বন্দীদের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের জন্য অনেক সময়ই নির্যাতনের পথ বেছে নিয়ে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ব্যতিক্রম নয় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সিও। তবে তারা এক্ষেত্রে ‘নির্যাতন’ শব্দটি ব্যবহার করতে নারাজ। বরং এর পরিবর্তে তারা বেছে নিয়েছে ‘প্রবলতর জিজ্ঞাসাবাদকরণ পদ্ধতি (Enhanced Interrogation Techniques)’ শব্দত্রয়ীকে। তবে যে শব্দ কিংবা শব্দগুচ্ছই ব্যবহার করা হোক না কেন, পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য রয়ে গেছে আগের মতোই।
এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন বন্দীর উপর সেসব ‘প্রবলতর’ পদ্ধতির প্রয়োগ করা হয়েছে এবং কতজন এর ফলে মারা গেছে তার সঠিক কোনো হিসাব প্রকাশ করে নি সিআইএ। তবে অনুমান করা হয়ে থাকে সংখ্যাটা একশোর কাছাকাছি। মলদ্বার দিয়ে পান করানো, উচ্চ শব্দ, ঠান্ডা পানিতে চুবানো, ঠান্ডা প্রকোষ্ঠে রাখা, দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ঘুমোতে না দেয়া, থাপ্পড়, ঘুষি, নিজেদের মলমূত্রে দাঁড়িয়ে থাকা, ওয়াটারবোর্ডিং, পরিবারের প্রতি হুমকি ইত্যাদি নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে সিআইএ’র হাতে পড়া বন্দীদের। কেউ কেউ মারা গিয়েছে সেখানেই। আজ থাকছে সেসব নির্যাতন পদ্ধতি নিয়েই আলোচনা।
রেক্টাল ফীডিং বা মলদ্বার দিয়ে পান করানো
রেক্টাল ফীডিং বলতে মলদ্বার দিয়ে তরল পদার্থ প্রবেশ করানোর একধরনের প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়। একজন ব্যক্তি যখন মুখ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে খাবার খেতে পারে না, তখনই এ পন্থাটি বেছে নেয়া হয়। উনিশ শতকের দিকে এটি বেশ প্রচলিত থাকলেও বর্তমানে এর স্থান দখল করে নিয়ে নিয়েছে টিউব ফীডিং ও ইন্ট্রাভেনাস ফীডিং।
কমপক্ষে পাঁচজন বন্দীর উপর এমন নির্যাতন চালিয়েছিলো সিআইএ। এদের মাঝে ২০০০ সালের ১২ অক্টোবর ইউএসএস কোলে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিহিত সৌদি নাগরিক আব্দ আল-রহমান আল-নাশিরীও ছিলো। সামনের দিকে মুখ করে মাথাটা কোমরের চেয়ে তুলনামূলক নিচু অবস্থায় রেখে তাকে রেক্টাল ফীডিং করানো হয়েছিলো। মাজিদ খান নামক আরেক বন্দীর সাথেও এমনটা করা হয়েছে। তার খাবারের ট্রে-তে রাখা ছিলো হাম্মাস, সস মেশানো পাস্তা, বাদাম, কিশমিশ। এগুলো তার মলদ্বার দিয়ে ঢোকানো হয়েছিলো।
এখন প্রশ্ন হলো- বন্দীদের অবস্থা কি এতটাই খারাপ হয়েছিলো যে, তারা মুখ দিয়ে খেতে পারছিলো না?
