কিছুদিন আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়া তারা মিত্র দেশ বেলারুশে ‘ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা’ স্থাপন করতে যাচ্ছেন। ব্রিটেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী কাছে সম্প্রতি ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ লোহার পুরু স্তর ভেদ করার ক্ষমতাসম্পন্ন গুলি দেয়ার কথা জানায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট পুতিন ঘোষণা দেন।
ইউরোপে বেলারুশ দেশটি রাশিয়ার সবচেয়ে কাছের মিত্র হিসেবে পরিচিত। ইউক্রেনের হামলার সময় বেলারুশ রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করেছে। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকারী বাহিনীগুলোর একটি বেলারুশ থেকে ইউক্রেনে হামলা পরিচালনা করেছিল। বেলারুশে ‘ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা’ স্থাপন করলে পোল্যান্ড ও দুটি বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুয়ানিয়া এবং লাটভিয়া রাশিয়ার কাছাকাছি রুশ ট্যাকটিকাল পারমাণবিক বোমা স্থাপিত হবে। বলে রাখা ভালো, উক্ত তিনটি দেশই সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য।
রাশিয়াই প্রথম রাষ্ট্র নয় যে তার মিত্র দেশে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন বেলারুশে রুশ পারমাণবিক বোমা মোতায়েনের ঘটনাকে বিভিন্ন দেশের আমেরিকার পরমাণু বোমা স্থাপনের সাথে তুলনা করেছেন। এবং তিনি এটাও দাবি করছেন যে এর দ্বারা আন্তর্জাতিক আইনের কোনো লঙ্ঘন হচ্ছে না, সুতরাং এ নিয়ে বিশ্ববাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের ভাষায়, “তারা বছরের পর বছর ধরে যা করে আসছে, আমরা সেটিরই অনুসরণ করছি। তারা বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করেছে, সেসব দেশ থেকে বোমা নিক্ষেপের জন্য যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে এবং তারা সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। আমরা ঠিক সেটিই করতে যাচ্ছি।” রুশ প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পর আমেরিকা আতঙ্ক প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন দাবি করেছেন, ১৯৬২ সালের মিসাইল সংকটের পর পৃথিবী আবারও ভয়াবহ পারমাণবিক ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করছে। রাশিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছে, তাদের অবস্থানকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
রাশিয়ার পূর্বসূরি সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধকরণ চুক্তি’তে স্বাক্ষর করেছিল। এই চুক্তির শর্তে বলা হয়েছিল যে, কোনো পারমাণবিক শক্তিধর দেশ অন্য কোনো দেশে পরমাণু অস্ত্র বা এই সম্পর্কিত প্রযুক্তি আদানপ্রদান করতে পারবে না। কিন্তু চাইলে তার সীমারেখার বাইরে অন্য দেশের অনুমতিসাপেক্ষে সেই দেশে মোতায়েন করতে পারবে। সেই সাথে এটি নিশ্চিত করতে হবে যে, পারমাণবিক বোমা অন্য দেশে মোতায়েন থাকলেও সেটির কর্তৃত্ব পারমাণবিক শক্তিধর দেশের কাছেই আছে। আমেরিকা এই শর্তানুযায়ীই এতদিন বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করতো। এখন রাশিয়াও একই পথে হাঁটতে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা অক্ষশক্তির দেশ জাপানের উপর দুটি পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল। জাপানের যে দুটো শহরে পারমাণবিক বোমা হামলা হয়েছিল, তার একটি হচ্ছে হিরোশিমা, আরেকটি নাগাসাকি। নিক্ষেপকৃত দুটো বোমার নাম ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’। এই দুটো বোমা নিক্ষেপের ফলে পৃথিবীবাসী ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পারমাণবিক ধ্বংসলীলার অভিজ্ঞতা লাভ করে।
জাপানের দুটো শহরই বোমা হামলার ফলে ধ্বংস হয়ে যায়, মৃত্যুমুখে পতিত হয় হাজার হাজার মানুষ। এই বোমা হামলার প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী৷ তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে বেঁচে যাওয়া মানুষদের দেহে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ে, যেগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে যায়। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশের হুমকির হাত থেকে বাঁচতে পারমাণবিক অস্ত্র বেশ ভালো ‘নিরোধক’ ভূমিকা পালন করতে পারে। এজন্য ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের কয়েক বছর পরই পাকিস্তান পরমাণু কর্মসূচি চালায় এবং সফল হয়।
