ভারত মহাসাগরের চাগোশ দ্বীপপুঞ্জ ছিল প্রকৃতির স্বর্গ। স্বনির্ভর দ্বীপবাসীদের প্রকৃতি সব দিয়েছিল দু’হাত ভরে, আবহাওয়াও ছিল বন্ধুর মতো। প্রকৃতির কোলে বড় হওয়া প্রায় ২,০০০ দ্বীপবাসীর জন্য এখানে ছিল একটি স্কুল, হাসপাতাল, চার্চ, রেলওয়ে এবং সর্বোপরি শান্তিপূর্ণ একটি জীবন। অন্তত ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। কারণ, এরপর এই অধিবাসীদের হারাতে হয় তাদের প্রিয় মাতৃভূমি।
না, প্রকৃতি কেড়ে নেয়নি তাদের সবকিছু। ক্ষমতালোভী মানুষের নির্দয় চাওয়ার কবলে এই মানুষদের হারাতে হয় সবই! ষাটের দশকের শেষের দিক থেকে সত্তরের দশকের শুরু পর্যন্ত চলে দ্বীপের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার পর্ব! বিশ্বে মানবতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অন্যতম হর্তাকর্তা হিসেবে সবসময়ই নিজেদের জাহির করেছে দুই পরাশক্তি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বে প্রভাব বিস্তার ও নিজেদের স্বার্থ রক্ষার বেলায় অবশ্য তাদের তথাকথিত এই চেহারার ভিন্ন এক কুৎসিত রূপ নতুন কিছু নয়। ক্ষমতাবানদের মিথ্যার আবরণে ঢেকে স্বার্থ হাসিলের নির্মম শিকার হতে হয়েছিল চাগোশ দ্বীপপুঞ্জের জনগণের এবং মূল হোতা ছিল ব্রিটিশ সরকার। কারণ, চাগোশ দ্বীপপুঞ্জ ছিল একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, রাশিয়ার সাথে স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে তাদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করার ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেছিল। এই সময়ে তাদের চোখ পড়ে ভারত মহাসাগরের ব্রিটিশ উপনিবেশ চাগোশ দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ দিয়েগো গার্সিয়ার দিকে। দ্বীপের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটিশদের প্রস্তাব করেছিল পারমাণবিক সাবমেরিন সংক্রান্ত প্রযুক্তি, যা ছিল অত্যন্ত গোপনীয়। ঠিক কী ধরনের বিনিময় হয়েছে, তা থেকে শুরু করে দ্বীপের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ প্রক্রিয়া, সবকিছুই হয়েছিল চরম গোপনীয়তার সাথে। ব্রিটিশদের এই চক্রান্তের পুরো সত্য বের হয়েছে ঘটনার আরও ২০ বছর পরে, যখন দ্বীপবাসীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য সর্বাত্মক আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। লন্ডনের পাবলিক রেকর্ড অফিসের নথিপত্র ঘাটতে গিয়ে দ্বীপবাসীর পক্ষে লড়াই করা আইনজীবীদের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে চাগোশ দ্বীপপুঞ্জের উচ্ছেদ বিষয়ক গোপনীয় নথিপত্র, উন্মোচিত হয় দীর্ঘদিন আড়াল করে রাখা নির্মম সত্য।
ধূর্ত ব্রিটিশরা বিশ্বের যে প্রান্তেই তাদের উপনিবেশ ছেড়েছে, সেখানেই তারা কোনো না কোনো ‘সমস্যা’, ‘জটিলতা’ বা সুবিধা আদায়ের ব্যবস্থা করে তবেই স্বাধীনতা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে তাকালেই অনেকটা বোঝা যায়। ১৯৬৮ সালের দিকে মরিশাস স্বাধীনতা পেলেও পার্শ্ববর্তী চাগোশ দ্বীপ থেকে যায় ব্রিটিশদের অধীনেই। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ করার জন্য সব ধরনের হীন পন্থা অবলম্বন করেছে যুক্তরাজ্যের হ্যারোল্ড উইলসন সরকার।
ঔষধ ও যেসব খাদ্যের জন্য মরিশাসের উপর চাগোশিয়ানরা নির্ভরশীল ছিল, চাগোশ দ্বীপের সেসব চালান বন্ধ করে দেয় যুক্তরাজ্য সরকার। অবৈধ উচ্ছেদের সূচনা ১৯৬৫ সালে, সরকারের প্রবল চাপের মুখে স্থানীয় বাসিন্দাদের সামনে তাদের মাতৃভূমি ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মরিচা ধরা পুরনো জাহাজে করে মহিলা ও শিশুদের দ্বীপান্তরিত করা হয়, জাহাজটি ছিল মূলত সার বহনের কার্গো। জাহাজের এই আরোহীদের নামিয়ে দেওয়া হয় সেইচেলসে, যেখানে তাদের জেলে বন্দী হিসেবে আটকে রাখা হয়েছিল। সেইচেলস থেকে অবশেষে এই অধিবাসীদের নিয়ে যাওয়া হয় মরিশাসে, থাকতে দেওয়া হয়েছিল পরিত্যক্ত কিছু বাড়িতে, যেখানে কোনো বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না।
ভয়ংকর সেই অভিজ্ঞতার কথা চাগোশ দ্বীপের অধিবাসীরাই সবচেয়ে ভালো জানে, ঠিক কতটা অমানবিক আচরণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাদের। চাগোশিয়ান লিসবি এলিস উচ্ছেদের সময়ে গর্ভবতী ছিলেন, চারদিন পর যখন গন্তব্যে পৌঁছান তিনি, তখন তার বাচ্চাটি মারা যায়। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের কাছে তিনি বলেন, “জাহাজের অবস্থা খুবই বাজে ছিল। সেখানে আমরা যেন পশু ও ক্রীতদাস হিসেবে ছিলাম!”
