গণতন্ত্রের ২৫ বছর পরও বর্ণবৈষম্যে শীর্ষস্থানে নেলসন ম্যান্ডেলার দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের শাসনের অবসান ঘটেছে প্রায় দুই যুগ আগে। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রবাদপুরুষ নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে রাজনৈতিক মুক্তি পেয়েছিল দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা। ম্যান্ডেলা মারা গিয়েছেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। তারপর অতিবাহিত হয়েছে আরও ৫ বছর। বর্ণবৈষম্যের দিক থেকে কেমন আছে আজকের দক্ষিণ আফ্রিকা?

শ্বেতাঙ্গরা দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। যদিও তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর জাতি মনে করে; অপরদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গদের মনে করতো নীচু জাত হিসেবে। এ কারণে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শাসন-শোষণ, নির্যাতন, অবজ্ঞা ইত্যাদি নেতিবাচক কর্মকাণ্ডকে বৈধ মনে করে শ্বেতাঙ্গ অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা। কিন্তু সেই শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী হয়নি। নেলসন ম্যান্ডেলার হাত ধরে আসে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি। 

জোহানেসবার্গের এই চিত্রটিই দেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। একপাশে অভিজাত শ্রেণীর বসবাস, অপর পাশে দরিদ্র শ্রেণীর বস্তির দৃশ্য; Image Source: CNN

তারপর দীর্ঘ ইতিহাস। দক্ষিণ আফ্রিকায় পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পেয়েছে। বহু বর্ণের দেশটিতে সকলের জন্য বাক স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও দেশের অধিকাংশ মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

এমনকি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ২৫তম বছরে এসেও দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বৈষম্যপূর্ণ অর্থনীতির দেশ। অর্থাৎ ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দারিদ্র মানুষের সংখ্যাও। এমনকি এই বৈষম্য ১৯৯৪ সালকেও ছাড়িয়ে গেছে- যে বছরটিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে খাতা-কলমে বর্ণবাদের অবসান ঘটলেও দীর্ঘদিনের শ্বেতাঙ্গ শাসনের প্রভাব এখনো দূর করা যায়নি। শ্বেতাঙ্গরা শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার অধিকারী ছিল এমনটি নয়। দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ও কল-কারখানার মালিকানাও ছিল তাদের দখলে। ১৯৯৪ সালে যখন দেশটির কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেন, তখন হয়তো সকলেই ভেবেছিল, এবার বুঝি কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক ভাগ্যও বদলে যাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি; তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন তার রাজনৈতিক উত্তরসূরিরাও।  

কৃষ্ণাঙ্গ আন্দোলনের নেতা ও দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা; Image Source: wikipedia.org

২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘বিশ্ব ব্যাংকের দারিদ্র্যতা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য’ বিষয়ক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশটির সুবিধাবঞ্চিত যে সকল নাগরিক পূর্বে তুলনামূলক কম সম্পদের অধিকারী ছিলেন; যাদের দক্ষতার অভাব ছিল; যারা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হতেন; কিংবা যারা বেকার ছিলেন- তাদের কারোরই ভাগ্যের তেমন কোনো উন্নতি ঘটেনি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যারা নিজেদের উচ্চবর্ণের মনে করতো, সমাজের অভিজাত শ্রেণী হিসেবে গণ্য হতো, অর্থাৎ সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গরাই এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক নেতৃত্ব ধরে রেখেছেন। 

যখন ম্যান্ডেলার দল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)’ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতায় আসে, তখন জাতীয় পর্যায়ে তারা মাত্র ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। এর ফলে অনেক অঞ্চলে বর্ণবৈষম্য নতুন মাত্রা ধারণ করেছিল এবং শ্বেতাঙ্গদের সাথে কৃষ্ণাঙ্গদের আরও দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এর ফলে শ্বেতাঙ্গদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অর্থনৈতিক জগত থেকে কৃষ্ণাঙ্গরা তেমন কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেনি। 

বিশ্ব ব্যাংকের পরিসংখ্যানের উপর ভিত্তি করে সিএনএন এর তথ্যচিত্র; Image Source: CNN

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনেও অনুরূপ চিত্র উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানটির পরিসংখ্যানে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা ৬৩ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক বৈষম্যপূর্ণ দেশের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করছে। এই তালিকায় ২৫ পয়েন্ট নিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গণমাধ্যম সিএনএন-এর তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে, ১৯৯৩ সালে দেশটির পয়েন্ট ছিল ৫৯, যা বর্তমানে ক্রম অবনতির মাধ্যমে ৬৩-তে এসে উপনীত হয়েছে। অবশ্য ২০০৫ সালে এটি আরও অবনতি হয়ে ৬৫-তে গিয়েছিল।