পারমাণবিক বোমা দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে ‘স্ট্রাটেজিক পারমাণবিক বোমা’, অপরটি ‘ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা’। বিশেষজ্ঞ এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ মধ্যস্থতাকারীরা ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমাকে সঠিকভাবে চিত্রায়িত করতে বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন বিতর্ক করেছেন। সাধারণভাবে বলা হয়, ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্য থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কৌশলগত সাফল্য অর্জন করা। অপরদিকে স্ট্রাটেজিক পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের পেছনে লক্ষ্য থাকে আরও বৃহৎ। যেমন- কোনো বড় শহর বা অঞ্চল পুরোপুরি ধ্বংস করার জন্য স্ট্রাটেজিক পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হতে পারে।
উদাহরণ দেয়া যাক। আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে যে পারমাণবিক হামলা চালিয়েছিল, সেটি হচ্ছে স্ট্রাটেজিক পারমাণবিক বোমা হামলার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। অপরদিকে যদি বর্তমানে রাশিয়া ইউক্রেনের বাখমুতে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের নির্দিষ্ট অবস্থান ধ্বংস করে কৌশলগত সাফল্য অর্জন করতে চায়, তাহলে সেটি হবে ‘ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা’ হামলার উদাহরণ।
এটি স্পষ্ট যে, স্ট্রাটেজিক ও ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা তৈরি ও নিক্ষেপের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমার পরিসীমাও কম হয়ে থাকে। সাধারণত ভূমি থেকে নিক্ষেপ করা ট্যাকটিক্যাল নিউক্লিয়ার বোমার পরিসীমা থাকে পাঁচশো কিলোমিটার বা প্রায় তিনশো মাইল। অপরদিকে যুদ্ধবিমান বা সমুদ্রে অবস্থানরত যুদ্ধজাহাজ থেকে নিক্ষেপ করা এ ধরনের বোমাযুক্ত মিসাইলের পরিসীমা হয়ে থাকে সর্বোচ্চ ছয়শো কিলোমিটার।
ক্ষয়ক্ষতি সাধন করার ক্ষমতা, নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্য ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে পারমাণবিক বোমাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তবে স্ট্রাটেজিক বোমের তুলনায় এটি অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হলেও এর ক্ষয়ক্ষতি সাধনের ক্ষমতাকে ছোট করে দেখলে ভুল হবে। ভারতের বিমান বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডোর রিপন গুপ্তের মতে, জাপানে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানোর সময় যো বোমাগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল, বর্তমানের ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক বোমাগুলো তার চেয়েও শক্তিশালী।
গত বছর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন ইউক্রেনের পরিচালিত বিশেষ সামরিক অভিযানে ব্যবহার করার মতো সব ধরনের উপায়ই তার হাতে রয়েছে। এর মাধ্যমে যে তিনি পারমাণবিক বোমার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন তা একেবারেই স্পষ্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে যদি রাশিয়া কোনোপ্রকার ট্যাকটিক্যাল কিংবা স্ট্রাটেজিক পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে, তাহলে ‘আর্মাগেডন’ শুরু হবে। আর্মাগেডন বলতে বোঝানো হয় ভালো ও মন্দের তীব্র লড়াই, যার ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থে আর্মাগেডনের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার বক্তব্যের মাধ্যমে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনে শেষ পর্যন্ত পরাজয় এড়াতে পারমাণবিক বোমার আশ্রয় নেয়, তাহলে ইউক্রেনের বর্তমান যুদ্ধটি আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে তীব্র ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে রূপ নেবে, যেটিতে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
রাশিয়া বর্তমান সংঘাতের ক্ষেত্র ইউক্রেনে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে কিনা, তা সময়ই বলে দেবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাশিয়া মূলত যুক্তরাজ্যের ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ বুলেটের পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে বেলারুশে পারমাণবিক বোমা মোতায়েন করতে যাচ্ছে। ইউক্রেনের যুদ্ধে দু’পক্ষই যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং যুদ্ধ যদি চলমান থাকে, তাহলে আরও হতে থাকবে। ইউক্রেন বর্তমানে ন্যাটো এবং রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়াকে পরাজিত করে রাশিয়ার উত্থান রোধ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অপরদিকে আমেরিকান আধিপত্যের অবসানের পর বহুকেন্দ্রিক বিশ্বে একটি শক্তিশালী পক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেন যদি ন্যাটোর সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে রাশিয়ার একেবারে দোরগোড়ায় আমেরিকা পরমাণু বোমা মোতায়েন করার সুযোগ পাবে। এটা স্বাভাবিকভাবেই রাশিয়ার জন্য অস্বস্তিকর এবং হুমকিস্বরূপ। তাই ন্যাটোর হাত থেকে নিজেদের সীমান্ত নিরাপদ রাখাও এই যুদ্ধের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।