গত মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) নেদারল্যান্ডের হেগ শহরে অবস্থিত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) শুরু হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা অভিযোগের শুনানি। এই শুনানিতে অংশ নিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে উপস্থিত রয়েছে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত নিয়ে। প্রতিনিধি দলটিতে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের তিনজন প্রতিনিধিও রয়েছেন। আর এই শুনানির জন্য মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করছে যে দলটি, সেটির নেতৃত্বে রয়েছেন স্বয়ং অং সান সু চি।
তবে যে তথ্যটি হয়তো অনেকেরই অজানা তা হলো, আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলাটি করেছে গাম্বিয়া। আর যারা তথ্যটি জানেন, তাদের মধ্যেও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে: মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গা গণহত্যায় গাম্বিয়া ভুক্তভোগী না হওয়া, এবং তাদের সরাসরি কোনো সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও, কেন তারাই মামলাটি করেছে। এছাড়া আরো যে প্রশ্নগুলো হরহামেশাই উত্থাপিত হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে: এই মামলা আসলেই কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, মামলায় গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মূলত কী অভিযোগ এনেছে, আইসিজের পক্ষে বিচারকের দায়িত্বে কারা রয়েছেন, গণহত্যা বিষয়ক পূর্ববর্তী মামলাগুলোয় আইসিজে কী রায় দিয়েছিল ইত্যাদি।
আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া
শুরুতেই আমাদের জেনে নেয়া দরকার গাম্বিয়া সম্পর্কে। কৃষিপ্রধান দেশটির রাষ্ট্রীয় নাম গাম্বিয়া ইসলামী প্রজাতন্ত্র। নাম থেকেই বুঝতে পারছেন, মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ এটি। আয়তনে বাংলাদেশের ১২ ভাগের ১ ভাগ দেশটি, এবং মোট জনসংখ্যা মাত্র ১৯ লক্ষ, যার শতকরা ৯৫ ভাগই সুন্নি মুসলমান। পশ্চিম আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম দেশ এটি, যার উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক সেনেগাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং পশ্চিমে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগর। সেরেকুন্দা দেশটির বৃহত্তম শহর হলেও, এর রাজধানী হলো বন্দর নগরী বাঞ্জুল।
উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হওয়া গাম্বিয়া ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৮২ সালে সেনেগালের সাথে একত্র হয়ে তারা ‘সেনেগাম্বিয়া’ নামের একটি কনফেডারেশন তৈরি করে। তবে ১৯৮৯ সালে কনফেডারেশনটি ভেঙে যায়, এবং ১৯৯৪ সালে একটি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন লেফটেন্যান্ট ইয়াহিয়া জামেহ্। পরবর্তী ২২ বছর তিনি দেশটির ক্ষমতা দখল করে রাখেন, এবং একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। অবশেষে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাকে পরাজিত করে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন আদামা বারো।
যে কারণে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে গাম্বিয়া
তাতমাদাও নামে পরিচিত মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর নৃশংস অভিযানের মাধ্যমে ব্যাপক খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ চালায়। তাতমাদাও-এর এই নৃশংসতা চরমে পৌঁছায় ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে, যখন তারা রোহিঙ্গাদের উপর পুরোদমে জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করতে শুরু করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ী, এই অভিযানের ফলে ৭ লক্ষ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের উপর চালানো এই বর্বরোচিত হামলা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে বিশ্ব গণমাধ্যম, জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে, অর্গানাইজেশন অভ ইসলামিক কোঅপারেশন (ওআইসি)-র ৫৭টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে, আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে গাম্বিয়া। সেখানে তারা অভিযোগ করে, নৃশংস সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার।
