তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সোমবার তার সবচেয়ে বড় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন। এ বিজয়ের ফলে তিনি প্রায় ৮ কোটি ১০ লক্ষ জনগণের দেশটিতে অন্তত ২০২৩ সাল পর্যন্ত নির্বাহী ক্ষমতায় থাকবেন। ন্যাটোর সদস্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রার্থী এই দেশটির আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, এরদোয়ান তুরস্ককে রূপান্তরিত করার অন্বেষণ থেকে কখনও পশ্চাদপসরণ হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অনেক বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সড়ক, সেতু, হাসপাতাল ও বিদ্যালয় নির্মাণের তত্ত্বাবধায়নের জন্য তুর্কি মুসলমান শ্রমিক শ্রেণী ৬৫ বছর বয়সী এরদোয়ানকে বেশ পছন্দ করে। তবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করায় তিনি বেশ সমালোচিত হয়েছেন। প্রায় ১৬ হাজার মানুষকে তিনি কারাগারে প্রেরণ করেন।
জয়লাভের পর এরদোয়ান রাজধানী আঙ্কারায় তার দলের সদর দফতরের বারান্দা থেকে বিজয়ী ভাষণ দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, “এই নির্বাচনের বিজয়ী আমার ৮ কোটি ১০ লক্ষ নাগরিকের মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তি।”
নির্বাচনের ফলাফল
প্রায় সব ভোট গণনার পর দেখা যায়, এরদোয়ান প্রায় ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মুহাররেম ইনসে পেয়েছেন ৩১ শতাংশ ভোট। রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু জানায়, ক্ষমতাসীন জোটের মাঝে একেপি নিজেই ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে আনুমানিক ২৯৩ টি আসন পেয়েছে। জোটের অপর অংশীদার, এমএইচপি প্রায় ১১ শতাংশ ভোট নিয়ে আনুমানিক ৫০টি আসন পেয়েছে।
রাষ্ট্রপতির ভোটে মুহাররেম ইনসের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও প্রধান বিরোধী দল সিএইচপি মাত্র ২৩% (১৪৬ আসন) জিতেছে, যখন তার জাতীয়তাবাদী দল জিতেছে মাত্র ১০ শতাংশ ভোট (৪৪ আসন)।
এই বিজয়ের ফলে কী ক্ষমতা পাবেন তিনি?
তুরস্কের নতুন সংবিধানের অধীন রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান নতুন বেশ কিছু ক্ষমতা পাবেন। গত বছর ৫১ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণে একটি সংশোধিত গণভোটে এই পরিবর্তনগুলো অনুমোদন করা হয়েছিল। এগুলো নির্বাচনের পর কার্যকর হওয়ার কথা।
এগুলোর মধ্যে থাকছে-
· সরাসরি মন্ত্রী ও ভাইস প্রেসিডেন্টসহ শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগ।
· দেশের আইনী ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা।
· রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থা আরোপ করার ক্ষমতা।
কিছু সমালোচকের মতে প্রেসিডেন্টের এই বর্ধিত ভূমিকাটি একক ব্যক্তির হাতে খুব বেশি ক্ষমতা দিয়ে দিচ্ছে। তুরস্কের নতুন এই ব্যবস্থায় ফ্রান্স বা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কার্যনির্বাহী পরিষদের মতো ভারসাম্য থাকবে না। বর্ধিত এই কর্তৃত্ব এরদোয়ানকে তুরস্কের অর্থনৈতিক দুর্দশার মোকাবেলা করতে এবং দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুর্দি বিদ্রোহীদেরকে পরাজিত করার ক্ষমতা প্রদান করবে বলে তিনি মনে করেন। তার বিজয় ভাষণে তিনি বলেন, তুরস্ক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আরো দৃঢ়ভাবে পদক্ষেপ নেবে। তিনি আরও জানান, তারা সিরিয়ার ভূখণ্ডকে মুক্ত করবেন যেন শরণার্থী সেখানে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে পারে।
এরদোয়ান ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে ১১ বছর মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। নতুন সংবিধানের অধীনে তিনি ২০২৩ সালে তার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। এর অর্থ জয়ী হলে তিনি ২০২৮ পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারেন।
নির্বাচনটি কি অবাধ ও নিরপেক্ষ ছিল?