সিআইএ’র ভাষ্যমতে বন্দীরা খেতে না চাওয়ায় তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতেই এমনটা করা হচ্ছিলো। কিন্তু সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি বন্দীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট থেকে এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পায় নি। বরং বন্দীদের উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, তাদের উপর আচরণগত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রদর্শনের জন্যই মূলত এমনটা করা হয়েছিলো। আর একজন বন্দী এর ফলশ্রুতিতে মারাত্মক অসুস্থও হয়ে পড়েছিলো।
এমনকি সিআইএ থেকে দাবি করা হয় যে, বন্দী সহযোগিতা করতে অসহযোগিতা করলেই তারা এমনটা করেছিলো। কিন্তু সিনেট কমিটি জানায় যে, বন্দী সহযোগিতা করতে চাইলেও সিআইএ এমন পন্থা অবলম্বন থেকে পিছপা হয় নি।
বাক্সে বন্দী রাখা
বাক্সে আটকানো থাকলে যে কারো পক্ষেই স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করা সম্ভব না। আর এমন শাস্তিই দেয়া হয়েছিলো সৌদি নাগরিক আবু যুবায়দাহকে। তার ভাষ্যমতে, তাকে বিভিন্ন আকারের বাক্সেই আটকে রাখা হয়েছিলো। সেসব বাক্সে থাকাকালে দম বন্ধ হয়ে আসতো তার, পাশাপাশি ক্ষতগুলোতে নতুন করে সংক্রমণ শুরু হতো। তাকে কতক্ষণ সেসব বাক্সে আটকে রাখা হতো সেটা মনে না থাকলেও মাঝে মাঝেই সেখানে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন বলে তার বিশ্বাস।
পোকামাকড়
বন্দীদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায়ে পোকামাকড়কেও বেছে নিতে চেয়েছিলো সিআইএ। যেসব বন্দীর এন্টোমোফোবিয়া তথা পতঙ্গভীতি থাকতো, শুধুমাত্র তাদের বেলাতেই এমনটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। একটু আগে বলা আবু যুবায়দাহ-এর কথাই ধরা যাক। পতঙ্গভীতি ছিলো তারও। সেই ভীতিকে কাজে লাগিয়ে তার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য উদ্ধারে পতঙ্গের সাহায্য নেয়ার কথা ভেবেছিলো সিআইএ। কিন্তু শেষপর্যন্ত তা আর করা হয় নি।
ঠান্ডা পানি
জিজ্ঞাসাবাদের সময় অনেক বন্দীর গায়েই সরাসরি ঠান্ডা পানি ঢেলে দেয়া হতো। ৯/১১ কমিশন রিপোর্টের ভাষ্যমতে ৯/১১ হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিহিত খালিদ শেখ মোহাম্মদের সাথে গ্রেফতার হওয়া ওয়ালিদ বিন আত্তাশ জানান যে, গ্রেফতার হওয়ার পর আফগানিস্তানে প্রথম দুই সপ্তাহ তাকে পানি ঢেলে প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে রাখা হতো। এছাড়াও ঠান্ডা পানির মাঝে ডুবিয়ে রাখা হতো মিনিটখানেক ধরে।
২০০২ সালের নভেম্বর মাসে কাবুলের উত্তরে থাকা সিআইএ’র ব্ল্যাক সাইট সল্ট পিটে মারা যান সন্দেহভাজন আফগান জঙ্গী গুল রহমান। তার মৃত্যুর কারণ ছিলো হাইপোথার্মিয়া। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ঠান্ডা পানিতে চুবিয়ে গুল রহমানকে একটি ঠান্ডা প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হয়েছিলো। কোমরের নিচ থেকে তার গায়ে কোনো কাপড়ও ছিলো না।
