কারামেহের যুদ্ধ: যখন ইসরায়েল পরাজিত হয়েছিল জর্দানীয় ও ফিলিস্তিনিদের কাছে

লেভান্ট অঞ্চলে অবস্থিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের শীর্ষ সামরিক শক্তিগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েল যেসব সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তারা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিজয় লাভ করেছে। এর ফলে (এবং ইসরায়েলি ও ইসরায়েলপন্থী প্রচারণার কারণে) বিশ্বব্যাপী ‘ইসরায়েল অপরাজেয়’ এরকম একটি ধারণা বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রই প্রকৃতপক্ষে অপরাজেয় নয়, এবং ইসরায়েলও এর ব্যতিক্রম নয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইসরায়েল বিশুদ্ধ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করেছে। এরকমই একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা হচ্ছে ‘কারামেহের খণ্ডযুদ্ধ’ বা ‘ব্যাটল অফ কারামেহ’ (Battle of Karameh)।

১৯৬৮ সাল। এই সময়কে মধ্যপ্রাচ্যের আরব জনসাধারণের জন্য খুবই অবমাননাকর একটি সময় হিসেবে অভিহিত করলে অত্যুক্তি করা হবে না। ছয় মাস আগে ১৯৬৭ সালের জুনে অনুষ্ঠিত মাত্র ৬ দিন স্থায়ী আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধে ক্ষুদ্র ইসরায়েলের নিকট আরব রাষ্ট্রগুলোর (প্রধানত মিসর, জর্দান, সিরিয়া ও ইরাক) সম্মিলিত বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। ইসরায়েলিরা দখল করে নিয়েছে মিসর, জর্দান ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যে তীব্র কিন্তু বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলছে, কিন্তু মিসরীয়রা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে এসময় আরব বিশ্বের জন্য খুব একটা ভালো সময় যাচ্ছিল না।

১৯৬৭ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় ইসরায়েল জর্দানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুজালেমসহ জর্দান নদীর পশ্চিম তীর দখল করে নেয়। এই অঞ্চলটি ১৯৪৮–১৯৪৯ সালের আরব–ইসরায়েলি যুদ্ধের সময় থেকে জর্দানের শাসনাধীনে ছিল, এবং ফিলিস্তিনি গেরিলারা মাঝে মাঝে এই অঞ্চলটি থেকে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করত। ইসরায়েল অঞ্চলটি দখল করে নেয়ার পর হাজার হাজার ফিলিস্তিনি অঞ্চলটি ছেড়ে জর্দানে আশ্রয় গ্রহণ করে, এবং ‘ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা’ (Palestine Liberation Organization, ‘PLO’) জর্দান থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে। ১৯৬৮ সালের প্রারম্ভে মধ্য জর্দানের কারামেহ নামক একটি ক্ষুদ্র শহরে ফিলিস্তিনি গেরিলারা তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে, এবং পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাত এখানে তাঁর সদর দপ্তর স্থাপন করেন।

কারামেহের যুদ্ধের সময় জর্দানীয়দের ভারী কামান; Source: Wikimedia Commons

ফিলিস্তিনি গেরিলারা এখান থেকে ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে শুরু করে, এবং জর্দানীয় সেনাবাহিনীর পদাতিক ও গোলন্দাজ ইউনিটগুলো তাদেরকে কাভারিং ফায়ার দিয়ে সহায়তা করে। ১৯৬৮ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি জর্দানীয় সৈন্যরা ইসরায়েলের বেইত শিয়ান ও জর্দান উপত্যকার ওপর মর্টার নিক্ষেপ করে, এবং প্রত্যুত্তরে ইসরায়েলিরা জর্দানীয় সশস্ত্রবাহিনীর ঘাঁটি, গোলন্দাজ ব্যাটারি ও পূর্ব ঘোর খালের ওপর গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলা পরিচালনা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও জর্দানের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি হয়, এবং কারামেহ থেকে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের অপসারণের ব্যাপারে জর্দানীয় সরকার সম্মত হয়। কিন্তু জর্দানীয় সরকার কারামেহে সৈন্য ও পুলিশ প্রেরণ করলে ফিলিস্তিনি গেরিলারা তাদের ঘিরে ফেলে, এবং জর্দানীয়রা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৬৮ সালের মার্চের মধ্যে কারামেহে প্রায় ৯০০-১,০০০ ফিলিস্তিনি গেরিলা এবং কয়েক শত বেসামরিক ফিলিস্তিনি অবস্থান করছিল।

