অনুবাদকের নোট ৩২ বছর বয়সী ইরিনা কিপোরেঙ্কো ইউক্রেনিয়ান ইনস্টিটিউটে ফিল্ম প্রোগ্রাম ম্যানেজার পদে দায়িত্বরত আছেন। এই লেখাটি ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২২-এ টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কিপোরেঙ্কোর একটি ইংরেজি লেখার অনুবাদ। লেখকের অনুমতিক্রমে বাংলাভাষীদের জন্য অনুবাদটি প্রকাশিত হলো।
“মা, বোমা হামলা শুরু হয়েছে।” বিষ্যুদবার ভোরে কিয়েভে একটা বিকট শব্দ শুনে আমার ঘুম ভাঙল। আশা করার কোনো কারণ ছিল না, তবু আমি আশা করছিলাম যে, কাছে কোথাও একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তারপরও, আমি নিজেকে একটা কম্বলে মুড়িয়ে নিলাম। দৌড়ে ছুটে গেলাম পাশের ঘরে। আমার মামণিকে জাগাতে, যে ওডেসা থেকে আমার বাসায় বেড়াতে এসেছে। সে শুরুতে আমার কথা বিশ্বাস করে নি, কিন্তু আমি ভয়ে কাঁপছিলাম আর কান্না করছিলাম।
আমি ফেসবুক খুললাম। সেখানে আমার এক বন্ধু একটা পোস্ট করেছিল। তাতে লেখা ছিল, যুদ্ধ! “আমার ইউক্রেন আক্রমণের শিকার!” বৃষ্টির মতো মিসাইল নেমে আসছে আমার দেশে। কিয়েভে। কৃষ্ণসাগরের তীরের ওডেসায়। অন্যান্য বড় শহরে।
বুঝতে পারছিলাম আমাদেরকে দ্রুত সরে পড়তে হবে। আমি ঝটপট একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের লিফটটা ব্যবহার করব না। ১৫ তলা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাব। বাইরে, একদল মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হলো আমাদের, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল রাতভর মদ গিলেছে। জিজ্ঞেস করলাম, তারা কিছু শুনেছে কিনা। তারা বলল, যে তারা বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনেছে। আম্মু তাদের কথায় ভরসা পেল না। ফিসফিস করে বলল, “যত্ত সব মাতালের দল!”
এরপর আমাদের চোখ পড়ল একটা মিসাইলের ওপর। মিসাইলটা আমাদের স্থানীয় দোকান আর পাতালরেল স্টেশনের কাছেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের উঠানে বিস্ফোরিত হয়েছিল। ভাঙা কাচ আর বেঁকে যাওয়া ধাতবখণ্ডগুলো ঘাসের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। রাশিয়া দাবি করছে, তারা ইউক্রেনজুড়ে শুধু সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ চালাচ্ছে। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। এটা একটা আবাসিক এলাকার সড়ক।
আমরা স্টেশনে ঢুকে পড়লাম। বোমা হামলা থেকে বাঁচতে এটাকে সাময়িকভাবে একটা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে রূপ দেয়া হয়েছে। একটা বড় বৈদ্যুতিক বিলবোর্ড থেকে ইউক্রেনের পতাকা ঝুলছিল। আমি সেখানে কয়েক মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবতে লাগলাম, যাক, এই হচ্ছে পরিস্থিতি। সেটা একটা নির্ধারণী মুহূর্ত ছিল।
ভূগর্ভে ঘণ্টাখানেক থাকার পর আমরা বেরিয়ে এলাম। দেখি সব দিকে জনতার ঢেউ। অধিকাংশই ফুটপাত ধরে সুটকেস টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ তাদের পোষা প্রাণীদেরকে বহন করছেন। একটা লোককে দেখলাম তার জানালায় টেপ পেঁচাচ্ছেন। তিনি এমনটা করছিলেন, যাতে পরবর্তীবার যখন একটা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটবে, হয়তো এই টেপ জানালাটার ভেঙে পড়া ঠেকাবে। প্রত্যেকেই তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিলেন। কোথায় যাচ্ছিলেন এই প্রশ্নটাই অর্থহীন হয়ে পড়েছিল – গন্তব্য যেখানেই হোক, তারা স্রেফ আটকাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছিলেন।
রাশিয়া ইউক্রেনে একটি পূর্ণমাত্রার আগ্রাসন চালিয়েছে। আমার বন্ধুদের একেকজন একেকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। কেউ হঠাৎ রক্তদান করার তাড়না বোধ করেছে। যারা সেনাবাহিনীর সংরক্ষিত তালিকায় ছিল, যখন তাদেরকে ফ্রন্টে যেতে বলা হয়েছে, তারা সানন্দে সাড়া দিয়ে সেখানে গেছে। আর বেশ কয়েকজন তাদের গাড়িতে চেপে বসেছে, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের দিকে রওনা দিয়েছে বা সীমান্ত পেরিয়ে দেশের বাইরে চলে গেছে।
