মানুষের মন কখনো চায় পাখির মতো ‘উড়ে উড়ে’ প্রকৃতির বর্ণিল সাজ অবলোকন করতে, আবার তাকেই ঝাঁপ দিতে দেখা যায় সাগরতলের রহস্য সন্ধানে। কখনো বা ছুটে চলে জমাট কঠিন শুভ্র বরফের উপর দিয়ে মাইলের পর মাইল। তাকে পাওয়া যায় ইতিহাসের পথে পথে, নিমগ্ন কোনো গুরুগম্ভীর সৃষ্টিকর্মে; কখনো আবার দেখা যায় প্রতিদিনের সূর্যোদয়ের পিছন পিছন হাজির হওয়া সকালে এক কাপ চা হাতে হাসি-তামাশায় মেতে উঠতে। কখনো সে হয়ে ওঠে নির্মম, নিষ্ঠুর; আবার সেই মানবের মাঝেই দেখা যায় স্নেহ, ভালোবাসার বিমূর্ত অবস্থান। আর এভাবেই নানা রূপে, বিভিন্ন ঢঙে গল্প লিখে যাচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এমন হাজারো চলমান গল্পকে নিশ্চল ফ্রেমে বন্দী করে রাখছেন কিছু ফটোগ্রাফার। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের বাছাই করা এরকম নয়টি ছবি ও ক্যামেরার পিছনে থাকা সেসব কারিগরদের নিয়ে আজকের এই আয়োজন।
লেক রেতবার রঙ মোহনা, সেনেগাল
লেক রেতবা সেনেগালের কেপ ভার্ট উপদ্বীপের উত্তরের আকর্ষণ। আর এই আকর্ষণের অন্যতম কারণ লেকের বর্ণিল পানি। Dunaliella salina নামের এক শৈবালের উপস্থিতি লেক রেতবাকে করেছে রক্তবর্ণ (কেউ কেউ একে পিতল বা Pink রঙের বলেও অভিহিত করেন)। এই লেকের পানি যে প্রচণ্ড লবণাক্ত সেটা রোমানিয়ার ফটোগ্রাফার পল ভ্লাদের উপরের ছবিখানা দেখলে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। সরু এক বালিয়াড়ির ওপাশে থাকা আটলান্টিক মহাসাগরের নোনাজল থেকে প্রায় দশগুণ বেশি লবণাক্ত এই লেকের রঙিন পানি। লবণাক্ততা যেমন এই অঞ্চলের লবণ বাণিজ্যের দুয়ার খুলে দিয়েছে তেমনই এখানকার সৌন্দর্য লাখে লাখে পর্যটক নিয়ে আসে শুষ্ক মৌসুমে।
সেনেগালের রাজধানী ডাকার থেকে প্রতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার বেগে গাড়ি চালালে মাত্র ত্রিশ মিনিট লাগবে ৩ বর্গ কিলোমিটার ক্ষেত্রফলের এই লেকে পৌঁছে যেতে। তবে যেকোনো সময় গেলেই যে এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাবে এমন কিন্তু না। লেক রেতবা নভেম্বর থেকে জুনের গ্রীষ্ম মৌসুমে সবচেয়ে আকর্ষণীয় রূপে থাকে। তবে এই অসামান্য সৌন্দর্য ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট মর্যাদা পেতে সেই ২০০৫ সাল থেকে অপেক্ষায় আছে। তবে যা-ই হোক, স্বীকৃতির অপ্রাপ্তি তো সেনেগালের অন্যতম সুন্দর এই প্রাকৃতিক স্থানকে ম্লান করতে পারবে না।
রেনেসাঁর ফুটপাথে শিল্পের ছোঁয়া, ইতালি
