“যতদিন পর্যন্ত সরকার বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারবে না, ততদিন পর্যন্ত আমরা ডিজেল পাচার করতে থাকবো। সরকার যদি এখানে কলকারখানা স্থাপন করে, তাহলে কেউই তার জীবন বিপন্ন করে সীমান্ত পার হবে না।”
“প্রতিমাসে সীমান্ত পার হতে গিয়ে আমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। সরকার সবসময়ই বেলুচিস্তান প্রদেশকে অবহেলা করেছে। পাঞ্জাবের মতো এখানে কোনো কলকারখানা নেই, আয়ের অন্য উৎসও নেই।”
“আমাদের এখানকার মাটি বৃষ্টির পানির অভাবে শুকিয়ে গিয়েছে। গ্রানাইটের পাহাড় আর ময়লা ধুলাময় রাস্তা পাড়ি দিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেলার এই পথ আমাদের বেছে নিতে হয়েছে।”
প্রথম কথাটি পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী যুবকের, যিনি বৈধ কোনো পেশায় নিজের কর্মসংস্থান করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ডিজেল পাচারের পথ বেছে নিয়েছেন। দ্বিতীয় কথাটি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পিএইচডি শিক্ষার্থীর। তিনি তার বড় পরিবারের ব্যয়ভার বহনের জন্য মাঝেমধ্যে ডিজেল পাচারের পথ বেছে নেন। একেবারে শেষের বক্তব্যটি ফিদা বালোচ নামের একজন ব্যক্তির, যিনি পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী বেলুচিস্তান প্রদেশে ডিজেল পাচারের সাথে জড়িত।
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী একটি প্রদেশ। এই প্রদেশটির নাম কখনও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্য, কখনও বা নৃশংস জঙ্গি হামলা, আবার কখনও সামরিক বাহিনীর নির্মমতার জন্য গণমাধ্যমে এসেছে অনেকবার। ঠিক একই নামে ইরানেও একটি সীমান্তবর্তী প্রদেশ রয়েছে। তবে ইরানের বেলুচিস্তান প্রদেশ নিয়ে তেমন খবর পাওয়া যায় না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের সাথে ইরানের সিস্তান এবং বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে। এই সীমান্ত দিয়ে প্রতি বছর বিশাল পরিমাণ ডিজেল পাচার করা হয়। শুধু ডিজেলই নয়, কিছু পরিমাণ মাদক ও অবৈধ অস্ত্রও পাচার নয় ডিজেলের পাশাপাশি ইরানের দুটি সীমান্ত প্রদেশ (সিস্তান ও বেলুচিস্তান) এবং পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশ বেলুচিস্তানের সম্মিলিত জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ডিজেল পাচারের সাথে জড়িত। তবে এই পাচারের পেছনে রয়েছে বেশ কিছু আর্থসামাজিক কারণ।
ঠিক কী পরিমাণ ডিজেল পাচার হয় দুই দেশের মধ্যে, তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়৷ ২০১৫ সালে এক অনুমান অনুযায়ী, দৈনিক প্রায় সাত লাখ লিটার ডিজেল পাচার করা হয়েছিল। ২০২০ সালে ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী, দেশটি থেকে দৈনিক প্রায় এগারো লাখ লিটার ডিজেল পাচার হয়েছে পাকিস্তানে। এত পরিমাণ ডিজেল পাচার হওয়ার পেছনে কারণ মূলত তিনটি। অনাবৃষ্টির ফলে সৃষ্ট খরা, ডিজেলের স্বল্পমূল্য এবং বেকারত্ব।
উপরে যে তিনজন ব্যক্তির বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে দুজন বেশ শিক্ষিত। একজন স্নাতক ডিগ্রিধারী, আরেকজন পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তারা শিক্ষাগ্রহণে ত্রুটি না রাখলেও তাদের কর্মসংস্থান নেই। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান দেশটির সবচেয়ে খরাপ্রবণ ও অনুন্নত প্রদেশগুলোর একটি৷ খরা পাকিস্তানের একটি বড় সমস্যা, যেটি বেলুচিস্তান প্রদেশে তীব্র রূপ ধারণ করেছে। প্রতিকূল আবহওয়ার জন্য এখানে একদিকে যেমন শক্ত কৃষিখাত গড়ে ওঠেনি, তেমনই পাকিস্তানের নামকরা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে কারখানা গড়ে তুলতে আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। এর ফলে এখানে যারা জন্ম নিয়েছে, তাদেরকে ছোট থেকেই দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে হয়েছে৷ পরিবার চালাতে অনেকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন ডিজেল চোরাচালানের পথ। কারণ, এটি ছাড়া তাদের হাতে অর্থ আয়ের আর কোনো পথ খোলা নেই।
