উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে যাত্রা: পূর্বপ্রস্তুতি এবং অতঃপর

জুন মাস শেষ হলো বলে, ইতোমধ্যে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদনকারীদের বেশিরভাগই তাদের ভর্তির আবেদনের ফলাফল পেয়ে গিয়েছেন। অনেকে হয়ত এর মধ্যে ভিসাও পেয়ে গিয়েছেন। যারা এখনও ভিসা পাননি তারাও হয়ত কিছুদিনের মাঝেই ভিসা পেয়ে যাবেন নিজের কাংখিত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ও গবেষণা করতে যাওয়ার জন্য। অনেকেই হয়ত এর মাঝেই নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে দিয়েছেন। যারা শুরু করে দিয়েছেন কিংবা করতে যাচ্ছেন তাদের সবার জন্যই এই লেখা।

এয়ার টিকেট কনফার্মেশন

বিশ্ববিদ্যালয়গুলার ফল (Fall) সেশনের ক্লাশ সাধারণত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগস্টের মাঝামাঝি কিংবা কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয়। তাই এ সময়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রচুর চাপ থাকে আর এয়ারলাইন্সগুলোর জন্য পিক সিজন। তাই এই সময়ে টিকিটের দামও থাকে চড়া। কাজেই আপনি যেদিনই ভিসা পাবেন, আপনার উচিত সেদিনই টিকিট বুকিং দেয়া।

ট্রাভেল এজেন্টের কাছে টিকিট বুকিং দেয়ার আগে সবচেয়ে ভাল হয় অনলাইন থেকে দাম দেখে নেয়া। তাহলে তাদের সাথে টিকিটের দাম নিয়ে দরাদরি করতে সুবিধা হবে। বাইরে যাওয়ার আগে দুর্দিনের বাজারে আশি টাকা মানেই এক ডলার, তাই টিকিটের দাম যদি এক হাজার টাকাও কমানো যায়, তাতেও দশ ডলার বেঁচে যায়। তবে সবচেয়ে ভালো হয় বাইরের দেশে যদি আপনার পরিচিত কেউ থেকে থাকে। তাহলে তাকেও অনুরোধ করতে পারেন তার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আপনাকে একটি টিকিট কেটে দেয়ার জন্য। তাতে অহেতুক এক ট্রাভেল এজেন্সি থেকে অন্য ট্রাভেল এজেন্সিতে ঘোরাঘুরি করার সময় এবং শ্রম দুটোই বেঁচে যাবে।

Source: 123RF

শপিং

শপিংয়ের লিস্টটা আসলে দেশভেদে ভিন্ন। আপনি যে দেশে উচ্চ শিক্ষার্থে যাচ্ছেন, সবার আগে weather.com থেকে সেই দেশের, সেই শহরের এবং আশেপাশের শহরের ফল, স্প্রিং এবং সামারের সময়কালের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দেখে নিন। তারপর সেই অনুযায়ী জামাকাপড় কিনুন। আর যদি তা না দেখে কেনেন, তাহলে দেখা যাবে ইউএসএর টেক্সাসে থাকা আপনার বন্ধুর “শীত নেই, শীত নেই” কথা শুনে এক গাদা টি শার্ট আর পাতলা দুটো জ্যাকেট কিনে গেলেন মিনিয়াপোলিসে, যেখানে শীতের সময়ে তাপমাত্রা থাকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছে। তখন আপনাকে আবার কতগুলো ডলার খরচ করে শীতের মোটা মোটা জ্যাকেট কিনতে হবে। লিঙ্গভেদে যেহেতু ছেলে-মেয়ের শপিংয়ের ধরণ আলাদা, তাই এই লেখায় শুধু কমন কিছু আইটেমের কথা লিখা হলো।

