Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমানে রেকর্ডবৃদ্ধি: সমাধানের পথ কী?  

পৃথিবীতে মাত্রাতিরিক্ত কোনোকিছুই শুভ ফল বয়ে আনে না। হোক তা প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিম। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে বন্যার সমস্যা, বৃষ্টি না হলে খরা, জনসংখ্যা দ্রুত বাড়লে সমস্যা, আবার দ্রুত কমতে থাকলেও বিপদ, প্রয়োজনের অধিক উৎপাদন করলে বাজার অর্থনীতিতে পণ্যের দাম কমে যায়, আবার উৎপাদন কম হলেও দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। অর্থাৎ, সবকিছুই একটা সাম্যাবস্থায় থাকা চাই, তাহলে সেগুলো বাধাবিপত্তি ছাড়া চলতে পারবে।

একই ব্যাপার গ্রিনহাউজ গ্যাস কার্বন ডাইঅক্সাইডের জন্যও প্রযোজ্য। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকার জন্য যতটা অবদান অক্সিজেনের, ততটাই কার্বন ডাইঅক্সাইডের। এই গ্যাসটিই পৃথিবীর আবহাওয়া বসবাসযোগ্য রেখেছে। কিন্তু এটিও যখন সাম্যাবস্থায় থাকবে না, তখন ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সুদূর অতীতে ডেভোনিয়ান গণবিলুপ্তির কালে দ্রুত পৃথিবীতে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ কমে যাওয়ায় পৃথিবীর তাপমাত্রা অত্যধিক কমে গিয়েছিল, নিশ্চিহ্ন হয়েছিল অধিকাংশ প্রাণী। আর বর্তমানকালে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছেই, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পৃথিবীর তাপমাত্রাও। এবার তাহলে কোন দিকে এগোচ্ছে পৃথিবী?

বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস; Image Source: climatechronology.com

‘গ্রিনহাউজ ইফেক্ট’ বা গ্রিনহাউজ গ্যাস দ্বারা সৃষ্ট প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে মানুষের চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে উনিশ শতক থেকে। ১৮২৪ সালে ফরাসি গণিতবিদ জোসেফ ফুরিয়ার দাবি করেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা আরো অনেক কম হতো যদি এর কোনো বায়ুমণ্ডল না থাকতো। তার এই চাঞ্চল্যকর অনুমানের পরই বিজ্ঞানীরা ভাবতে শুরু করেন, বায়ুমণ্ডল কি আসলেই তাপ আটকে রাখতে সক্ষম? নানা দিকে নানাপ্রকার গবেষণা শুরু হয় তখন। অধিকাংশেরই ধারণা ছিল, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে বায়ুমণ্ডলের ভূমিকা থাকলেও বায়ুমণ্ডলের সকল গ্যাসের ভূমিকা নেই। এ সংক্রান্ত প্রথম সাফল্য আসে ফুরিয়ারের অনুমানের ৭২ বছর পর, সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াসের কল্যাণে। তিনি গবেষণা করে দেখান যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীর তাপমাত্রার বৃদ্ধি সম্পর্কিত। তিনি সিদ্ধান্ত দেন, জীবাশ্ম জ্বালানির অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের উপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। আর তখন থেকেই পৃথিবীর জন্য গ্রিনহাউজ গ্যাস আশীর্বাদ কম, হুমকি বেশি হয়ে গেল!

বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি; Image Source: e360.yale.edu

২০১৮’র শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ে অবস্থিত ‘মাওনা লোয়া’ অবজারভেটরিতে বায়ুমণ্ডলে ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাপ উঠে আসে। এই পরিমাণটি হলো ৪১১ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন)। আর ২০১৯ সালের মে মাসের হিসাব ৪১৫ পিপিএম। শুধু তা-ই নয়, মাওনা লোয়া থেকে আরো দুঃসংবাদ আছে। দীর্ঘদিন যাবত বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা এই মানমন্দিরটি জানিয়েছে যে, দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ। ১৯৮০’র দশকেও বছরে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের গড় বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১.৬ পিপিএম। অথচ একাধিক জলবায়ু চুক্তি আর অসংখ্য পরিবেশ বিষয়ক সংগঠনের তৎপরতার পরও গত ১০ বছরে ২.২ পিপিএম গড়ে বাড়ছে কার্বন ডাইঅক্সাইড! এবং যদি এই গ্যাসের বৃদ্ধি বর্তমান গতিতেই চলমান থাকে, তাহলে ২০৩৮ সালের মধ্যে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ৪৫০ পিপিএম ছাড়াবে!

