শহরজুড়ে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ, আকাশছোঁয়া অট্টালিকা, সুদৃশ্য সবুজ পার্ক, সুউচ্চ মসজিদের মিনার, রাস্তার ধারে অসংখ্য সারি সারি রঙিন খাবারের দোকান। পর্যটকদের জন্য এই শহর তার সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসে আছে। এজন্য সারা বছরই বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী এবং সংস্কৃতির পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সৌন্দর্য যেন ঠিকরে পড়ছে শহরের প্রতিটি কোণায়।
বলা হচ্ছিল মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের কথা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই শহরটি সারা বছরই যেন উৎসব উপলক্ষে সাজানো থাকে। এখানে পুরাতন ঐতিহ্যের পাশাপাশি রয়েছে আধুনিকতার ছোঁয়া। নান্দনিক ডিজাইনের সব ভবন আর প্রশস্ত রাস্তাগুলোতে সন্ধ্যা নামলেই পিঁপড়ের স্রোতের মতো আলো জ্বালিয়ে ছুটে চলে গাড়িগুলো। সব সময়ই যেন খুব কর্মব্যস্ত, একটুও দম ফেলার ফুসরত নেই। তারপরও এই শহরের সৌন্দর্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে ভ্রমণ পিপাসুরা বেশ আগ্রহী। চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের এই শহর সম্পর্কেই।
দক্ষিণ চীন সাগরের তীরে গড়ে ওঠা ২৪৩ বর্গ কিলোমিটারের এই অসাধারণ শহরটি মালয়েশিয়ার রাজধানী এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক দিয়ে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে একটি।
কুয়ালালামপুর মালয়েশিয়ার সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং রাজনীতির প্রধান কেন্দ্র। এখানেই অবস্থিত মালয়েশিয়ার জাতীয় সংসদ এবং মালয়েশিয়ার রাজার আবাসস্থল। একসময় ফেডারেল সরকারের নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় শাখার সদর দপ্তর ছিল শহরটিতে। ১৯৯৯ সালে কিছু কিছু রাজনৈতিক কার্যক্রম পুত্রজায়াতে স্থানান্তর করা হলেও এখনও এই শহরকেই প্রধান রাজনৈতিক কেন্দ্র বলে মনে করা হয়।
মালয়েশিয়ার তিনটি ফেডারেল অঞ্চলের মধ্যে কুয়ালালামপুর একটি, যা সেলেঙ্গর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৯৮ সালে কমনওয়েলথ গেমস এবং ২০১৭ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান গেমসসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সাক্ষী হয়ে রয়েছে এই শহরটি।
শপিংয়ের জন্য কুয়ালালামপুর বরাবরই বিখ্যাত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দশটি শপিংমলের মধ্যে তিনটিই রয়েছে চমৎকার এই শহরে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সিঙ্গাপুরের পরেই কুয়ালালামপুরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং আধুনিক শহর বলে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া ইআইইউ এর ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী শান্তি ও নিরাপত্তা বিবেচনায় বিশ্বের ৬০০টি শহরের মধ্যে কুয়ালালামপুরের অবস্থান ৩১তম। এমনকি সাংহাই এবং বেইজিংয়ের চেয়েও নিরাপদ এই শহর।
কুয়ালালামপুর আধুনিক শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৯ সালের দিকে। ১৮৫৭ সালে যখন ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল, ঠিক তখন কুয়ালালামপুর ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের অধীনে। সেসময় কিছু চীনা ভাগ্যান্বেষীর দল ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন সাগরপাড়ের এই অঞ্চলে। তখন এই অঞ্চল ছিল সম্পূর্ণ বনজঙ্গলে ঘেরা। তেমন জনবসতি ছিল না। চীনা ভাগ্যান্বেষী দলটি ব্রিটিশদের অনুমতি সাপেক্ষ বন-জঙ্গল কেটে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন শুরু করে।
এরপর জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। এক গ্রাম থেকে শহরে পরিণত হয় কুয়ালালামপুর। চীনাদের স্থাপিত সেই বসতি কুলালামপুরে এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে এ অঞ্চলটি চায়না টাউন নামে পরিচিত। অবশ্য আজকে রঙিন ও ঝলমলে আলোয় এই শহরকে দেখলে মনেই হবে না যে এখানে একদিন জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম ছিল। দ্রুত বর্ধনশীল এই শহরের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৮০ লক্ষ।
পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার মালয়েশিয়ার সবচেয়ে গর্বের স্থাপনা। বিশ্বব্যাপী পর্যটকদেরও এই ল্যান্ডমার্কের প্রতি বেশ দুর্বলতা রয়েছে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বহুতল এই ভবনটি ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। ১৯৯৬ সালে নির্মিত এই ভবনটির তৎকালীন নির্মাণব্যয় ছিল ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর সর্বোচ্চ উচ্চতা ১,৪৮৩ ফুট বা ৪৫২ মিটার। বেজমেন্টসহ ৯৩ তলাবিশিষ্ট এই ভবনের ফ্লোরের আয়তন ৪২,৫২,০০০ বর্গ ফুট। মার্কিন বিমান নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান বোয়িং, কাতারভিত্তিক সংবাদ সংস্থা আল-জাজিরা, মাইক্রোসফট, রয়টার্স এবং ক্রওলার নেটওয়ার্কসহ বিশ্ববিখ্যাত বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে এই ভবনেই।
দক্ষিণ চীন সাগরপাড়ের অসাধারণ এই শহরটিতে রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইসলামিক আর্টস মিউজিয়াম। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এই মিউজিয়ামটি মালয়েশিয়ার জাতীয় মসজিদের ঠিক পাশেই। ১৯৯৮ সালে এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এর পর থেকে একে ঘিরে বিশ্বব্যাপী পর্যটকদের যেন কৌতূহলের শেষ নেই।
মিউজিয়ামের ১২টি প্রদর্শন কক্ষে প্রায় ৭ হাজার স্মারক ও নিদর্শন রয়েছে। এখানে রয়েছে চীনা এবং মালয় মুসলমানদের বিভিন্ন ইসলামিক নিদর্শন। এছাড়া এর কমপ্লেক্সে রয়েছে গবেষণা কেন্দ্র, বিক্রয় কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট, আলোচনা কক্ষ, শিশু ও গবেষকদের জন্য পৃথক পাঠাগার। ৩০ হাজার বর্গ ফুটের বিশাল এই ভবনের তৃতীয় এবং চতুর্থ তলাকে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মালয়েশিয়ার এই মিউজিয়ামটি এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে সুন্দর এবং আকর্ষণীয় মিউজিয়াম বলে বিবেচিত। আমেরিকান অনলাইন ট্রাভেলভিত্তিক সংস্থা ট্রিপ অ্যাডভাইজারের জরিপে পর পর দু’বছর (২০১৪ এবং ২০১৫ সালে) এশিয়ার সেরা ১০ মিউজিয়ামের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে এই স্থাপনাটি।
কুয়ালালামপুর টাওয়ার সারাবিশ্বে কুয়ালালামপুরের প্রতিনিধিত্ব করে। অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন এই টাওয়ারটি শহরটির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলেও কুয়ালালামপুর টাওয়ার সরকারিভাবে এ শহরের প্রধান কেন্দ্র। ৪২০ মিটার উচ্চতাসম্পন্ন এই টাওয়ারটি মূলত একটি যোগাযোগ টাওয়ার, যা ১৯৯৫ সালে স্থাপিত হয়। এর চূড়ায় রয়েছে একটি রেস্টুরেন্ট এবং ওঠার জন্য রয়েছে একটি লিফট। ভাবুন তো, ৪২০ মিটার উচ্চতায় বসে আপনি ডিনার করছেন আর পাখির চোখে দেখছেন ঝলমলে রঙিন আলোয় চমৎকার এই শহরটি!
শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পর্যটনের আরেক আকর্ষণ বাতু কেভ। এটি সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রার্থনা কেন্দ্র। মূলত তীর্থস্থান হলেও এটি সৌন্দর্য এবং ইতিহাসের সংমিশ্রণে একটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। তীর্থস্থানে প্রার্থনাকারীদের তুলনায় বর্তমানে এখানে পর্যটকদের আনাগোনাই বেশি চোখে পড়ে।
কুয়ালালামপুরের মুসলিম স্থাপত্যগুলো পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণস্থল। এর মধ্যে রয়েছে ১৫,০০০ মুসল্লী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় মসজিদ। ১৯৬৫ সালে নির্মিত এই মসজিদটি বর্তমানে শুধুমাত্র মসজিদ বা মুসলমানদের ধর্মশালার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, পর্যটকদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় স্থাপনা হিসেবেও। এর মিনারটি প্রায় ৭৩ মিটার উঁচু। সকল ধর্মের মানুষ এখানে প্রবেশ করে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে।
এছাড়াও কুয়ালালামপুরে রয়েছে লেক গার্ডেন। ১৭৩ হেক্টরের বিশাল এই জায়গা ব্যস্ততম শহরের মধ্যে যেন এক টুকরো সবুজের সমারোহ। শান্ত, শীতল ও স্নিগ্ধ পরিবেশে বসে পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার দেখার অনুভূতি আপনি ভুলতে পারবেন না। মালয়েশিয়ার অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে জানতে হলে আপনাকে যেতে হবে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে। এটি শহরের ঠিক কেন্দ্রে অবস্থিত।
বুকিত বিন্টাং অঞ্চলটি কুয়ালালামপুরের পর্যটনের মূল কেন্দ্র বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে রয়েছে পর্যটকদের থাকা-খাওয়া এবং বিনোদনের সব রকম ব্যবস্থা। আধুনিক মানের সব হোটেল, বিলাসবহুল শপিংমল, স্ট্রিট শপ, রেস্টুরেন্ট, স্ট্রিট ফুড কর্ণার, গেমিং জোন সবই রয়েছে এ অঞ্চলে। এজন্য কুয়ালালামপুরে থাকার জন্য পর্যটকরা এই অঞ্চলকেই বেছে নেয়। সব মিলিয়ে কুয়ালালামপুর ভ্রমণ আপনাকে অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেবে- এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।