লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ছিল ভেনেজুয়েলা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তেলের রিজার্ভ আবিষ্কার হওয়ার পর ভেনেজুয়েলার মানুষেরা আশ্বস্ত হয় এই ভেবে যে, লাতিন আমেরিকার গড়পড়তা দুর্বল কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশের তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে হয়তো ভেনেজুয়েলা আধুনিক শিল্পনির্ভর হওয়ার দিকে পা বাড়াবে। তেলের রিজার্ভ আবিষ্কারের পর অতিক্রান্ত হয়েছে একশো বছর। এই সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্থান-পতনের সাক্ষী হয়েছে দেশটি। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট এত গভীর হয়েছে সেখানেতে যে ভেনেজুয়েলার নাগরিকেরা সুযোগ পেলেই মাতৃভূমি থেকে পালাচ্ছেন। গত কয়েক বছরে প্রায় আধা কোটিরও বেশি মানুষের ভেনেজুয়েলা ছাড়ার পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে দেশটি তার নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার রক্ষায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক দুর্দশা সম্পর্কে আরেকটু গভীরে যাওয়া যাক। হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিকার্ডো হাউসমানের মতে, ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির এই ধরনের অবনমন রীতিমতো অবিশ্বাস্য। সাধারণত যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়লে একটি দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই ধরনের অবনমন ঘটে। ভেনেজুয়েলায় প্রলয়ঙ্কারী কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত লাগেনি, রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়েনি কিংবা বাইরের কোনো রাষ্ট্রের সাথে তারা যুদ্ধেও জড়ায়নি। তারপরও ভেনেজুয়েলার অর্থনীতির এ ধরনের অবনমন সত্যি অকল্পনীয়। মহামন্দার সময় আমেরিকার অর্থনীতির যে অবস্থা হয়েছিল কিংবা গৃহযুদ্ধের সময় স্প্যানিশ অর্থনীতির যে অবস্থা হয়েছিল– তার চেয়েও দ্বিগুণ খারাপ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে ভেনেজুয়েলা। দেশটিতে বেকারত্ব চরমে পৌঁছেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশচুম্বী, মুদ্রাস্ফীতির জন্য অর্থের মান একদম পড়ে গিয়েছে, জীবনধারণের মৌলিক জিনিসগুলোর গভীর সংকট চলছে। এর সাথে বাড়তি যুক্ত হয়েছে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা।
ভেনেজুয়েলার আজকের যে অবস্থা, তার পেছনের কারণগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক। সেজন্য আমাদের ‘পেট্রোস্টেট’ এর ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে।
‘পেট্রোস্টেট’ শব্দটি দ্বারা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে এখানে পেট্রোলিয়ামের (Petroleum) সাথে রাষ্ট্রের (State) কোনো সম্পর্ক রয়েছে। একটি দেশকে পেট্রোস্টেট বলার জন্য তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে:
১) রাষ্ট্রের আয় খনিজ তেল ও গ্যাসের রপ্তানির উপর অতি-নির্ভরশীলতা,
২) রাজনৈতিক ক্ষমতা দেশের অভিজাত শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত থাকা, এবং
৩) রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়া, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা চরম আকার ধারণ করা।
পেট্রোস্টেটগুলোর মূল সমস্যা হচ্ছে এই রাষ্ট্রগুলো অতিমাত্রায় খনিজ তেল ও গ্যাস তথা পেট্রোলিয়ামের উপর নির্ভরশীল থাকে। সাধারণত এসব দেশ অন্যান্য শিল্পের প্রসারের প্রতি খুব বেশি আগ্রহী থাকে না। অর্থাৎ মাত্র একটি শিল্পের প্রাধান্য থাকায় পেট্রোস্টেটগুলোর অর্থনীতিতে খুব বেশি বৈচিত্র্য দেখতে পাওয়া যায় না। রাষ্ট্রের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার একটি বড় অংশ পেট্রোলিয়াম শিল্পের সাথে জড়িত থাকে। কৃষি কিংবা অন্যান্য শিল্পের ক্ষেত্রে জনবল সংকট দেখা দেয়। বেশিরভাগ পেট্রোস্টেট কৃষিশিল্পের প্রসার ঘটাতে না পারায় তাদের খাদ্যশস্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি করতে বড় অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। অন্যান্য শিল্পের প্রসার না ঘটায় রাষ্ট্রগুলো আরও বেশি করে পেট্রোলিয়াম শিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং দিনশেষে এটি তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিছু পেট্রোস্টেটের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে রাষ্ট্রগুলো খনিজ তেল ও গ্যাসের রপ্তানির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল থাকার কারণে জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের দিকে মনোযোগী থাকে না। এতে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যে বন্ধন, তা