ইরান থেকে পাকিস্তানে ডিজেল পাচারের আরেকটি বড় কারণ ইরানে পাকিস্তানের তুলনায় ডিজেলের অতি অল্প মূল্য। দুই দেশের মূদ্রার মান ভিন্ন হওয়ায় আমরা যদি ডলার দিয়ে হিসাব করি, পাকিস্তানে এক গ্যালন ডিজেলের দাম যেখানে ৩ ডলার, সেখানে ইরানে সেটির দাম হচ্ছে মাত্র ৩৪ সেন্ট। অর্থাৎ ইরানে ডিজেলের মূল্য পাকিস্তানের দশ ভাগের এক ভাগ (প্রায়)। ইরানের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোতেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুব একটা হয়নি। ফলে সেখানকারও মোট জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পাকিস্তানে ডিজেল পাচারের সাথে জড়িত।
সাধারণত একটি দেশের মোট জনগোষ্ঠীর যে অংশটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় একটু পিছিয়ে থাকেন, তারা কৃষিখাতে আত্মনিয়োগ করেন। দেশকে অন্ন জোগানোর গুরুদায়িত্ব তারা নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। অনেকে ছোট থেকেই কৃষিখাতে আত্মনিয়োগের ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়ে ওঠে না। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের বিরূপ আবহাওয়ার কারণে এখানে কৃষিকাজ করা বেশ কঠিন। ফলে স্বাভাবিকভাবে যাদের কৃষিতে আত্মনিয়োগ করার কথা, বেলুচিস্তান প্রদেশে তারা সেটি করতে পারছেন না। সুতরাং তাদের হাতে ডিজেল চোরাচালান ছাড়া আর পথ খোলা নেই।
পাকিস্তানের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা এই ডিজেল পাচারের পথ বন্ধ করার জন্য একদিকে যেমন আইনের কঠোর প্রয়োগের পথ বেছে নিয়েছেন, অপরদিকে অঞ্চলটিতে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের পথও সুগম করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকার ফলে তাদের প্রচেষ্টা হুমকির মধ্যে পড়ে গিয়েছে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের ওয়াশুক জেলার মেশখেল শহরের একজন সাংবাদিক হলেন নাসির কুবদানি। তার মতে, তার জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষই চোরাচালানের সাথে জড়িত। এমনকি যদি সেখানে চোরাচালান রোধের আইন শক্তভাবে প্রয়োগ করা হলেও চোরাচালান কমার সম্ভাবনা কম। কারণ এই জেলার মানুষের হাতে অন্য কোনো পথ নেই। সুতরাং আইন দিয়ে তাদের আটকে রাখা সম্ভব নয়।
ডিজেল চোরাচালানের শুরুটা হয় জ্বালানির ডিপো থেকে। ইরানি পাচারকারীরা শত শত লিটার ডিজেল প্লাস্টিকের ট্যাংকে ভরে নিয়ে সেই ট্যাংকগুলো ট্রাক কিংবা ছোট মালবাহী গাড়িতে ওঠান। এরপর পাহাড়ি উঁচুনিচু, আঁকাবাঁকা রাস্তার উপর দিয় তারা দ্রুত (অনেক সময় একশো কিলোমিটার বেগে) সীমান্তবর্তী এলাকায় চলে আসেন। গাড়িগুলোর নম্বরপ্লেট কখনও কার্ডবোর্ড দিয়ে, কখনও কাদা দিয়ে ঢাকা থাকে। সীমান্তবর্তী এলাকায় এরপর ট্রাক কিংবা মালবাহী গাড়ি থেকে ডিজেল নামিয়ে এরপর গাধার পিঠে চড়ানো হয়। সেই গাধার পিঠে করেই দুই দেশের সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাকিস্তানে ডিজেল নিয়ে আসা হয়। এই পাচারকৃত ডিজেলগুলো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের পেট্রোল পাম্পগুলোতে সরবরাহ করা হয়। সীমান্ত পার হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় সীমান্তরক্ষীদের ফাঁকি দেয়া হয়, আবার অনেক সময় ঘুষ প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে নিয়ম লঙ্ঘনের জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে প্রায়ই অনেক পাচারকারী মারাও যান। অর্থাৎ ডিজেল পাচারকারীদের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই পাচারকাজে অংশ নিতে হয়।
বেলুচিস্তান প্রদেশে যদি স্থানীয় মানুষের বৈধ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না হয়, তাহলে আইন দিয়ে ডিজেল পাচার ঠেকানো সম্ভব হবে না। ইরানের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে দেশটিতে ডিজেলের দাম আরও কমে যাওয়ায় ইরানি পাচারকারীরাও আরও বেশি আগ্রহী হয়েছে পাচারের ক্ষেত্রে। সুতরাং প্রকৃতিগত কিংবা আর্থসামাজিক কারণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবও রয়েছে। বেলুচিস্তান প্রদেশকে যদি পাকিস্তানের মূলধারার অর্থনীতির সাথে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ প্রদান করা না হয়, তাহলে পাচারের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধ সংঘটনের হারও অত্যধিক পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।