২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে ইউক্রেনে একটি তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত হয়। এই আন্দোলন ক্রমশ একটি রক্তাক্ত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানে রূপ নেয় এবং এর ফলে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনটির সমর্থকদের দৃষ্টিতে, এটি ছিল ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি ‘গণবিপ্লব’। আন্দোলনটির বিরোধীদের দৃষ্টিতে, এটি ছিল ইউক্রেনের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে পরিচালিত একটি ‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান’। এই ‘বিপ্লব’ বা ‘অভ্যুত্থান’টি ‘ইউরোমাইদান’ নামে পরিচিতি অর্জন করেছে।
‘ইউরোমাইদান’কে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা হোক না কেন, বর্তমান বিশ্বের ভূরাজনীতিতে এটি ছিল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইউরোমাইদান যে কেবল ইউক্রেনে একটি মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি করে তা-ই নয়, ইউরোমাইদানের ফলে রুশ–পশ্চিমা স্নায়ুযুদ্ধ তীব্র রূপ ধারণ করে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে তিক্ত রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরম্ভ হয় এবং পূর্ব ইউক্রেনের দনবাসে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শুরু হয়। বস্তুত ইউরোমাইদান সংঘটিত না হলে বর্তমানের বিশ্ব রাজনীতির রূপ বহুলাংশেই ভিন্ন হতো। এই নিবন্ধে ইউরোমাইদানের প্রেক্ষাপট, তাৎক্ষণিক কারণ, ঘটনাবলির বিবরণ, বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা এবং তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ফলাফল সংক্ষেপে আলোচিত হবে।
ইউরোমাইদানের প্রাক্কালে ইউক্রেন: রুশ–পশ্চিমা স্নায়ুযুদ্ধের কেন্দ্রস্থল
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউক্রেন ও রাশিয়া দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিরোধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু ১৯৯০–এর দশকে ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়েই বিস্তৃত ও নানাবিধ অভ্যন্তরীণ সমস্যায় নিমজ্জিত ছিল, এবং এর ফলে রাষ্ট্র দুইটি পরস্পরের বিরুদ্ধে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত ছিল। ১৯৯৪ সালে লিওনিদ কুচমা ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্কের তুলনামূলক উন্নতি ঘটে এবং ১৯৯৭ সালে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি ‘বন্ধুত্ব, সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই সময়ে ইউক্রেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়।
১৯৯৯ সালে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে রাশিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের মাত্রা ক্রমে ক্রমে তীব্র হতে থাকে, এবং ইউক্রেন এই দ্বন্দ্বের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ২০০৪ সালে ইউক্রেনে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাশিয়া ইউক্রেনের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ানুকোভিচকে এবং যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ইয়ুশ্চেঙ্কোকে সমর্থন করে। নির্বাচনে ইয়ানুকোভিচ বিজয়ী হন, কিন্তু ইয়ুশ্চেঙ্কোকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে একটি গোপন ‘রাজনৈতিক–মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ পরিচালনা করে এবং তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করে। এর ফলে ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
ইয়ুশ্চেঙ্কো পশ্চিমাপন্থী ও রুশবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন এবং তার শাসনামলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে দ্বন্দ্বের মাত্রা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইয়ুশ্চেঙ্কো ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ সমস্যাদির সমাধান করতে ব্যর্থ হন এবং তার রাজনৈতিক মিত্র ও তদানীন্তন ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী ইউলিয়া তিমোশেঙ্কোর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তার অধীনে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি ঘটতে থাকে এবং এসবের ফলে তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