হতভাগ্য এই বাসিন্দাদের মধ্যে প্রায় ২৬টি পরিবার মৃত্যুবরণ করেন নিষ্ঠুর দরিদ্রতায়, ৯ জন আত্মহত্যা করেছিল এবং বেঁচে থাকার তাগিদে একটি মেয়ে বাধ্য হয়েছিল পতিতাবৃত্তিতে জড়াতে। অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক জন পিলজার চাগোশিয়ানদের অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন এবং তাদের বর্ণনায় উঠে আসে ব্রিটিশ বর্বরতার নির্মম ঘটনা।
এক মহিলা জানান, পরিবার নিয়ে চিকিৎসার জন্য মরিশাসের হাসপাতালে গেলে তাদের জানানো হয়, নিজেদের ভূমিতে আর কোনোদিন তাদের ফিরতে দেওয়া হবে না। এই সংবাদ শুনেই তার স্বামী স্ট্রোক করেন এবং মারা যান। লিজেতে তালাত নামের আরেকজন জানান, তার বাচ্চারা একরকম ‘বিষণ্ণতায় মারা গেছে”। আকস্মিক এই উচ্ছেদ অভিযানের শুরুটা বেশিরভাগ পরিবারের জন্যই ছিল মারাত্মক আঘাত। চাগোশিয়ানদের জন্য মাতৃভূমি ছেড়ে ভিনদেশে যাওয়ার ধাক্কার সাথে যোগ হয়েছিল যাত্রাপথের দুঃস্বপ্ন, এরপর ছিল মৌলিক সুবিধাহীন নতুন আবাসভূমি এবং সবমিলিয়ে তৈরি হওয়া দরিদ্রতা।
উন্মোচিত গোপন নথিপত্র থেকে দেখা যায়, বিনা কারণে নির্বাসিত এই বাসিন্দাদের প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয় মাত্র ৩,০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড বা তারও কম অর্থ! ঘরবাড়ি, গৃহপালিত পশু ও সর্বোপরি সবকিছু ফেলে আসার পর নতুন দারিদ্র্যতার মুখে মানবেতর জীবনযাপন করা মানুষের জন্য এই অর্থ সহায়তা ছিল তাদের জীবনের প্রতি একধরনের উপহাস। একটি নথিতে দেখা যায়, ব্রিটিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ঠিক কীভাবে এই অপকর্ম ঢাকতে হবে তার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে, যা মূলত নোংরা মিথ্যা ও গল্পে ভরপুর। কর্মকর্তাদের উল্লেখ করতে বলা হয় যে, নির্বাসিত এই মানুষগুলো স্থানীয় বাসিন্দা নয়, তারা ছিল অভিবাসী শ্রমিক।
চাগোশ দ্বীপপুঞ্জ স্থানীয় বাসিন্দাশূন্য করতে সময় লেগেছিল প্রায় ১০ বছর। এরপর সেখানকার সবচেয়ে বড় দ্বীপ দিয়েগো গার্সিয়াতে যুক্তরাষ্ট্র গড়ে তোলে তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিগুলোর একটি, যেখানে আছে প্রায় ২,০০০ সৈন্যের বসবাস। যুদ্ধবিমানের জন্য দুটি রানওয়ে, ৩০টি যুদ্ধজাহাজ, পরমাণু অস্ত্রবাহী সাবমেরিন ও গোয়েন্দা তৎপরতার জন্য একটি স্যাটেলাইট স্টেশনে পরিণত হয়েছে একসময়ের প্রাকৃতিক স্বর্গ। ইরাক ও আফগানিস্তানে আক্রমণের জন্য এই ঘাঁটি ব্যবহার করা হয়েছিল। তাছাড়া, ৯/১১ এর পর অনেক বন্দীকেই সিআইএ এখানে নিয়ে এসে কথিত তথ্য আদায়ের নামে চালাত পাশবিক অত্যাচার।
চাগোশিয়ানরা অবশ্য হাল ছাড়েননি, অধিকার আদায়ের জন্য তারা এখন চালিয়ে যাচ্ছে আইনি লড়াই। কিন্তু, ব্রিটিশ সরকারের নির্লজ্জ মিথ্যাচারের কাছে তাদের অধিকার আদায়ের লড়াই বিপর্যস্ত। ২০০০ সালে লন্ডনে হাই কোর্ট রায় দেয়, এই উচ্ছেদ ছিল সম্পূর্ণ অবৈধ। আদালতের রায় ও ব্রিটিশ সংসদকে পাশ কাটানোর জন্য তখন টনি ব্লেয়ার ব্যবহার করেন রানীর বিশেষ ক্ষমতা।