মামণি আর আমি আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসলাম। আমাদের কিছু জরুরি জিনিসপাতি গোছগাছ করার জন্য। আমি বসার ঘরের ঠিক মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, যদি আর কোনদিন ফিরে না আসি? রাশিয়ার হাজার বছরের সাম্রাজ্যিক বাসনা অবশেষে উপস্থিত হয়েছে, সে আমার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
আমার প্রজন্ম কী মনে রাখবে? আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে কী বলব? আমাদের দেখার আর কোন স্বপ্নটা বাকি আছে? এই সব প্রশ্নের উত্তর একটাই: আজাদির লড়াই।
১৯৮৯ সালে ক্রিমিয়ায় জন্মেছিলাম আমি। মায়াবী একটা উপদ্বীপ যা কৃষ্ণসাগরে এসে থেমেছে। এটা ছিল সুখে পরিপূর্ণ একটা এলাকা। অন্তত আমার স্মৃতি তো তাই বলে, যখন আমি ছোট্টটি ছিলাম। যদিও বছরগুলো ছিল ১৯৯০’এর দশকের দারিদ্র্য কবলিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ধারাবাহিকতায় অঞ্চলটি ধুঁকে মরছিল। ইউক্রেন স্বাধীন হলে পরে আমরা ভেবেছিলাম, রক্তপাতে ভরা শতাব্দীগুলো আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। কিন্তু আমরা ভুল ভেবেছিলাম। আমাদের মুক্তি আসেনি। রাশিয়া আমাদের দেশের ঘটনাপ্রবাহে নাক গলানো ও আমাদের সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করা অব্যাহত রাখে। ২০০৪ সালে আমি যখন কিশোরী ছিলাম, মস্কো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিল। আমরা এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি, যা পরবর্তীকালে কমলা বিপ্লব নামে পরিচিতি পায়।
একজন ৩২ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় নারী হিসাবে, আমি আমার জীবদ্দশায় আমার দেশে অনেককিছুর উত্থান-পতন দেখেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত আমার পরিবারকে ক্রিমিয়া ছেড়ে আসতে বাধ্য করে। আমরা সমুদ্রের ওপারের ওডেসায় চলে আসি। শহরটা সুন্দর, সুন্দর তার প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা বন্দরগুলো। সমুদ্রতীরে রেস্তোরাঁগুলো গ্রিল করা মাছ পরিবেশন করে আর ভোরেই শুরু হয়ে যায় মানুষের নাচ। ওডেসা বহু সংস্কৃতির একটা ক্যালেইডোস্কোপ। ইহুদি, বুলগেরীয়, মলদোভীয়, আর গাগাউজ সম্প্রদায়গুলো এখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী মিলে-মিশে থেকেছে।
সেখানে, আমি একটা নতুন স্কুলে যাওয়া শুরু করলাম, একটা নতুন বাসায় থাকা শুরু করলাম। জীবনটা খুব সুন্দর মনে হচ্ছিল। জীবনের যেমনটা হওয়ার কথা।
একটা সুপরিচিত প্রবাদ আছে। “কেউ ওডেসাবাসী হয়ে উঠতে পারে না, ওডেসাতে জন্মাতে হয়।” আমি এই শহরে জীবনের বিশটারও বেশি বছর কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আমি কখনোই নিজেকে ওডেসাবাসী দাবি করিনি। তবুও, আপনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন, বিষণ্ণ বোধ করেছেন আর প্রেমে পড়েছেন, সেই জায়গাটার ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকতে পারবেন না। আর তাই ওডেসা হয়ে উঠল আমার দ্বিতীয় বাড়ি।
পাহাড় আর তৃণভূমিতে হাইকিং করার জন্য প্রায়ই ক্রিমিয়ায় ফিরে আসতাম আমি। কিন্তু ২০১৩ সালে একটা ঘটনা ঘটল। ইউরোপের সাথে করা একটা বাণিজ্যচুক্তি থেকে সরে আসার জন্য আমাদের তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের ওপর চাপপ্রয়োগ করল ক্রেমলিন। এর প্রতিবাদে আমরা ইউক্রেনীয়রা পথে নেমে এলাম। ২০১৪ সালের গণতন্ত্রপন্থী মাইদান বিপ্লবে উৎখাত হলেন ইয়ানুকোভিচ। আমরা ভাবলাম শেষপর্যন্ত আমরা মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু হায়, এবারও আমরা ভুল ভেবেছিলাম!
