পৃথিবীর এক বৈচিত্র্যময় দেশের নাম ভারত। এটি এমন একটি দেশ যেখানে বিভিন্ন সংস্কৃতি, ভাষা, সামাজিক রীতিনীতি, ধর্ম ও জনগোষ্ঠীর এক অপূর্ব সম্মিলন ঘটেছে।বৈচিত্র্যময় দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মানুষদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, আচার সবকিছুই অঞ্চলভেদে ভিন্ন। ভারতের তেমনি কিছু অঞ্চলের মানুষদের সংস্কৃতি, জীবনযাপন এবং আচার-আচরণ সম্পর্কে জানানো হবে এই লেখার মধ্য দিয়ে।
কালোজাদুর আঁতুড়ঘর আসামের মায়ং
চোখের সামনে মানুষের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কিংবা হিংস্র কোনো পশু এসে কুকুরের মতো মানুষের পায়ে লুটোপুটি খাওয়া- এ ধরনের নানা অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে থাকে অাসামের মায়ং গ্রামে। ‘কালোজাদুর ভূমি’ হিসেবে গ্রামটি সর্বাধিক পরিচিত। গুয়াহাটি থেকে ৪০ কি.মি. দূরে এই গ্রামটি অবস্থিত। মায়ং শব্দটি এসেছে ‘মায়া’ থেকে, অর্থাৎ বিভ্রম। আর এজন্য মায়ং গ্রামটি ভারতের ‘জাদুবিদ্যার রাজধানী’ নামেও অনেকে চিনে থাকেন। ডাকিনীবিদ্যা, তন্ত্রসাধনা, কালোজাদুর এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে গ্রামটিতে।
প্রাচীনকালে এই অঞ্চলের বাচ্চাদের ছোট থেকেই জাদুবিদ্যা শেখানো হতো। শোনা যায়, পাতা থেকে মাছ বা দুষ্ট লোককে জন্তুতে পরিণত করার ঘটনা অবাস্তব শোনালেও মায়ং এ ছিল তা রীতিমতো বাস্তব এক ঘটনা। দুরারোগ্য অসুখও সেরে যেত কয়েকটা মন্ত্রেই। কথিত আছে, বহু বছর আগে নেপাল থেকে এক রাজা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় একটি রাজ্য বরহামায়ং স্থাপন করেন এবং সেখানে তিনি শুরু করেন তার তন্ত্র সাধনা। সেই থেকে এর শুরু।
সম্মোহনবিদ্যার মাধ্যমে কোনো জন্তু বা মানুষকে সম্মোহিত করা, শরীর বদল কিংবা বন্দুকের গুলিকে নিমিষে ভ্যানিশ করা ছিল যেন রীতিমতো তাদের বাঁ হাতের খেলা। পিঠের ব্যথা সারানোর জন্য তান্ত্রিকেরা তামার থালা ব্যবহার করে থাকেন। এই মন্ত্রপূত থালা নিজেই রোগীর পিঠে আটকে যায়। স্থানীয়রা মনে করেন, এই থালাই পিঠের যন্ত্রণা খেয়ে ফেলে।
পিঠের যন্ত্রণা মারাত্মক হলে এই থালা আগুনের মতো গরম হয়ে যায় এবং ফেটে চৌচির হয়ে যায়। আবার নতুন থালা লাগিয়ে ব্যথা সারানো হয়। এখানকার কিছু বাড়িতে এখনো পুরনো মন্ত্রের বেশ কিছু পুঁথি সযত্নে রাখা আছে।
রাজস্থানের পিপালানত্রি: যেখানে কন্যা সন্তানের জন্মকে স্বাগত জানানো হয় গাছ রোপনের মাধ্যমে
ভারতের অনেক অঞ্চলে এখনো কন্যা সন্তান জন্মানোকে খুব একটা ভালভাবে নেয়া হয় না। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রাজস্থানের রাজসমন্ড জেলার পিপালানত্রি গ্রাম। এই গ্রামে কন্যা সন্তানের জন্মকে শুধুমাত্র স্বাগত জানানেই হয় না, তার নামে ১১টি গাছও রোপন করা হয়। গাছ রীতিমতো লালন-পালন করা হয়, যাতে মেয়েটির সাথে সাথে গাছও বেড়ে ওঠে। বিগত ছয় বছরে প্রায় দুই লাখ পঞ্চাশ হাজার গাছ লাগানো হয়েছে গ্রামটিতে। এতে প্রাকৃতিক উন্নয়নও হয়েছে। নিম, তুলসি, আম গাছে পিপালানত্রি এখন সবুজে ছেয়ে গেছে। আড়াই লাখ অ্যালোভেরা গাছও রোপন করা হয়েছে। অ্যালোভেরার জেল, আচার, জুস তৈরি করেন স্থানীয় মহিলারা।
গ্রামের প্রাক্তন প্রধান শ্যাম সুন্দর পালিওয়াল এই অভিনব প্রথার সূত্রপাত করেন। তবে এখনো বেশ কয়েকটি পরিবার রয়েছে, যারা মন খুলে কন্যা সন্তানকে স্বীকার করতে চান না। সেসব পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়। মেয়ের বাবার কাছ থেকে দশ হাজার রুপি নেয়া হয়। গ্রামবাসীরা এর সাথে আরো একুশ হাজার রুপি দিয়ে মেয়ের নামে ফিক্সড ডিপোজিট খুলে দেন। ২০ বছর পর সময় পূর্ণ হলে মেয়ের হাতেই সেই টাকা তুলে দেয়া হয়।
বাবা-মাকে এফিডেভিটে সই করানো হয়, যাতে তারা ১৮ বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দিতে না পারেন। পিপালানত্রি গ্রামে মদ্যপান, গাছ কাটা একেবারেই নিষিদ্ধ। স্থানীয়দের মতে, ৭-৮ বছরে গ্রামে কোনো পুলিশ কেস পর্যন্ত হয়নি। মহিলাদের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য আরো কিছু কাজ করতে ইচ্ছুক বাসিন্দারা।