এমতাবস্থায় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ইউক্রেনের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ইয়ুশ্চেঙ্কো, ইয়ানুকোভিচ ও তিমোশেঙ্কো এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনের প্রথম দফায় ইয়ানুকোভিচ ৩৫.৩২% ও তিমোশেঙ্কো ২৫.০৫% ভোট লাভ করেন, এবং ক্ষমতাসীন ইয়ুশ্চেঙ্কো মাত্র ৫.৪৫% ভোট লাভ করেন। কোনো প্রার্থীই ৫০% বা তার বেশি ভোট না পাওয়ায় ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় দফায় ইয়ানুকোভিচ ৪৮.৯৫% এবং তিমোশেঙ্কো ৪৫.৪৭% ভোট লাভ করেন, অর্থাৎ ইয়ানুকোভিচ বিজয়ী হন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনটি সাধারণভাবে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে মত ব্যক্ত করেন এবং পশ্চিমা বিশ্ব এবার সরাসরি ইয়ানুকোভিচের বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু তিমোশেঙ্কো নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে বলে দাবি করেন। অবশ্য তার দাবির বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি, এবং ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইয়ানুকোভিচ ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন।
ইয়ানুকোভিচ রুশপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু তার সরকারের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি রুশঘেঁষা ছিল না। তার অধীনে নতুন ইউক্রেনীয় সরকার পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার নীতি গ্রহণ করে। এসময় ইউক্রেন ঘোষণা করে যে, তারা ন্যাটো বা অন্য কোনো সামরিক জোটে যোগদান করবে না। বস্তুত ইয়ানুকোভিচের পররাষ্ট্রনীতি ছিল বহুলাংশে প্রাক্তন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি কুচমা কর্তৃক অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির অনুরূপ। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ইয়ানুকোভিচের সরকার ইউক্রেনের প্রদেশগুলোকে নিজস্ব আঞ্চলিক ভাষা বেছে নেয়ার সুযোগ প্রদান করে এবং সাধারণভাবে পূর্ব ও পশ্চিম ইউক্রেনের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। কিন্তু নতুন সরকারের অধীনে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি।
প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ডে রুশ–পশ্চিমা প্রতিযোগিতা: ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায় বনাম ইউরোপীয় ইউনিয়ন
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তম ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের আইনগতভাবে স্বীকৃত উত্তরসূরীতে পরিণত হয় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। কিন্তু রাশিয়ার জনসংখ্যা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের জনংখ্যার অর্ধেকেরও কম, রাশিয়ার আয়তন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আয়তনের চেয়ে প্রায় ২৫% কম এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যান্য ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীন হয়ে যাওয়ার ফলে রাশিয়া বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক ও শিল্প সম্পদ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হারায়। তদুপরি, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপে এবং বিশ্বব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়নের যে বিস্তৃত প্রভাব বলয় ছিল, রাশিয়া সেটিও হারিয়ে ফেলে। সর্বোপরি, ১৯৯০–এর দশকে রাশিয়ায় মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দেয় এবং রুশ সশস্ত্রবাহিনী গুণগত ও সংখ্যাগত দিক থেকে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় রুশ পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য ছিল প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর (বা প্রজাতন্ত্রগুলোর অধিকাংশের) ওপর রুশ প্রভাব বিস্তার করা এবং তাদের সমন্বয়ে একটি ফেডারেশন বা কনফেডারেশনের সৃষ্টি করা। এই উদ্দেশ্যে ১৯৯০–এর দশক থেকে রাশিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ডে বিভিন্ন ‘অঙ্গীভূতকরণ প্রকল্প’ (integration project) গ্রহণ করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রাক্তন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর অধিকাংশ ‘স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ’ বা ‘সোদ্রুঝেস্তভো নিয়েজাভিসিমিখ গোসুদার্স্তভ’ (রুশ: Содружество Независимых Государств, ‘СНГ’) গঠন করে এবং রাশিয়া উক্ত সংগঠনটিকে একটি শিথিল ফেডারেশনে রূপান্তরিত করার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৯৯৯ সালে রাশিয়া ও বেলারুশ ‘ইউনিয়ন রাষ্ট্র’ বা ‘সয়ুজনোয়ে গোসুদার্স্তভো’ (রুশ: Союзное государство) নামক একটি একক রাষ্ট্র গঠনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি একটি শিথিল কনফেডারেশন রূপে বিরাজ করছে।