এরপর যেটা ঘটল, রাশিয়া গায়ের জোরে ক্রিমিয়া দখল করে নিল, আর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন পূর্ব ইউক্রেনে একটা যুদ্ধ উসকে দিলেন। আট বছর ধরে, রাশিয়া এই সশস্ত্র আর রক্তাক্ত বিদ্রোহে মদদ দিয়ে গেছে। এই পুরো সময়ে, প্রায় ১৪ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, যাদের অনেকেই বেসামরিক নাগরিক।
এরপর, তিন বছর আগে, একটা ভূমিধ্বস বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হলেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। আর তাই এ-বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২৪ তারিখে, পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ চালালেন।
বিষ্যুদবার রাতটা আমরা আমাদের কাজিনের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বেজমেন্টে কাটিয়েছি। যখন সাইরেন বেজে উঠছিল, আমরা প্রায় ১০০ জন, সব বয়সের মানুষ, গুটিশুটি পাকিয়ে যাচ্ছিলাম। কারো কারো সাথে তাদের পোষা কুকুরবেরালও ছিল। আমার কাজিনের ৭ বছর বয়সী মেয়েটা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছিল। সে তার খেলনা শুকরটাকে বুকে চেপে ধরে আমাদেরকে অনবরত জিজ্ঞেস করে চলছিল, “এসব কেন ঘটছে? আমি কি খারাপ কিছু করেছি, খালামণি?”
আমি আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে যেই জিনিসগুলো এনেছিলাম, সেগুলো চেক করতে থাকলাম। একটা ফোল্ডারে আমার সব দলিল-দস্তাবেজ ছিল। আমাদের বাবা চার মাস আগে কোভিড-১৯’এর কারণে মারা গেছেন। ফোল্ডারটায় তার ছবিগুলো ছিল। আব্বুকে ছাড়া বেঁচে থাকতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু এরপরই আবার ভাবি, যদি সে বেঁচে থাকত, এই পরিস্থিতিটা তার কাছে কতটা অসহনীয় মনে হতো? আমি মনে মনে বললাম, “অন্তত এই দোজখ দেখতে উপস্থিত নেই তুমি।”
শুক্রবার সকাল সাতটায় সাইরেনের শব্দে ঘুম ভাঙল। আমরা আমাদের সাথে কিছু আপেল, রুটি, চা, আর চকলেট এনেছিলাম। দোকানপাট সব বন্ধ, পেটে কিছু পড়লেই হয়। কিয়েভে বোমাবর্ষণ অব্যাহত থাকল। আমাদের সরকার রুশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বেসামরিক নাগরিকদের হাতে ১১,০০০ বন্দুক তুলে দিয়েছে। ১৮ আর ৬০ বছরের মাঝামাঝি বয়সী পুরুষদের দেশ ছেড়ে যাবার অনুমতি মেলেনি। আমাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। যেকোন মুহূর্তে রুশ ট্যাংক কিয়েভে প্রবেশ করবে।
সবকিছুর পরও, আমরা আতঙ্কে জমে যাচ্ছি না। মানুষেরা পরিকল্পনা আঁটছে, কীভাবে বেরিয়ে আসা যায়। আমার যথেষ্ট ঘোরাঘুরি করা হয়েছে, তাই মামণি আর আমি থেকে যাচ্ছি। ট্রেনে চেপে হয়তো দেশের পশ্চিম অংশের কোনো শহরের জন্য কিয়েভ ছেড়ে যাব আমরা। কিন্তু ইউক্রেন ছেড়ে আমরা কোথাও যাচ্ছি না। এটা আমাদের দেশ।
মূল লেখা: https://time.com/6151505/ukraine-home-putin-kyiv-crimea/