ইসরায়েলি রণপ্রস্তুতি

ফিলিস্তিনিদের ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর থেকেই ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকরা জর্দানের অভ্যন্তরে অবস্থিত পিএলও ঘাঁটিতে একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করার ব্যাপারে আলোচনা শুরু করেন। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ছিল, কারণ জর্দান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল এবং এজন্য জর্দানের ওপর নতুন করে ইসরায়েলি আক্রমণের ফলে যুক্তরাষ্ট্র অসন্তুষ্ট হতে পারত। তদুপরি, তারা আশঙ্কা করছিল যে, এই অভিযানে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে এবং এটি ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, ইসরায়েলি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এই পরিকল্পনার পক্ষে ছিল, এবং তাদের যুক্তি ছিল যে, এই আক্রমণের ফলে ইয়াসির আরাফাত ও পিএলওর শক্তিক্ষয় ঘটবে ও তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে। এমতাবস্থায় ইসরায়েলি মন্ত্রিপরিষদ এই অভিযানটি অনুমোদন করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিল, এবং বেশ কয়েকবার তারা এই অভিযানটি স্থগিত রাখে।

ইতোমধ্যে পিএলওর প্রধান সদস্য ফাতাহ ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি করছিল। ১৭ মার্চ জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলি স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়োসেফ তেকোয়াহ আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ‘আরবদের আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ডে’র নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ১৮ মার্চ ফাতাহ গেরিলাদের পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে একটি স্কুলবাস বিধ্বস্ত হয়, এবং এর ফলে ২ জন প্রাপ্তবয়স্ক বেসামরিক নাগরিক নিহত ও ১০ জন শিশু আহত হয়। এটি ছিল তিন মাসের মধ্যে ফাতাহ কর্তৃক ইসরায়েলের অভ্যন্তরে পরিচালিত ৩৮ তম আক্রমণ। এই আক্রমণের পর ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা কারামেহে পিএলও ঘাঁটির ওপর আক্রমণ পরিচালনার অনুমোদন প্রদান করে। শেষ মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অভিযান পরিচালনা থেকে ইসরায়েলকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কারামেহ শহরে ইসরায়েলি সৈন্যরা; Source: Wikimedia Commons

ইসরায়েলিরা একই সময়ে জর্দানের অভ্যন্তরে দুটি অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাদের লক্ষ্যবস্তু ছিল কারামেহ শহর এবং শহরটি থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত সাফি গ্রামে অবস্থিত পিএলও ঘাঁটিদ্বয়। এই দুটি লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ পরিচালনার জন্য ইসরায়েলিরা দুটি পৃথক পরিকল্পনা করেছিল– কারামেহের জন্য ‘অপারেশন ইনফার্নো’, আর সাফির জন্য ‘অপারেশন আসুতা’। এই অভিযান পরিচালনার উদ্দেশ্যে ইসরায়েলিরা ইসরায়েলি–জর্দানীয় সীমান্ত বরাবর যে সৈন্যদল জড়ো করে, তাদের মধ্যে ছিল ১টি আর্মার্ড ব্রিগেড, ১টি পদাতিক ব্রিগেড, ১টি প্যারাট্রুপার ব্যাটালিয়ন, ১টি প্রকৌশল ব্যাটালিয়ন এবং ৫টি গোলন্দাজ ব্যাটালিয়ন। সৈন্যদলটির সাঁজোয়া বহরে মোট ৪৭টি ট্যাঙ্ক ছিল।

ইসরায়েলিরা এই সৈন্যদলকে ৪টি টাস্কফোর্সে বিভক্ত করে। এগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ টাস্কফোর্সের কাজ ছিল জর্দান নদীর ওপরে অবস্থিত অ্যালেনবি সেতু অতিক্রম করা এবং দক্ষিণ দিক থেকে কারামেহে পৌঁছানো। দ্বিতীয় টাস্কফোর্সের কাজ ছিল দামিয়াহ সেতু অতিক্রম করা এবং উত্তর দিক থেকে কারামেহে পৌঁছানো। এর মধ্য দিয়ে তারা দুদিক থেকে কারামেহের ওপর আক্রমণ চালাবে। তৃতীয় টাস্কফোর্সটির কাজ ছিল হেলিকপ্টার থেকে কারামেহ শহরে অবতরণ করে আক্রমণ পরিচালনা করা। আর চতুর্থ টাস্কফোর্সের কাজ ছিল রাজা আব্দুল্লাহ সেতুর কাছে আক্রমণ চালিয়ে জর্দানীয় সৈন্যদের কারামেহ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া। অবশ্য ইসরায়েলিদের ধারণা ছিল, জর্দানীয় সশস্ত্রবাহিনী এমনিতেও তাদের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করবে না।