১) শীতকালীন জ্যাকেট

বাংলাদেশ থেকে গেলে যেকোনো দেশে প্রথম শীতকালটা কাটানো বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। দেখা যায়, যখন আপনার ক্যাম্পাসে মানুষজন সাধারণ জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন আপনি হয়তো হুডি কিংবা পাতলা জ্যাকেট পরে ঘুরছেন। আর যখন দেখবেন তারা ক্যাম্পাসে শীতকালীন জ্যাকেট পরে ঘুরছে, তখন শীতের অত্যাচারে আপনার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। তাই খুব ঠান্ডার জায়গায় গেলে রীতিমতো আপনাকে বস্তা কিনে নিয়ে যেতে হবে, এবং এই বস্তা টাইপ জ্যাকেটের জন্য সবচেয়ে দুর্দান্ত জায়গা হলো বঙ্গবাজারের দ্বিতীয় তলা আর এরপরে নিউমার্কেট। তবে যেখান থেকেই কিনুন না কেন, আপনাকে বেশ ভাল দরদাম করেই কিনতে হবে। দেখে কেনার দায়িত্ব পুরাপুরি আপনার। তবে যে জ্যাকেটই কিনুন না কেন, দেখে নেবেন যাতে সাথে টুপি কিংবা হুড সংযুক্ত থাকে। আর অবশ্যই দুই পিস কিনবেন।

২) হুডি – সামার জ্যাকেট

এগুলো হলো কম ঠান্ডার সঙ্গী। অবশ্য বাইরের দেশে কম ঠান্ডা মানে আমাদের দেশের শীতকাল। আর মাঝে মাঝে সামারেও এমন বৃষ্টি হয় যে, সেই বৃষ্টিও এদেশের শীত নামিয়ে দেয়। কাজেই এ জিনিসও কেনা লাগবে। অন্তত চার থেকে ছয়টি কেনা ভালো।

Source: AliExpress

৩) থার্মাল ইনার

কানাডার মতো জায়গা, যেখানে শীত মানেই মাইনাস ত্রিশ-চল্লিশ, সেখানে এটি অবশ্যই লাগবে। জামা-কাপড়ের নীচে পরা লাগে, তাতে ঠান্ডাটা সরাসরি গায়ে লাগে না। তবে দেশি থার্মাল ইনার ভালো হয় না, এটা একটা সমস্যা। পরার কিছুদিন পরেই দেখা যাবে এদিক-সেদিক দিয়ে সেলাই খুলে গেছে। কাজেই এই জিনিস বেশি কেনার দরকার নেই। দুই সেট কিনলেই চলবে। কোনোভাবে এক শীত পার করলে আবহাওয়ার সাথে একবার এডজাস্ট করে নিলে আসলেই আর পরার প্রয়োজন হয় না। আর চাইলে পরে অফসিজনে অনলাইনে ডিসকাউন্টে কেনা যায়, সস্তায় টেকসই জিনিস।

৪) কানটুপি, মাফলার ও হাত মোজা

টনসিলের সমস্যা না থাকলে মাফলার কেনার দরকার নেই। তবে কানটুপি এবং হাত মোজা অবশ্যই কিনতে হবে। অত্যধিক দাম দিয়ে বাংলাদেশ থেকে চামড়ার হাত মোজা কেনার মানে নেই। আর কিনলেও তা অরিজিনাল লেদার যে হবে তার গ্যারান্টি নেই। উলের হাত মোজা দিয়েই কাজ চলবে। ছোটখাট জিনিস এগুলো বেশি হারায়। তাই কানটুপি তিন-চারটা আর হাত মোজা তিন-চার জোড়া কিনে আনা ভালো।

৫) জিন্স প্যান্ট

যারা জিন্স প্যান্ট পরতে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না, তারা এখন থেকে শোয়ার সময়েও জিন্স প্যান্ট পরে ঘুমানোর অভ্যাস করুন। কারণ এই জিনিস ছাড়া কোনো গতি নেই। জিন্সের সুবিধা অনেক। নিয়মিত ধোয়ার ঝামেলা নেই, ইস্ত্রি করার ঝামেলা নেই, ঠান্ডা প্রতিরোধক– একের ভেতর তিন সুবিধা। কাজেই জিন্স পরার অভ্যাস না থাকলে অভ্যাস করুন। এ জিনিস একটু ভাল জায়গা থেকে দেখে-শুনে কেনেন, যাতে ফিটিং ভাল হয় আর এক ওয়াশে রঙ চলে না যায়। বাংলাদেশে যেসব জিন্স পাওয়া যায় তা বাংলাদেশের তাপমাত্রার সাপেক্ষে বানানো, কাজেই পারলে একটু মোটা কাপড়ের জিন্স হলে ভাল হয়।