অত্যন্ত সহজ সরল গ্রিনহাউজ প্রক্রিয়াটিই পৃথিবীর জন্য ভয়াবহ বিপত্তির কারণ। বায়ুমণ্ডলে একাধিক গ্রিনহাউজ গ্যাস থাকলেও কার্বন ডাইঅক্সাইডই পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। মূলত, স্বাভাবিক অবস্থায় সূর্যকিরণ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রায় প্রভাব ফেলে না বললেই চলে। সূর্যকিরণে পৃথিবী যতটা উত্তপ্ত হয়, রাতের বেলায় তাপ বিকিরণ করে আবার শীতল হয়ে যায়। কিন্তু বিকিরণে বাধা দেবার অসীম ক্ষমতা আছে গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর। এ গ্যাসগুলো তাপ শোষণ করতে পারে। ফলে পৃথিবী থেকে তাপের বড় একটা অংশ বিকিরিত হতে পারে না। এই তাপ গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো দ্বারা পৃথিবীতেই আটকে যায় আর পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়া চলছে শত শত বছর ধরে। আর এর ফলে প্রকৃতিতে যেসব জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে বড় প্রভাব ফেলছে।

প্রধান গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলো

বাতাসে গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ শিল্পায়ন; Image Source: bbc.com

কার্বন ডাইঅক্সাইড

গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি অবদান কার্বন ডাইঅক্সাইডের। বায়ুমণ্ডলে অপরাপর গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর তুলনায় এর পরিমাণও অনেক বেশি। তাছাড়া, মানুষ প্রতিদিন পৃথিবীতে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করছে, তার তিন-চতুর্থাংশই হলো কার্বন ডাইঅক্সাইড। যেকোনো জৈব পদার্থের দহন, কয়লা, তেল, গ্যাস, রাসায়নিক কারখানা ইত্যাদি থেকে প্রতিনিয়ত কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসৃত হচ্ছে। প্রাণীজগতের শ্বসন প্রক্রিয়ায়ও এ গ্যাস নিঃসৃত হয়, তথাপি তা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কার্বন ডাইঅক্সাইডের আরেকটি দিক হলো, এই গ্যাস বিশ্লিষ্ট হবার পূর্বে বায়ুমণ্ডলে ১২ বছর অবস্থান করতে পারে!

মিথেন

আমরা যে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করি, তার প্রধান উপাদান হলো মিথেন গ্যাস। এ গ্যাস নানা উপায়ে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, যেমন- প্রাকৃতিক উৎস থেকে, গ্যাসের খনি থেকে, রান্নাবান্নায়, পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকে কিংবা গবাদি পশুর বর্জ্য থেকে। এটি দীর্ঘদিন বায়ুমণ্ডলে থাকতে না পারলেও কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় প্রায় ৮৪ গুণ অধিক শক্তিশালী এবং তাপ শোষণক্ষম! কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরই নিঃসরণের দিক থেকে মিথেনের অবস্থান, যা মোট নিঃসরণের ১৬ ভাগ দখল করে আছে।

নাইট্রাস অক্সাইড

মোট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের মাত্র ৬ ভাগ দখল করে আছে নাইট্রাস অক্সাইড। তথাপি এটি হয়ে উঠেছে বায়ুমণ্ডলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির আরেক ত্রাস। কার্বন ডাইঅক্সাইডের তুলনায় ২৬৪ গুণ অধিক শক্তিশালী এ গ্যাস বায়ুমণ্ডলে অক্ষত টিকে থাকতে পারে শত বছর পর্যন্ত! জীবাশ্ম জ্বালানী ছাড়াও কৃষি, সার, গবাদি পশুর বর্জ্য থেকে প্রকৃতিতে নিঃসৃত হয় এই ক্ষতিকর গ্যাস।

