সৌদি আরবের সাথে কানাডার নতুন করে শুরু হওয়া কূটনৈতিক সংকট নিয়ে আমরা আলোচনা করেছিলাম আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায়। গত সোমবার শুরু হওয়া এ সংকট দিনে দিনে আরো ঘনীভূত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সৌদি আরব কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে, নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে, কানাডার সাথে নতুন করা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি বাতিল করেছে, কানাডাগামী সাউদিয়া এয়ারলাইন্সের সকল ফ্লাইট বাতিল করেছে, প্রায় ১৬,০০০ সৌদি ছাত্রছাত্রীকে এক মাসের মধ্যে কানাডা ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছে এবং কানাডা থেকে সকল সৌদি রোগীকে ও ট্রেনিংয়ে থাকা প্রায় ৮০০ ডাক্তারকে ফিরিয়ে নিয়েছে। আর এ সব কিছুই ঘটেছে সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা একটি টুইট বার্তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে।
সৌদি আরবের সাথে বিভিন্ন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের এ ধরনের সংকট অবশ্য নতুন না। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো সব সময়ই সৌদি আরবের কঠোর দমন-নিপীড়ন নীতির এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সমালোচনা করে এসেছে। প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরবও মাঝে মাঝেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৫ সালে সুইডেন এবং ২০১৭ সালে জার্মানি সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনা করায় সৌদি আরব দেশটি থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের বহিষ্কার করেছিল। কিন্তু এবার সৌদি আরব কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, এটা কি শুধুই একটি টুইটের প্রতিক্রিয়া, নাকি এর পেছনে আরো কোনো কারণ আছে?
অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, কানাডার বিরুদ্ধে সৌদি আরবের এই প্রতিক্রিয়ার মূল কারণ কানাডার টুইট না, বরং সৌদি আরব এই টুইটকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্ববাসীকে, বিশেষ করে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রপ্রধানদেরকে একটি বার্তা দিতে চাচ্ছে যে, তারা কেউ যেন সৌদি আরবের অভ্যন্তরীন বিষয়ে নাক না গলায়। ইউনিভার্সিটি অফ ডেনভারের সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজ অ্যাট দ্য জোসেফ কোরবেল স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের পরিচালক নাদের হাশেমির মতে, “এটা অত্যন্ত পরিস্কার যে, সৌদি আরব কানাডাকে ব্যবহার করছে বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়ার জন্য, আপনি যদি সৌদি আরবের সাথে ব্যবসা করতে চান, তাহলে আপনাকে মানবাধিকারের ব্যাপারে চুপ থাকতে হবে।”
“The unusually strong reaction shows that Saudi Arabia, under the day-to-day leadership of Crown Prince Mohammed bin Salman, 32, is willing to wield its wealth to deter Western countries from criticizing how its absolute monarchy is run.” https://t.co/MZXRkz9XnL @MadawiDr
— Nader Hashemi (@naderalihashemi) August 9, 2018
হাশেমির মতে, মূল সংকটটি কানাডা নয়, বরং সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নিজে। মোহাম্মদ বিন সালমান, যিনি তার নামের অদ্যাক্ষর এমবিএস নামেই অধিক পরিচিত, অত্যন্ত ক্ষমতালোভী এবং উদ্ধত। তিনি মনে করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার পক্ষেই আছেন এবং ফলে তিনি কাতার এবং লেবাননের মতোই বিশ্বের যেকোনো দেশের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন। বাস্তবেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব সময় মানবাধিকার, নারী অধিকারের পক্ষে কথা বললেও কানাডা এবং সৌদি আরবের এ সংকটে তারা কোনো পক্ষ নেবে না বলে জানিয়েছে।
