২০০৭ সালের অক্টোবর মাস, চলছে আফগান স্টারের তৃতীয় সিজন। প্রায় ২ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে রয়েছেন ৩ জন নারী। তাদেরই একজন ২২ বছর বয়সী সেতারা হুসেইনজাদা। আফগানিস্তানের হেরাটের অধিবাসী সেতারাকে খোলা মনের স্বাধীন সত্ত্বা বললে বোধহয় খুব বেশি ভুল হবে না। একাকী কাবুলে বসবাসকারী এই নারী জীবনের পরোয়ানা না করে গান গেয়ে চলেছেন। তারই পথ ধরে আফগান স্টারে অংশগ্রহণ করেন তিনি। গান-বাজনা ইসলামে নিষিদ্ধ- এ কথা বলে ফতোয়া জারি করে রাখা সমাজে আফগান স্টার যেন এক বিপ্লবেরই সামিল। যেদিন আফগান স্টারের শীর্ষ দশের তালিকা থেকে বাদ পড়ে গেলেন, আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেন সেতারা। নাচের তালে তালে মাথা থেকে কাপড়ও পড়ে যায় তার, বেরিয়ে যায় খোলা চুল। তাতে একেবারে ছি ছি রব পড়ে যায় চারদিকে। তার সহশিল্পীরাও বলতে থাকেন কাজটি সেতারা ভালো করল না। এর জন্য হয়তো জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হবে তার।
প্রায় ৩০ বছর ধরে নাচ, গান, টেলিভিশন দেখা- এককথায় যাবতীয় সব বিনোদনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে আফগানদের জন্য। ১৯৭৯ সাল থেকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ, গৃহযুদ্ধ, তালেবান শাসন- একের পর এক দুঃখ-কষ্ট দেখেই বড় হয়েছে আফগানিস্তানের শিশুরা। ১৯৯৬ সাল থেকে দেশটিতে নাচা, গান গাওয়া, এমনকি টেলিভিশন দেখাকেও রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে ফেলে দেয়া হয়। সে বছরই আফগানিস্তানের শাসন চলে যায় তালেবানদের হাতে। সুন্নী ইসলামী ও পশতু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নামধারী তালেবান বা তালিবান নেতারা ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয়। আফগান রাজধানী কাবুল পরিণত হয় তাদের মূল ঘাঁটিতে। সারা দেশব্যাপী ইসলামের নামে অরাজকতা চালাতে থাকে তারা। শুধু বিনোদন কেন, নারী শিক্ষা, সর্বসাধারণের ভোটাধিকার সব কিছুই ছিনিয়ে নেয় তারা। তবুও থেমে থাকেনি আফগানিস্তানের সাহসী কিছু মানুষ।
রাতের অন্ধকারে মেয়েদের স্কুলে পাঠাত আফগানিস্তানের কতিপয় সচেতন পরিবার। সংস্কৃতির চর্চাও থেমে থাকেনি উদারমনা পরিবারগুলোতে। কিন্তু রাত গভীর হওয়ার আগেই গুটিয়ে ফেলতে হতো বেঁচে থাকার বিলাসিতার যাবতীয় চিহ্ন-প্রমাণ। প্রায় প্রতি রাতেই কোনো না কোনো বাড়িতে হানা দিত তালেবানরা। ইসলামী বই ব্যতীত অন্য কোনো বই বা গানবাজনার সামগ্রী পেলে তো কথাই নেই, সোজা গুলি করে খুলি উড়িয়ে দেয়া হতো বাড়ির কর্তার। কাজেই সারাক্ষণ তালেবানদের ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকা পরিবারগুলো ২০০১ সালে যখন স্বাধীনতার মুখ দেখল, নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন তাদের মাঝে জেগে উঠল।
সঙ্গীত নিয়ে আফগানিস্তানের এই ৩০ বছরের অন্ধকার অধ্যায়ের আগে কিন্তু রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু চিত্র। আশির দশকে কাবুলে মেয়েরা মিনিস্কার্ট পরে ঘুরত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, কনসার্টে গান গেত। তাদের ছিল আহমাদ জহিরের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তারকা, যাকে ডাকা হতো আগফান এলভিস নামে। ১৯৭৯ সালে এক রহস্যময় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান জহির।
আফগানিস্তানের ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম। রাশিয়ার দ্বিতীয় প্রধান ধর্ম ইসলাম। কাজেই সে বছর সোভিয়েতের কমিউনিস্ট সরকার আফগানিস্তানে এসে নিজেদের রাজত্ব কায়েম করার চেষ্টা করে। কিন্তু বহুবিধ বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়ে ১৯৮৯ সালে তল্পিতল্পা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয় তাদের, মাঝখান দিয়ে প্রাণ হারায় ৪০তম সোভিয়েত আর্মির প্রায় ১০ হাজার সৈন্য। তবে যতদিন আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনারা অবস্থান করছিল, ততদিন রেডিও, টেলিভিশন বেশ সক্রিয় ছিল। গান গাওয়াকে তখনো হারাম বলে ফরমান জারি করা হয়নি।