ভোটগ্রহণ কেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার ছিল। তবে ভোটের আগে নির্বাচনী জালিয়াতির বিষয়ে উদ্বেগ উত্থাপিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমের মতে প্রায় ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোটে অংশগ্রহণ করেছেন।
সমালোচকরা বলছেন, নির্বাচনী প্রচারাভিযান খুব অসঙ্গত অবস্থার অধীনে ঘটেছে। এরদোয়ান ভোটের জন্য গণমাধ্যমের উপর প্রভাব খুব বেশি বিস্তার করেন। বিরোধীদলগুলো গণমাধ্যমে প্রচারের ক্ষেত্রে খুব কম প্রচার পেয়েছে। ডানপন্থী কর্মীরা জানান, তুরস্কের সব দলের জন্য ব্যাপারে সংবাদ করার জন্য গণমাধ্যম মুক্ত নয়। পর্যবেক্ষক দলগুলোর মতে, আধুনিক এর্দোয়ানের শাসনামলে এটি সাংবাদিকদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেলখানা হয়ে উঠেছে।
এদিকে এরদোয়ান বলেছেন, “আমি আশা করি কেউ নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে ফলাফলের উপর ছায়া ফেলে গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা করবে না।”
প্রতিক্রিয়া
এরদোয়ানের বিজয়ের ফলে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সহ ইসলামী নেতারা অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এরদোয়ানের “মহান রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এবং গণ সমর্থন” এর কথা বলেন।
রিপাবলিকান পিপলস পার্টি (সিএইচপি) থেকে জনাব ইনসে বলেন, নির্বাচনের ঘোষণা থেকে ফলাফল দান পর্যন্ত নির্বাচনটি অসঙ্গত ছিল। তিনি আরও বলেন, তুরস্ক এক ব্যক্তির শাসনের বিপজ্জনক সময়ের মধ্যে প্রবেশ করছে। তবে তিনি স্বীকার করেন যে, সরকারি ফলাফল এবং তার দলের পরিসংখ্যানের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই। তাই তিনি এ ফলাফল মেনে নেবেন।
নির্বাচনে আলোচ্য বিষয়গুলো কী ছিল?
সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল অর্থনীত। তুর্কি লিরার মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১১ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছিল, যদিও দেশটির অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরদোয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংককে সুদের হার না বাড়াতে চাপ প্রয়োগ করেন এবং ভোটের আগে প্রস্তাব করেছিলেন যে, তিনি এর স্বাধীনতা সীমিত করতে পারেন। এছাড়া সন্ত্রাসবাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কেননা তুরস্ক প্রায়ই কুর্দি জঙ্গী এবং আইএস জিহাদীদের আক্রমণের শিকার হয়।
এরদোয়ানের প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাকে তুরস্কের নাগরিক অধিকার ক্ষতিগ্রস্ত করার এবং আধিপত্যবাদী শাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিল। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরে তুরস্কে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। এর সাথে প্রায় ১ লক্ষ ৭ হাজার সরকারি কর্মচারী এবং সৈন্যদের তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিদ্রোহের পর থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি লোককে বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছে।
মুহাররম ইনসে প্রচারের অগ্রগতিতে বিপুল জনসংযোগ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিএইচপি প্রার্থী ইনসের এই প্রচারণা তুরস্কের বিরোধী দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এরদোয়ানের আধিপত্যর সমাপ্তি ঘটাতে ব্যর্থ হন।
আবারও নির্বাচনে জয়ী হয়ে নতুন ক্ষমতা পাওয়া এরদোয়ানের পরবর্তী পদক্ষেপগুলো জনগণের পক্ষে হবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে।
Featured Image Source: BBC