২০০০ সালে রাশিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়’ বা ‘এভ্রাজিস্কোয়ে একোনোমিচেস্কোয়ে সুবশ্চেস্তভো’ (রুশ: Евразийское экономическое сообщество, ‘ЕврАзЭС’) নামক একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি করে। ২০১০ সালে সংগঠনটির ৩টি সদস্যের (রাশিয়া, বেলারুশ ও কাজাখস্তান) সমন্বয়ে ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ভিত্তিক কাস্টমস ইউনিয়ন’ বা ‘তামোঝেন্নিম সয়ুজোম না বাজে এভ্রাজিস্কোগো একোনোমিচেস্কোগো সুবশ্চেস্তভা’ (রুশ: Таможенным союзом на базе Евразийского экономического сообщества, ‘ТС ЕврАзЭС’) নামক একটি কাস্টমস ইউনিয়ন গঠিত হয়। ২০১২ সালে ‘ЕврАзЭС’–এর অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো একটি ‘একক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ‘এদিনোয়ে একোনোমিচেস্কোয়ে প্রোসত্রানস্তভো’ (রুশ: Единое экономическое пространство) গঠন করে।
রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল এই আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সংগঠনটিকে ক্রমান্বয়ে একটি ‘ইউরেশীয় ইউনিয়নে’ রূপান্তরিত করা এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ভূখণ্ডের সম্পূর্ণ অংশ বা বৃহদাংশকে এই ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার এই প্রকল্পের তীব্র বিরোধী। তারা একে সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার রুশ প্রচেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং এটিকে তাদের স্বার্থের প্রতিকূল হিসেবে বিবেচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য গড়ে উঠেছে, রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধি সেই আধিপত্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং এজন্য তারা রাশিয়াকে কোনো জোট গঠন বা প্রভাব বলয় সৃষ্টির সুযোগ দিতে নারাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিতে, রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া ব্যতীত প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবশিষ্টাংশে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলো ইউরোপের অংশ এবং এজন্য তারা সেই রাষ্ট্রগুলোকে (যেগুলোর মধ্যে ইউক্রেনও ছিল) ক্রমান্বয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী।
কিয়েভ, মস্কো ও ব্রাসেলস: কাস্টমস ইউনিয়ন বনাম সম্পৃক্ততা চুক্তি
২০১০–এর দশকের প্রারম্ভে ইউক্রেন এই প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ‘অঙ্গীভূতকরণ প্রকল্পে’র প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের রুশপন্থী অংশ চাচ্ছিল, ইউক্রেন ‘ЕврАзЭС’–এর কাস্টমস ইউনিয়নে যোগদান করুক। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী অংশ চাচ্ছিল, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একটি ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে (Association Agreement) স্বাক্ষর করুক। ইউক্রেনের মধ্যপন্থী রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ সম্ভব হলে একসঙ্গে দুই প্রকল্পের সঙ্গেই ইউক্রেনকে যুক্ত করতেন বলে প্রতীয়মান হয়, কিন্তু প্রকল্প দুটি পরস্পরের সম্পূরক ছিল না এবং এজন্য একই সঙ্গে উভয় প্রকল্পে যোগদান করা ইউক্রেনের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে ইউক্রেনে একটি গুরুতর রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি হয়।
২০১২ সালের শেষভাগে ও ২০১৩ সালের প্রথমভাগে রাশিয়া ইউক্রেনকে ‘ЕврАзЭС’–এর কাস্টমস ইউনিয়নে যোগদান করার কিংবা ‘ЕврАзЭС’–এর পূর্ণ সদস্য হওয়ার আহ্বান জানায় এবং বিনিময়ে কাস্টমস ইউনিয়ন থেকে প্রাপ্ত সুবিধাদির পাশাপাশি ইউক্রেনকে অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। উল্লেখ্য, ইউক্রেন অভ্যন্তরীণ জ্বালানি চাহিদা পূরণ করার জন্য বহুলাংশে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, এবং রাশিয়া ইউক্রেনকে এই মর্মে প্রস্তাব দেয় যে, ইউক্রেন ‘ЕврАзЭС’–এ বা ‘ЕврАзЭС’–এর কাস্টমস ইউনিয়নে যোগদান করলে রাশিয়া স্বল্প মূল্যে ইউক্রেনকে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করবে। কিন্তু ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ জানান যে, ইউক্রেনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বেশি জরুরি, এবং ‘ইউক্রেন কমিউনিস্ট পার্টি’ (ইউক্রেনীয়: Комуністична партія України, ‘কোমুনিস্তিচনা পার্তিয়া উক্রায়নি’) বাদে ইউক্রেনের সকল রাজনৈতিক দল (ইয়ানুকোভিচের ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’সহ) রুশ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তা সত্ত্বেও ২০১৩ সালের মে মাসে ইউক্রেন ‘ЕврАзЭС’–এর কাস্টমস ইউনিয়নের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয় মন্ত্রিপরিষদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’র