মাইকেলাঞ্জেলো, দা ভিঞ্চি আর বত্তিসেল্লির অমর শিল্পকর্ম রয়েছে ইতালির ঐতিহাসিক শহর ফ্লোরেন্সের উফফিজি জাদুঘরে। ফ্লোরেন্স ইতালি রেনেসাঁর প্রাণকেন্দ্র। ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ফ্লোরেন্সের প্রতিটি ধূলিকণা যেন মধ্যযুগের নীরব সাক্ষী। এর পথে পথে রচিত আছে শত শতাব্দীর জানা-অজানা হাজারো গল্প। ফটোগ্রাফার জিয়াকোমো মার্কেজিয়ানি তার জন্মভূমির এই ঐতিহ্য নগরীর এক অধুনা শিল্পকর্মকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন নাইকন D7200 ক্যামেরায়। সাধারণ খড়িমাটির ছোঁয়ায় শিল্পী যেন ফুটিয়ে তুলছিলেন বিমূর্ত এক শিল্পকলাকে।
বিশালতায় যেন বিশালের দেখা, মেক্সিকো
কিছু প্রাপ্তি থাকে প্রত্যাশার বাইরে, অপ্রত্যাশিত কিছু মুহূর্ত যেন হঠাৎই ধরা দেয় অক্ষির গোচরে। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ হাউসের ছিলেন তেমনি একজন সৌভাগ্যবান ফটোগ্রাফার। তিনি তার ক্যাননের ক্যামেরা নিয়ে যখন মেক্সিকোর পর্যটন নগরী কাবো সান লুকাসের নীল সমুদ্রে ঝাঁপ দেন, তখনই সামনে এসে দেখা দেয় এই হাম্পব্যাক তিমিটি। মুহূর্তকাল দেরি না করে ফটাফট তুলে ফেলেন সহসা আসা এই অতিথির ছবি। পানির প্রায় ৪৫ ফুট গভীরে পাওয়া এই অমূল্য স্মৃতিই ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক কর্তৃপক্ষের নেক নজরে পড়েছে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের সেরা নয়টি ছবির তালিকায় স্থান পাওয়ার নিমিত্তে।
অবসরের আড্ডাখানা, চীন
অবসর কীসের জন্য? জীবন সায়াহ্নে একটু বিশ্রাম, সমবয়সী বৃদ্ধ বন্ধুদের সাথে গল্পগুজবে মেতে থাকা, তাস খেলতে খেলতে জিতে যাওয়ার আনন্দে ফোকলা দাঁতে হেসে ওঠা, আর মোড়ের সেই পুরাতন চায়ের দোকানে এক কাপ চা খেয়ে সকালটা শুরু করা, এই-ই তো কর্মব্যস্ত জীবনের উপসংহারে শুরু হওয়া নতুন অধ্যায়। পশ্চিম চিনের চেংডু শহরের এই চায়ের দোকানটির কথাই ধরা যাক; যেন উপরের কথাগুলোর এক চলমান স্থিরচিত্র। পূর্ব জাভা থেকে আসা ইন্দোনেশিয়ান ফটোগ্রাফার হান্ডি লাকসনো চিনের পুরাতন একটি চায়ের দোকানে পুরো আধা বেলা সময় কাটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন অবসরের সেই কার্যাদিসমূহ। এখানে মূলত আসেন ষাট থেকে নব্বই বছরের বৃদ্ধগণ। তাস পিটিয়ে আর ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে যখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে যায়, তখন সবাই নিজ নিজ গৃহপানে রওয়ানা দেন। আর সেদিনের মতো সাঙ্গ হয় শতাব্দি প্রাচীন এই চা দোকানগুলোর ঐতিহ্যমন্ডিত আড্ডাবাজি।
মাতৃত্বের মহত্ব, ভারত
ঢেউয়ের তোড়ে বেলাভূমিতে ভেসে এসেছিল ঠিকই; কিন্তু ফিরে যাবার বেলায় আটকে যায় এক মা। নিরাপদে ডিমরূপী সন্তানদের এই ধরাধামে এনে হয়তো তাকেই চলে যেতে হবে ওপার দুনিয়ায়। শুধু ভারতের উড়িষ্যা উপকূল নয়, সারা বিশ্বজুড়েই মা কচ্ছপ সাগরতটে ডিম পাড়তে এসে আটকে যায় আর বিবেকহীন, নিষ্ঠুর কিছু মানুষরূপী প্রাণী সেই সুযোগে অপব্যবহার করে। ফটোগ্রাফার সিদ্ধার্থ খাদাঙ্গা অলিভ রিডলি জাতের মা কচ্ছপের এই হৃদয়স্পর্শী ছবিটি তার নাইকনের D800 ক্যামেরায় তুলে এনেছেন।
রুক্ষতার প্রতিচ্ছবি, বাল্টিক সাগর
ছবিটি লিথুয়ানিয়ান ফটোগ্রাফার ও অভিযাত্রিক সাউলিয়াস দামুলেভিশিয়াসের তোলা নিজের একটি ছবি; অধুনা আমরা যাকে সেলফি বলে থাকি। ২০১৬ সালে সাউলিয়াসসহ তিনজনের একটি অভিযাত্রিক দল জমে যাওয়া বাল্টিক সাগরের উপর দিয়ে স্কি করে পাড়ি দেন ২৩০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ। ফিনল্যান্ডের ওউলু থেকে শুরু হওয়া নয়দিনের এই দীর্ঘ অভিযাত্রা শেষ হয় সুইডেনের লুলিয়াতে গিয়ে। অভিযানের মাঝামাঝি দিনে ফুজিফিল্মের ক্যামেরায় তোলা এই ছবিতে একজন অভিযাত্রিকের রুক্ষ মুখাবয়ব ফুটে উঠেছে।
চেরি স্বর্গ, জাপান
Cherry blossom… জাপানকে উৎসবের রঙে রাঙিয়ে দেওয়া এক বসন্তের ফুল। সাধারণত মার্চের শেষাশেষি আর পুরো এপ্রিল জুড়ে থাকে এই প্রাকৃতিক ফুলেল উৎসব। জাপানে চেরি গাছ Prunus serrulata-কে বলে সাকুরা। কাজপাগল, নিষ্ঠাবান জাপানিরা ফি বছর এই সময়ে পার্কগুলোতে মেতে ওঠে শতাব্দি প্রাচীন চড়ুইভাতি উৎসব হানামিতে। এই সময়টা তারা নির্মল অবসরে নিজেদের ব্যাপৃত করে। ফটোগ্রাফার দানিলো ডুঙ্গোর তোলা ছবিটি যেন উৎসবের নগরীর উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কোন মুগ্ধ পাখির চোখ।
সম্পর্কের নির্মলতা, রাশিয়া
ছবিটিতে হয়তো সেরকম কোনো দৃশ্যমান আকর্ষণ নেই। কিন্তু এই ছবি ঘিরে আছে এক বিমূর্ত ভালোবাসার বলয়। এই বলয় এক বাবা ও তার ছোট্ট মেয়ের মধ্যে বিরাজমান। ফটোগ্রাফার দিমিত্রি এলিজারোভ তার মেয়ের জন্য নিজ হাতে স্পেসস্যুট সদৃশ পোশাক বানিয়ে দিয়েছেন। জায়গাটি রাশিয়ার বোগদানোভিচের একটি পরিত্যক্ত খনি অঞ্চলের। এই ছবিটি একদিকে যেমন আমাদের দূষিত পৃথিবীর সাক্ষ্য বহন করছে, তেমনি এখানে আছে দুনিয়ার অন্যতম এক পবিত্র সম্পর্কের উদাহরণ।
লাল চোখের স্থির শিকারি, কোস্টারিকা
ইতালিয়ান ফটোগ্রাফার মার্কো আনফস্সির এই ছবিটি ম্যাক্রো লেন্সের কারসাজি। আর ছবির চরিত্র কোস্টারিকার লাল চোখা এক গেছো ব্যাঙ। দিনের বেশিরভাগ সময় গাছেই কাটিয়ে দেওয়া এই প্রাণীটির প্রিয় খাদ্য তালিকায় আছে মথ, ঝিঁঝিঁ পোকা আর নানা রকম পোকামাকড়।
ফিচার ইমেজঃ Edited by writer