২০১৮ সালের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রকাশ্য বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে চীন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয় যার কারণে বাণিজ্য যুদ্ধের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সূত্রপাত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীন এবং চীন থেকে আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের উপর এমন কিছু শর্ত জুড়ে দেন যে কারণে চীন বাধ্য হয় এই যুদ্ধে নামতে। তবে চীনের ক্রেতা বাজার এত বেশি যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য নিয়ে সমস্যার মধ্যেও তাদের অর্থনীতি বৃদ্ধিতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে সময় সবসময় অনুকূলে না-ও থাকতে পারে। সেজন্য চীন অভ্যন্তরীণভাবে তাদের অর্থনীতি বাজারকে ভিন্নরূপে সাজাচ্ছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক বাণিজ্য থেকে সরে এসে চীন এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রাষ্ট্র তৈরির জন্য বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে, স্থলপথে এবং রেলপথে বাণিজ্য করার জন্য মেগা প্রকল্প সিল্ক রুট নিয়ে কাজ করছে যা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট নামে পরিচিতি লাভ করেছে। চীন তাদের কাজ ঠিকভাবেই করছে, কিন্তু আগে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের মোট রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যয় করা হতো এবং যুক্তরাষ্ট্র যখন চীনের উপর অত্যধিক ট্যারিফ বা মূল্য বসানোর ঘোষণা দেয়, তখনই মূলত সমস্যার সূত্রপাত হয়।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের গত আট মাসের বাণিজ্য যুদ্ধ পর্যালোচনা করে আইএমএফ (ইন্টারন্যাশনাল মনেটারি ফান্ড) একটি প্রতিবেদন পাঠায় এবং সেখানে একটি সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়- বাণিজ্য যুদ্ধ অব্যাহত থাকলেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে না।
গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জিন-ক্লড জাঙ্কারের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতর একটি শান্তিপূর্ণ বৈঠক হয়। ফলাফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ আবার একে অপরের সাথে বাণিজ্যের জন্য রাজি হয়। ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আরও কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পণ্য আমদানি করবে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মাবলী নতুন করে ঢেলে সাজাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করবে ইইউ। চীনের জন্য এটা সুসংবাদ না দুঃসংবাদ সেটা বলা যাচ্ছে না। কারণ চীন নিজেও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমিয়ে দিয়ে এখন ইইউভুক্ত দেশগুলোর দিকে ঝুঁকেছে। হয়তো সামনে গিয়ে ইইউকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে আরেকটি কোন্দল দেখা দিতে পারে।
তবে একটা বিষয় অত্যন্ত হাস্যকর যে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের উপর এমন কিছু শর্ত আরোপ করেছে যেটা চীন থেকে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এখানে চীনের দোষ নেই। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে গণ্য করছে এবং উন্নত দেশের উপর যে ধরনের শর্ত আরোপ করা হয় সে ধরণের শর্ত দিয়েছে তারা। কিন্তু চীন হচ্ছে একটি উন্নয়নশীল দেশ, বা অনেকেই একে বলে ‘উন্নয়নশীল উন্নত দেশ’।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ উন্নত। তাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল। অর্থনীতিতে যেকোনো ধরনের পরিবর্তন ঘটলে কিংবা অর্থনৈতিক ঘাটতি দেখা দিলে তারা নিজেদের ভেতর তা নিবিষ্ট করতে সক্ষম। কিন্তু চীন কেবলমাত্র উন্নত দেশের কাতারের দিকে এগোচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়াটা হচ্ছে চীনের জন্য দুঃসংবাদ। এটা অনেকটা এরকম যে, দুই দেশের পক্ষ থেকে দুজন বক্সিং খেলছে। একজন হেভিওয়েট বক্সারের সাথে মাঝারি ওয়েটের বক্সার লড়াই করছে।
তবে চীনকে এখানে মোটেও খাটো করে দেখা হচ্ছে না। তারা তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ব্যবস্থাকে চালু রেখেছে। নিজ দেশের ভেতরকার অর্থনীতি চালু থাকার কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার খুব বেশি নিচে নেমে যায়নি। গত বছর চীনের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৯ শতাংশ। এই বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমস্যা শুরু হওয়ার কারণে তাদের কিছু ক্ষতি হয়েছে, তবুও ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বজায় রেখেছে চীন।
অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি সচল রাখতে চীন তাদের ক্রেডিট গ্রোথ বাড়িয়ে দিয়েছে। যার মানে হচ্ছে, ঋণ নিয়ে নিজ দেশে পণ্য তৈরি এবং কেনাবেচার হার বাড়িয়ে দেয়া। যেহেতু চীনের লোকবল প্রচুর এবং শ্রমিকদের শিল্পক্ষেত্রে দক্ষতা অনেক, তাই তারা তাদের ক্রেডিট গ্রোথ বাড়িয়ে নিজ অর্থনীতি সচল রাখছে। লোকবল বেশি হবার কারণে যাদের কাছ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে, তাদেরকে সুদসহ তারা ফেরত দিতে পারছে।
এই বিশ্বাসটুকু অর্জন চীনের জন্য অনেক বড় পাওয়া। এই গ্রোথ বা প্রবৃদ্ধি বাড়ার কারণে তারা তাদের দেশের ছোট ছোট ফার্মগুলোতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণে সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লাভ আশা করা যাচ্ছে এবং লাভ আসছেও। এই বৃদ্ধির কারণে চীনের নেট ইনকাম দিনকে দিন বাড়ছে।
অপরদিকে চীনের ক্রেডিট গ্রোথ বাড়ানোর সাথে সাথে তারা ফিসকাল পলিসি অনুমোদন করতে পারছে। ফিসকাল পলিসি বা সরকারি রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি হচ্ছে এমন একটি নিয়ম যেখানে একটি দেশের অর্থনৈতিক পণ্যদ্রব্যের চাহিদা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং চাকরিক্ষেত্র বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কিছু নীতির অবলম্বন করা হয়।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বোঝা যাবে। ধরা যাক, একটি দেশ অর্থনৈতিক মন্দার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় সেই দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের জন্য কর দেয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিল। যখন নাগরিকদের কর দেয়ার পরিমাণ কমে যাবে, তখন তাদের বেশি বেশি করে পণ্যদ্রব্য কেনার সুযোগ থাকবে এবং বেশি করে বিনিয়োগ করার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, যে কারণে তাদের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।
এই চাহিদা বৃদ্ধির ফলে সেসব চাহিদা পূরণে ফার্মগুলোকে অধিক লোকবল নিয়োগ দিতে হবে, যা বেকারত্ব কমিয়ে দেবে। এরপর অধিক লোকবল পাওয়ার জন্য ফার্মগুলোর নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। যখনই এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে তখন চাকরিজীবীদের বেতনের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে এবং এর সাথে সাথে তাদের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে। এর ফলস্বরূপ যেহেতু ট্যাক্স বা কর কম দিতে হচ্ছে, তাই বিনিয়োগ এবং চাহিদার পরিমাণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
চীনের ভেতরেও ঠিক এমনটি চলছে। যার ফলে তাদের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এতটাই সচল যে সেটা এই প্রবৃদ্ধিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। চীনের এই অর্থনৈতিক সংস্কার সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।
তবে চীন এখন নিজেদেরকে আরেকটু অন্যভাবে সাজাতে চাচ্ছে। চীন আগে থেকেই অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধনশীল দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। এখন তারা অর্থনীতিতে দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ার পাশপাশি পণ্যদ্রব্যের গুণগতমান রক্ষার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এই সংস্কার চীনের জন্য অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে এবং অনেক বাধা পেরিয়ে এই লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। এখানে সবচেয়ে বেশি যে বাধা আসবে সেটা হচ্ছে চীনের দেনা-পাওনার হিসেব।
দেনা বা ঋণ পরিশোধ করতে গত তিন বছরে তাদের সরকার-প্রধানকে তুমুল যুদ্ধ করতে হয়েছে। সরকারি এবং বেসরকারি দুই পর্যায়েই চীনের ঋণের একটি বড় অংশ পরিশোধ করা ছিলো না। এই ঋণ সমস্যা সমাধানের কারণে তাদের মনেটারি পলিসিতে বেশ কিছু সংস্কারের প্রয়োজন পড়েছিল।
তবে আশার কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে এই ব্যাপারে চীন অনেকখানি এগিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের মাথায় ব্যাড লোন এবং ঋণের এক বিরাট বোঝা চেপে বসে আছে। প্রায় দু’শ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে তাদের। সম্ভবত এই কারণে ট্রাম্প ইইউ এর সাথে একটি সমঝোতায় এসেছে, যাতে ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্যদ্রব্য আমদানি করে। তবে শেষ কথা এটাই যে, চীন তাদের অর্থনীতির চাকা ভেতরের ভাগে সচল রেখেছে, যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ চললেও তাদের অর্থনীতির প্রবল আধিপত্য নিঃশেষ হওয়ার কোনো আশংকা নেই।
ফিচার ইমেজ: open paper.com