দুর্বল হয়ে পড়ে, একইসাথে রাষ্ট্রও বিশাল অংকের অর্থ হাতছাড়া করে ফেলে। সাধারণত পেট্রোস্টেটগুলো বিদেশি বহুজাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আহ্বান জানায় খনি থেকে তেল উত্তোলনের জন্য এবং প্রতি ব্যারেল তেলের উপর উচ্চহারে ট্যাক্স বসায়। শুধু এই ট্যাক্সের মাধ্যমেই পেট্রোস্টেটগুলো বিশাল অংকের অর্থ লাভ করে। আবার অনেক সময় পেট্রোস্টেটগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করে। ভেনেজুয়েলা দীর্ঘদিন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তেল উত্তোলন করালেও পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালের দিকে নিজেরাই তেল উত্তোলনকারী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। এর প্রধান সুবিধা হলো, তেল ও গ্যাস উৎপাদনের যে বাড়তি লভ্যাংশ অর্জন করা যায়।
ভেনেজুয়েলা হচ্ছে একটি আদর্শ পেট্রোস্টেটের উদাহরণ। দেশটির প্রথম তেলের খনি আবিষ্কার হওয়ার শত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর এখনও দেশটির রাজনৈতিক নেতারা তাদের অর্থনীতিতে খুব বেশি বৈচিত্র্য আনতে পারেনি, যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সেখানকার সাধারণ মানুষকে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি মোটাদাগে তেলের খনিগুলোর উপর নির্ভরশীল। দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের ৯৯ শতাংশ আসে খনিজ তেল ও গ্যাস রপ্তানি করার মাধ্যমে। দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক দল অনেকদিন থেকে ক্ষমতায় থাকার কারণে দলের অভিজাত নেতৃবৃন্দের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে আছে। ভেনেজুয়েলার জনগণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে সরকারের উপর অসন্তুষ্ট এবং বেশ কয়েক বছর ধরেই সেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজমান রয়েছে। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার জনগণ নিকোলাস মাদুরো সরকারের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছে অনেকবার, এবং অভিযোগ আছে, মাদুরো সরকার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সেসব আন্দোলন ভেস্তে দেয়ার চেষ্টা করেছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ সবসময় একটি রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুখ দেখাতে পারে না। ভেনেজুয়েলার কথাই ধরা যাক। দেশটি যেহেতু তেল ও গ্যাসের রপ্তানির উপর নির্ভরশীল, তাই যদি এই খাত কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ভেনেজুয়েলা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেল ও গ্যাসের দাম সবসময় একরকম থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আরব তেল উত্তোলনকারী রাষ্ট্রগুলো যখন ইসরায়েলকে সমর্থন দেয়া দেশগুলোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন খনিজ তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল চারগুণ। ভেনেজুয়েলা সেসময় বিপুল পরিমাণ তেল রপ্তানি করে বিরাট অংকের অর্থ কামিয়ে নিয়েছিল। আবার ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম পড়ে যায়। সম্প্রতি দেখা গিয়েছে, ২০১৪ সালে যেখানে এক ব্যারেল তেলের দাম ছিল ১০০ ডলার, ২০১৬ সালে এসে তেলের দাম নেমে এসেছিল মাত্র ৩০ ডলারে! এতে করে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি গভীর সংকটে নিপতিত হয়, যেটি এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
গত বছরের শুরুর দিকে যখন করোনাভাইরাসের আগ্রাসন শুরু হয়, তখন প্রতিটি রাষ্ট্রের সমস্ত অর্থনৈতিক কার্যক্রম থমকে যেতে শুরু করে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান লকডাউনকেই এই ভাইরাসের ধ্বংসলীলা ঠেকানোর মূল অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন। কঠোর লকডাউনের জন্য কারখানা, যানবাহন, গাড়ি চলাচল সব বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি অনেকক্ষেত্রে অনেক দেশ তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমান্ত বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। এমন অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবীব্যাপী খনিজ তেলের চাহিদা কমে যায়, শুরু হয় দরপতন। ২০১৬ সালের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় এমনিতে উৎপাদন অনেকাংশে কমে গিয়েছিল ভেনেজুয়েলায়, করোনাভাইরাসের উদ্ভবের পর থেকে সেই অবস্থা আরও খারাপের দিকে গিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৪ সালের যা উত্তোলন করা হতো, বর্তমানে তার মাত্র ত্রিশ শতাংশ তেল উত্তোলন করা হচ্ছে। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোও এখন আর ভেনেজুয়েলায় বিনিয়োগে আগ্রহী নয়।