গুল রহমানের উপর বিভিন্ন রকম নির্যাতনই চালানো হয়েছিলো। এর মাঝে ছিলো টানা ৪৮ ঘন্টা ঘুমোতে না দেয়া, উচ্চ শব্দ, একেবারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে রাখা, ঠান্ডা পানিতে চুবানো ও খারাপ আচরণ। শুরুতে সিআইএ হেডকোয়ার্টার থেকে এসব ব্যাপারে অনুমোদন দেয়া হয় নি। কিন্তু রহমানের মৃত্যুর একদিন আগে এক সিআইএ অফিসার তাকে হাতকড়া পরিয়ে দেয়ালের সাথে আটকে রাখতে এবং অর্ধনগ্ন করে ঠান্ডা মেঝেতে বসিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ পর্যায়ে সিআইএ থেকে সেটা অনুমোদন করা হয়। রহমানের মৃত্যুর পর সেই অফিসারকে কোনো তিরষ্কার তো করা হয়ই নি, বরং চার মাস পরে এ কাজের পুরষ্কার হিসেবে তিনি আড়াই হাজার ডলার পেয়েছিলেন।
স্ট্রেস পজিশন
বন্দীদের শরীরকে বিভিন্ন সময়ই টানটানভাবে রাখার মাধ্যমেও নির্যাতন করা হয়েছে। কমপক্ষে দশজন বন্দীর কথা জানা যায়, যাদের হাত সিলিংয়ে আটকে রেখে টানা তিন দিন দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো। কখনো কখনো নিয়মিত বিরতিতে এমনটা চলতো টানা তিন মাসের মতো! কখনো আবার মাথার উপরে হাত বেঁধে বন্দীদের আটকে রাখা হতো মেঝেতে।
তিনজন বন্দীকে এমন অবস্থায় রেখেই মল-মূত্র ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিলো এবং তাদেরকে সেভাবেই রেখে দেয়া হয়েছিলো।
ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো
বন্দীদের উপর চালানো নির্যাতনগুলোর মাঝে অন্যতম কুখ্যাত বলা যায় তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর এ প্রক্রিয়াটিকে। এটি অবশ্য অন্যান্য নির্যাতনের সাথেও সম্পর্কিত। যেমন একটু আগেই উল্লেখ করা স্ট্রেস পজিশনেও স্বাভাবিকভাবে একজন বন্দীর পক্ষে ঘুমোনো বেশ কষ্টকর। মাঝে মাঝেই স্বল্প বিরতিতে দিনভর উচ্চ শব্দে গান বাজানো হতো। বন্দী যাতে না ঘুমোতে পারে, সেজন্য তাদের সেলগুলোতে রাখা হতো বেশ ঠান্ডা পরিবেশ। একজন বন্দীকে সর্বোচ্চ টানা ১৮০ ঘন্টা অর্থাৎ প্রায় সাড়ে সাতদিন না ঘুমিয়ে রাখার ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছিলো সিআইএ। অবশ্য তারা বিচার বিভাগের কাছে জানায় যে, তারা সর্বোচ্চ ৯৬ ঘন্টা তিনজন বন্দীকে একটানা জাগিয়ে রেখেছিলো। একজন বন্দী জানিয়েছিলো যে, সে যখন ঘুমাতে চাইতো, তখনই প্রহরী এসে তার মুখে পানির ছিটা দিয়ে যেত।
ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানো বন্দীদের মাঝে দুজনের নাম ছিলো আবু হাজিম ও আব্দ আল-করিম। পালাতে গিয়ে তাদের পায়ে জখম হয়েছিলো। তাদেরকেও দীর্ঘ সময় দাঁড় করিয়ে রাখা হতো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর অভিপ্রায়ে।
উলঙ্গকরণ
বন্দীদেরকে তাদের অসহায়ত্বের কথা স্মরণ করিয়ে এর সাথে অভ্যস্ত করতে তাদের উলঙ্গকরণের আশ্রয় নিয়েছিলো সিআইএ। যে কারো জন্যই এটা বেশ লজ্জাজনক একটি পরিস্থিতি। যদি বন্দীরা সাহায্য করতে সম্মত হতো, তাহলেই তাদের কাপড় পরিয়ে দেয়া হতো!