ইসরায়েলিদের এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল খুবই সরল– কারামেহে অবস্থিত পিএলও ঘাঁটিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া, ইয়াসির আরাফাতকে বন্দি করা অথবা হত্যা করা, এবং ফিলিস্তিনি গেরিলাদের সহায়তা করার জন্য জর্দানকে শাস্তি প্রদান করা। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলিদের বিরাট বিজয় তাদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি করেছিল, ফলে এই অভিযান যে সফল হবেই, সেটি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো সংশয় ছিল না।

ফিলিস্তিনি ও জর্দানীয় রণপ্রস্তুতি

ইসরায়েলিরা তাদের রণপ্রস্তুতি গোপন রাখতে পারেনি বা রাখার চেষ্টা করে ন। জর্দানীয় গোয়েন্দা সংস্থা জর্দানীয়–ইসরায়েলি সীমান্তের কাছাকাছি ইসরায়েলি সামরিক তৎপরতা লক্ষ্য করে এবং জর্দানীয় সরকারকে সতর্ক করে দেয়। পিএলওর ডেপুটি কমান্ডার আবু ইয়াদের দাবি অনুযায়ী, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ আসন্ন ইসরায়েলি আক্রমণ সম্পর্কে জর্দানীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করেছিল, এবং জর্দানীয় গোয়েন্দা সংস্থা ফিলিস্তিনি গেরিলাদের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেয়। তদুপরি, মিসরীয় গোয়েন্দা সংস্থাও সম্ভাব্য ইসরায়েলি আক্রমণ সম্পর্কে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের সতর্ক করে দেয়। এর ফলে ফিলিস্তিনি বা জর্দানীয়রা ইসরায়েলি আক্রমণের জন্য ঠিক অপ্রস্তুত ছিল না।

কারামেহের যুদ্ধের পর একটি পরিত্যক্ত ইসরায়েলি সেঞ্চুরিয়ন ট্যাঙ্ক; Source: Wikimedia Commons

সম্ভাব্য ইসরায়েলি আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জর্দানীয় সরকার কারামেহ ও এর নিকটবর্তী সেতুগুলোর আশেপাশে জর্দানীয় সেনাবাহিনীর ১ম পদাতিক ডিভিশনকে মোতায়েন করে। এই ডিভিশনের অধীনে ছিল ৪টি ব্রিগেড, ১০টি গোলন্দাজ ব্যাটারি এবং ১টি ট্যাঙ্ক ব্যাটালিয়ন। তাদের কাছে ছিল ১০৫টি ট্যাঙ্ক এবং ৮৮টি ভারী কামান। জর্দানীয় পদাতিক সৈন্যদেরকে জর্দান নদীর ওপর অবস্থিত সেতুগুলোর কাছে মোতায়েন করা হয় এবং প্রতিটি পদাতিক সৈন্যদলের সঙ্গে একটি করে ট্যাঙ্ক কোম্পানি সংযুক্ত করা হয়। আর কারামেহের নিকটবর্তী উঁচু স্থানগুলোতে ভারী কামানগুলো স্থাপন করা হয়। এর পাশাপাশি কারামেহে ৯০০-১,০০০ ফিলিস্তিনি গেরিলা অবস্থান করছিল, এবং তারাও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। তারা অল্প কিছু যোদ্ধা কারামেহ শহরের ভিতরে রেখে বাকিদেরকে আশেপাশে সুবিধাজনক স্থানে স্নাইপিং পজিশনে মোতায়েন করে।