খসড়া অনুমোদন করে। কিন্তু এসময় ইউক্রেনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছিল। ইউক্রেনের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছিল এবং রুশ রাষ্ট্রীয় প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি ‘গাজপ্রম’–এর কাছে ইউক্রেনের অন্তত ২০০ কোটি (বা ২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার বকেয়া ছিল। ইউক্রেন আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে চাচ্ছিল, কিন্তু আইএমএফ ঋণ প্রদানের জন্য ইউক্রেনের ওপর কঠিন শর্তাবলি চাপিয়ে দিয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, তারা ইউক্রেনকে সহজ শর্তে আইএমএফ–এর কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। কিন্তু তারা এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি।
২০১৩ সালের নভেম্বরের শেষদিকে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করার কথা ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, ইউক্রেন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করলে ইউক্রেনের অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার জন্য ইউক্রেনকে ৬০ কোটি (বা ৬০০ মিলিয়ন) ইউরো সহায়তা হিসেবে প্রদান করা হবে। এর বিপরীতে রাশিয়া ইউক্রেনকে এই মর্মে প্রস্তাব দেয় যে, ইউক্রেন যদি এই চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে, সেক্ষেত্রে রাশিয়া ইউক্রেন ১,৫০০ কোটি (বা ১৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার সহায়তা হিসেবে প্রদান করবে, ইউক্রেনের কাছে স্বল্প মূল্যে গ্যাস রপ্তানি করবে এবং ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্পের অর্থায়ন করবে। অর্থনৈতিক দুর্দশায় ভুগতে থাকা ইউক্রেনের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রস্তাবের তুলনায় রুশ প্রস্তাবটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বেশি লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে ২১ নভেম্বর ইউক্রেনীয় মন্ত্রিপরিষদ ঘোষণা করে যে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করবে না।
ইউরোমাইদানের সূচনা
ইউক্রেনীয় সরকারের উক্ত সিদ্ধান্ত প্রচারিত হওয়ার পরপরই ইউক্রেনীয় মধ্য ডানপন্থী দল ‘উক্রায়নস্কি দেমোক্রাতিচনি আলইয়ান্স জা রেফর্মি’র (ইউক্রেনীয়: Український Демократичний Альянс за Реформи) নেতা ভিতালি ক্লিচকো জানান যে, তারা তদানীন্তন ইউক্রেনীয় প্রধানমন্ত্রী মিকোলা আজারভের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের আইন ভঙ্গের দায়ে মামলা দায়ের করবেন এবং তিনি ইউক্রেনীয় সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য ২৪ নভেম্বর জনসাধারণকে বিক্ষোভে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। ইউক্রেনীয় সরকার বিক্ষোভের আশঙ্কা করছিল, এবং সেদিন সন্ধ্যায় রাজধানী কিয়েভের জেলা প্রশাসনিক আদালত কিয়েভ নগর কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কিয়েভ শহরে বিক্ষোভের সময় তাঁবু বা অন্যান্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ নিষিদ্ধ করে।
সেদিন সন্ধ্যায়ই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিক্ষোভের আহ্বান ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং সেদিন রাত ১০টায় ১,০০০ থেকে ২,০০০ মানুষ রাজধানী কিয়েভের ‘স্বাধীনতা সরণি’ বা ‘মাইদান নিজালেঝনোস্তি’তে (ইউক্রেনীয়: Майдан Незалежності) জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে। ক্লিচকো, উগ্র জাতীয়তাবাদী দল ‘ভসেউক্রায়নস্কে ওবেদনান্নায়া ‘সভোবোদা”র (ইউক্রেনীয়: Всеукраїнське об’єднання «Свобода») নেতা ওলেহ তিয়াহনিবোক এবং মধ্য ডানপন্থী দল ‘ভসেউক্রায়নস্কে ওবেদনান্নায়া ‘বাৎকিভশ্চিনা”র (ইউক্রেনীয়: Всеукраїнське об’єднання «Батьківщина») নেতা আরসেনি ইয়াৎসেনিউক এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন।
বিক্ষোভকারীরা আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কিয়েভের ‘মাইদান নিজালেঝনোস্তি’তে তাঁবু স্থাপন করতে শুরু করে। ইউক্রেনীয় ভাষায় ‘মাইদান’ শব্দের অর্থ ‘সরণি’ বা ‘সড়ক’। বিক্ষোভ শুরুর পর ইউক্রেনীয় সরকারবিরোধীরা এই আন্দোলন সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘এভ্রোমাইদান’ (ইউক্রেনীয়: Євромайдан) বা ‘ইউরোমাইদান’ (ইংরেজি: Euromaidan) নামে একটি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করতে শুরু করে। ইউক্রেনীয় ভাষায় এই শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় ‘ইউরোপীয় সরণি’। এই নামানুসারে ইউক্রেনে ২০১৩–১৪ সালে সংঘটিত রাজনৈতিক অভ্যুত্থানকে ‘ইউরোমাইদান’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