Source: maristpoll.marist.edu

৬) টি-শার্ট

সস্তায় টি শার্ট কেনার সবচেয়ে ভালো জায়গা নিউমার্কেট আর ঢাকা কলেজের উল্টো পাশের রাস্তার উপরে। একটু বিকেল করে গেলে আর ভাল দামাদামি করতে পারলে সস্তায় অনেক টি-শার্ট কেনা যায়। এই টি শার্ট দিয়ে পুরা একটা লাগেজ ভর্তি করা যায়, অন্তত বিশটি টি-শার্ট কিনা উচিত। মার্কেটভেদে টি-শার্টের দাম এবং কোয়ালিটি ভিন্ন ভিন্ন। তাই নিজের বাজেটের দিকে তাকিয়ে মার্কেট পছন্দ করুন।

৭) ফরমাল শার্ট-প্যান্ট

কনফারেন্সে যাওয়া, পোস্টার প্রেজেন্ট করা, পেপার প্রেজেন্ট করা- এগুলো একজন গ্রাজুয়েট ছাত্র-ছাত্রীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর এসব জায়গায় আপনি টি-শার্ট আর জিন্স পরে যেতে পারবেন না। আপনার গবেষণা শুরু হওয়ার এক বছরের মাথায় আপনার প্রফেসর আপনাকে কোনো না কোনো কনফারেন্সে পাঠাবে পোস্টার কিংবা ওরাল প্রেজেন্টেশনের জন্য। এছাড়া প্রতি সেমিস্টারের ক্যারিয়ার ফেয়ার তো আছেই। এসব জায়গায় যেতে হলে ফরমাল ড্রেস লাগবে। তাই অন্তত দুই সেট ফরমাল কাপড় কেনা উচিত।

৮) কমপ্লিট স্যুট

আগে থেকে বানানো থাকলে নিয়ে যাওয়া যায়, নইলে দেশ ছাড়ার সময় তাড়াহুড়ো করে বানানোর দরকার নেই। আমার দেখা অভিজ্ঞতা বলে, দেশি অনেক জায়গাতেই ভালোভাবে এগুলো বানাতে পারে না। আর যেখানে ভালোভাবে বানায়, সেখানে সার্ভিস চার্জ অত্যধিক বেশী। এর চেয়ে ক্রিস্টমাসের সময়ে যখন ডিসকাউন্ট চলে মলগুলোতে, তখন অনেক কম দামে ১২০-১৫০ ডলারে ভাল দেখে একটি কমপ্লিট স্যুট কেনা যায়।

Source: Paul Costelloe Man

৯) কেডস–ফরমাল শু

কেডস–ফরমাল শু না থাকলে নতুন করে কেনার দরকার নেই। শুধু প্রাথমিকভাবে কাজ চালানোর জন্য এক জোড়া কিনে আনা যায়। বাইরে ক্রিস্টমাসের সময়ে ডিসকাউন্টে বেশ সস্তায় কেডস পাওয়া যায়। একশ ডলারের পুমার কেডস পঞ্চাশেও পাওয়া যায়; নাইকি, এডিডাস ষাট ডলারে আমি কিনতে দেখছি। মাঝে মাঝে ক্লিয়ারেন্স সেল থাকে। তখন ষাট ডলারের জুতা ত্রিশ ডলারেও পাওয়া যায়। অনেকে আবার দোকানে গিয়ে জুতার মাপ নিয়ে অনলাইনে ভাল ডিল দেখে অর্ডার দেয়, এভাবেও চাইলে জুতা কেনা যায়।

১০) স্যান্ডেল

 এক থেকে দুই জোড়া, বাইরে মনে হয় খুব বেশি পরাও হবে না। কারণ ল্যাবে কখনোই স্যান্ডেল পরে যাওয়া যায় না। তাই দিনের বেশিরভাগ সময়েই আপনারে কেডস পরে কাটাতে হবে। তাই স্যান্ডেল দেখা যাবে পরলে ঘরেই পরা হয়। শুধু ঘরে পরার জন্য এক-দুই জোড়া কিনলেই হবে।

