানির প্রকৌশলীরা।

ইস্তাম্বুল সিবাহির শপিংমল ক্লক

ইস্তাম্বুল সিবাহির শপিংমল ঘড়ি

এই ঘড়িটি বর্তমান বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘড়ি। ইস্তাম্বুলের বিখ্যাত শপিংমল সিবাহিরে এই দেয়াল ঘড়িটি স্থাপিত। ২০০৫ সালে এই ঘড়ি তৈরি করা হয়েছে। এই ঘড়ির ডায়ালের ব্যাস ৩৬ মিটার এবং ঘড়িটি শপিংমলের ছাদে স্বচ্ছ ব্যাকগ্রাউন্ডে তৈরি করা হয়েছে।

বিগ বেন (এলিজাবেথ টাওয়ার) লন্ডন, ইংল্যান্ড

বিগ বেন (এলিজাবেথ টাওয়ার) লন্ডন, ইংল্যান্ড

আজকাল কম বেশি সকলেই পকেটে টাকা থাকলেই বা অল্প স্বল্প সামর্থ্য আর সাথে শখ থাকলে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে থাকেন। ভ্রমণ পিপাসুদের মাঝে কেউ যদি লন্ডন গিয়ে থাকেন, তবে তার অবশ্যই বিগ বেন সম্পর্কে ধারণা থাকার কথা। বিশালাকৃতির এই ক্লক টাওয়ারটি লন্ডনের অন্যতম সেরা আইকন। আসলে টাওয়ারটির আসল নাম কিন্তু এলিজাবেথ টাওয়ার।

ঘড়ির মাঝে যে লোহার ফ্রেম রয়েছে তার ব্যস ২৩ ফুট। তার উপর রয়েছে ৩১২টি ওপাল গ্লাস। ঘড়ির চারপাশের রং সোনালি বর্ণের। কেউ কি আইডিয়া করতে পারেন যে, ঘড়িটির পেন্ডুলামের ওজন আনুমানিক কত হতে পারে? কী, পারলেন না তো? পেন্ডুলামের ওজন ৩১০ কেজি। নির্ভুল সময় পেতে হলে ৪.১ মিটারের ঘড়ির কাঁটাটিকে বছরে দৌঁড়াতে হয় ১৯০ কিলোমিটার। প্রতি এক ঘন্টা অন্তর অন্তর বেজে ওঠে ঘড়ির বেল। সম্পূর্ণ টাওয়ারটি বিগ বেন নামে যদিও পরিচিত, কিন্তু আসলে ভেতরের বিরাট বেল্টটির নামই বিগ বেন। ঘড়িটির নিচে লেখা রয়েছে, “ঈশ্বর, আমাদের মহারানি ভিক্টোরিয়াকে রক্ষা করুন”।

টাওয়ার অফ ওয়াইন্ডস

টাওয়ার অফ ওয়াইন্ডস, এথেন্স

পৃথিবীর অন্যতম পুরনো ও জনপ্রিয় ঘড়ি এথেন্সের টাওয়ার অফ ওয়াইন্ডস। মার্বেল নির্মিত ৪০ ফুট লম্বা এই টাওয়ারটির বর্তমানেও অস্তিত্ব রয়েছে সাবলীলভাবে। জলের মাধ্যমে বিশেষভাবে চালানো হতো এই ঘড়ি। সেজন্যেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ঘড়িটি সর্বত্র পরিচিতি রয়েছে ওয়াটার ক্লক নামে। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সূর্যঘড়ির পরেই ওয়াটার ক্লকের আবির্ভাব। অবশ্য এই টাওয়ারের উপরেও একটি সূর্যঘড়ি রয়েছে।