২২ নভেম্বর আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ইউক্রেনীয় পুলিস কিয়েভে বিক্ষোভকারীদের তাঁবু নির্মাণে বাধা প্রদান করে এবং পুলিসের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। সেদিন কিয়েভ বাদে লভিভ, ভিন্নিৎসা, দনেৎস্ক, ক্রিভয় রগ, সুমি, খারকিভ, চের্নেভিৎসি প্রভৃতি শহরেও ক্ষুদ্র আকারে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অবশ্য ইউরোমাইদানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিয়েভ ছিল এই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু এবং ইউক্রেনীয় সরকার ও সরকারবিরোধীরা উভয়েই কিয়েভকে নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করছিল।
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে প্রধানত দুই ধরনের চিন্তাধারার মানুষ ছিল। এদের মধ্যে একদল ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ইউক্রেনের অঙ্গীভূতকরণের জোরালো সমর্থক এবং তাদের এই অবস্থানের মূল কারণ ছিল ব্যক্তিগত। তাদের বিশ্বাস ছিল, ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করলে ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের পথ ত্বরান্বিত হবে এবং তারা মুক্তভাবে কাজের খোঁজে ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রবেশের সুযোগ পাবে। বস্তুত ইউক্রেনের শোচনীয় অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইউক্রেন ছেড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর শ্রমবাজারে প্রবেশের সুযোগ পেতে ব্যগ্র ছিল।
বিক্ষোভকারীদের অপর দলটি ছিল প্রধানত রুশবিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং এদের সিংহভাগ ছিল ঐতিহাসিকভাবে রুশবিরোধী পশ্চিম ইউক্রেন থেকে আগত। তাদের ধারণা ছিল, ইউক্রেনীয় সরকার যেহেতু রাশিয়ার চাপে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, সেহেতু এরপর তারা রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করবে। এই প্রক্রিয়া বানচাল করতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
২৪ নভেম্বর কিয়েভে উক্রায়নস্কি দেমোক্রাতিচনি আলইয়ান্স জা রেফর্মি, সভোবোদা ও বাৎকিভশ্চিনা ‘ইউরোপীয় ইউক্রেনের জন্য’ শিরোনামে একটি সমাবেশের আয়োজন করে এবং সেদিনের বিক্ষোভে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ অংশ নেয়। সেখানে বিরোধী দলীয় নেতারা ইউরোপের সঙ্গে অঙ্গীভূতকরণ প্রক্রিয়া বজায় রাখার ও ইউক্রেনীয় সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সমাবেশের পর বিক্ষোভকারীদের একাংশ (প্রধানত ‘সভোবোদা’ দলের সমর্থকরা) ইউক্রেনীয় মন্ত্রিপরিষদের কার্যালয় দখল করে নেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইউক্রেনের অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও সেদিন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় সরকারের সমর্থকরা কিয়েভে ও অন্য কয়েকটি শহরে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে মিছিল করে।
২৫ থেকে ২৮ নভেম্বর খুব অল্প সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। ২৯ নভেম্বর ইউক্রেন কর্তৃক ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’ স্বাক্ষরের সময়সীমা শেষ হয়ে যায় এবং ইউক্রেন চুক্তিতে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে। সেদিন কিয়েভে ইউক্রেনীয় সরকারের সমর্থকরা সমাবেশ করে, অন্যদিকে সন্ধ্যায় বিরোধী দলগুলো তাদের সমাবেশের আয়োজন করে। এসময় তারা রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচকে অভিশংসন করার এবং নির্ধারিত সময়ের আগে আইনসভা ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানায়।
৩০ নভেম্বরের ঘটনাবলি: ইউরোমাইদানকে ছত্রভঙ্গ করার প্রথম বৃহৎ প্রচেষ্টা
২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর মাইদান নিজালেঝনোস্তিতে প্রায় ১,০০০ বিক্ষোভকারী অবস্থান করছিল। বিক্ষোভকারীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং এরপর ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ বাহিনী ‘বেরকুৎ’ (ইউক্রেনীয়: Беркут) মাইদান নিজালেঝনোস্তি থেকে বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদ করতে শুরু করে। বেরকুৎ সদস্যদের আগমনের পর সিংহভাগ বিক্ষোভকারী মাইদান ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা বেরকুৎ সদস্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষের সময় ৭০ জন বিক্ষোভকারী এবং ৭ জন পুলিশ আহত হয়। পুলিশ ৩০ জন বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়।
