আধুনিক যুগে প্রতিটি রাষ্ট্রেরই নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী রয়েছে– এই বিষয়টি বোধহয় আমাদের কারোরই অজানা নয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিভিন্ন উপায়ে গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য সংগ্রহ করে, যেগুলো পরবর্তীতে নিবিড় বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নীতিনির্ধারকদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। দেশের জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যগুলো মাথায় রাখেন। এছাড়া বাইরের কোনো দেশ যেন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার জন্যও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সদা তৎপর থাকে। বৈশ্বিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যদি কোনো হামলার গোপন পরিকল্পনা করে থাকে, তবে সেগুলোর আগাম তথ্য সংগ্রহ করার পর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতেও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো আসলে তাদের বিশাল কর্মযজ্ঞের খুব অল্প কিছু কাজের তালিকা। বাস্তবে একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাজের তালিকা আরও অনেক লম্বা।
আমেরিকার দিকে যাওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছে, তখন আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল দায়িত্ব ছিল জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির সামরিক অপারেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে মিত্রপক্ষের সেনাপ্রধানদের হাতে হস্তান্তর করা। এক্ষেত্রে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলোর নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তা পেয়েছিল, যেহেতু এই দেশগুলো আমেরিকার সাথে মিত্রপক্ষে বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আদর্শগত দিক থেকে আমেরিকার প্রধান শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আমেরিকার একধরনের যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই সোভিয়েত ইউনিয়ন কমিউনিজম পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার ঘোষণা দিলে আমেরিকাও কমিউনিজম প্রতিরোধ করে পুঁজিবাদ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এভাবে দুই পরাশক্তির মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মূল দায়িত্ব ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও তার মিত্র দেশগুলোর গোপন খবর বের করে আনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর লক্ষ্য ও কর্মপদ্ধতিতেও বিশাল পরিবর্তন আসে।
আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থার কথা উঠলেই আমাদের মাথায় সাধারণত দুটি নাম আসে– এফবিআই এবং সিআইএ। হলিউডের মুভি কিংবা থ্রিলার বইয়ের মাধ্যমে আমরা অনেকেই এই দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম, লক্ষ্য কিংবা দুঃসাহসিক সব গোপন অভিযান সম্পর্কে জেনেছি। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সাধারণত নিজেদের সমস্ত কার্যক্রম সাধারণ মানুষের আড়ালে রাখতে চায়, এজন্য গোয়েন্দা সংস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহও অনেক বেশি। অনেকের ধারণা- এই দুটো গোয়েন্দা সংস্থার কাজ এবং লক্ষ্য হয়তো একই। কিন্তু বাস্তবে কি তা-ই? এফবিআই এবং সিআইএ কি একই গোয়েন্দা সংস্থার দুটো আলাদা নাম? নাকি এগুলো দুটো ভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা? দুটোর সাংগঠনিক গঠন ও কর্মপদ্ধতি কি আলাদা? চলুন, এসবের উত্তর খোঁজা যাক। দুটো গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান পার্থক্যগুলো সম্পর্কে জানতে পারলে এসব প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই পাওয়া যাবে।
শুরুতে এফবিআই এবং সিআইএ– দুটো গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিষ্ঠা ও নামকরণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। এফবিআই (FBI) এর পূর্ণরূপ হলো ‘ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ (Federal Bureau of Investigation)। ১৯০৮ সালে মার্কিন এ্যাটর্নি জেনারেল চার্লস বোনাপার্ট কিছু সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফেডারেল গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পরীক্ষক স্ট্যানলি ডব্লিউ. ফিঞ্চের কাছে রিপোর্ট করতে বলেন। এর এক বছর পরই প্রধান পরীক্ষকের অফিসকে ‘ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ (Bureau of Investigation) নামকরণ করা হয়। ১৯৩৫ সালের পর থেকে একে ‘ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন’ (Federal Bureau of Investigation) আখ্যায়িত করা হচ্ছে। অপরদিকে সিআইএ (CIA) এর পূর্ণরূপ হচ্ছে (Central Intelligence Agency)। সিআইএ হচ্ছে ওএসএস (OSS – Office of Strategic Service) এর উত্তরসূরী সংগঠন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৪৪ সালে ওএসএস এর প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা জেনারেল উইলিয়াম ডনোভান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের কাছে একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেন, যে সংস্থাটি গতানুগতিক ওএসএস এর চেয়ে আরও অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী হবে। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (National Security Act of 1947) এর অধীনে সিআইএ গঠন করা হয়।