শিল্পজাত গ্যাস

বেশকিছু ফ্লোরিনেটেড গ্যাস শিল্পজাত গ্যাসের আওতায় পড়ে, যেগুলো মোট গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের ২ শতাংশ বহন করে। ক্লোরোফ্লুরো কার্বন (সিএফসি), হাইড্রোফ্লুরো কার্বন, পারফ্লুরো কার্বন, সালফার হেক্সাফ্লুরাইড, নাইট্রোজেন ট্রাইফ্লুরাইডের মতো ফ্লোরিনেটেড গ্যাসগুলো পরিমাণে কম হলেও সবচেয়ে মারাত্মক। এই গ্যাসগুলো কার্বন ডাইঅক্সাইডের চেয়ে হাজার গুণ শক্তিশালী এবং বায়ুমণ্ডলে ঘুরে বেড়ায় কয়েকশত বছর! রেফ্রিজারেটর, এয়ারকুলার এবং বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য উৎপাদনের উপজাত হিসেবে এই গ্যাসগুলো প্রকৃতিতে নিঃসৃত হয়।

২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিঃসৃত গ্রিনহাউজ গ্যাসগুলোর অনুপাত; Image Source: pressrepublican.com

১৯০৬ সালের পর থেকে বায়ুমণ্ডলে এসব গ্যাসের উপস্থিতি ক্রমাগত বাড়তে থাকায় বাড়ছে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রাও। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্র বেড়েছে গড়ে ০.৯° সেলসিয়াসের বেশি। আর এতে করে পরিবেশ প্রকৃতির উপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বিশ্বজুড়ে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে জলবায়ুতে। সে পরিবর্তনের সাথে অভিযোজিত হতে না পেরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে প্রাণীজগতের অনেক প্রাণী। গ্রিনহাউজ গ্যাস বৃদ্ধির কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ পরিবেশের উপর এর সার্বিক প্রভাব একনজরে দেখে আসি চলুন।

  • তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে পৃথিবীর দুই মেরু সহ শীতল অঞ্চলগুলোতে দ্রুত গলে যাচ্ছে বরফ, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। এর ফলে বিশ্বের নিম্নাঞ্চলগুলো রয়েছে পানিতে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। সমুদ্রপৃষ্ঠের বরফ, পাহাড়ের হিমবাহ, পশ্চিম এন্টার্কটিকা ও গ্রিনল্যান্ড আর আর্কটিক সাগরের বরফ গলনের হার এত বেশি যে আর একশো বছর পর এখানকার সমস্ত বরফ গলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে যদি না পৃথিবীর তাপমাত্র বৃদ্ধি স্থবির না হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্কে ১৯১০ সালে বড় বড় পাহাড়ি হিমবাহের সংখ্যা ছিল ১৫০টি। বর্তমানে সংখ্যাটা নেমে এসেছে মাত্র ৩০টিতে! ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে ৩.২ মিলিমিটার করে।

    গলে যাচ্ছে শীতল অঞ্চলের বরফ; Image Source; safety4sea.com
  • তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে মেরু অঞ্চলের প্রাণীগুলো রয়েছে বিলুপ্তির পথে। এডেলি পেঙ্গুইন, মেরু ভাল্লুকসহ অসংখ্য মেরু অঞ্চলের প্রাণী প্রজাতির ৯০ শতাংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বরফ গলার বর্তমান হার অব্যহত থাকলে অবশিষ্টাংশ নিশ্চিহ্ন হতে বেশিদিন লাগবে না হয়তো।

  • পৃথিবীর কোনো অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি হচ্ছে, শহর-গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে বন্যায়, হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত তুষারপাত।অন্যদিকে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। এ সবই জলবায়ু পরিবর্তনের ফসল।