৩০ নভেম্বরের সংঘর্ষের ঘটনা ইউক্রেনীয় সরকারের জন্য মারাত্মক নেতিবাচক পরিণতি ডেকে আনে, কারণ এই ঘটনাকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জোরদার সরকারবিরোধী প্রচারণা চালাতে শুরু করে। তারা নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদ করার ঘটনাকে একটি ‘রক্তাক্ত’ পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং নিরাপত্তারক্ষীরা ইউক্রেনীয় জনসাধারণের ‘সন্তানদের মেরেছে’ এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকে। ইউক্রেনীয় প্রচারমাধ্যমের সিংহভাগ ছিল নব্য অভিজাত শ্রেণির (oligarchs) নিয়ন্ত্রণাধীন এবং তারা নিরাপত্তারক্ষীদের দ্বারা বিক্ষোভকারীদের বলপূর্বক ছত্রভঙ্গ করার দৃশ্য বারবার প্রচার করতে থাকে। কিন্তু উগ্র জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা যে পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সংঘর্ষের সূচনা করেছিল, সেই চিত্রটি প্রচারমাধ্যম থেকে সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখা হয়।
বস্তুত ৩০ নভেম্বরের ঘটনাকে সরকারবিরোধী দলগুলো তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করে। ঐদিনই প্রায় ১০,০০০ মানুষ কিয়েভে একটি নতুন বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। ক্লিচকো, তিয়াহনিবোক ও ইয়াৎসেনিউক এই বিক্ষোভে অংশ নেন। তারা রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ ও সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভিতালি জাখারচেঙ্কো ও বেরকুৎ কর্মকর্তাদের শাস্তি প্রদানের দাবি করেন। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের প্রাদেশিক প্রশাসনগুলো সাধারণভাবে সহিংসতার নিন্দা জানায়, কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, পশ্চিম ইউক্রেনের প্রাদেশিক প্রশাসনগুলো তীব্রভাবে ইউক্রেনীয় সরকারের নিন্দা জানায় এবং তাদের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলনের আহ্বান জানায়।
রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন যে, বেরকুৎ কর্তৃক বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদের ঘটনা তার অনুমতির ব্যতিরেকে সংঘটিত হয়েছে এবং যারা এই সংঘর্ষ শুরু করেছে তাদেরকে তদন্তের মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হবে। তিনি ৩০ নভেম্বরের ঘটনার তদন্ত করার জন্য ইউক্রেনের প্রোসিকিউটর জেনারেলের কার্যালয়কে নির্দেশ দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাকারচেঙ্কো এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী আজারভ বেরকুৎ কর্তৃক ‘মাত্রাতিরিক্ত’ বল প্রয়োগের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিয়েভ পুলিসের প্রধান ভালেরি কোরিয়াক (যিনি বেরকুৎ কর্তৃক পরিচালিত অভিযানের নির্দেশ দিয়েছিলেন) পদত্যাগ করেন, কিন্তু জাখারচেঙ্কো তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাখ্যান করেন এবং তদন্ত চলাকালীন সময় পর্যন্ত তাকে তার পদ থেকে সাময়িকভাবে অপসারণ করেন।
ইউরোমাইদানের বিস্তার এবং ক্রমবর্ধমান সংঘাত
কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আন্দোলনের বিস্তার রোধ করতে ব্যর্থ হয়। ১ ডিসেম্বর কিয়েভে প্রায় ৫০,০০০ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয় এবং ক্রমে এই সংখ্যা ১ লক্ষে পৌঁছায়। উল্লেখ্য, বিরোধী দলগুলো বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য হাজার হাজার মানুষকে পশ্চিম ইউক্রেন থেকে কিয়েভে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে। একই দিনে একদল উগ্র জাতীয়তাবাদী কিয়েভে ভ্লাদিমির লেনিনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু বেরকুৎ সদস্যরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়।
বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোর সশস্ত্র সদস্যরা কিয়েভের বিভিন্ন সরকারি ভবন দখল করে নেয় এবং ৩০০ গাড়ির একটি বহর নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনের ওপর আক্রমণ করার প্রচেষ্টা চালায়। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন পুলিশ সদস্য গুরুতরভাবে আহত হয়। সেদিন কিয়েভের পাশাপাশি ইউক্রেন জুড়ে অন্যান্য বড় শহরগুলোতেও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়।
২ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা সশস্ত্র ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’ গঠন করতে শুরু করে এবং কিয়েভ নগর কর্তৃপক্ষের শান্তিপূর্ণভাবে দখলকৃত সরকারি ভবনগুলো ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ৩ ডিসেম্বর ইউক্রেনীয় আইনসভার অধিবেশনে বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী দলগুলো ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করে, কিন্তু সিংহভাগ আইনসভা সদস্য তাদের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ৪ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায় এবং আইনসভা অবরোধ করে। বিরোধী দলগুলো ঘোষণা করে যে, ইউক্রেনীয় সরকারের পদত্যাগের আগপর্যন্ত তারা আইনসভা অবরুদ্ধ করে রাখবে। একই দিনে ইউক্রেনীয় সরকারের সমর্থকরা কিয়েভে সরকারের পক্ষে সমাবেশ করে।