২০০১ সালে তালেবানরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে আফগানিস্তানের তরুণ প্রজন্মকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নেয় দেশটির শীর্ষস্থানীয় স্বাধীন টেলিভিশন কোম্পানি টোলো টিভি। এতদিন ধরে সঙ্গীতের প্রতি যে তৃষ্ণা সঙ্গীতপ্রেমীরা জমিয়ে রেখেছিল, তার যেন একটা সদগতি হয় এবার। ভিডিও প্লেয়ার, ক্যাসেট, ডিভিডি যেখানে যা লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, আস্তে আস্তে সব সামনে আসতে থাকে।
এরই পরিক্রমায় ২০০৭ সালে টোলো টিভি ‘পপ আইডলের’ আদলে একটি সঙ্গীত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে, যার নাম দেয়া হয় ‘আফগান স্টার’। প্রথম বছরেই প্রায় ১,০০০ প্রতিযোগী অংশ নেয় সেখানে। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়েও গান গাইতে আসে। তালেবানরা দেশের শাসনভার ছেড়ে দিলেও তাদের মানসিকতার বশবর্তী হয়ে অনেকেই মেনে নিতে পারেনি টেলিভিশনে সঙ্গীত প্রতিযোগিতার মতো এমন অধর্মকে। একেকজনের বাড়ির দেয়ালে গিয়ে মৃত্যু পরোয়ানা লিখে আসা হতো। তবে খ্যাতি আর ৫ হাজার ডলার পুরস্কারের (যা তাদের বাৎসরিক গড় আয়ের প্রায় ১০ গুণ) সামনে এই হুমকিগুলো খুব মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া স্বাধীনচেতা কণ্ঠগুলোকে রুখে দেয়া কি এতই সোজা? তা প্রমাণ করতেও এগিয়ে আসে আফগানিস্তানের প্রকৃত স্টাররা।
একদিকে বন্দুকের নল, আরেকদিকে খ্যাতি আর অর্থের আহ্বান- সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী দুই পরিস্থিতির মুখোমুখি ‘আফগান স্টার’ প্রতিযোগিতা নিয়ে তাই বহির্বিশ্বেও হইচই পড়ে যায়। ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত আফগান স্টারের তৃতীয় সিজন নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাতে এগিয়ে আসেন হাভানা মার্কিং। ডকুমেন্টারিটির নামও দেয়া হয় ‘আফগান স্টার’। প্রতিযোগিতার প্রথম তিন আসরের উপস্থাপক দাউদ সিদিকি জানান, তাদের এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করার মূল উদ্দেশ্য হলো জনগণের মন বন্দুক থেকে সঙ্গীতের দিকে ফেরানো। তালেবানদের আমলেও গোপনে তিনি বিভিন্ন তালেবান বিরোধী ভিডিও ধারণ করতেন। সে বছর আফগান স্টারের চূড়ান্ত পর্বটি দেখে প্রায় ১১ মিলিয়ন মানুষ, যা আফগান জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে আফগানীরা প্রথমবারের মতো ভোট দেয়ার আনন্দ উপভোগ করে, প্রথমবারের মতো তারা গণতন্ত্রের স্বাদ পায়।
আফগান স্টারের আলোড়ন সৃষ্টিকারী তৃতীয় আসরকে কেন্দ্র করে এক দল ব্রিটিশ চলচ্চিত্র কর্মীর সহায়তায় ডকুমেন্টারির কাজে এগিয়ে যান হাভানা। “ভাগ্য ভীষণ সহায় ছিল আমাদের,” বলেন হাভানা। চারজন প্রতিযোগীর উপর ভিত্তি করেই ডকুমেন্টারিটি বানান তিনি। “ডকুমেন্টারির কথা তখনই মাথায় এলো যখন দেখলাম এর বিস্তৃতি দিন দিন বাড়ছে। শীর্ষ দশের ভেতর দুজন নারীও আছে। কাজেই সাম্প্রদায়িকতাকে ছাপিয়ে কীভাবে সঙ্গীতের জয় হচ্ছে ,তা বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই ছিল আমার লক্ষ্য। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না”। সানডেন্স ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিশ্ব সিনেমা ক্যাটাগরিতে দর্শকপ্রিয় এবং সেরা পরিচালক দুই বিভাগে পুরষ্কার অর্জন করে ‘আফগান স্টার’ ডকুমেন্টারিটি। সিদিকি ছবির প্রিমিয়ারে অংশ নিতে সানডেন্সে যান, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনি আর ফিরে আসেননি।
