ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ফুটবল কিংবা আমাজন বনের জন্য পুরো বিশ্বেই বিখ্যাত। প্রতি চার বছর পর পর অনুষ্ঠিত হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপের উন্মাদনায় যখন পুরো বিশ্ব কাঁপতে থাকে, তখন আমাদের দেশেরও ফুটবল সমর্থকদের এক বিশাল অংশ ব্রাজিলের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। শুধু ফুটবল কিংবা আমাজন বন নয়, প্রাকৃতিক সম্পদেরও বিশাল ভান্ডার নিয়ে ব্রাজিল পৃথিবীর সবচেয়ে উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি।
করোনাভাইরাসের আগ্রাসন শুরুর পর থেকে বিভিন্ন দেশের সাফল্য কিংবা ব্যর্থতার হিসাব-নিকাশ কষে দেখা হয়েছে বিভিন্ন মানদন্ডে। যে রাষ্ট্রগুলো করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সফলতার পরিচয় দিয়েছে, সেসব রাষ্ট্র সম্পর্কে মিডিয়ায় মাতামাতি হয়েছে। ভারতের কেরালা, ভিয়েতনাম কিংবা প্রাথমিক পর্যায়ে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য পৃথিবীর অনেক দেশকে অনুপ্রাণিত করেছে। করোনা-বিপর্যস্ত অঞ্চলের মানুষ নতুন করে আশার আলো দেখতে পেয়েছে সেসব গল্প শোনার পর। আবার করোনার আগ্রাসন মোকাবেলায় ব্যর্থ রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নীতি নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে অপরাপর অঞ্চলের রাষ্ট্রনেতাদের।
ল্যাটিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতো ব্রাজিলেও করোনাভাইরাস হানা দিয়েছে। কিন্তু হতাশাজনক বিষয় হলো, ব্রাজিল যেভাবে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তাতে শুধু সেই দেশের প্রশাসনের অদূরদর্শিতাই প্রতীয়মান হয়। এর ফলাফলও ভোগ করতে হচ্ছে ব্রাজিলের জনগণকে। করোনায় সবচেয়ে বিপর্যস্ত হওয়া আমেরিকার পর ব্রাজিলের নাম উচ্চারিত হচ্ছে সর্বত্র। সাও পাওলোর কবরস্থানগুলোতে এখন আর কোনো জায়গা ফাঁকা নেই। আইসিইউ-এর অভাবে হাজারে হাজারে লোক মারা যাচ্ছে।
এই বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি যখন করোনা হানা দিল ব্রাজিলে, তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে বেশ আতঙ্ক দেখা দেয়। সবসময় যেসব জায়গা জনাকীর্ণ থাকত, মানুষদের পদচারণায় মুখর থাকত, সেসব জায়গা হঠাৎ করে ভুতুড়ে, জনমানবহীন আস্তানায় পরিণত হলো। যেসব রাস্তায় গাড়ির টায়ারের শব্দ পাওয়া যেত, সেসব রাস্তায় বিভিন্ন চারপেয়ে পশু ঘুরে বেড়াতে লাগল নিশ্চিন্তে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হতো না। বের হলেও সবকিছু ঢেকে করোনাভাইরাসের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে বের হতো। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে কেউ ছাড় দেয়নি প্রথমদিকে।
ব্রাজিলের জনগণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ার ঠিক উল্টোটি দেখা যায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্রাজিল প্রেসিডেন্ট জায়ার বলসোনারোর প্রশাসন যেভাবে অবহেলা প্রদর্শন করেছে, তাতে একটি দায়িত্বশীল প্রশাসনে অযোগ্যতা ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। প্রেসিডেন্ট বলসোনারো করোনাভাইরাসকে আখ্যায়িত করেন ‘একটি সাধারণ মহামারি’ হিসেবে, যেসব বিষয়ে ব্রাজিল অভ্যস্ত। অথচ শুরুর দিকেই কঠোর পদক্ষেপ, যেমন- কার্যকর লক-ডাউন কিংবা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে পারলে পরবর্তীতে এত ভুগতে হতো না দেশটিকে।
ব্রাজিলের স্বাস্থ্যখাতের ভগ্নদশা করোনা বিপর্যয়ের ভয়াবহতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও কয়েকগুণ। নিও-লিবারেলিজম নীতি অনুসরণ করা ব্রাজিলের স্বাস্থ্যখাতের পেছনে বেশি ব্যয় করেনি পূর্ববর্তী সরকারগুলো। বেশি করে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো পদক্ষেপও নিতে সক্ষম ছিল না বলসোনারো সরকার।
ব্যক্তিমালিকানায় থাকা হাসপাতালগুলো করোনাভাইরাসের ফলে যে সংকট তৈরি হয়েছে, সেগুলোর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে মুনাফা লোটার ক্ষেত্রে। জানুয়ারিতে যেখানে এক বাক্স মাস্কের দাম ছিল মাত্র সাড়ে চার ডলার, করোনা হানা দেয়ার পরে মার্চে সেই এক বাক্স মাস্কের দাম বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে একশো চল্লিশ ডলারে! রিও ডি জেনেইরো কিংবা সাও পাওলোর হাসপাতালগুলো চিকিৎসা সামগ্রীর অপ্রতুলতার কথা বার বার বলেছে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়নি। বলসোনারো সরকার এই মূল্যবৃদ্ধি মনিটরিং করা কিংবা চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের কোনো উদ্যোগ তো নেয়ইনি, বরং বারবার অর্থনীতিকে সচল রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টার কথা প্রচার করেছে।
