পার্বত্য চট্টগ্রামের আকাশ বরাবরের মতোই মনোমুগ্ধকর। একগুচ্ছ শুভ্র মেঘের ভেলা যেন দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করে নীল আকাশের সৌন্দর্য। নীল আকাশের বুকে গুচ্ছাকারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মেঘগুলোর ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়া সূর্যরশ্মি যেন নতুন সময়ের জানান দিচ্ছে। রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ পাড়ি দিতে দিতে এক ঝলক রোদ-মেঘ আর পানির কলকল ধ্বনি আমাকে প্রকৃতির কোলে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তেই একদিনের সফর সম্ভব, যদি আপনি দৃঢ়-প্রত্যয়ীদের তালিকায় থাকেন। পর্যটন নগরীর সিংহভাগ সৌন্দর্য এক নিমেষেই রোমাঞ্চ সহকারে আদায় করে নেওয়া সম্ভব শুধুমাত্র একটি ঝটিকা সফরে। পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী, ৩ ভাগ জল আর ১ ভাগ স্থল। কাপ্তাই হ্রদে ৫ ঘণ্টা ভ্রমণ আমাকে ভাবতে বাধ্য করেছে, রাঙামাটি ৩.৫ ভাগ জল আর বাকি অংশ স্থল। মানচিত্রের হিসেবে আয়তনের দিকে রাঙামাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জেলা। এই জেলার অলিতে-গলিতে তাই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যাদের নেশা ধরে যায়, তাদের জন্যই মূলত রাঙামাটি।
চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে মাত্র ১২০ টাকার টিকেটে রাঙামাটি পৌঁছানো সম্ভব। রাঙামাটিগামী পাহাড়িকা বাস আপনাকে যথেষ্ট ভালো সেবাই প্রদান করবে, কাঙ্ক্ষিত সেবা বললেও ভুল হবে না। খুব ভোরে রওনা হলে দু’ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে রাঙামাটি পৌঁছানো সম্ভব। আমাদের দু-ঘণ্টারও কম সময় লেগেছিল। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা দুর্গম পথে বাসে ভয়ংকর সব মোড় ঘোরানো দৃশ্য আপনাকে আতঙ্কিত করে তুলবে। অথচ এই আতঙ্কের মাঝেই লুকিয়ে থাকবে রোমাঞ্চ! এ আতঙ্কের মাঝেই সুখ। আপনি যেখানেই ঘুরতে যান না কেন! রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার বা পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এক জায়গায় নেমে গেলেই চলবে। আমরা পুরাতন বাসস্ট্যান্ডেই নেমেছিলাম।
রাঙামাটি মফস্বল তথা ছিমছাম ধাঁচের সাজানো-গোছানো শান্ত শহর। কোনো প্রকার অধিক মানুষের আনাগোনা নেই। যতদূর চোখ যাবে, শুধু নীরবতা আর নীরবতা। পাখির ডাকও খুব স্পষ্ট, এখানে কানে এসে পৌঁছায়। রাঙামাটির মানুষগুলোর চোখে-মুখে সরলতা ফুটে ওঠে। রাঙামাটি পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের পরের গন্তব্য তবলছড়ি ঘাটে। সেখানে আমাদের ট্রলার ঠিক করা রয়েছে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড থেকে তবলছড়ি যেতে জনপ্রতি সিএনজি ভাড়া মাত্র ১০ টাকা। তবলছড়ি ঘাট থেকেই আমাদের শুভলং যাত্রা শুরু হবে পাহাড়ে ঘেরা কাপ্তাই হ্রদের উপর দিয়ে। আমাদের জন্য আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছেন ট্রলারের মাঝি গফুর ভাই।