এর আগে ২০১৯ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সৌদি আরবের মক্কায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওআইসির ১৪তম সম্মেলন, যেখানে রোহিঙ্গা সংকটকে আইসিজেতে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর দায়িত্ব দেয়া হয় ওআইসির অ্যাড হক মিনিস্ট্রিয়াল কমিটিকে। সেই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছে ১৯৭৮ সালে জাতিসংঘ গণহত্যা সনদে স্বাক্ষর করা গাম্বিয়া। মিয়ানমারও ১৯৫৬ সালে স্বাক্ষর করে এ সনদে, যার ৯ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো কেবল গণহত্যা থেকে বিরতই থাকবে না, বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য বিচার করতেও বাধ্য থাকবে।
গাম্বিয়াই হলো ইতিহাসের প্রথম দেশ যারা কথিত অপরাধে সরাসরি সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও গণহত্যা সনদে তাদের সদস্যপদকে কাজে লাগিয়ে আইসিজের কাছে একটি মামলা দায়ের করেছে। অতি সম্প্রতিই গাম্বিয়া ইয়াহিয়া জামেহর ২২ বছরের দমনমূলক শাসন থেকে উদ্ধার পেয়েছে, এবং তাদের নিজেদেরও রয়েছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের করুণ ইতিহাস। এ কারণেই আইসিজের কাছে তাদের মামলা দায়েরের বিষয়টি আরো তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে নো পিস উইদাউট জাস্টিস নামক সংস্থার অন্যতম পরিচালক এ্যালিসন স্মিথ বলেন,
“গাম্বিয়া এমন একটি দেশ যারা কিছুকাল আগেই একনায়কতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে। এমন একটি দেশ যে রোহিঙ্গা গণহত্যার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছে তা সাধুবাদ পাবার যোগ্য, এবং অন্য দেশগুলোর উচিত এ দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা।”
মামলা দায়েরের পর গাম্বিয়ার বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আবুবাকর তামবাদু বলেছিলেন, “মিয়ানমার তাদের নিজেদের জনগণ, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অভিযান পরিচালনা করেছে, সেটির জন্য তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা আমাদের লক্ষ্য।” এছাড়া সম্প্রতি তিনি আরো বলেন, “সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমারকে এই নির্মম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে। তাদেরকে এই বর্বরতা ও হিংস্রতা বন্ধ করতে হবে, যা আমাদের সবার বিবেককে ব্যথিত ও ব্যথাহত করে যাচ্ছে। দেশটিকে নিজের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।”
যে কারণে মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ
একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, গাম্বিয়া আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে মামলাটি করেছে, সেটি প্রচলিত ফৌজদারি মামলা নয়। ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের একটি মূল অংশে পরিণত হয়েছে। কোনো রাষ্ট্র যদি মনে করে যে অপর একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন মান্য করছে না, তখন তারা আইসিজের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার রাখে। ঠিক সেই অধিকারটিকেই কাজে লাগিয়েছে গাম্বিয়া।
যদিও এ মামলাটির একটি চূড়ান্ত রায়ে উপনীত হতে বেশ কয়েক বছর লেগে যেতে পারে, গাম্বিয়া আদালয়ের কাছে কিছু অস্থায়ী পদক্ষেপ আদেশের অনুরোধ জানিয়েছে যেন “গণহত্যা সনদ অনুযায়ী রোহিঙ্গা গোষ্ঠী এবং গাম্বিয়ার মানুষদের অধিকার রক্ষা করা যায়, এবং নতুন করে কোনো বিবাদ সৃষ্টির মাধ্যমে আদালতের চূড়ান্ত রায় ঘোষণাকে পিছিয়ে দেয়া না হয়।” ১০-১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত নেদারল্যান্ডের হেগে এই অস্থায়ী পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারেই শুনানি চলছে।
আদালতের কাছে গাম্বিয়া “অতিশয় জরুরি প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে” যে অস্থায়ী পদক্ষেপগুলোর আদেশে প্রদানের আবেদন জানিয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- মিয়ানমারকে এখনই সব ধরনের গণহত্যা কর্মকাণ্ড রোধের ব্যবস্থা নিতে হবে;
- মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন তাদের সামরিক বাহিনী কোনো ধরনের গণহত্যা কর্মকাণ্ড পরিচালনা না করে;
- মিয়ানমার এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের কোনো ধাপে বাধা দিতে কিংবা অস্বীকৃতি জানাতে পারবে না।
এই অস্থায়ী পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে আদেশ খুব দ্রুতই প্রদান করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা ২০ মার্চ, ১৯৯৩ সালে গণহত্যা সনদের ভিত্তিতে যুগোস্লাভিয়া প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলে, আইসিজে মাত্র কয়েক সপ্তাহ পরই, ৮ এপ্রিল আদেশ প্রদান করেছিল।
আদালতের কাছে আরো যে আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া