করোনার আগ্রাসন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর মতো অনভিজ্ঞ ছিলেন না ব্রাজিলের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের গভর্নররা। তারা জনগণের অবাধ চলাচলে বাধা আরোপ করেছেন, লকডাউন কার্যকর করতে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন। প্রেসিডেন্টের সাথে তাদের বিরোধ হয়েছে, কারণ তিনি ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পদ্ধতি’ হিসেবে লকডাউনকে চরম উপায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আরোপ করা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অঙ্গরাজ্যগুলোতে গভর্নররা চাইলে লকডাউন আরোপ করতে পারবেন, এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বলসোনারো কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
করোনাভাইরাস ব্রাজিলে হানা দেয়ার পর দুজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তাদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এই দুজনই ব্রাজিলের উগ্র ডানপন্থী প্রেসিডেন্টের করোনা মোকাবেলার পদ্ধতিতে দ্বিমত পোষণ করেন। প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী লুইজ ম্যানডেত্তাকে প্রেসিডেন্ট বলসোনারো চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন তার সাথে দ্বিমত পোষণের জন্য। এরপর নেলসন টেইচকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনিও তার পূর্বসূরির মতো প্রেসিডেন্টের করোনা মোকাবেলার পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ছিলেন না। নেলসন টেইচ করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করতে চেয়েছিলেন। এক মাসের মাথায় তিনিও পদত্যাগ করেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় অথবা তিনি নিজেই তার পূর্বসূরীর পরিণতি দেখে পদত্যাগে বাধ্য হন।
দুই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর অপসারণের পর একজন সামরিক ব্যক্তিত্বকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। অথচ তার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে। তিনি পেশায় একজন জেনারেল, বলসোনারোর কাছের ব্যক্তি। বলে রাখা ভালো, আগের দুজন স্বাস্থ্যমন্ত্রীই ডাক্তার ছিলেন।
ব্রাজিলের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এই জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। করোনা সর্বপ্রথম এসেছিল সেই শহরগুলোতে, যেখানে বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত বেশি হয়। এসব শহর অর্থনৈতিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ, শহরের অধিবাসীদের আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে করোনাভাইরাস ব্রাজিলের সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন, অসচ্ছল, অসচেতন জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং ভয়াবহ রূপ নেয়। এই জনগোষ্ঠীর সামর্থ্য নেই ব্রাজিলের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করার। সরকারের পক্ষ থেকেও তাদেরকে স্বাস্থ্যসচেতন করা কিংবা স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।
প্রেসিডেন্ট বলসোনারো ব্রাজিলের পরবর্তী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চান অর্থনীতির উপর ভর করে। তিনি জাতীয় উৎপাদনে ছাড় দিতে কোনোভাবেই রাজি নন। অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে মানুষের জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও তিনি তাতেই রাজি। এজন্য লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টিনের মতো পদক্ষেপগুলোর ঘোর বিরোধী তিনি, কারণ এসব পদক্ষেপের কারণে জনগণ কর্মক্ষেত্রে আসতে পারবে না, উৎপাদনের ইউনিটগুলো সচল থাকতে পারবে না শ্রমিকের অভাবে। ফলে অর্থনীতি থমকে দাঁড়াবে, জাতীয় উৎপাদন হ্রাস পাবে। কিন্তু লকডাউন কিংবা কোয়ারেন্টিন কার্যকর না হলে যে ব্রাজিলের বিশাল সংখ্যক জনগণ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে এবং এতে অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে– এসব দূরদর্শী চিন্তা বিবেচনায় নিতে অপারগ তিনি।
ব্রাজিলের একজন কর্তৃত্ববাদী প্রেসিডেন্টের খামখেয়ালিপনা ও অদূরদর্শিতার বলি হতে হচ্ছে সেদেশের সাধারণ জনগণকে। দেশটিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ভাসমান কিংবা দারিদ্র্যের কষাঘাতে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী, যাদের প্রতি রাষ্ট্রের অবহেলা চোখে পড়ার মতো। একটি কার্যকর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা পারতো ব্রাজিলের করোনা বিপর্যয়কে রুখে দিতে, কিন্তু বলসোনারো প্রশাসন সেটি করার মতো দায়িত্বশীলতা দেখায়নি। করোনা মোকাবেলায় রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক দিক থেকে ব্রাজিলের ব্যর্থতার দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই।