মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জেতানোর জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাকিংয়ের অভিযোগ নতুন না। কিন্তু এবার তার চেয়েও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে রাশিয়ার হ্যাকারদের বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, রাশিয়ান হ্যাকাররা নাকি ন্যাটোর সেনাবাহিনী এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার উদ্দেশ্যে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে অবস্থিত ন্যাটোর সৈন্যদের মোবাইল ফোন হ্যাক করছে। সম্প্রতি ন্যাটোর এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং কিছু সৈন্যের বরাত দিয়ে এমনটিই জানিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়া ন্যাটোর অন্তত ৪,০০০ সৈন্যের স্মার্ট ফোন হ্যাক করেছে। রাশিয়ার সীমান্তবর্তী পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া সহ আরো কিছু দেশে অবস্থিত ন্যাটোর সৈন্যদের স্মার্টফোন লক্ষ্য করে এই হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটানো হয়, যাদের মধ্যে বেশ কিছু মার্কিন সেনাও ছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, হ্যাকিংয়ের কাজে রাশিয়া অত্যাধুনিক নজরদারির যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছে। চালকবিহীন ড্রোন এবং ভূমিতে অবস্থিত পোর্টেবল টেলিফোন অ্যান্টেনার মাধ্যমে তৈরি অ্যাকসেস পয়েন্ট ব্যবহার করে তারা স্মার্টফোনগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তারা ন্যাটোর সৈন্যদের প্রকৃত সংখ্যা, সেনা ঘাঁটিগুলো সম্পর্কিত তথ্য, তাদের দৈনন্দিন কার্যাবলী, পরিকল্পনা প্রভৃতি জানার চেষ্টা করে। রাশিয়া অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কিন্তু ন্যাটোর কর্মকর্তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, যে ধরনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে বোঝা যায়, এর পেছনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা আছে।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে পোল্যান্ডের ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটিতে নিযুক্ত এক মার্কিন আর্মি লেফটেন্যান্ট কর্নেল ক্রিস্টোফার লে’হোরেক্সের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, তার ব্যক্তিগত আইফোনটি এ বছরের গ্রীষ্মকালে হ্যাক করা হয়েছিল। হ্যাকাররা প্রাথমিক নিরাপত্তা দেয়াল ভেঙে দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্ত বুহ্যও ভেদ করার চেষ্টা করছিল। ঐ সামরিক কর্মকর্তার মতে, তিনি তখন লক্ষ্য করেন যে, যেখান থেকে হ্যাক করার চেষ্টা করা হচ্ছিল, সেটি একটি রাশিয়ান আইপি ঠিকানা। তিনি বলেন, তারা তার ভৌগলিক অবস্থান বের করার চেষ্টা করছিল।
ক্রিস্টোফার লে’হোরেক্স জানান, শুধু তিনি একাই না, তার অধীনস্থ আরো কিছু সৈন্যের মোবাইলও হ্যাক হয়েছিল। তিনি জানান, তার অন্তত ছয় জন সৈন্যের ফেসবুক অ্যাকাউন্টও হ্যাক হয়েছিল। তার মতে, সবগুলো হ্যাকিংয়ের ঘটনাই রাশিয়ান গোয়েন্দাবাহিনীর কাজ। তারা তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও ন্যাটোর সৈন্যদেরকে ভয় দেখানো এবং তাদেরকে উল্টোপাল্টা মেসেজ দিয়ে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করাও হ্যাকারদের উদ্দেশ্য হতে পারে।
পোল্যান্ড ছাড়াও রাশিয়ার সীমান্তের নিকটবর্তী এস্তোনিয়াতে নিযুক্ত ন্যাটোর সৈন্যদের স্মার্টফোনেও হ্যাকিংয়ের ঘটনা ঘটেছে। জার্নালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, সেখানে অবস্থিত সৈন্যদের মোবাইল ফোনগুলোকে অদ্ভুত আচরণ করতে দেখা গেছে। এ বছরের জানুয়ারিতে এস্তোনিয়ার তাপা সামরিক ঘাঁটিতে থাকা ন্যাটোর সৈন্যরা লক্ষ্য করে, তাদের মোবাইল ফোনের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে মানুষের নাম্বার গায়েব হয়ে যাচ্ছে এবং এমন সব মিউজিক চালু হচ্ছে, যেগুলো তারা কখনও ডাউনলোডই করেনি।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কর্তৃপক্ষ এস্তোনিয়ার ঐ ঘাঁটির সৈন্যদের উপর স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তাদেরকে ফোনের সিম কার্ড খুলে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছে। তাদেরকে শুধুমাত্র কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর নির্দিষ্ট স্থানে সীমিত সময়ের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। জার্নালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিকে এত বেশি গুরুত্বের সাথে নিয়েছে যে, সৈন্যরা আসলেই সিম কার্ড ত্যাগ করেছে কিনা, সেটা নিশ্চিত করার জন্য অপারেশনের পূর্বে তাদেরকে পানিতে ঝাঁপ দেওয়ানো হয়েছে।