ইসরায়েলিদের আক্রমণের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, সেটা সম্পর্কে ফিলিস্তিনি বা জর্দানীয়দের স্পষ্ট ধারণা ছিল না। তাদের আশঙ্কা ছিল, ইসরায়েলিরা হয়তো জর্দানের রাজধানী আম্মান দখলের উদ্দেশ্যে আক্রমণ পরিচালনা করবে। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী জর্দানীয় সৈন্যদের মধ্যে প্রচারপত্র বিলি করে, এবং সেগুলোতে বলা হয় যে, ইসরায়েলিরা তাদের কোনো ক্ষতি করতে আগ্রহী নয় এবং এই যুদ্ধে তারা যেন হস্তক্ষেপ না করে। কিন্তু জর্দানীয় সৈন্যরা এগুলোকে উপেক্ষা করে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়।

যুদ্ধ

১৯৬৮ সালের ২১ মার্চ ভোর সাড়ে ৫টায় ইসরায়েলি সৈন্যরা জর্দান নদীর ওপরে অবস্থিত সেতু তিনটির ওপর একইসঙ্গে আক্রমণ শুরু করে। উত্তরে ইসরায়েলি সামরিক প্রকৌশলীরা নদীর ওপর একটি পন্টুন সেতু তৈরি করে এবং এটি দিয়ে সৈন্যরা নদী অতিক্রম করে। অ্যালেনবি সেতু বরাবরও ইসরায়েলি সৈন্যরা অগ্রসর হয়। সকাল সাড়ে ৬টায় ইসরায়েলিরা হেলিকপ্টার থেকে কারামেহ শহরের উত্তরে প্যারাট্রুপার নামায়, কিন্তু ফাতাহ কমান্ডো ও জর্দানীয় সৈন্যরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়, এবং ইসরায়েলিদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়।

যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত কারামেহ শহরের একটি চিত্র; Source: Wikimedia Commons

দক্ষিণে জর্দানীয়দের ব্যাপক গোলাবর্ষণের ফলে ইসরায়েলিরা আব্দুল্লাহ সেতুর কাছে পন্টুন সেতু তৈরি করতে ব্যর্থ হয় এবং তাদের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। কিন্তু তারা অ্যালেনবি সেতু অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। সেতুটি অতিক্রমের পর ইসরায়েলি সৈন্যদলটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়। একটি দল উত্তর দিকে কারামেহ অভিমুখে অগ্রসর হয়, আরেকটি দল পূর্ব দিকে সালৎ সড়ক অবরোধ করতে অগ্রসর হয়, এবং অন্য একটি দল দক্ষিণ দিকে আব্দুল্লাহ সেতু অতিক্রমের জন্য নিযুক্ত সৈন্যদের সহায়তা করতে অগ্রসর হয়। অন্য একটি ইসরায়েলি সৈন্যদ দামিয়াহ সেতু অতিক্রম করে এবং মুসরি দখল করে কারামেহের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু জর্দানীয়রা তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে।

অ্যালেনবি সেতু অতিক্রম করে যে ইসরায়েলি সৈন্যদলটি কারামেহ অভিমুখে অগ্রসর হয়েছিল, তারা জর্দানীয়দের প্রতিরোধ ভেঙে সকাল ৭টার একটু আগে কারামেহে পৌঁছায়, এবং ৮টার মধ্যে শহরটি পুরোপুরি দখল করে নেয়। এই বাহিনীটি ইতিপূর্বে কারামেহে নামানো প্যারাট্রুপারদের সঙ্গে একজোট হয়, এবং শহরটিতে অবস্থিত পিএলও ঘাঁটিটি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায়। জর্দানীয় ও ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিতে তারা ঘাঁটিটির অধিকাংশ ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়, কিন্তু ইয়াসির আরাফাত ইতোমধ্যে নিরাপদ স্থানে পশ্চাৎপসরণ করায় তাকে বন্দি করা ইসরায়েলিদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এদিকে অ্যালেনবি সেতু অতিক্রমকারী ইসরায়েলি সৈন্যদলের অপর দুটি অংশ জর্দানীয় সৈন্যদের সঙ্গে এক প্রলম্বিত সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং কারামেহে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলিরা বিমান হামলা চালিয়ে জর্দানীয়দের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনিরা প্রথমবারের মতো আত্মঘাতী বোমা হামলা পরিচালনা করে।

