পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের ক্ষমতায় আসার ঘটনা ধারাবাহিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতির সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাষ্ট্রক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর অবারিত প্রবেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম দখল করেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। এক মাসেরও কম সময়ে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন জেনারেল আইয়ুব খান, যিনি সামরিক বাহিনীর শীর্ষপদে এসেছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার সুপারিশেই। এক দশক পরে, জেনারেল আইয়ুব খানকে সরিয়ে আবার ক্ষমতায় আসেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। আশির দশকে সামরিক বাহিনীকে আরেকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় নিয়ে যান জেনারেল জিয়াউল হক। গত শতাব্দীর শেষদিকে এসে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নেওয়াজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ
জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের দিল্লীতে, ১৯৪৩ সালের আগস্টে। তার পূর্ববর্তী তিন প্রজন্ম ছিলেন সরকারি আমলা। তার বাবা কাজ করেছেন ব্রিটিশ ভারতে একজন অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে। দেশভাগের বেদনাবিধুর স্মৃতি নিয়ে ১৯৪৭ সালের আগস্টে জেনারেল মোশাররফের পরিবার দিল্লী থেকে করাচিতে স্থানান্তর হয়। তার বাবা যোগ দেন পাকিস্তানের ফরেইন সার্ভিসে। সেই সুবাদে জেনারেল মোশাররফের শৈশবের বড় একটা অংশ কেটেছে তুরস্কে। দেশে ফিরে তিনি পড়াশোনা করেছেন সেইন্ট প্যাট্রিক স্কুলে। ১৯৬১ সালে জেনারেল মোশাররফ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি, কাকুলে যোগ দেন, এবং ১৯৬৪ সালে আর্টিলারিতে কমিশন পান।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ এক বর্ণাঢ্য সামরিক জীবন পেয়েছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে অর্জনযোগ্য প্রায় সকল পদকই জিতেছেন। সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের পর পরই তিনি যোগ দেওয়ার সুযোগ পান এলিট স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে; ১৯৬৪-৭২ সাল তিনি কাজ করেছেন এখানেই। স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপে থাকা অবস্থায় তিনি অংশগ্রহণ করেন ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে, প্রশংসিত হন শত্রুর আক্রমণের মুখেও কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নিজের ঘাঁটি ধরে রাখায়। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ থেকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে এসে। কিন্তু, ডিসেম্বরে পাকিস্তান অংশে ভারতের সাথে যুদ্ধাবস্থায় সেই পোস্টিং হয়নি জেনারেল মোশাররফের। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশ হন পাকিস্তানে থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
১৯৭১ সালের পরেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে দ্রুতই প্রমোশন ঘটতে থাকে জেনারেল মোশাররফের। তিনি লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে প্রমোশন পান ১৯৭৪ সালে, কর্নেল পদে পদোন্নতি পেয়ে যান ১৯৭৮ সালের মধ্যেই। পরবর্তী এক দশক জুড়ে স্ট্র্যাটিজিক পড়াশোনা আর যোগাযোগের জায়গাগুলো বাড়তে থাকে জেনারেল মোশাররফের। আশির দশকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেন ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে, সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজেও।
এই সময়ের মধ্যেই প্রমোশন পেয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হন পারভেজ মোশাররফ, ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিয়াচন গ্লেসিয়ারের কাছাকাছি অঞ্চলে। আশির দশকের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের ঘনিষ্ঠ অফিসার ছিলেন জেনারেল মোশাররফ। তার যুদ্ধ-অভিজ্ঞতা ভূমিকা রেখেছিল ঘনিষ্ঠতা তৈরিতে। নব্বইয়ের দশকে তিনি পড়াশোনা করতে যান রয়্যাল কলেজ অব ডিফেন্স স্টাডিজে। সেখানে তিনি থিসিস করেন জেনারেল অ্যান্টনি ওয়াকারের অধীনে, যিনি জেনারেল মোশাররফকে তার জীবনে পাওয়া সেরা ছাত্র হিসেবে অভিহিত করেন। তার মাস্টার্সের থিসিস ছিল অস্ত্র প্রতিযোগিতা কীভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করছে।
পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল জেনারেল মোশাররফের। মেজর জেনারেল হিসেবে বেনজীর ভুট্টোর অধীনে অনেক দায়িত্বই পালন করেন তিনি। ১৯৯৩-৯৫ সালের মধ্যে জেনারেল মোশাররফ সেনাবাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, যা তার পরবর্তী মিলিটারি ক্যারিয়ারে উত্থানে ভূমিকা রাখে। ১৯৯৫ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে প্রমোশন পান পারভেজ মোশাররফ। তার পদায়ন হয় কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আই স্ট্রাইক কোরের কোর কমান্ডার হিসেবে। মংলা মিলিটারি ডিসট্রিক্টের এই কোরে রয়েছে পঞ্চাশ হাজার সেনাসদস্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুটো স্ট্রাইকার কোরের এটি একটি। স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানের হয়ে সবগুলো যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছে এই কোর। এর অধীনে রয়েছে বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার।
জেনারেল জাহাঙ্গীর কারামতের পর সেনাপ্রধান হিসেবে আলোচনায় ছিলেন তিনজন অফিসার। লেফটেন্যান্ট জেনারেল আলি কুলি খান, লেফটেন্যান্ট জেনারেল খালিদ নেওয়াজ, এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ সিনিয়র দুজনকে বাদ দিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে ফোর স্টার জেনারেল পদে প্রমোশন দেন। তিনি পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ১৯৯৮ সালের অক্টোবরে। সেনাপ্রধানের পদে নয় বছর ছিলেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের সাথে দ্বন্দ্বে ক্ষমতা দখল করেন তিনি। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, পাকিস্তানে জারি করেন সামরিক শাসন। প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফকে রাখা হয় গৃহবন্দী করে।
জেনারেল মোশাররফের লিগ্যাসি
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ অন্য স্বৈরশাসকদের মতোই রাজনৈতিক স্বাধীনতা আর নাগরিক অধিকারের ধারণাকে গুরুত্ব দেননি। নিজের শাসনের বৈধতার জন্য গণভোটের আয়োজন করেছেন, নিয়ন্ত্রিত যেসব নির্বাচনে তিনি ভোট পেয়েছেন ৯৮ শতাংশের অধিক। রাজনৈতিক অধিকার সীমাবদ্ধ রাখলেও জেনারেল মোশাররফের সময়ে সামাজিক উদারীকরণ হয়েছে পাকিস্তানের সমাজে। নারী অধিকারের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অগ্রগতি হয়েছে, উন্নতি হয়েছে শিক্ষাসহ অন্যান্য সূচকেও।
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরেই ঘটে নাইন-ইলেভেনের ঘটনা, শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ। পশ্চিমা শক্তিগুলো যুক্ত হয় এই যুদ্ধে। এর মূল যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আফগানিস্তান ও ইরাক, পরবর্তীতে সেটি ছড়িয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ পাকিস্তান ও পশ্চিমা শক্তিগুলোকে কাছাকাছি আনে, পাকিস্তান ছিল পশ্চিমাদের প্রসন্ন দৃষ্টিতে। জেনারেল মোশাররফ এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে টিকে থাকেন ক্ষমতায়, পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহৃত হতে থাকে তথাকথিত সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের ঘাঁটি হিসেবে। সিআইএ মানুষবিহীন ড্রোনের ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানে।