  • একদিকে প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংস হলেও অন্যদিকে বাড়ছে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ। জলবায়ু পরিবর্তনে পুরো বিশ্বজুড়েই বাড়ছে মশা, মাছি, জেলিফিশের উপদ্রব। যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েকবছরে ‘বার্কবিটল’ নামক একপ্রকার গুবরেপোকার সংখ্যা গুণিতক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ধ্বংস করেছে হাজারো একর বনাঞ্চল।

এদিকে, খুব দ্রুত সময়ের মাঝে যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনা না যায়, এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করা না যায়, তাহলে পৃথিবীতে বড় ধরনের বিপর্যয়ই ঘটতে চলেছে বলে সতর্ক করেছেন বিজ্ঞানীরা।

  • বরফ গলার বর্তমান হার অব্যহত থাকলে এই শতকের শেষে পৃথিবীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৮২ সেন্টিমিটার বা তারও বেশি বৃদ্ধি পেতে পারে!

    সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি অব্যহত থাকলে ডুবে যাবে পৃথিবীর অনেক নিম্নাঞ্চল; Image Source: whoi.edu
  • ঘূর্ণিঝড়-জ্বলোচ্ছাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আগামী শতকে হবে আরো প্রলয়ঙ্করী, আরো শক্তিশালী। খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যার মতো ব্যাপারগুলো ঘটবে ঘন ঘন। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যাধিক খরা বা ‘মেগাড্রাফট’ সংঘটিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রও তেমনই একটি অঞ্চল।

  • পৃথিবীর মোট সুপেয় পানির তিন-চতুর্থাংশই শীতল অঞ্চলগুলোর বরফে সংরক্ষিত। এগুলো গলে যাওয়া মানে সুপেয় পানির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া।

  • প্রাণীবৈচিত্র্যে ধ্বস নামবে, অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ২১ শতক শেষ হতে হতে অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকে রক্ষা পেতে বাস্তুসংস্থানগুলো মেরু অঞ্চলের দিকে অবস্থান্তর হবে। যেগুলো অবস্থান পরিবর্তনে ব্যর্থ হবে, সেগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন যে পৃথিবীকে এক দুঃস্বপ্নের দিকে ধাবিত করছে তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু এই দুঃস্বপ্নত রোধই বা হবে কি করে? কৃষি থেকে শুরু করে উৎপাদন ব্যবস্থা, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, এককথায় বিশ্ব অর্থনীতির চাকা সচল আছে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভর করে। ফলে অর্থনীতির প্রতিটা ধাপ থেকে নির্গত হচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস। পৃথিবীর মাত্র ২০টি দেশই মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ৮০ শতাংশ নির্গত করে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র আর ভারত এক্ষেত্রে উপরের তিনটি দেশ। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার একেবারেই কি বন্ধ করে দেয়া সম্ভব এসব দেশের পক্ষে? ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি ২০১৫’ এই অলীক সমাধানের দিকে না এগোলেও অন্তত গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ সহনশীল মাত্রায় নামিয়ে আনার কথা বলে। ‘ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসিসি এ শতকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি সর্বোচ্চ ২° সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।

প্যারিস চুক্তির ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যতে নামিয়ে আনার লক্ষ্য অবাস্তব বলে প্রমাণিত হয়েছে; Image Source: streykhmer.org

কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বড় বড় সব বৈশ্বিক চুক্তি হচ্ছে ঠিকই, বিশ্বনেতারা দিচ্ছেন মুখরোচক সব প্রতিশ্রুতিও, কিন্তু বরাবরই সেগুলো পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লরাই নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালনে গাফিলতি দেখাচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ২০১৫ সালের তুলনায় অন্তত ২৫ শতাংশ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু সেই লক্ষ্য এখন অসম্ভবই ঠেকছে। তাছাড়া, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় অর্থনীতির দেশগুলোর যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়ার কথা ছিল, তারা সেই অর্থও দিচ্ছে না।