খাবারদাবারে কড়াকড়ি
স্বাভাবিক খাবারদাবারের পরিবর্তে আকর্ষণহীন তরল খাবারই জুটতো বন্দীদের ভাগ্যে। বন্দীদের জন্য দৈনিক কমপক্ষে ১,৫০০ ক্যালোরি খাবার সরবরাহের দিকটি নিশ্চিত করা হতো। সেই সাথে তাদের ওজনও যেন ১০% এর বেশী না কমে সেটাও দেখা হচ্ছিলো। এ খাবারগুলোর এমন পরিবর্তন তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো অন্যান্য নির্যাতনে সহায়ক হতো সিআইএ’র জন্য।
শারীরিক নির্যাতন
বন্দীদের উপর চালানো হতো বিভিন্ন রকমের শারীরিক নির্যাতন। এক বন্দীর ভাষ্যমতে, তার মুখে ও পিঠে রক্ত বের হওয়ার আগপর্যন্ত থাপ্পড় ও ঘুষি মারা হয়েছিলো। একইসাথে তার গলায় দড়ি পরিয়ে ও পিলারে আটকে রেখে মাথাটা পিলারের উপর ক্রমাগত আঘাত করা হচ্ছিলো।
বন্দীকে ভীতসন্ত্রস্ত ও হতাশ করে তোলা এবং তাকে অপমানিত করার জন্য পেটে থাপ্পড় মারা হতো। বন্দীর থেকে আনুমানিক এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে, আঙুলগুলো একত্রিত করে হাতের পেছনের অংশ দিয়ে তার পেটে আঘাত করতো একজন প্রশ্নকর্তা।
সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জন রিজ্জো তার বই ‘কোম্পানি ম্যান’-এ লিখেছেন যে, বন্দীর মনোযোগ আকর্ষণের জন্য দু’হাতে তার জামার কলার ধরে একজন প্রশ্নকর্তা সজোরে বন্দীকে তার দিকে টেনে আনতেন। আল কায়েদার সদস্য আবু যুবায়দাহ-এর সাথে এমনটি করা হয়েছিলো। একইসাথে বন্দীর মাথাটি এমনভাবে চেপে ধরা হতো যেন সে মাথা নাড়াতে না পারে। এরপর প্রশ্নকর্তা তার দুই হাত বন্দীর মুখের দুপাশে নিয়ে আঙুলগুলো তার চোখের একেবারে সামনে রাখতেন। এমন কাজ বন্দীর মনে তার চোখ নষ্ট করে দেয়ার ভয় সঞ্চার করতো। এছাড়া বন্দীকে চমকে দেয়া ও অপমান করার জন্য গালে থাপ্পড় মারা তো ছিলো খুবই সাধারণ ঘটনা।
একজন বন্দীকে দেয়াল থেকে আনুমানিক চার ফুট দূরে রেখে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। তাকে এমনভাবে ঝুঁকে থাকতে হতো যেন তার আঙুলগুলো দেয়াল কেবলমাত্র স্পর্শ করতে পারে। এভাবেই তাকে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। রিজ্জোর মতে, আবু যুবায়দাহকে এমন শাস্তি দেয়া হয়েছিলো।
নকল, কিছুটা নমনীয় দেয়াল বানিয়ে বন্দীকে সেখানে সজোরে ধাক্কা দেয়া হতো। এতে মোটামুটি বড় একটা শব্দ হতো যাতে বন্দী ভাবতো যে, সে হয়তো বড় রকমের কোনো আঘাত পেয়েছে। সিআইএ এ নির্যাতনের নাম দিয়েছিলো ‘ওয়ালিং (Walling)’।
দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হতো বন্দীদের। এ দাঁড়িয়ে থাকার সময়কাল তিন দিন থেকে সর্বোচ্চ ১৭ দিনও হয়েছে এক বন্দীর বেলায়। বাস্লীর নাসরি আলী আল-মারওয়ালাহ নামক এক বন্দীকে উলঙ্গ করে টানা পাঁচ দিন দাঁড় করে রাখা হয়েছিলো। আবু জা’ফর আল-ইরাকী নামক আরেক বন্দীকে টানা ৫৪ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিলো।
পরিবারের প্রতি হুমকি
বন্দীদের থেকে তথ্য আদায়ে তাদের পরিবারের প্রতি নানাবিধ হুমকি দিয়েছিলো সিআইএ। এর সবগুলোই ছিলো তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা।
আল-নাশিরীকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো যে, তার মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও সেখানে ধরে আনা হবে এবং তার সামনেই তার মা-কে ধর্ষণ করা হবে। খালিদ শেখ মোহাম্মদকে হুমকি দেয়া হয়েছিলো যে, তিনি বন্দী থাকা অবস্থায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে কোনো সন্ত্রাসী হামলা হয়, তাহলে তার সন্তানদেরকে হত্যা করা হবে। সন্তানদের নিয়ে তার দুশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিতে জেলে তার রুমে ছেলেদের ছবি ঝুলিয়ে দিয়েছিলো কর্মকর্তারা।