এভাবে ‘অপারেশন ইনফার্নো’ একটি পূর্ণ যুদ্ধে রূপ নেয়। অন্যদিকে, একই সময়ে মৃত সাগরের দক্ষিণে সাফি গ্রামের নিকটে অবস্থিত কয়েকটি ক্ষুদ্র পিএলও ঘাঁটির বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সৈন্যরা ‘অপারেশন আসুতা’ আরম্ভ করে। এই অভিযানে ইসরায়েল সেনা ও বিমানবাহিনীর আক্রমণে ২০ জন জর্দানীয় সৈন্য ও পুলিশ এবং ২০ জন ফাতাহ যোদ্ধা নিহত হয়। ২৭ জন ফাতাহ যোদ্ধাকে ইসরায়েলিরা বন্দি করে নিয়ে যায়। অর্থাৎ, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র মাত্রার ‘অপারেশন আসুতা’ সাফল্য অর্জন করে, কিন্তু বৃহৎ মাত্রার ‘অপারেশন ইনফার্নো’ একটি অচলাবস্থায় রূপ নেয়।

যুদ্ধের পর অধিকৃত ইসরায়েলি সামরিক সরঞ্জামের পাশে একজন জর্দানীয় সৈন্য; Source: Wikimedia Commons

ইসরায়েলিরা অনুধাবন করতে পারে যে, কারামেহের পিএলও ঘাঁটি পুরোপুরি ধ্বংস করা কিংবা পিএলও যোদ্ধাদের সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে তারা পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সকাল ১১টায় ইসরায়েলি হেলিকপ্টারে করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের অপসারণ আরম্ভ হয়। ইসরায়েলি সরকারের নির্দেশ ছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে যতগুলো সাঁজোয়া যান উদ্ধার করা সম্ভব, সবগুলোই যেন উদ্ধার করা হয়। ফলে ইসরায়েলিদের সৈন্য প্রত্যাহার সম্পন্ন করতে করতে রাত ৮টা ৪০ মিনিট বেজে যায়।

এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। যুদ্ধের ফলে ৪০ থেকে ৮৪ জন জর্দানীয় সৈন্য নিহত এবং ১০৮ থেকে ২৫০ জন আহত হয়। ১০০ থেকে ২০০ জন ফিলিস্তিনি গেরিলাও এই যুদ্ধে প্রাণ হারায়। তদুপরি, ইসরায়েলিরা পশ্চাৎপসরণের সময় ৪ জন জর্দানীয় সৈন্য এবং ১২০ থেকে ১৫৬ জন ফিলিস্তিনি গেরিলাকে বন্দি করে সঙ্গে নিয়ে যায়। এর পাশাপাশি জর্দানীয়দের ২৮টি ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ইসরায়েলিরা ২টি জর্দানীয় ট্যাঙ্ক দখল করে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, এই যুদ্ধে ২৮ থেকে ৩৩ জন ইসরায়েলি সৈন্য নিহত এবং ৬৯ থেকে ১৬১ জন আহত হয়। তাদের ২৭টি ট্যাঙ্ক, ২টি হাফ–ট্রাক, ৬টি আর্মার্ড কার ও ১টি যুদ্ধবিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং আরো ১টি যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়। তদুপরি, তাদের ৪টি ক্ষতিগ্রস্ত ট্যাঙ্ক তারা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিত্যাগ করে।

ফলাফল

ইসরায়েলি সরকারের দাবি অনুযায়ী, কারামেহের যুদ্ধে ইসরায়েল বিজয়ী হয়েছে, কারণ এই যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ফিলিস্তিনি ও জর্দানীয়দের তুলনায় কম, এবং তারা কারামেহে অবস্থিত পিএলও ঘাঁটির বৃহদাংশ ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। বাস্তবিকই কারামেহের যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনি গেরিলারা অনুধাবন করতে পারে যে, জর্দানীয়–ইসরায়েলি সীমান্তের এত কাছাকাছি তাদের ঘাঁটির উপস্থিতি তাদের নিজেদের জন্যই নিরাপদ নয়। এজন্য তারা তাদের ঘাঁটি জর্দানের আরো ভিতরে সরিয়ে নেয়, ফলে তাদের পক্ষে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনা তুলনামূলকভাবে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

কারামেহের যুদ্ধের পর ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ইয়াসির আরাফাতের ছবি; Source: WorthPoint

অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি ও জর্দানীয়রা দাবি করে যে, এই যুদ্ধে তারাই প্রকৃত বিজয়ী। বস্তুত ইসরায়েলিরা তাদের এই অভিযানের কোনো লক্ষ্যই পুরোপুরিভাবে অর্জন করতে পারে নি। ইয়াসির আরাফাতকে বন্দি করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি; কারামেহের পিএলও ঘাঁটি তারা পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি (যুদ্ধের অল্প কিছুদিন পরেই ঘাঁটিটিকে পুনরায় গড়ে তোলা হয়); এবং জর্দানকে শাস্তি প্রদান করা তো সম্ভব হয়ইনি, উল্টো ইসরায়েলিদের ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে জর্দানীয়রা ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাছাড়া, এই যুদ্ধে ইসরায়েলিরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাৎপসরণ করেছে, জর্দানীয় বা ফিলিস্তিনিরা নয়। যুদ্ধের পর জর্দানীয়রা দখলকৃত ইসরায়েলি সামরিক সরঞ্জাম আম্মানে ‘বিজয়সূচক ট্রফি’ হিসেবে প্রদর্শন করে। বস্তুত এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইসরায়েলি সৈন্যরাও ইসরায়েলি সরকারের দাবির সঙ্গে একমত নয়, এবং তাদের মতে এই যুদ্ধটি ছিল ইসরায়েলের জন্য একটি পরাজয়।

এই যুদ্ধে আরবদের বিজয়ের মূল কৃতিত্ব ছিল জর্দানীয়দের, কিন্তু জর্দানের রাজা হুসেইন ফিলিস্তিনি গেরিলাদের এই কৃতিত্ব নিতে দেন। এই যুদ্ধ ছিল ফাতাহের জন্য একটি বিরাট প্রচারণামূলক বিজয়। কারামেহের যুদ্ধ শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই প্রায় ৫,০০০ স্বেচ্ছাসেবক ফাতাহে যোগদান করে, এবং ১৯৬৮ সালের মার্চের মধ্যেই ফাতাহ প্রায় ২০,০০০ নতুন সদস্য লাভ করে। ১৯৬৮ সালের মধ্যেই বিশ্বের অন্তত ৮০টি রাষ্ট্রে ফাতাহের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এক কথায়, এই যুদ্ধে বিজয়ের ফলে ফাতাহ একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগঠনে পরিণত হয়, এবং ফিলিস্তিনি ইস্যু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায়।

২০১৮ সালে কারামেহের যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জর্দানের রাজা আব্দুল্লাহ কারামেহের যুদ্ধে অংশ নেয়া একজন জর্দানীয় সৈন্যের সঙ্গে কথা বলছেন; Source: The Jordan Times

অবশ্য পিএলওর জন্য এই যুদ্ধের একটি নেতিবাচক প্রভাবও ছিল। এই যুদ্ধে বিজয়ের ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়, এবং তারা এমনকি জর্দানীয় সরকারকে উৎখাত করার কথাও বলতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে জর্দানীয় সরকারের সঙ্গে তাদের তীব্র দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, এবং ১৯৬৯ সালে জর্দানীয় গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জর্দানীয় সরকার জর্দান থেকে পিএলওকে বিতাড়িত করে। এই ঘটনাটি ‘কালো সেপ্টেম্বর’ (Black September) নামে পরিচিতি অর্জন করেছে।

কিন্তু সামগ্রিকভাবে, কারামেহের যুদ্ধে ইসরায়েলি ব্যর্থতা ছিল ফিলিস্তিনি ও সমগ্র আরব বিশ্বের জন্য একটি বিরাট মনস্তাত্ত্বিক বিজয়। ইসরায়েলের নিকট বারংবার পরাজিত হওয়ার ফলে আরবদের মধ্যে যে গ্লানির সৃষ্টি হয়েছিল, এই খণ্ডযুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের ফলে এই গ্লানি আংশিকভাবে দূরীভূত হয়। কারামেহের যুদ্ধের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ জর্দানের অভ্যন্তরে আক্রমণ পরিচালনার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দাপ্রস্তাব গ্রহণ করে। এই যুদ্ধের পর ইসরায়েলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেন, “আজ থেকে ২০ বছর পর ইতিহাসবিদরা এই দিনকে ইসরায়েলের ধ্বংস শুরুর দিন হিসেবে লিখবে।”

Related Articles

Exit mobile version