তবলছড়ি ঘাটে পৌঁছানোর পর গফুর ভাইকে দেখে আমি অনেকখানি অবাক হয়েছি। আবহমান বাংলায় মাঝি বলতে আমরা বুঝি মাথায় বা কোমরে গামছা পেঁচিয়ে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে তীরের দিকে এগিয়ে চলা এক সৈনিক। তবে গফুর ভাই একেবারে অন্যরকম। আবহমান বাংলার মাঝি বলতে আমরা যা বুঝি, গফুর ভাই তার ঠিক উল্টো। তাকে ‘ট্রলারের পাইলট’ ভাবাই আমার কাছে বেশি মানানসই লাগছিল। আমার এ মন্তব্যের সাথে আমার বাকি ছয় ভ্রমণসঙ্গীও একমত হবেন আশা করি।
কোনো ভ্রমণে মূল সফর শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত আপনার মাঝে আতঙ্ক কাজ করা শুরু করবে, বিশেষত যখন আপনি নিজেই এই ভ্রমণের আয়োজকের ভূমিকায়। তবলছড়ি ঘাট থেকে ট্রলার ছাড়ার ৮-১০ মিনিটের মধ্যেই আমাদের প্রতি মিনিটেই টাকা উসুল হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে।
মূলত কাপ্তাই হ্রদের সৌন্দর্য কিংবা ট্রলারে চড়ে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর মুহূর্তগুলো ব্যাখ্যায় পুরোপুরি উপলব্ধি করানো অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। শুভলংয়ের পথে পথে কাপ্তাই হ্রদ তার রূপ পরিবর্তন করেছে বহুবার। কখনো আকাশের রঙের সাথে মিশে একাকার হয়ে নীল বর্ণে রূপ নিয়েছে। কখনো বা চারপাশ ঘিরে রাখা পাহাড়ের রঙে সবুজ হয়েছে। হ্রদের তীরে পাহাড়ের পাদদেশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা পার হওয়ার সময় আবার পানি ঘোলাটে হয়ে আমাদের গ্রামীণ পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ট্রলার যত ধীরে ধীরে এগোবে, ততই আপনার আগ্রহ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বিশাল ট্রলারে মাত্র সাতজন মানুষ। আমরা যে যার মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাপ্তাই হ্রদের স্নিগ্ধ পরিবেশ উপভোগ করছিলাম। স্মৃতি সংরক্ষণার্থে মোবাইল ক্যামেরা তো সর্বদা সচল ছিল।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েকের মতো ভ্রমণ শেষে আমরা বড় শুভলং ঝর্ণায় পৌঁছালাম। জনপ্রতি ১৫ টাকা করে টিকেট কেটে ভেতরে প্রবেশের পর আমাদের প্রথম ধারণাই ছিল, “শুভলং আসলেই অনেক লং”। উপর থেকে দীর্ঘ একটা পথ পাড়ি দিয়ে শুভলংয়ের পানি নিচে এসে আছড়ে পড়ে। ঝুঁকি নিয়ে মানুষ এ ঝর্ণার উপরেও পৌঁছে যায়। ঝুঁকি না নিলে ভ্রমণের মূল আনন্দ লাভ করাও অনেকাংশে অসম্ভব। ঝর্ণার ব্যাপারে আমার পূর্ব অভিজ্ঞতানুযায়ী শুভলং কিছুটা ব্যতিক্রমী ঝর্ণা। অনেক উপর থেকে এর ধারা প্রবাহিত হলেও মাঝের অংশে দীর্ঘ একটা পথ এর জলধারা পাথরের সাথে কোনোপ্রকার সংঘর্ষ ছাড়াই নিচে নেমে আসে। এই ছোট্ট একটি বিষয় শুভলং ঝর্ণাকে অন্যান্য ঝর্ণার কাছ থেকে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দেয় আমার কাছে। শুভলংয়ের পরিবেশ কিছুটা কক্সবাজারের হিমছড়ির মতোই। এখানেও আপনাকে কিছুটা সিঁড়ি বাইতে হবে। তবে হিমছড়ির তুলনায় অনেক সীমিত।