৫ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা কিয়েভে বেরকুৎ ও ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ঘাঁটি অবরোধ করে এবং বিরোধী দলগুলো বেরকুৎ বাহিনীকে নিষিদ্ধ করে বাহিনীটির সদস্যদের সমস্ত পদমর্যাদা কেড়ে নেয়ার দাবি জানায়। ৬ ডিসেম্বর ক্লিচকো, তিয়াহনিবোক ও ইয়াৎসেনিউক ইউক্রেনের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে আহ্বান জানান এবং ক্লিচকো ঘোষণা করেন যে, ইউক্রেনীয় মন্ত্রিপরিষদের পদত্যাগের আগপর্যন্ত তারা কোনো রকমের সংলাপে বসতে আগ্রহী নন। ৭ ডিসেম্বর তারা দাবি করেন যে, ইউক্রেনীয় সরকারকে পদত্যাগ করে নতুন একটি সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, যারা অবিলম্বে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ‘সম্পৃক্ততা চুক্তি’তে স্বাক্ষর করবে এবং আইএমএফের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা শুরু করবে। একই দিনে বিক্ষোভকারীরে ইউক্রেনের ৫টি টেলিভিশন চ্যানেলের কার্যালয়ে ভাঙচুর করে।
৯–১০ ডিসেম্বরের ঘটনাবলি: ইউরোমাইদানকে ছত্রভঙ্গ করার দ্বিতীয় বৃহৎ প্রচেষ্টা
৮ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারীরা আন্দোলনকে আরো জোরদার করে। এদিন ‘সভোবোদা’ দলের সদস্যরা লেনিন স্মৃতিসৌধ গুঁড়িয়ে দেয় এবং কিয়েভের সরকারি কোয়ার্টার পুরোপুরি দখল করে নেয়। অন্যদিকে, ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ দলের সদস্যরা কিয়েভে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে সমাবেশ করে। ৯ ডিসেম্বর বেরকুৎ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের কিয়েভের সরকারি কোয়ার্টার থেকে বিতাড়িত করে।
১০ ডিসেম্বর নাগাদ সিংহভাগ বিক্ষোভকারী মাইদান থেকে সরে পড়ে এবং মাত্র ১,০০০ বিক্ষোভকারী সেখানে অবস্থান করতে থাকে। ১১ ডিসেম্বর বেরকুৎ সদস্যরা ও অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষীরা তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করার প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম ইউক্রেন থেকে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী আবার কিয়েভে আসতে শুরু করে এবং শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা ২৫,০০০–এ গিয়ে পৌঁছায়। এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তারক্ষীরা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে ৬ জন বিক্ষোভকারী এবং ৯ জন নিরাপত্তারক্ষী আহত হয়।
১২ ডিসেম্বর পশ্চিম ইউক্রেন থেকে কিয়েভে বিক্ষোভকারীদের আগমন অব্যাহত থাকে এবং ১৩ ডিসেম্বর বিক্ষোভকারী ইউক্রেনীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আপিল আদালত এবং ইউক্রেনীয় জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের সচিব আন্দ্রি ক্লুয়েভের বাসভবন ভাঙচুর করে। একই দিনে পূর্ব ইউক্রেন থেকে ইউক্রেনীয় সরকারের সমর্থকরা কিয়েভে আসতে শুরু করে এবং ১৪ ডিসেম্বর তাদের একটি সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী আজারভ ইউক্রেনীয় জনসাধারণকে বিক্ষোভ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। একই দিনে রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ ৩০ নভেম্বর বিক্ষোভকারীদের উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়ার দায়ে কিয়েভ নগর প্রশাসনের প্রধান ওলেক্সান্দর পোপোভ এবং ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের উপ–সচিব ভলোদিমির সিভকোভিচকে বরখাস্ত করেন।
ইউরোমাইদানের মধ্যম পর্যায়: আন্দোলনের যুগপৎ সম্প্রসারণ ও সংকোচন
১৫ ডিসেম্বর কিয়েভে ইউক্রেনীয় সরকারের সমর্থক ও বিরোধীরা পাল্টাপাল্টি সমাবেশ করতে থাকে এবং ইউক্রেনীয় সরকারবিরোধীরা রাশিয়ার সঙ্গে কাস্টমস ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী আজারভ ও ক্ষমতাসীন ‘পার্তিয়া রেহিওনিভ’ দলের সদস্যরা একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন, এবং এই বৈঠকে দলের সদস্যরা ইউক্রেনীয় সরকারের কাঠামোয় ৯০% পরিবর্তন আনার দাবি জানায়। ১৭ ডিসেম্বর বিরোধী দলগুলো পুনরায় ইউক্রেনীয় আইনসভার অধিবেশন পণ্ড করে দেয়। একই দিন রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ রাশিয়া সফর করেন এবং প্রায় ২০০ বিক্ষোভকারী কিয়েভের বিমানবন্দরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ১৮ ডিসেম্বর কিয়েভে প্রায় ১০,০০০ মানুষ বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে। ১৯ ডিসেম্বর ইউক্রেনীয় আইনসভা