১১) ঘরের পোশাক

এটা যার যার পছন্দ। তবে এই লিস্টে ট্রাউজার, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট থাকা উচিত। বাইরে ট্রাউজার আর থ্রি কোয়ার্টারের দাম অনেক বেশি। এটা যার যার সুবিধামতো হিসেব করে কেনা উচিত। আর এছাড়া আছে বিছানার চাদর, বালিশের কভার এসব। এগুলো দুই থেকে চার সেট আনলেই চলবে।

১২) লাগেজ–হ্যান্ড লাগেজ-ব্যাকপ্যাক 

লাগেজ কেনার আগে যে এয়ার লাইন্সে যাচ্ছেন তাদের ওয়েবসাইট থেকে লাগেজের সাইজ দেখে নিন। লাগেজ কেনার পূর্বশর্ত– লাগেজের চাকা আর হ্যান্ডেল অবশ্যই অবশ্যই ভাল মানের হওয়া চাই। লাগেজ ছিড়ে গেলে যাক, কিন্তু যাতে চাকা খুলে না যায় আর হ্যান্ডেলও ভেঙে না যায়।

Source: Wired

আর ব্যাকপ্যাক যেটাই কেনেন না কেন, তাতে যাতে ল্যাপটপ বহন করার কম্পার্টমেন্ট থাকে এবং ওয়াটারপ্রুফ হয়। আর সাইজে একটু বড় হলে ভাল হয়, যাতে আশেপাশে কোথাও শর্ট ট্যুর দিলে ব্যাকপ্যাকে জামাকাপড় ভরে নিয়ে যাওয়া যায়। তবে ব্যাকপ্যাক কেনার সময় দেখে নেবেন ল্যাপটপ যে কম্পার্টমেন্টে রাখবেন সেটা যাতে প্যাডেড হয়। তাতে যদি দুর্ঘটনাবশত ব্যাকপ্যাক মাটিতে পড়ে যায়, ল্যাপটপ ক্ষতি কম হবে।

১৩) টেকি জিনিসপাতি – ল্যাপটপ, সেল ফোন, এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ এবং ইউএসবি ড্রাইভ

এগুলোর হিসাব সহজ। নিজের কাছে আগে থাকলে নিয়ে আসুন, নইলে নতুন করে কেনার মানে নেই। ই–বে তে সারা বছরই সস্তায় এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ, ইউএসবি ড্রাইভ, মাউস কেনা যায় এবং বাংলাদেশ থেকে এগুলোর মান হাজার গুণে ভাল। ল্যাপটপ না থাকলে বেস্ট বাই কিংবা অ্যামাজন থেকে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে নিজের বাজেট বুঝে ল্যাপটপ কিনে ফেলা যায়। আর দেশি ফোন শুরুতে নিয়ে আসাই ভালো। কিছুদিন ব্যবহার করে পরে টাকা জমিয়ে একটি ভাল ফোন চাইলে আপনি কিনতে পারেন।

১৪) মশলাপাতি

মশলাপাতির জন্য লাগেজের তিন থেকে পাঁচ কেজি ওজন ছেড়ে দেয়া উচিত। বাসায় মায়ের সাথে কথা বলে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা, গরম মশলা এগুলোর পাউডার দিয়ে যাতে অন্তত ছয় মাসের রান্নার কাজ চালানো যায় সেভাবে নিয়ে আসা উচিত। তবে ফুরিয়ে গেলে চিন্তা নেই। ইন্ডিয়ান দোকানে এসব আইটেমই পাওয়া যায়, তবে ছোট শহরগুলোতে একটু ঝামেলা হয়। দোকানের সংখ্যা থাকে কম, আর দাম একটু বেশি পড়ে।

১৫) ওষুধপাতি

যদিও প্রত্যেক শিক্ষার্থীর হেলথ ইন্স্যুরেন্স থাকে, তবে তার মানে এই না এখানে চিকিৎসার সাথে ওষুধ ফ্রি। এখানের ওষুধের দাম ভয়াবহ রকমের বেশি। নরমাল কাউন্টার ড্রাগ, যেমন জ্বর, পেট ব্যথা, মাথা ব্যথা টাইপের ওষুধের দামও বেশি। তাই এই ধরনের ওষুধ কিনে আনা উচিত বেশি করে। আর কেনার সময় খেয়াল রাখা উচিত ওষুধের মেয়াদ যাতে দুই বছর অন্তত থাকে। যাদের প্রেসক্রাইবড ড্রাগ আছে, নিয়মিত সেবন করতে হয়, তাদের উচিত ডাক্তারের সাথে কথা বলে ওষুধ বেশি করে নিয়ে আসা। নইলে ওষুধ কিনত কিনতে ফকির হয়ে যেতে হবে। দেশি প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে এখানে ওষুধ কেনা যাবে না। বিনা প্রেসক্রিপশনে তো আরও না। কাজেই এসব জিনিস হিসেব করে নিয়ে আসা উচিত।