শুভলংয়ে বড় ঝর্ণায় সময় কাটিয়ে ছোট ঝর্ণায় যাওয়ার পথে গল্পে গল্পে সময় পার করছিলাম। বার বার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছিলাম এই ভেবে যে, শুক্রবার হলেও মানুষের চাপ বেশ কম ছিল। অধিক মানুষের ভিড়ে ভ্রমণের আনন্দ মাটি হয়ে যায়। ছোট শুভলং ঝর্ণায় পোঁছানোর পর জায়গার সংকুলান কিছুটা বাধা সৃষ্টি করেছে প্রথমদিকের উপভোগে। কিছুটা সময় পার হওয়ার পর নিজেরাই স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলাম ছোট শুভলংয়ে। ছোট শুভলংয়ের হিমশীতল পানি শারীরিক ও মানসিক অবসাদ দূর করার মহৌষধ হিসেবে কাজ করেছে আমার জন্য, তাই ছোট শুভলং ছেড়ে আসতে চাচ্ছিলাম না।
দুপুরের সূর্য ধীরে ধীরে হেলতে শুরু করেছে। আমাদের যাত্রাও তাই পাহাড়ের বুকে স্থাপিত তাইন্নবি রেস্তোরাঁয়। বাঙালিদের হোটেল হলেও পাহাড়িদের সম্মানার্থে এই নাম রাখা হয়েছে। রাঙামাটির সনাতনী দুপুরের খাবার প্রথম দর্শনেই মানসিক শান্তি প্রদান করবে। খাবার পরিবেশনের নিয়ম, চাকচিক্য, রাজকীয় ভাব; ডালের মাঝেও পাবেন আপনি কাপ্তাই হ্রদের সুমিষ্ট ঘ্রাণ। ২৮০ টাকা দামের এই দুপুরের খাবারকে সুখের উপঢৌকন বললেও ভুল হবে না। মূলত কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয় বিশেষায়িত করার ক্ষেত্রে এই খাবারকে। রাঙামাটির সনাতনী ব্যাম্বো চিকেনও এই খাবারের অন্যতম অংশ। এভাবে প্রতি মূহূর্তেই আপনি রাঙামাটির প্রেমে হাবুডুবু খেতে বাধ্য।
কাপ্তাই হ্রদে ভ্রমণের সময় পাহাড়ের বুকে সবুজ দৃশ্য অনেকখানি ভিন্নতার ছোঁয়া দিয়ে যায়। কখনো মনে হতে পারে, পাহাড়ের নিচের অংশ গাঢ় সবুজ, আবার মনে হবে উপরের অংশ হলুদাভ সবুজ। এটি মূলত রোদের খেলা। তবে এই খেলাই আপনাকে বাধ্য করবে রাঙামাটির প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে বার বার ভাবতে। পানিপথে লাফ দিয়ে সাঁতার কাটার আগ্রহ কার না জন্মায়! তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে মাঝিরা বা স্থানীয় প্রশাসন সাধারণত নিষেধ করে থাকে হ্রদের পানিতে নামতে। হ্রদের বুকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মাছ চাষের জন্য ভাড়াও দেওয়া হয়। বিশাল হ্রদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে মাছ চাষের জন্য আলাদাকৃত স্থানসমূহ সুনিপুণভাবে সাজিয়ে আলাদা করা হয়েছে।
ট্রলারের ছাদের উপর মাথা রেখে পা ছড়িয়ে শুয়ে নীল আকাশের বিশালতা মাপতে মাপতে পলওয়েল পার্কের সীমানা পার হচ্ছিলাম। রাঙামাটির চমৎকার এই স্থানটি বাইরে থেকে দেখেই ধারণা করে নেওয়া যায়, কতটা সাজানো গোছানো এই পার্কটি। পার্কের আকর্ষণীয় জায়গাটি লাভ পয়েন্ট, যেখানে কিনা ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে তালা মেরে যায় প্রেমিক যুগলরা। পলওয়েল পার্ক মূলত রিসোর্ট হলেও আবহমান বাংলার সংস্কৃতিও এখানে তুলে ধরা হয়েছে বিভিন্ন ভাস্কর্য স্থাপনের মাধ্যমে। হ্রদের তীরে রিসোর্টের ছোট ছোট কটেজের বারান্দায় বসে এক কাপ কফি হাতে মধুচন্দ্রিমার সময়গুলো পার করে নবদম্পতিরা।
পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইন্টারনেটে যে স্থানের ছবিগুলো দিয়ে আলাদা করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো ঝুলন্ত ব্রিজ। অনেকাংশে এই একটিমাত্র জায়গার ছবিই রাঙামাটিকে সবার কাছে পরিচিত করিয়ে দেয়। এখানে প্রবেশমূল্য তথা টিকেটের খরচ পড়বে ৩০ টাকা। ঝুলন্ত ব্রিজের খ্যাতি দেশ জুড়ে বিস্তৃত। তবে রাঙামাটির অন্যান্য দর্শনীয় স্থানের তুলনায় ঝুলন্ত ব্রিজ কিছুটা পিছিয়ে। এখানেও শুভলংয়ের মতো সিঁড়ি মাড়িয়ে মূল জায়গায় পৌঁছাতে হয়। হিমছড়ির যে বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছিলাম, এখানেও একেবারে সেটাই। ঝুলন্ত ব্রিজে পর্যটকদের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
ঝুলন্ত ব্রিজের মূল স্থান থেকেও সিঁড়ি মাড়িয়ে উপরের স্থানে পৌঁছানোর পর পাহাড়ের উপর থেকে আকাশ ও কাপ্তাই হ্রদ মিলেমিশে একাকার হবার দৃশ্য আপনার দৃষ্টি জুড়িয়ে দেবে। ভ্রমণের সকল ক্লান্তি সেখানেই শেষ হবে। ঝুলন্ত ব্রিজ পারিবারিক সফরের জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা। এখানে শিশুদের পাশে বসিয়ে মায়েরা দোলনায় দোল খায় প্রতিনিয়ত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অলংকারের দোকানে খদ্দেররা ভিড় জমায়। সিমেন্টের তৈরি সোফাগুলোয় গুলোতে বসে জম্পেশ আড্ডা দেওয়া যায় হ্রদের সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে।
ভ্রমণে আপনাকে এখানে এসেই ইতি টানতে হবে। তাহলে আপনি কিছুটা অবকাশ যাপনের সময় পাবেন বাড়তি। সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে ঝুলন্ত ব্রিজের পাহাড়ের অংশে অবশ্যই জম্পেশ আড্ডা জরুরি সিমেন্টের সোফাগুলোয় গা এলিয়ে দিয়ে। বাংলাদেশকে নদীমাতৃক দেশ বলা হয়; আর রাঙামাটিকে বলতে হবে লেকমাতৃক কিংবা হ্রদমাতৃক জেলা।
ভ্রমণে আপনি অবশ্যই পরিবেশের প্রতি দায়িত্বশীল কিংবা সচেতন হওয়া জরুরি। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ছুঁড়ে ফেলা থেকে বিরত থাকবেন। অবশ্যই আপনার ভ্রমণ সঙ্গীদেরও এমন কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখবেন। পর্যটন নগরীকে ভালোবাসবেন, দিনশেষে পর্যটন নগরীও আপনাকে দু-হাত ঢেলে তার সর্বোচ্চ উজাড় করে দেবে। গফুর ভাইকেও সেখানেই বিদায় দিয়েছিলাম আমরা। তার আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ। দিনশেষে ট্রলারে আমাদের খরচ পড়েছিলো ১,৫০০ টাকা।
ঝুলন্ত ব্রিজ দর্শন শেষে এবার আমাদের বাড়ি ফেরার পালা। সিএনজি করে রাঙামাটি শহরের বনরূপায় চট্টগ্রামগামী পাহাড়িকার কাউন্টারে পৌঁছাই আমরা। ব্রিজ থেকে সিএনজি ভাড়া নিয়েছিলো ১২০ টাকা। সন্ধ্যা পরবর্তী বাসের টিকিট কেটে বিশ্রাম নিতে নিতে স্মৃতিতে ঘোরপাক খাচ্ছিল রাঙামাটির সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। প্রকৃতির কাছে এভাবেই মানুষ বার বার হারিয়ে যায়, হেরে যায় মানুষের অহংকার। হারিয়ে যায় মানুষের অবসাদ, মানসিক সকল ক্লান্তি ও অপবিত্রতা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের পথে বাসে বসে আক্ষেপ হচ্ছিল,
“কাপ্তাই হ্রদে ট্রলারের ছাদে শুয়ে একটা জোছনাবিলাসের সুযোগ কেন তৈরি হলো না ?”