গ্রেপ্তারকৃত সকল বিক্ষোভকারীকে মুক্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কিয়েভে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে এবং বিক্ষোভকারীরা বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সামনে ভাঙচুর চালায়। অন্যদিকে, ডিসেম্বর জুড়ে পূর্ব ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে এবং ইউরোমাইদানের বিপক্ষে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম ইউক্রেনেও কিছু মানুষ ইউরোমাইদানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করার চেষ্টা করে, কিন্তু সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন ইউরোমাইদানের বিপক্ষে বিক্ষোভ করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি কিয়েভে উগ্র জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা ও অক্ষশক্তির সহযোগী স্তেপান বান্দেরার জন্মদিন উপলক্ষে মিছিলের আয়োজন করে। অবশ্য এই সময় নাগাদ সরকারবিরোধী আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে আসতে শুরু করে এবং বহুসংখ্যক বিক্ষোভকারী কিয়েভ থেকে নিজেদের অঞ্চলে ফিরে যায়। কিন্তু বিক্ষোভকারীদের একাংশ মাইদানে অবস্থান করতে থাকে। ১০ জানুয়ারি তাদের সঙ্গে আবার বেরকুৎ সদস্যদের সংঘর্ষ হয় এবং এর ফলে ৩ জন বিক্ষোভকারী ও ২০ জন বেরকুৎ সদস্য আহত হয়। ১২ জানুয়ারি সরকারবিরোধীরা কিয়েভে একটি সমাবেশের আয়োজন করে এবং প্রায় ৫০,০০০ মানুষ এই সমাবেশে অংশ নেয়।
ইউরোমাইদান: আন্দোলন থেকে অভ্যুত্থানের পথে
১৫ জানুয়ারি নাগাদ আবার বিরোধী দলগুলো পশ্চিম ইউক্রেন থেকে কিয়েভে হাজার হাজার বিক্ষোভকারীকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে এবং তাদের গঠিত সশস্ত্র ‘আত্মরক্ষা ইউনিট’গুলো দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, কিয়েভে উক্ত আত্মরক্ষা ইউনিটগুলোর একটি সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা বলপূর্বক ইউক্রেনীয় সরকারকে উৎখাত করতে ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু বিক্ষোভকারীদের অন্যান্য অংশ তখনো এই পর্যায়ের ঝুঁকি নিতে আগ্রহী ছিল না। এমতাবস্থায় ১৬ জানুয়ারি ইউক্রেনীয় আইনসভা কতিপয় নতুন আইন প্রণয়ন করে এবং এর মধ্য দিয়ে বিক্ষোভসূচক কর্মকাণ্ডের ওপর বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করে।
এমতাবস্থায় ১৯ জানুয়ারি কিয়েভে উগ্র জাতীয়তাবাদী বিক্ষোভকারীরা পুলিস ও অন্যান্য নিরাপত্তারক্ষীদের আক্রমণ করে। তারা বেরকুৎ–এর ৪টি বাস, ২টি ট্রাক ও দিনামো স্টেডিয়ামের টিকেট কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ করে, এবং নিরাপত্তারক্ষীদের ওপর পাথর ও মলোটভ ককটেল নিক্ষেপ করে। প্রত্যুত্তরে নিরাপত্তারক্ষীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর টিয়ার গ্যাস, স্টান গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে। এই সংঘর্ষের ফলে অন্তত ৪২ জন বিক্ষোভকারী ও শতাধিক নিরাপত্তারক্ষী আহত হয়, যাদের মধ্যে প্রায় ৬১ জন নিরাপত্তারক্ষীর আঘাতের মাত্রা ছিল তুলনামূলকভাবে গুরুতর।
২০ জানুয়ারি উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। সেদিন ইউরোমাইদানের অন্যতম নেতা ক্লিচকো ইউক্রেনীয় নিরাপত্তারক্ষীদের সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা সরকারের পক্ষ ত্যাগ করলে সরকারের পতনের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। অর্থাৎ, ইউরোমাইদান খোলাখুলিভাবে ইউক্রেনীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আহ্বান জানাচ্ছিল।
বস্তুত ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি নাগাদ এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইউক্রেনীয় বিরোধী দলগুলো ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং বিক্ষোভের মাধ্যমে এই লক্ষ্য অর্জিত না হলে তারা সশস্ত্র পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত। এই পর্যায়ে ইউক্রেনের আঞ্চলিক বিভাজন সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, কারণ পশ্চিম ইউক্রেন স্পষ্টভাবে ইউক্রেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার পক্ষপাতী ছিল এবং পূর্ব ইউক্রেন স্পষ্টভাবে ইউক্রেনীয় সরকারের পক্ষে ও ইউরোমাইদানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় সরকার ও ইউক্রেনীয় বিরোধী দলগুলোর মূল লক্ষ্যবস্তু ছিল রাজধানী কিয়েভ। তখন পর্যন্ত কিয়েভ ইউক্রেনীয় সরকারের হাতে ছিল, কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণ কতদিন স্থায়ী হবে সেটি বোঝা যাচ্ছিল না। অবশ্য একটি বিষয় অনুধাবন করা যাচ্ছিল, আর সেটি হচ্ছে: ইউক্রেন বিশৃঙ্খলভাবে কিন্তু দ্রুতগতিতে গৃহযুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।