সন্তানদের ক্ষতি করা হবে, মা-কে যৌন হয়রানি করা হবে এবং মায়ের গলা কাটা হবে- অন্তত তিনজন বন্দীকে এমন হুমকি দেয়ার নজির খুঁজে পেয়েছিলো সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটি।
ওয়াটারবোর্ডিং
এখন পর্যন্ত সিআইএ’র যতগুলো নির্যাতন পদ্ধতি নিয়ে আলাপ করা হয়েছে, সেগুলোর মাঝে সবচেয়ে অমানবিক বোধহয় এই ওয়াটারবোর্ডিং। এখানে একজন বন্দীকে প্রথমে হাত-পা বেঁধে আটকানো হয় একটি বোর্ডে। এরপর তার মুখের উপর একটি কাপড় রেখে পানি ঢালা হতে থাকে। তখন দম নিতে না পেরে, হাত-পা ছুটাতে না পেরে কাতর বন্দী ঠিক পানিতে ডুবে যাওয়ার মানসিক আতঙ্কের মধ্য দিয়েই যায়। তীব্র শারীরিক ব্যথা, ফুসফুসের ক্ষতি, অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতি, হাত-পা ছুটাতে না পেরে হাড় ভেঙে যাওয়া, মানসিক ক্ষতি থেকে শুরু করে মৃত্যুও হতে পারে একজন বন্দীর। এর শারীরিক প্রভাব নির্যাতনের মাসখানেকের মাঝে সেরে গেলেও মানসিক প্রভাব থেকে যেতে পারে বছরের পর বছর।
ভয়াবহ এই ওয়াটারবোর্ডও ব্যবহার করেছিলো সিআইএ বন্দীদের শায়েস্তা করে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এর ফলে বন্দীদের শরীরে মারাত্মক কাঁপুনি দেখা দিতো। সেই সাথে তারা বমিও করতো বলে জানা গেছে। উদাহরণস্বরুপ আবু যুবায়দাহ-এর কথাই আবার টেনে আনা যায়। তার উপর ওয়াটারবোর্ডিং প্রয়োগ করা হলে তিনি একবারেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর যখন চিকিৎসকেরা তারা জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন, তখন তিনি বমি করতে শুরু করেন। দিনে দুই-চারবার তাকে এমন নির্যাতনের ভেতর দিয়ে যেতে হতো। এর ফলে তার মারাত্মক খিঁচুনি হতো। তাকে সর্বমোট ৮৩ বার ওয়াটারবোর্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। অন্যদিকে খালিদ শেখ মোহাম্মদকে একই নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিলো ১৮৩ বার। এর মাঝে খালিদের নির্যাতনের মাত্রা এতটাই বেশি ছিলো যে, ২০০৩ সালের ১২ মার্চ বিকাল থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত তাকে মোট ৬৫ বার ওয়াটারবোর্ডিংয়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।
এখন তাহলে জানা লাগে এত নির্যাতন আসলে কতটা সফলতার মুখ দেখেছিলো। আসলেই কি বন্দীদের এত জিজ্ঞাসাবাদ যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসী আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলো? বন্দীরা কি প্রকৃতপক্ষে সিআইএ কর্তারা যা চাইছিলেন, ঠিক তেমন তথ্যই দিয়েছিলো? এমন অনুসন্ধিৎসার ব্যাপারে কিছুটা জানাতে সক্ষম সিনেট ইন্টেলিজেন্স কমিটির ৫০০ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট, যা সিআইএ’র এমন প্রোগ্রামের উপর তাদের ৬,৭০০ পৃষ্ঠার বিশাল ও গোপনীয় রিপোর্টের সারসংক্ষেপ। এ রিপোর্ট থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, বন্দীদের উপর এমন অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে সিআইএ আসলে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয় নি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো সন্ত্রাসী আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে কিংবা কোনো নিরপরাধ নাগরিকের জীবন বাঁচাতে পেরেছে। এছাড়া যে তথ্যগুলো সিআইএ এত নির্যাতন চালিয়ে উদ্ঘাটন করেছে, সেগুলো যে প্রচলিত জিজ্ঞাসাবাদ পদ্ধতির মাধ্যমেও জানা যেত না, তার সপক্ষেও সিআইএ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারে নি।
ফিচার ইমেজের ছবিটি প্রতীকী