Source: Moneycontrol

১৬) অন্যান্য

এই ক্যাটাগরিতে পড়ে ব্রাশ, সাবান, শ্যাম্পু, ক্রিম এসব। এগুলো এখানেই সস্তা। এমনিতে শুরুতে সেট হতে গেলে কমপক্ষে দুইশ থেকে তিনশ ডলারের জিনিসপাতি কেনাই লাগবে। এসব আর বড়জোর দশ থেকে পনেরো ডলার হবে। শুধু শুধু লাগেজ ভারি করার মানে নেই। তার চেয়ে বেশি করে টি-শার্ট আনা ভাল। তবে কারও মাথায় নিয়মিত তেল দেয়ার অভ্যাস থাকলে নারিকেল তেল নিয়ে আসা উচিত। আর সেই সাথে চিরুনী এবং ব্রাশ। আর ছেলেরা চাইলে শেভিং কিট নিয়ে আসতে পারেন। এখান থেকেও কেনা যায়। দাম একটু বেশি হলেও কোয়ালিটি অনেক ভালো।

স্টেপলার মেশিন, পাঞ্চ মেশিন, এন্টি কাটার এই টাইপের অফিস সাপ্লাই কিনে শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করার মানে নেই। আপনার ল্যাবে এসব সাপ্লাই থাকে। তাই শুধু শুধু লাগেজ ভারি করার মানে নেই। তবে ব্যাকপ্যাকে অন্তত ডজনখানেক কলম, পেন্সিল এগুলো থাকা উচিত।

আবাসস্থল ঠিক করা

এটা সবচেয়ে ভেজালের কাজ। আপনি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন সেখানে যদি দেশি ভাই-বোন থাকে তাহলে ভালো। নাহলে সর্বনাশ। বাসা খোঁজার ব্যাপারে দেশি ভাই-বোনেরা আপনাকে সাহায্য করবে। সাধারণত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রীদের অ্যাসোসিয়েশন থাকে। আর ফেসবুকে তাদের একটি গ্রুপ থাকবেই। কাজেই ফেসবুকে সেই কাংখিত গ্রুপ খুঁজে নিয়ে জানিয়ে দিন আপনি বাসা খুঁজছেন। আর যদি একান্তই বাংলাদেশী ছাত্র-ছাত্রী না থাকে কিংবা তাদের কেউই যদি কোনো সাড়া না দেয়, তাহলে ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানী এই দুই কমিউনিটির গ্রুপ আপনি অবশ্যই পাবেন। এদের ফেসবুক গ্রুপেও আপনি পোস্ট দিতে পারেন। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরাই শেয়ার্ড এপার্টমেন্টে থাকে। আর সেমিস্টার শেষে কেউ না কেউ গ্র্যাজুয়েট করেই। তাদের জায়গায় নতুন কাউকে প্রয়োজন হয়। আবার ওদিকে নতুন কেউ আসে। সে-ও চায় শেয়ার্ড বাসা নিতে। তাই একটু খোঁজখবর রাখলেই বাসা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয় না।

আর এরপরেও ব্যবস্থা না হলে ইউনিভার্সিটির হাউজিং লিস্টে অন ক্যাম্পাস এবং অফ ক্যাম্পাসে বাসা দেখতে পারেন। তাদের সাথে যোগাযোগ করে নিজে নিজেই বাসা ঠিক করা যায়।