পশ্চিমাদের সাথেও জেনারেল মোশাররফকে দ্বৈত গেম খেলতে হয়েছে। একদিকে যেমন পশ্চিমাদের সুনজরে থাকার জন্য তিনি কিছু মিলিট্যান্টকে ধরিয়ে দিয়েছেন, আবার মিলিট্যান্ট কিছু গোষ্ঠীর সাথেও রেখেছেন সুসম্পর্ক। তালেবানদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সক্রিয় অংশীদার হয়েছে পাকিস্তান, আবার তালেবানদের উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। জেনারেল মোশাররফের এই দ্বৈত খেলার আরেকটি কারণ হতে পারে, আফগানিস্তানি তালেবানদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে পাকিস্তানি তালেবানদের। পাকিস্তানি তালেবানরা আবার অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, চালাতে পারে সন্ত্রাসী হামলা, লক্ষ্যবস্তু করতে পারে সামরিক অবকাঠামো আর বেসামরিক নাগরিকদের।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সাথে দ্বন্দ্বে প্রথমে সেনাপ্রধানের পদ ছাড়তে হয় জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে, পরবর্তী সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বে আসেন জেনারেল কায়ানি। পার্লামেন্টে অভিশংসনের শঙ্কায় পরবর্তীতে ছাড়তে হয় প্রেসিডেন্ট পদও, অবসান হয় জেনারেল মোশাররফের স্বৈরশাসনের। পাকিস্তানে তিনিই ক্ষমতা দখল করা সর্বশেষ সেনাপ্রধান।
বর্তমানের পাকিস্তান আসলে জেনারেল মোশাররফের রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারই। পাকিস্তানে যে মিলিট্যান্সির উত্থান ঘটেছে, বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে পাকিস্তান শীর্ষ কয়েকটি দেশের মধ্যে রয়েছে, এটি জেনারেল মোশাররফের শাসনেরই লিগ্যাসি। একটি দেশে যখন মানুষেরা স্বাধীনভাবে নিজেদের মত প্রকাশের সুযোগ পায় না, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায় না, রাজনৈতিকভাবে নিজের অসন্তুষ্টি প্রকাশের উপায় দেখে না, তখনই তারা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলোর উপর হতাশ হয়েছে মিলিট্যান্সির দিকে ঝুঁকে। পাকিস্তানে মিলিট্যান্সির উত্থানের পেছনে স্বৈরশাসকের দায় আছে, একইভাবে দায় বর্তায় জেনারেল পারভেজ মোশাররফের উপরও।
বিংশ শতাব্দীতে বহু সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে। সেনাবাহিনীর জেনারেলরা নিয়মিত ক্ষমতা দখল করেছে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে। কিন্তু, স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকেই কমছে সামরিক শাসকের গ্রহণযোগ্যতা, কমছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সমর্থন। জেনারেল মোশাররফ সামরিক বাহিনীর সাংগঠনিক সক্ষমতা আর সংঘাত উৎপাদনের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। তার শাসনে সহায়ক হয়েছে সেনাবাহিনীর সুস্পষ্ট চেইন অব কমান্ডও। কিন্তু, সামরিক বাহিনীর ব্যাপারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন খুব দ্রুত বদলাচ্ছিল তার সময়ে। গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো হরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়ে জেনারেল মোশাররফ প্রশ্নবিদ্ধ করেন সেনাবাহিনীকেই। তার সময় থেকেই সামরিক বাহিনীকে নিয়ে সমালোচনা বৃদ্ধি পায় পাকিস্তানে, বৃদ্ধি পায় রাজনীতিতে তাদের গডফাদারসুলভ আচরণের সমালোচনাও। বর্তমানে জেনারেল বাজওয়া আর জেনারেল আসিম মুনির যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সামরিক বাহিনীর প্রায় সবকিছু নিয়েই সমালোচনা হচ্ছে পাকিস্তানে, এর দায়ও জেনারেল মোশাররফের উপর বর্তায়।
প্রেসিডেন্সি পরবর্তী জীবন
জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতা ছাড়েন ২০০৮ সালে, দ্রুতই নির্বাসনে যেতে হয় তাকে। ২০১৩ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসলেও আদালতের বাধায় সেবার আর নির্বাচন করা হয়নি তার। এর মধ্যেই পাকিস্তানে জেনারেল মোশাররফের বিরুদ্ধে শুরু হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা। নেওয়াজ শরীফের ইচ্ছায় সেই মামলার কার্যক্রম এগিয়েছেও দ্রুত। তবে, ২০১৬ সালেই দেশত্যাগের সুযোগ পান জেনারেল মোশাররফ, লন্ডন হয়ে স্থায়ী হন দুবাইয়ে। ২০১৬ সালের দেশত্যাগের পর আর ফিরে আসার সুযোগ পাননি, ২০১৯ সালে আদালত দেয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদন্ডের সাজা।
দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে দুবাইয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন জেনারেল মোশাররফ। বর্ণাঢ্য সামরিক ক্যারিয়ার উপভোগ করা আর সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে ততোধিক সমালোচিত জেনারেল মোশাররফ চিরনিদ্রায় শায়িত হয়েছেন পাকিস্তানেই।