ডকুমেন্টারিটি নির্মাণের সময় হাভানার সাথে ছিলেন ক্যামেরাম্যান ফিল স্টেবিং, একজন ড্রাইভার আর একজন দেহরক্ষী। “মুমতাজকে, আমাদের ড্রাইভার, এক সপ্তাহ আটকে রেখেছিল তালেবানরা। তার অপরাধ ছিল সাথে একটি মিউজিক ক্যাসেট রাখা। আফগান সঙ্গীতের সাথে সে-ই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়,” জানান হাভানা। আফগান এক কুস্তিগিরকে দেহরক্ষী হিসেবে রাখার একমাত্র কারণ হলো অপহরণের ভয়। পাঁচ মিনিট পর কী ঘটবে, আগে থেকে তার লেশমাত্র জানার উপায় ছিল না হাভানাদের। “কাজেই আমরা কেবল টোলো টিভির অ্যাকশন অনুসরণ করেছি, চা পান করেছি, কখন একটু শ্যুট করতে পারব সেই ধান্ধায় থেকেছি। পুরো ডকুমেন্টারিটিতে আমাদের এই প্রতীক্ষার ব্যাপারটি খুব সুন্দর করে ফুটে উঠেছে”।
‘আফগান স্টারের’ তৃতীয় আসরের ২ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র ৩ জন ছিলেন নারী। শীর্ষ দশের মধ্যে দুজন নারীর উপস্থিতি কিঞ্চিৎ পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হলেও তা মার্জনীয় বলেই মনে করেন আফগানরা। শীর্ষ দশ থেকে প্রতিযোগিতার ফলাফল ছেড়ে দেয়া হয় দর্শকের ভোটের উপর। এই আসরের প্রধান দুজন নারী এবং দুজন পুরুষ প্রতিযোগীর উপরেই ফোকাস করেন হাভানা। “আমি বিখ্যাত হতে চাই, যাতে আমার দেশের লোকজনের জন্য গান গেতে পারি,” বলেন রাফি নওয়াবজাদা। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণের বাড়ি মাজার-ই-শরীফে। রাফি যেন বিজয়ী হয় সেজন্য বিশেষ প্রার্থনা করেন এই এলাকার ইমাম। প্রার্থনার জোরেই হোক কিংবা ভক্তদের ভালোবাসা আর নিজের যোগ্যতায়, আফগান স্টারের তৃতীয় আসরের চূড়ান্ত বিজয়ী হয় রাফি।
রাফির সাথে ফাইনাল রাউন্ডে থাকা আরেক প্রতিযোগীর নাম হামিদ সখীজাদা। ২০ বছর বয়সী এই সঙ্গীতশিল্পীর গানের গলা মাতিয়ে রেখেছিল সবাইকে। হাজারা থেকে আসা হামিদের পছন্দ আফগান ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত। “শিল্পীকে শ্রোতাদের কথাও মাথায় রাখতে হয়”, বলেন হামিদ, “তারা চাইলে আমি পপ গানও গাইব”। অপর এক প্রতিযোগী লিমা সাহার এসেছিলেন কান্দাহার থেকে। ২৫ বছর বয়সী এই পশতু গায়িকা জীবন বাজি রেখে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। পুরো পরিবারকে বিপদে ফেলে দিয়ে আফগান স্টারের তৃতীয় বিজয়িনী হন তিনি। পশতু গায়িকা হওয়ায় তালেবানরাও তাকে ভোট দিয়েছে, এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি।
লিমার নামে তালেবানরা মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে পরিবার তাকে লুকিয়ে রাখে। আর শুরুতেই বলা হয়েছিল সেতারা হুসেইনজাদার কথা। আফগান স্টারে অডিশন দেয়ার পরপরই কারা যেন তার বাড়ির সামনের দেয়ালে বড় বড় করে লিখে রেখে যায়- ‘সেতারাকে বাঁচতে দেয়া হবে না। এই বেশ্যা যেন হেরাটে আর ফিরে না আসে’। কাবুল থেকে তাকে উচ্ছেদ করা হলে বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হেরাটে এসে আত্মগোপন করে সেতারা। পরবর্তীতে অবশ্য তার গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে।
ছেলে-মেয়েরা একসাথে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গাইছে, এটা মানতে পারেনি সাবেক তালেবান নেতারা। তারা টোলো টিভিতে চিঠি পাঠায় আফগান স্টার বন্ধ করে দেয়ার জন্য। সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে আফগান স্টারের বিপক্ষে এক বড় গোষ্ঠীকে দাঁড় করিয়ে দেয় তারা। কিন্তু তারপরও থেমে থাকেনি টোলো টিভি কর্তৃপক্ষ। রাস্তায়, চায়ের দোকানে গিয়ে তারাও জনমত গঠন করার চেষ্টা করে। এক কিশোরের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে নির্মম সত্য- “আফগান স্টার রাজনীতির চেয়ে ঢের ভালো। রাজনীতি খালি দুঃখই দেয়”।
আফগান স্টার এখনো চলছে। ২০১৭ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত হয় অনুষ্ঠানটির ১২তম আসর। এভাবেই যদি বন্দুক থেকে সঙ্গীতের দিকে জনগণের মনোযোগ ফেরানো যায়, তা-ই বা মন্দ কীসে?
ফিচার ইমেজ- afghanstardocumentary.com