অস্থায়ী আদেশের আবেদন ছাড়াও গাম্বিয়া আইসিজের কাছে আবেদন করেছে যেন তারা ঘোষণা দেয় যে মিয়ানমার গণহত্যা সনদের অধীনে তাদের করণীয়গুলো লঙ্ঘন করেছে, এবং এখনো করে যাচ্ছে, যা তাদেরকে অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এছাড়া মিয়ানমারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন গণহত্যার সাথে যুক্ত অপরাধীদেরকে, এমনকি সেনাপ্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদেরও, একটি উপযুক্ত ট্রাইবুনালের সামনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়, এবং অবশ্যই গণহত্যার ফলে ভুক্তভোগী রোহিঙ্গাদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে “যেসকল রোহিঙ্গা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে তাদের নিরাপদ ও সম্মানিত প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা” এবং “তাদেরকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান, তাদের যাবতীয় মানবাধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা, যেকোনো বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন থেকে থেকে মুক্ত করা”। এছাড়া গাম্বিয়া মিয়ানমারের কাছ থেকে আরো নিশ্চয়তা চেয়েছে যেন গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের মতো কোনো কার্যকলাপের পুনরাবৃত্তি না হয়।
জাতিসংঘ সনদের ৯৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সকল সদস্য রাষ্ট্রকে আইসিজের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে, এবং যদি তারা তা না করে, সেক্ষেত্রে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে “রায় কার্যকরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।”
আইসিজের সামনে হাজির না হওয়ার সুযোগ ছিল মিয়ানমারের
মিয়ানমার একটি সার্বভৌম দেশ। তাই তারা বাধ্য নয় আইসিজের সামনে হাজির হতে। আইসিজের কোনো ক্ষমতাও নেই মিয়ানমারকে বাধ্য করতে। তারপরও মিয়ানমারের অনানুষ্ঠানিক প্রধান অং সান সু চি, দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে, “মিয়ানমারের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায়” উপস্থিত হয়েছেন হেগে। এক্ষেত্রে তিনি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আইসিজের সংবিধিকে সম্মানের কথা উল্লেখ করেছেন, যাতে তিনি তার রাজনৈতিক দল, ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি, এবং মিয়ানমার সংসদেরও সমর্থন পেয়েছেন। তাছাড়া দেশটির সামরিক বাহিনী জানিয়েছে তারা “সরকারকে সবধরনের সাহায্য করবে” এবং সকল নির্দেশনাও অনুসরণ করবে।
আইসিজেতে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদানের সিদ্ধান্তে অং সান সু চি নিজ দেশে নিরঙ্কুশ জনসমর্থনও পেয়েছেন। অবশ্য একই সাথে এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না, মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ এখন কোনোভাবেই সু চি বা তার সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনার অবস্থায় নেই। যদি কেউ তা করে, তাহলে তার বিপদে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিয়মিতই সরকার, সামরিক বাহিনী কিংবা সু চি’র বিরুদ্ধে লেখা বা কথা বলা ব্যক্তিদেরকে গ্রেপ্তার ও সাজা প্রদান করছে।
এরপরও দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা আইসিজের বিচার প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে তারা এ-ও বলেছে যে রোহিঙ্গাদের উপর তাতমাদাও-এর নৃশংস অভিযানের সাথে অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়নের সাদৃশ্য রয়েছে।
যেভাবে আইসিজে অস্থায়ী আদেশ জারি করতে পারে
আইসিজের অস্থায়ী সিদ্ধান্তের আদেশগুলো জড়িত পক্ষগুলো অনুসরণ করতে বাধ্য। যেহেতু মিয়ানমার সরকার সরাসরি আইসিজের কর্তৃত্বকে স্বীকার করেই নিয়েছে, তাই বলা যেতে পারে যে আইসিজের আদেশগুলো মেনে চলার ব্যাপারেও এখন পর্যন্ত তারা রাজি। এদিকে গাম্বিয়া আদালতের কাছে আরো আবেদন জানিয়েছে যেন আদালত মিয়ানমার ও গাম্বিয়া উভয় দেশকেই বাধ্য করে অস্থায়ী আদেশ ইস্যুকরণের “চার মাসের মধ্যে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে।”
এছাড়া জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থাগুলোও চাইলে এগিয়ে আসতে পারে, নিজস্ব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, এমনকি রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধিরও চেষ্টা করতে পারে, যদি মিয়ানমার সরকার অস্থায়ী আদেশ মেনে চলতে ব্যর্থ হয়।