জলবিদ্যুৎ আর বায়ুকলের দিকে ঝুঁকতে হবে; Image Source: streykhmer.org

গ্রিনহাউজ গ্যাসের ক্রমাগত বাড়তে থাকার ব্যাপারটি অনিবার্য নয়। অবশ্যই এটি সমাধানযোগ্য একটি সমস্যা। সদিচ্ছা, সচেতনতা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পরিবেশ নিয়ে ভাবনা, প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন হওয়া, এসব ব্যাপার গ্রিনহাউজ গ্যাসের প্রভাব কমিয়ে আনার প্রাথমিক নিয়ামক। উদাহরণস্বরূপ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার কাজ মানুষকে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে বায়ুকল কিংবা সৌরশক্তির দিকে অগ্রসর হবার তাগিদটাও বৈশ্বিক নয়, জাতীয়ভাবে আসতে হবে, বনাঞ্চল রক্ষা করতে হবে, কার্বন নিঃসরণের উপর বড় বড় শিল্পকারখানায় মাত্রা আরোপ করার পাশাপাশি মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, কৃত্রিম সার উৎপাদন ও ব্যবহার দুটোই বর্জন করে জৈব বর্জ্যের দ্বারা সার তৈরি ও ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি, সবুজায়নের দিকে এগোতে হবে। তাই, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে কেবল বিশ্বনেতাদের দোষারোপ করলেই হবে না, প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিগত পর্যায়েই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অংশ নিতে পারে।

এছাড়া বিজ্ঞানীরাও প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে চলেছেন অবস্থার উন্নতি করার জন্য। তরল হাইড্রোজেন উৎপাদনের টেকসই ব্যবস্থা তৈরিতে তারা নিরলসভাবে গবেষণা করে চলেছেন। পরিবহন ব্যবস্থায় হাইড্রোজেনের ব্যবহার কার্বন নিঃসরণ রাতারাতি কমিয়ে আনতে পারে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্লান্টগুলো থেকে নিঃসৃত কার্বন ধরে রাখা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সরবরাহে স্মার্ট গ্রিডের ব্যবহার, জলবিদ্যুৎ, বায়ুকলের ব্যবহার, এমনকি নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা থাকার পরও অনেকে পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানোর কথাও বলে থাকেন।

পৃথিবীর সবুজায়নই গ্রিনহাউজ সমস্যার মূল সমাধান; Image Source: irico.com.cn

এদিকে বাতাস থেকে কার্বন শুষে নেয়া, বাতাসে সূর্যালোক প্রতিফলিত করে পৃথিবী থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয় এরূপ স্প্রে করা কিংবা দৈত্যাকার কাচ তৈরি করে সূর্যালোক পৃথিবীর বাইরে প্রতিফলিত করে দেয়ার মতো অদ্ভুত ভাবনাও ভাবা হয়েছে। তথাপি সেগুলো ভালোর চেয়ে মন্দ ফল বয়ে আনার সম্ভাবনা থাকায় আর সামনে এগোয়নি। অথচ বিশ্বজুড়ে সবুজায়ন, সামুদ্রিক প্রবাল প্রাচীরগুলো ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এই অদ্ভুত ব্যাপারগুলোর চেয়ে অনেক সহজ সমাধান। পরিবেশ দূষণ নিয়ে পরিবেশবাদীরা উচ্চকণ্ঠ গত শতকের মাঝামাঝি থেকেই। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির দুর্দান্ত গতির বাহনের উৎকট আওয়াজে তাদের গলার স্বর বরাবরই মিইয়ে গেছে। তবে এখন পৃথিবী যে মুমূর্ষু অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, এখন আর পরিবেশবাদী কিংবা পরিবেশের আর্ত চিৎকার উপেক্ষা করবার উপায় নেই। এখন অর্থনীতির গাড়ির প্রবল হর্নের মাঝেও কান পেতে শুনতে হবে রুগ্ন ধরণীর চিৎকার আর বাঁচার আকুতি।

Language: Bangla
Topic: Greenhouse gas and effect
Reference: Hyperlinked inside the article

Featured Image: activesustainability.com

Related Articles