বিশ্লেষকরা এজন্য সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। এ বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় নিয়োজিত অক্সফামের গণতন্ত্র ও প্রশাসন ব্যবস্থা বিষয়ক পরিচালক মথান্ডাজো এনডলভু বলেন,

সরকারি পর্যায়ে পদ্ধতিগত ত্রুটি ও ব্যর্থতার কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি উল্লেখ করেন, শুধুমাত্র আয়ের ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য তৈরি হয়েছে এমনটি নয়, বরং সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান ও চাকুরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও এই বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে।

২৫ বছরের গণতান্ত্রিক শাসনের স্বাদ আমরা ইতিবাচক ভাবে তুলে ধরতে পারতাম যদি ভূ-সম্পত্তিতে আমাদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠা হতো, উত্তম স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত হতো, আমাদের শিশুরা যথাযথ পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা পেত। সরকার সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি।

তবে এর মানে এই নয় যে, গত ২৫ বছরে সরকারের কোনো অর্জন নেই। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশটিতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর মৌলিক সেবা, যেমন- বিদ্যুৎ, পানি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ধারাবাহিক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশ এসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পেরেছে। এই অংশটি যখন ক্রমাগত সমৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে, তখন অন্যরা দু’বেলা আহারের জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করে যাচ্ছে।

দেশটির ৭১ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ ধনিক শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত; Image Source: CNN

এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশটির ৭১ শতাংশ সম্পদ মাত্র ১০ শতাংশ ধনিক শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে, অপরদিকে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করা ৬০ শতাংশ মানুষের দখলে রয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ সম্পদ। আর মধ্যবিত্ত ৩০ শতাংশের দখলে রয়েছে বাকি ২২ শতাংশ সম্পদ। এ বিষয়ে আক্ষেপ করে মথান্ডাজো এনডলভু বলেন,

আপনি যদি খেয়াল করেন, প্রতিদিন যে পরিমাণ লোক ক্লান্ত দেহে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ছে- সেই পরিসংখ্যানটা অত্যন্ত দুঃখজনক।

যে ক্ষুদ্র অংশটি দেশের উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছে, তারা মূলত শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী। শ্বেতাঙ্গরা এখনো অভিজাত শ্রেণী হিসেবে বিবেচিত। অন্যদিকে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে দারিদ্র্যের মাত্রা অনেক বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মারে লিবব্র্যান্ড, যিনি ২০০৮-১৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার সামাজিক অগ্রগতি নিয়ে কাজ করছেন, তিনি বলেন, 

দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজাত শ্রেণীর অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ- অন্তত শীর্ষ ৫ শতাংশ। আমরা এখন এমন এক পথে হাঁটছি- যেখানে বৈষম্যহীন সমাজের কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। এই সমাজে বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমাগত দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক তথ্যচিত্রে দেখা যায়, দেশটির শিল্প-কারখানার ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদগুলোর ৬৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের দখলে। আর কৃষ্ণাঙ্গদের দখলে মাত্র ১৪.৩ শতাংশ। বাকি পদগুলো ভারতীয় ও অন্যান্য মিশ্র বর্ণের লোকজনের দখলে। যদিও কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর প্রায় ৮০ শতাংশ সদস্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে, অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ সদস্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।  

 দেশটির শিল্প-কারখানার ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদসমূহে বৈষম্য; Source: Commission for Employment Equity/BBC

তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের চিত্র ভিন্ন। যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদগুলোর ৭০ শতাংশ শ্বেতাঙ্গদের দখলে, সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদগুলোর ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গদের দখলে। 

এই সামগ্রিক চিত্র বলে দেয়, বর্ণবৈষম্যকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের মধ্যে বড় ধরনের মনস্ত্বাত্তিক লড়াই চলছে। এই লড়াই যেকোনো সময় সংঘাতে রূপ নিতে পারে। বিশ্লেষকরা এর আশু কোনো সমাধান দেখছেন না। মারে লিবব্র্যান্ড বলেন,

এটি এমন এক জটিল পরিস্থিতি, যেখানে আপনি চাইলেও দ্রুততর কোনো সমাধান দিতে পারবেন না, কেননা এই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থা দায়ী।

তবে এর সমাধানে সকল ধর্ম-বর্ণের নাগরিকদের মধ্যে পারস্পারিক যোগাযোগ ও সম্পর্ক বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সামাজিক পর্যায়ে বর্ণবৈষম্য দূর করা না গেলে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই বৈষম্য দূর করা আরও কঠিন হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি যা-ই হোক, এই অবস্থার অবসান হোক, এটাই সবার কামনা।

This is a Bangla article about South Africa: the world's most unequal country.

All The Sources are hyperlinked in the article. 

Feature Image: Medium

Related Articles

Exit mobile version