তবে যারা বিবাহিত, তাদের উচিত শুরুতে সিংগেল আসা। তারপর ছয় মাস পর তাদের পরিবারকে নিয়ে আসা। এর মূল কারণ হলো শুরুর দিকে নতুন বাসা, নতুন করে সবকিছু কেনা এসব করতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়। বিশেষত ফ্যামিলির জন্য সস্তায় ভাল নেইবারহুডে ভাল বাসা পাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাসার আশেপাশে বাস স্টপেজ কত দূরে, আশেপাশে কোনো সুপার শপ, গ্যাস স্টেশন কিংবা কনভেনিয়েন্ট স্টোর আছে কি না এসব দেখে বাসা ভাড়া নেয়া উচিত। এগুলো কারও সাথে কথা বলে ঠিক করা যায় না। তাই শুরুতে একলা আসাই ভাল।

টাকা-পয়সা

বাইরে গিয়ে সবচেয়ে বড় খরচগুলো হয় অগ্রীম বাসা ভাড়া এবং আবাসস্থলের প্রাথমিক সরঞ্জামাদির খরচ। কাজেই প্রথম মাসে বেশ বড় রকমের খরচ যাবে। আর আপনার টিচিং এসিস্ট্যান্ট কিংবা রিসার্চ এসিস্ট্যান্টশিপ এর স্যালারি পেতেও আপনাকে এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তাই শুরুতে বেশ ভাল অঙ্কের টাকা পকেট থেকে বের হয়ে যাবে। এসব হিসাব করে টাকা নিয়ে যাওয়া উচিত। নিয়মানুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা বহন করতে গেলে এন্ডোর্স করাতে হয়। তাই ভিসা পাওয়ার পর পর ডলার এন্ডোর্স করে নেয়া উচিত।

Source: newsweek.com

ডকুমেন্টস

যাবতীয় একাডেমিক সার্টিফিকেট, মার্কশিট, বার্থ সার্টিফিকেট ইত্যাদি যত লিগ্যাল ডকুমেন্ট আছে সবগুলোর অরিজিনাল কপি নিজের কাছে একটি ফোল্ডারে অবশ্যই রাখবেন। আর সব ডকুমেন্ট স্ক্যান করে গুগল ড্রাইভে আপলোড দিয়ে রাখবেন। সেই সাথে পাসপোর্ট আর ভিসার কপিও। যদি কোনো কারণে ডকুমেন্ট হারিয়ে যায় তাহলে যাতে সফট কপি দিয়ে কাজ চালানো যায়। অনেকে ফটোকপি করে নিয়ে আসে তিন চার সেট। এগুলো করার মানে নেই। যখন দরকার হবে তখন স্ক্যান্ড ডকুমেন্ট প্রিন্ট করে নিলেই হয়। চার থেকে আট কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি সাথে আনা উচিত, যদি কোথাও কাজে লাগে সেজন্য। অবশ্য তিন থেকে ছয় মাস পর পুরনো ছবি আর কাজে লাগবে না। কারণ সব জায়গায় একদম নতুন তোলা ছবি চায়।

তবে ব্যাচেলরের ট্রান্সক্রিপ্টের বেশ কয়েক কপি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারের কাছে থেকে সত্যায়িত করে খামে সিল দিয়ে নিয়ে আসা উচিত। মাস্টার্স শেষে যারা পিএইচডি-তে আবেদন করবেন তাদের কাজে লাগবে।

চক্ষু ও দন্ত চিকিৎসা

বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় যে হেলথ ইনস্যুরেন্স দিয়ে থাকে তাদের শিক্ষার্থীদের, তার বেশিরভাগই চোখ এবং দাঁত কভার করে না। অনেকেই আছেন যারা বাংলাদেশে বছর শেষে ঘুরতে গিয়েছেন দাঁতের ডাক্তার দেখানোর জন্য। কারণ দাঁতের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। অল্প কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, যাদের মেডিকেল স্কুল আছে, তারা হয়ত বছরে একবার তাদের শিক্ষার্থীদের জন্য চক্ষু পরীক্ষার ব্যবস্থা করে। কিন্তু চশমা নিজের টাকায় কিনতে হবে। আর একটা নন ব্র্যান্ডের চশমা কিনতে যে টাকা খরচ হবে, তা দিয়ে বাংলাদেশে দুই বাচ্চা সমেত একটি পরিবার একমাস আরামে চলতে পারবে। তাই যারা চশমা পরেন তাদের উচিত তিন থেকে চার সেট চশমা নিয়ে আসা। যাদের চোখের সমস্যা নেই তাদেরও উচিত একবার চোখ দেখানো, আর সেই সাথে দাঁত চেকআপ করানোও জরুরি। কোনো জায়গায় মাইনর ফিলিং করানোর দরকার হলে সেটা করিয়ে ফেলা উচিত। আর যাদের আগে থেকে দাঁতে সমস্যা তারা সব সমস্যা সারিয়ে প্লেনে উঠবেন, নাহলে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাড়িতে যাওয়ার টিকিট কাটা লাগবে দাঁতের ডাক্তার দেখানোর জন্য।