জ্যটগ্লগ ক্লক টাওয়ার; বার্ন, সুইজারল্যান্ড

জ্যটগ্লগ ক্লক টাওয়ার; বার্ন, সুইজারল্যান্ড

বিশ্বের প্রাচীন ঘড়ির মধ্যে সুইজারল্যানন্ডের বার্নে অবস্থিত জ্যটগ্লগ ক্লক টাওয়ার অন্যতম। এই সুন্দর মধ্যযুগীয় টাওয়ার ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল। টাওয়ারের ঘড়িটি মূলত পঞ্চদশ শতকের একটি জ্যোতির্বিদ্যাঘড়ি। ইউনেস্কো বার্নকে ঐতিহ্যবাহী স্থান ঘোষণা করার পর থেকে টাওয়ারটি বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। বর্তমানে স্থানটি  জনপ্রিয় পর্যটন স্পট।

সেভিয়র টাওয়ার; মস্কো, রাশিয়া

সেভিয়র টাওয়ার, মস্কো, রাশিয়া

এই ঐতিহাসিক ঘড়িটি বিখ্যাত রেড স্কোয়ারে সেইন্ট বাসিলের কাছাকাছি অবস্থিত। এই বিশাল ঘড়িটি ১৪৯১ সালে ডিজাইন করা হয় এবং ঘড়িটি স্থাপিত হয় ১৬২৫ সালে। এই ঘড়িটি মস্কো শহরের অন্যতম আকর্ষণ। দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটকেই এলাকাটির সাথে ঘড়িটিও দেখতে আসেন।

প্রাগ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক; প্রাগ, চেক প্রজাতন্ত্র

প্রাগ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক, প্রাগ, চেক প্রজাতন্ত্র

এই ক্লক টাওয়ারটি অবস্থিত প্রাগের জনবহুল ওল্ড টাউন স্কোয়ারে। ঘড়িটির নির্মাণকাজ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। ১৮৬৫ সালে ঘড়ির নির্মাণ কাজ শেষ হয়। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘড়িটির অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই যুদ্ধ সমাপ্তির পরেই প্রধান প্রধান ক্ষতিগ্রস্থ অংশগুলো পুনঃনির্মাণ করা হয়। এই ঘড়ির প্রধান বিশেষত্ব হলো, প্রাচীন বোহেমেনিয়ান সময় অনুযায়ী ঘড়ির সময় চলে, অর্থাৎ সময়ের শুরুটা হয় মূলত সূর্যাস্তের পরে এবং সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়কে ১২ ঘন্টা ধরে সময় পরিমাপ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ঘড়ির নিম্নাংশে একটি ক্যালেন্ডারও যুক্ত রয়েছে বৈকি!

পিস টাওয়ার; ওটোয়া, কানাডা

পিস টাওয়ার; ওটোয়া, কানাডা

ক্লক টাওয়ারটি কানাডার ওটোয়া শহরের কেন্দ্রস্থলে কানাডিয়ান পার্লামেন্টেরিয়ান কমপ্লেক্সে অবস্থিত। বিজয় এবং শান্তির প্রতীক হিসেবে টাওয়ারটি তৈরি করা হয় যা ৩০২ ফুট লম্বা। ১৯১৬ সালে পিস টাওয়ারে আগুন লাগার কারণে ঘড়িটি ভিক্টোরিয়া টাওয়ারে স্থাপন করা হয়। কানাডার প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে এই ঘড়িটি ১৮০ ফুট উঁচু ভিক্টোরিয়া টাওয়ারে রাখা আছে।

শিবপুর ক্লক টাওয়ার, কলকাতা

শিবপুরের ক্লক টাওয়ার

১৯১২ সালে নির্মিত এই টাওয়ারটি চালানো হয় জলের সাহায্যে। ঘড়িটি হাওড়া জেলার শিবপুরের বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র ক্যাম্পাসে অবস্থিত। শতবর্ষ প্রাচীন এই ঘড়িটি আজ পর্যন্ত নির্ভুল সময়ের হিসেব দিয়ে যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র

১) ba-bamail.com/content.aspx?emailid=19401

২) 10mosttoday.com/10-most-famous-clock-towers-in-the-world/

৩) wonderslist.com/10-magnificent-clock-towers-around-the-world/

৪) en.wikipedia.org/wiki/Tower_of_the_Winds

Related Articles

Exit mobile version