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অবস্থিত ন্যাটোর হেডকোয়ার্টের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ডেভিড গালি সিএনবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তারা সীমান্তের তাদের পাশে নিযুক্ত জোটের (ন্যাটোর) সৈন্যদের ক্ষতি সাধন করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করেছেন। কিন্তু তার মতে, এ ধরনের ঘটনায় খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তাদের কর্মকর্তারা নানাবিধ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তাদের মিশন সম্পন্ন করার মতো যোগ্যতা সম্পন্ন। অবশ্য তিনি স্বীকার করেন, এ ধরনের আক্রমণগুলো প্রায়ই যথেষ্ট জটিল এবং নিখুঁত হয়ে থাকে। ফলে এগুলোকে সন্দেহাতীতভাবে সম্পূর্ণরূপে মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না।
গালি আরও বলেন, তাদের নিযুক্ত সৈন্যরা মূলত প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক না। তবে তারা নিজেদের অভিযান এবং নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। তার মতে, জোটের সৈন্যরা তাদের দৈনন্দিন প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে কীভাবে শত্রুর চোখকে সতর্কভাবে ফাঁকি দিতে হয়, সেটাও অনুশীলন করছে। তাদের প্রশিক্ষণের মধ্যে অনলাইন নিরাপত্তাও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সিএনবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে সরকারের সাথে কাজ করা ডালাস ভিত্তিক প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা জন মাইকেলসেন জানান, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার জাতীয় সব ধরনের যন্ত্রপাতির মধ্যে স্মার্টফোনকে নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। ডেস্কটপ বা কম্পিউটার সার্ভারের চেয়ে মোবাইল ফোনের দখল নিয়ে নেওয়া অনেক বেশি সহজ।
তিনি আরও জানান, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ফোনগুলোকে প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত করার জন্য জন্য যেসব বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করা হয়, সেগুলোও ঝুঁকিপূর্ণ। হ্যাকাররা সহজেই সেগুলো ব্যবহার করে নিরাপত্তার দেয়াল ভেদ করে নেটওয়ার্কে অনুপ্রবেশ করতে পারে। আর ন্যাটোর মতো এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটির কোনো নেটওয়ার্কে যদি কেউ অনুপ্রবেশ করতে পারে, তাহলে সেটা বিশ্বনিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। একটি হ্যাক করা ফোনই তখন মারাত্মক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর কখনোই খুব একটা সুসম্পর্ক ছিল না। ১৯৪৯ সালে ন্যাটোর সৃষ্টিই হয়েছিল মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তিকে মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখন নেই, কিন্তু তার উত্তরসূরী রাশিয়া এখনও ন্যাটোকে হুমকি হিসেবেই দেখে। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া আক্রমণ করে, তখন ন্যাটো সম্পর্কে রাশিয়ান প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, “ন্যাটো একটি সামরিক জোট, এবং আমরা এরকম একটি সামরিক জোটকে আমাদের বাড়ির আঙিনায় দেখতে পছন্দ করি না।”
কিন্তু এরপর থেকে ন্যাটো উল্টো রাশিয়ার আশেপাশের দেশগুলোতে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েই চলেছে। বিশেষ করে পোল্যান্ড এবং বাল্টিক অঞ্চলে ন্যাটোর সৈন্যদের ব্যাপক উপস্থিতি রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে রশিয়াও বিভিন্ন সময় এসব এলাকায় তাদের সামরিক মহড়া প্রদর্শন করেছে।
এ বছর সেপ্টেম্বরের ১৪ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত রাশিয়া এবং বেলারুশ মিলিটারি এক যৌথ সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে পশ্চিমা আগ্রাসন প্রতিহত করার অনুশীলন করে। কাজেই নিজেদের সীমান্তের ঠিক বাইরেই অবস্থিত বিপুল সংখ্যক শত্রুভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর উপর রাশিয়া নজরদারি করবে না, বা তাদের গোপন সংবাদ জানার চেষ্টা করবে না, এটাই বরং অস্বাভাবিক।
চ্যাথাম হাউজের রাশিয়া এবং ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের একজন অ্যাসোশিয়েট ফেলো, কিয়ের গিলস ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেন, রাশিয়া সবসময়ই তথ্য সংগ্রহের জন্য ন্যাটোর উপর নজরদারি করে এসেছে। কিন্তু এরকম মাত্রার হয়রানি এবং ভীতিপ্রদর্শনমূলক ব্যবস্থা সাম্প্রতিক সময়ে আর দেখা যায়নি।
ফিচার ইমেজ- activistpost.com