হাশেমির মতোই একই মত পোষণ করেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াটারলুর অধ্যাপিকা বাসমা মোমানি। দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল পত্রিকায় বাসমা লিখেছেন, এই সংকটের পেছনে যতটা না কানাডার পররাষ্ট্রনীতি দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতি। তার মতে, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নিজ দেশের পাশপাশি বহির্বিশ্বে ক্ষমতা প্রদর্শনের যে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, এটি তারই ধারাবাহিকতা। কাতার, ইয়েমেন, লেবানন প্রভৃতি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করার মতোই কানাডার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার মাধ্যমে তিনি স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চাইছেন।
My latest oped for @TIME Saudi is escalating its feud with Canada. Here’s the real message the crown prince is sending & he’s not yet king. Saudi Arabia will be sending shockwaves in diplomatic circles for years to come https://t.co/NUnHBAhd6I
— Bessma Momani (@b_momani) August 9, 2018
বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের শক্তি প্রদর্শন করাই হোক, কিংবা অন্য রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত রাখার জন্যই হোক, সৌদি আরবের জন্য কানাডাই হচ্ছে তুলনামূলকভাবে ভালো শিকার। কারণ, রাজনৈতিকভাবেও যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ব্রিটেনের মতো সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র না, এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও কানাডার উপর সৌদি আরবের নির্ভরশীলতা তুলনামূলকভাবে কম। দ্য আটলান্টিকের সহযোগী সম্পাদক সিগাল স্যামুয়েলের ভাষায়, পশ্চিমা বিশ্বকে একটি সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্য কানাডাই হচ্ছে সৌদি আরবের জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ একটি রাষ্ট্র।
ইউনিভার্সিটি অফ অটোয়ার মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক থমাস জুনোর উদ্ধৃতি দিয়ে সিগাল স্যামুয়েল বলেন, মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিমা বিশ্বকে সতর্ক করা যে, তারা যদি সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে সমালোচনা করে, তাহলে তাদেরকে তার মাশুল গুণতে হবে। জুনোর মতে, এই পদ্ধতিটি যেকোনো কাজের ব্যাপারে বিন সালমানের একটি মূলনীতি। তিনি যেকোনো সংস্কার করার সময়ও সেটা নিজের পদ্ধতিতেই করেন, অন্য কারো সমালোচনা তিনি সহ্য করেন না।
High time the #EU and its member states stand up to #SaudiArabia‘s ruthless crackdown on rights too, and press for the immediate and unconditional release of detained and imprisoned human rights defenders, incl several women’s rights activists. https://t.co/oRRahJtLh6
— Lotte Leicht (@LotteLeicht1) August 6, 2018
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি সৌদি নারীদেরকে গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছেন, কিন্তু আবার একই সময়ে গাড়ি চালানোর অধিকারের দাবিতে সোচ্চার নারী অধিকার কর্মীদেরকেও গ্রেপ্তার করেছেন। অর্থাৎ তার নীতি হচ্ছে, তিনি নারীদেরকে ড্রাইভিংয়ের অনুমতি দিবেন ঠিকই, কিন্তু সেটি নিজের পদ্ধতিতেই দেবেন, অন্য কারো সমালোচনা কিংবা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেবেন না। মোহাম্মদ বিন সালমানের ক্ষেত্রে এই নীতি প্রকটভাবে ধরা পড়লেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনির্বাচিত স্বৈরশাসকরা মোটামুটি এই নীতিই মেনে চলে। তারা অন্য কারো দাবির মুখে নতি স্বীকার করে না কিংবা কাউকে সমালোচনা করারই সুযোগ দেয় না, কারণ এতে তাদের দুর্বলতা প্রকাশ পায়।
তবে কারণ যা-ই হোক, সৌদি আরব এবং কানাডার মধ্যে শুরু হওয়া এ কূটনৈতিক সংকটের শীঘ্রই নিরসনের কোনো সম্ভাবনা নেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাতার এবং ইয়েমেনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নিজের ক্ষতি হলেও সৌদি আরব তার গৃহীত পদক্ষেপ থেকে সরে আসে না। অন্যদিকে কানাডাও মিত্র রাষ্ট্রগুলোর মধ্যস্থতায় সমঝোতার কথা বললেও মানবাধিকার বিষয়ক বক্তব্য থেকে সরে আসবে না বলে জানিয়েছে। সুতরাং যেকোনো এক দেশের সরকারের বড় ধরনের পরিবর্তনের পূর্ব পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কের আরো অবনতি যদি না-ও হয়, উন্নতির সম্ভাবনা খুবই কম। ২০১৯ সালে কানাডার সরকার পরিবর্তনের পরেই হয়তো তাদের সম্পর্ক আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে।
Featured Image © Alexander Glandien