মধ্যপ্রদেশের বড়ি গ্রাম: আত্মহত্যার ঘটনা যেখানে নিয়মিত ব্যাপার
ভারতের মধ্য প্রদেশের খারগোন জেলার ঝিরানিয়া তেহসিল অঞ্চলের বর্ধিষ্ণু এক গ্রামের নাম বড়ি। ২০০৯ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, গ্রামটিতে ৫২২টি পরিবার বাস করতো আর তখন গ্রামটির জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২,৬৪৪। বর্তমানে গ্রামটিতে ৩২০টি পরিবার বাস করে। লোকসংখ্যাও আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এই লোকসংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে এক অদ্ভুত ঘটনা। কোনো কারণ ছাড়াই এই গ্রামের লোকদের আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। আর তাই গ্রামটি আত্মহত্যাকারী গ্রাম হিসেবে ভারতে পরিচিতি পেয়েছে।
২০১৬ সালের এক তথ্য হতে জানা যায়, ১১০ দিনে প্রায় ১২০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এই গ্রামে। ২০১৫ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৮১ জন। গ্রামের ৩২০ পরিবারের মধ্যে প্রায় প্রত্যেক পরিবারের অন্তত একজন আত্মহত্যা করেছেন। গ্রামবাসীরা অনেকেই এজন্য দুষ্ট আত্মাকে দায়ী করে থাকেন। তাদের বিশ্বাস, কোনো অপদেবতা গ্রামবাসীদের এই আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করছে।
গ্রামটিতে শিক্ষার হার একদমই কম। তারা নানা কুসংস্কারে জর্জরিত। স্থানীয়রা যা-ই বলে থাকুক না কেন, মনোবিদদের ধারণা, এই ধরনের নিয়মিত আত্মহত্যার প্রধান কারণ বিষণ্নতা। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গ্রামবাসীদের মধ্যে স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগের প্রভাবও থাকতে পারে। কিন্তু এখনো এই অঞ্চলে এরকম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেই চলেছে।
গুজরাটের জাম্বুর অঞ্চল যেন আস্ত এক আফ্রিকা
ভারতের গুজরাটের জুনাগড় থেকে ১০০ কি.মি. দূরে জাম্বুর অঞ্চলে বান্টু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। অনেকে তাদেরকে সিদি হিসেবেই চেনে। এ বাসিন্দারা মূলত আফ্রিকা মহাদেশের গ্রেট লেক অঞ্চল থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কীভাবে তারা ভারতে এলো তা নিয়ে রয়েছে নানা রকমের ভাষ্য। ১৯৩১ সালে ভারতের আদমশুমারি থেকে জানা যায়, সপ্তদশ শতকে এই বান্টু সম্প্রদায়ের মানুষদের ভারতে আগমন ঘটে। ক্রীতদাস হিসেবে পর্তুগিজ নাবিকরা তাদেরকে ভারতে নিয়ে আসে।
আবার আরেকটি তথ্য হতে জানা যায়, জুনাগড়ের নবাব এক আফ্রিকান মহিলার প্রেমে পড়ে যান। তাকে বিয়ে করে ভারতে নিয়ে আসার সময় উপঢোকন হিসেবে রানীর সাথে একশো আফ্রিকান ক্রীতদাস পাঠানো হয়। তবে অন্য এক তথ্য বলছে, সপ্তম শতকে এই বান্টুদের নিয়ে আসেন আরবের ব্যবসায়ীরা। পরবর্তী সময়ে দাস প্রথা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা অন্য জায়গায় পালিয়ে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। তারা বর্তমানে ভারতীয় নাগরিক, কথা বলেন গুজরাটি ভাষায়।
সেই থেকেই তারা ভারতে আছেন। বর্তমানে তাদের সংখ্যা প্রায় ৬০,০০০, যার মধ্যে বেশিরভাগই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তবে কর্ণাটকের সকলেই প্রায় ক্যাথলিক খ্রিস্টান। পশ্চিম গুজরাটের জুনাগড় জেলার জাম্বুরে, পার্শ্ববর্তী রাজ্য কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে জাম্বুরে তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
নিজেদেরকে তারা সিদি হিসেবে পরিচিয় দিতে পছন্দ করে। আরবি ভাষায় ‘সিদি’ অর্থ শ্রীমান বা মনিব। তবে বর্তমানে তাদের অনেকেই নিজেদের ঐতিহ্য ও শিকড় সম্পর্কে খুব একটা অবগত নয়। পর্যটকদের নাচ-গান দেখানো সিদিদের অন্যতম পেশা। রাতে আফ্রিকান উপজাতীয়দের পোশাক পরে শুরু হয় নাচ-গান, চলে আফ্রিকান সঙ্গীতের তালে।
নাচের সময়ে তারা মুখে লাল, নীল, সবুজ রঙে নিজেদের সাজিয়ে তোলে। তাদের নাচের এক প্রধান অনুষঙ্গ হচ্ছে ড্রাম। এই ড্রামকে তারা বলে ধামাল। বংশানুক্রমিকভাবেই ড্রাম মাস্টার কে হবে নির্বাচন করা হয়। নাচ-গানের সাথে চলতে থাকে সিদিদের সবচেয়ে পবিত্র ব্যক্তির নামে মহিমাকীর্তন।
ফিচার ইমেজ: Odyssey