এবার দুটো সংগঠনের কার্যক্ষেত্র ও পদ্ধতির দিকে যাওয়া যাক। খুব সহজ ভাষায় বললে, এফবিআই মূলত আমেরিকার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে। যেমন, আমেরিকার অভ্যন্তরে যেকোনো ধরনের সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলা রুখে দেয়ার জন্য যদি গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, তাহলে সেই দায়িত্ব বর্তাবে এফবিআই-এর উপর। আমেরিকা যেহেতু বৈশ্বিক পুঁজিবাদের অভিভাবক, তাই স্বাভাবিকভাবেই দেশটির বেশ কিছু শত্রু দেশ রয়েছে। বাইরের যেকোনো দেশ যদি আমেরিকার ভেতর থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে চায়, তাহলে তার প্রতিরোধের দায়িত্ব এফবিআই-এর। এছাড়া ব্যাংক ডাকাতি কিংবা অপহরণের মতো গুরুতর অপরাধের জন্য তদন্তের ক্ষেত্রে এফবিআই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। সিআইএ-র সাথে এফবিআই-এর আরেকটি বড় পার্থক্য হচ্ছে- এফবিআই প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করতে পারে, যেটি সিআইএ পারে না। সিআইএ-র মূল কাজ হলো আমেরিকার বাইরে পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করা কিংবা গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করা। আমেরিকার পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে এখনও যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, সেসব দেশে সিআইএ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
এবার দুটো গোয়েন্দা সংস্থার প্রশাসনিক গঠনের দিকে একটু আলোকপাত করা যাক। সিআইএ-র নির্বাহী অফিসে চারটি প্রধান শাখা রয়েছে। এগুলো হলো–
১) দ্য ডিরেক্টরেট অব ইন্টেলিজেন্স: বিভিন্ন ধরনের ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ ও সেগুলো বিশ্লেষণ করে।
২) দ্য ন্যাশনাল ক্ল্যান্ডেস্টাইন সার্ভিস: গোপনে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে এবং প্রয়োজনে গোয়েন্দা অভিযান পরিচালনা করে।
৩) দ্য ডিরেক্টরেক্ট অব সাপোর্ট: সবধরনের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করে।
৪) দ্য ডিরেক্টরেক্ট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি: বিভিন্ন গোয়েন্দা অভিযান ও কার্যক্রমে সহায়তা করার জন্য গবেষণার মাধ্যমে নতুন সব প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে।
এফবিআই মূলত আমেরিকার বিচার বিভাগের একটি অংশ। এর প্রধান শাখাগুলো হচ্ছে–
১) ন্যাশনাল সিকিউরিটি ব্রাঞ্চ
২) ক্রিমিনাল, সাইবার, রেসপন্স এন্ড সার্ভিসেস ব্রাঞ্চ
৩) হিউম্যান রিসোর্সেস ব্রাঞ্চ
৪) সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ব্রাঞ্চ
৫) ইনফরমেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ব্রাঞ্চ
এবার আসা যাক দুটো ভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থায় নিয়োগ পেতে কী কী যোগ্যতা দরকার– সেই বিষয়ে। সিআইএ-তে নিয়োগ পেতে হলে প্রথম শর্ত হলো আমেরিকার নাগরিক হতে হবে এবং বয়স আঠারো বছরের বেশি হতে হবে। এরপরের শর্ত হচ্ছে অন্তত হাই স্কুল পাশ করতে হবে এবং বাইরের দেশে কাজ করতে গেলে একটি কলেজ ডিগ্রি থাকতে হবে। আমেরিকার বাইরের কোনো দেশের ভাষা জানা থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যাবে। অপরদিকে এফবিআই-এ নিয়োগ পাওয়ার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে আমেরিকার নাগরিক হতে হবে এবং অতীতে কোনো অপরাধের রেকর্ড থাকা যাবে না। এরপর একটি কলেজ ডিগ্রি থাকতে হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড টেস্ট’ নামে একটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও এফবিআইয়-এর ক্ষেত্রে শারীরিক সক্ষমতা পরীক্ষার জন্য ‘ফিজিক্যাল ফিটনেস টেস্ট’ ও বাড়তি পরীক্ষা হিসেবে ‘পলিগ্রাফ টেস্ট’ পাশ করে আসতে হয়। যারা এফবিআই-তে প্রাথমিকভাবে নিয়োগ পেয়ে থাকেন, তাদেরকে এফবিআই অ্যাকাডেমিতে একুশ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হতে হয়।
এফবিআই এবং সিআইএ-র ক্ষেত্রে উপরের বিভিন্ন পার্থক্যের মাধ্যমে এটা একেবারে স্পষ্ট যে, দুটো গোয়েন্দা সংস্থার মাঝে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এফবিআই আমেরিকার অভ্যন্তরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, অপরদিকে সিআইএ তাদের সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে আমেরিকার বাইরে। এফবিআই যেখানে মার্কিন বিচার বিভাগের অধীনে আইন প্রয়োগ করতে পারে, সেখানে সিআইএ-র এ ধরনের কোনো ক্ষমতা নেই। তবে অনেক অমিল থাকার পরও দুটো গোয়েন্দা সংস্থাই আমেরিকার সার্বিক নিরাপত্তার জন্য কাজ করে থাকে।