কোনোভাবেই যেন চাগোশিয়ানরা তাদের দ্বীপে ফিরতে না পারে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছিল সরকার, রাজকীয় সমর্থনও পেয়ে যাচ্ছিল তারা। চাগোশিয়ানদের তাদের ভূমিতে ফিরে যেতে দিতে হবে, হাই কোর্ট চূড়ান্ত এই রায় দিলে ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে যুক্তরাজ্যের ফরেন অফিস। আইন ও বিচার ব্যবস্থার জন্য আদর্শ মানা হয় যে দেশের ব্যবস্থাকে, সেই দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারকরা নির্লজ্জভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রায় দেয় আপিলের পক্ষে। যদিও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা নতুন কোনো তথ্য ও প্রমাণ কিছুই হাজির করেনি সুপ্রিম কোর্টে।
উইকিলিকস থেকে প্রকাশিত একটি গোপন বার্তায় উন্মোচিত হয় চাগোশ দ্বীপ যেন বাসিন্দারা ফিরতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ব্রিটিশ ও মার্কিনীদের নির্লজ্জ ও হাস্যকর প্রচেষ্টা। যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরামর্শ দেওয়া হয় চাগোশ দ্বীপকে ঘিরে যেন সামুদ্রের সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার, এতে হয়তো নির্বাসিত বাসিন্দাদের পুনরায় তাদের আবাস গড়ে তোলা থেকে বিরত রাখার একটি পথ তৈরি হবে।
অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে হাল না ছাড়া চাগোশ দ্বীপবাসীদের পক্ষে অবশেষে রায় দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস। আন্তর্জাতিক এই আদালত থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যকে এই বাসিন্দাদের জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। মরিশাসকে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ১৯৬৮ সালে, এখন চাগোশ দ্বীপপুঞ্জ ফিরিয়ে দিতে হবে মরিশাসের অধীনে। বিচারকদের মতে, মরিশাসে ব্রিটিশ উপনিবেশের সমাপ্তি ঘটবে চাগোশ দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের অধীনে ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই। এই প্রক্রিয়াতে নিজেদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারও ফিরে পাবে নির্বাসিতরা। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের পর অবশ্য আবারও যুক্তরাজ্যের আদালত চাগোশিয়ানদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে।
জন পিলজার উল্লেখ করেন, তিনি চাগোশিয়ানদের সম্পর্কে জানতে পারেন ১৯৮২ সালে, ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়। ফকল্যান্ডের ২,০০০ অধিবাসীর জন্য আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ পাঠানো হয়েছিল। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জ থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল প্রায় ২,০০০ জনকে, যাদের সবাই ছিল কৃষ্ণাঙ্গ। পিলজারের মতে, ব্রিটিশদের এই দ্বিমুখী আচরণের অন্যতম একটি কারণ ছিল সাদা ও কালোর বিভাজন। আধুনিক যুগেও সভ্যতার মুখোশের আড়ালে ব্রিটিশদের বর্ণবাদী চিন্তার পাশাপাশি স্বার্থ হাসিলের অমানবিক পদক্ষেপ মানব সভ্যতার জন্য বিশাল লজ্জা।
যা-ই হোক, আন্তর্জাতিক আদালতের ব্রিটিশ উপনিবেশের ধ্যানধারণার বিপক্ষে জয়ের পর চাগোশিয়ানরা তাদের ঘরে আবার ফিরে যেতে পারবে, এই আশায় বুক বেঁধে আছে নির্বাসিতরা। এখন ঘরের ফেরার অপেক্ষা!