Source: yc-optical.com

একাডেমিক প্রস্তুতি

এই বিষয়টা নিয়ে আমি কাউকে খুব একটা বলতে দেখিনি। তবে আমার কাছে এই ধরনের প্রস্তুতি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার আসার পর থেকে প্লেনে ওঠার আগপর্যন্ত একটা বড় সময় পাওয়া যায়। অন্তত ম্যাথ আর প্রোগ্রামিং এই দুটো বিষয়ে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এই সময়ে কাজ করা উচিত।

আপনি সায়েন্স কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে সাবজেক্টেই পড়তে যান না কেন, আপনার পুরো শিক্ষা জীবনে আপনাকে ম্যাটল্যাব ব্যবহার করতেই হবে। হয় কোনো কোর্সের হোমওয়ার্ক কিংবা প্রজেক্টের জন্য, কিংবা আপনার পুরো রিসার্চই হতে পারে পুরোপুরি ম্যাটল্যাব নির্ভর। এবং ম্যাটল্যাবকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। তাই এই সময়ে আপনি ম্যাটল্যাবে প্রোগ্রামিংটা শিখে নিতে পারেন। আর সেই সাথে ম্যাথ–পিওর ম্যাথের ছেলে-মেয়ে বাদে অন্যান্য ডিপার্টমেন্টের ছেলে-মেয়েদের ম্যাথের চর্চা ওই আন্ডারগ্র্যাডের ম্যাথের পরীক্ষায় পাশ করার জন্য।

কিন্তু বাইরে আপনাকে গবেষণা করতে গেলে ম্যাথ ভালো জানা লাগবেই। অন্তত অর্ডিনারি এবং পার্শিয়াল ডিফারেন্সিয়াল ইক্যুয়েশন, ম্যাট্রিক্স ম্যানিপুলেশন, লিনিয়ার এলজেব্রা এগুলোতে ভাল হওয়া লাগবে। বিশেষ করে ম্যাটল্যাব ব্যবহার করে কীভাবে বেসিক ডিফারেন্সিয়াল ইক্যুয়েশনগুলো সমাধান করতে হয়, কীভাবে বড় বড় ম্যাট্রিক্স ম্যানিপুলেশন করতে হয় এসব জিনিস দেখে রাখা উচিত। পরে অনেক সময় বাঁচবে, নইলে প্রতিদিনের পড়া আর কাজের বাইরে অতিরিক্ত পড়াশোনা করতে গেলে রাতের ঘুম নেই হয়ে যাবে। যারা লাইফ সায়েন্স কিংবা বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের তাদের উচিত স্ট্যাটিস্টিক্সের বেসিক কনসেপ্টগুলো রিভিউ করে যাওয়া এবং স্ট্যাটিস্টিক্যাল প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ R শিখে যাওয়া।

সবশেষ, শপিং লিস্ট পুরোপুরি নির্ভর করে নিজের পছন্দ আর ক্রয়ক্ষমতার উপর। কেউ যদি এয়ারলাইন্সে এক্সট্রা লাগেজ ফি দিয়ে অনেক বেশি কিছু নিয়ে যেতে পারেন, এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক একইভাবে আপনি চাইলে দশ হাজার ডলার নিয়ে যেতে পারেন, আবার তিন হাজার ডলার নিতে পারেন প্রাথমিকভাবে নতুন জায়গায় আপনার জীবন শুরু করার জন্য। তবে যেখানে যান না কেন, মনে রাখবেন, আপনি সবার আগে আপনার দেশের একজন প্রতিনিধি। আপনাকে দিয়েই পৃথিবীর মানুষ আপনার দেশকে চিনবে।

Related Articles

Exit mobile version