আইসিজে সংবিধির ৪১(২) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আদালয়ের অস্থায়ী পদক্ষেপের আদেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাঠিয়ে দেয়া হয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে। এমন একটি আদেশ নিরাপত্তা পরিষদের উপরও চাপ বৃদ্ধি করবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। যেমন নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের উদ্দেশ্যে একটি সমাধান পাশ করতে পারে যেন রোহিঙ্গাদের চলাচলের উপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়, রাখাইন রাজ্যে দাতব্য ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর প্রবেশে অপ্রয়োজনীয় বিধিনিষেধ তুলে নেয়া হয়, বৈষম্যমূলক আইনগুলো রদ করা হয়, এবং রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকা উপার্জন প্রভৃতি লাভের সুযোগ নিয়ন্ত্রণের অনুশীলন নিষিদ্ধ করা হয়। এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের নেতৃত্বের প্রতি চীনের সমর্থন এবং তাদের ভেটো ক্ষমতার কারণে নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদও মিয়ানমারের উপর চাপ প্রয়োগের অংশ হিসেবে প্রস্তাব পাশ করতে পারে যেন দেশটির সরকার আইসিজের আদেশগুলো মেনে নেয়।
আইসিজের বিচারক যারা
আইসিজের ১৫ সদস্যের বেঞ্চে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারক, যারা বিশ্বের প্রধান আইনি ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করছে। আইসিজের বিচারকরা পুরোপুরি স্বাধীনভাবে কাজ করে থাকেন, এবং দায়িত্ব গ্রহণের প্রাক্কালে তারা উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণা দেন যে তারা তাদের “ক্ষমতার চর্চা করবেন নিরপেক্ষভাবে, বিবেকবোধ দ্বারা চালিত হয়ে।” প্রত্যেক বিচারক নির্বাচিত হন নয় বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করতে।
এই আদালতের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হলেন সোমালিয়ার বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমেদ ইউসুফ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট চীনের বিচারপতি ঝু হানকিন। বিচারকদের নির্বাচন করেন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদ। অন্য সদস্যরা হলেন স্লোভাকিয়ার বিচারপতি পিটার টমকা, ফ্রান্সের বিচারপতি রনি আব্রাহাম, মরক্কোর মোহাম্মদ বেনুনা, ব্রাজিলের অ্যান্টোনিও অগাস্টো কানকাডো ত্রিনাদে, যুক্তরাষ্ট্রের জোয়ান ই ডনোহু, ইতালির গর্জিও গাজা, উগান্ডার জুলিয়া সেবুটিন্দে, ভারতের দলভির ভান্ডারি, জ্যামাইকার প্যাট্রিক লিপটন রবিনসন, অস্ট্রেলিয়ার রির্চাড ক্রর্ফোড, রাশিয়ার কিরিল গিভরগিয়ান, লেবাননের নওয়াফ সালাম এবং জাপানের ইউজি ইওয়াসাওয়া।
আইসিজে সংবিধির ৩১ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইসিজেতে উত্থিত একটি মামলার উভয় পক্ষই একজন করে অ্যাড হক বিচারক নিয়োগের অধিকার রাখে, যদি বিচারকদের বেঞ্চে ইতোমধ্যেই তাদের দেশের কেউ না থাকেন।
গাম্বিয়া আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ড. নাভানেথেম (নাভি) পিল্লাইকে তাদের অ্যাড হক বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের। পিল্লাই ইতঃপূর্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রুয়ান্ডার পক্ষে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ২০০৮ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকারের হাই কমিশনার হিসেবে।
মিয়ানমার আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন জার্মান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ক্লাউস ক্রেসকে তাদের অ্যাড হক বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদানের। ক্রেস জার্মানির ইউনিভার্সিটি অভ কলনের অন্তর্ভুক্ত আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা আইন ইনস্টিটিউটের পরিচালক।
আইসিজেতে ইতঃপূর্বের গণহত্যার রায়
২০০৭ সালে আইসিজে রায় দিয়েছিল যে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যা হয়েছিল, এবং সার্বিয়া গণহত্যা প্রতিরোধে তাদের যে দায়িত্ব তা লঙ্ঘন করেছিল। এছাড়া আদালতটি আরো রায় দিয়েছিল যে বসনিয়ান সার্ব জেনারেল রাতকো ম্লাদিচকে (স্রেব্রেনিৎসায় গণহত্যার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাছে সমর্পণে ব্যর্থতার মাধ্যমেও সার্বিয়া গণহত্যার সাথে জড়িতদের শাস্তি প্রদানে তাদের যে দায়িত্ব তা লঙ্ঘন করেছিল। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালে সার্ভিয়া যুগোস্লাভ ট্রাইব্যুনালের কাছে ম্লাদিচকে সমর্পণ করে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে।
বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/
রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ
১) রোহিঙ্গা গণহত্যা ইস্যু
২) রোহিঙ্গা গণহত্যা : বিশ্ব নেতাদের ভাবনা
৩) রোহিঙ্গা গণহত্যা কাঠগড়ায় সু চি