মার্কিন প্রেসিডেন্টরা হোয়াইট হাউজের বাইরে আসলে তাদের পেছনে দেখা যাবে এক সামরিক কর্মকর্তাকে, যিনি একটি ‘ব্রিফকেস’ নিয়ে হাঁটছেন। সাধারণত এটা কালো রঙের হয়ে থাকে। এই ব্রিফকেসই ‘নিউক্লিয়ার ফুটবল’। ব্রিফকেসটি সব সময় বন্ধ করা থাকে। প্রেসিডেন্টরা কোনো পারমাণবিক বোমা হামলার প্রয়োজন মনে হলেই কেবল ব্যাগটি খুলতে পারেন।
তাহলে এই ব্যাগে কি কোনো ফুটবল আছে? ‘নিউক্লিয়ার’ শব্দটি দেখে মনে হতে পারে ব্যাগে ফুটবল আকৃতির কোনো পারমাণবিক বোমা রাখা আছে। বাস্তবে প্রেসিডেন্টরা এরকম পারমাণবিক বোমা সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ান না। তবে এর মাধ্যমে তারা পারমাণবিক বোমা হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। বর্তমানে ভাইস প্রেসিডেন্টরাও বিকল্প নিউক্লিয়ার ফুটবল সাথে রাখেন। কিন্তু আক্রমণের নির্দেশ কেবল প্রেসিডেন্ট একাই দিতে পারেন। তাই তিনি হোয়াইট হাউজ থেকে বের হলেও সার্বক্ষণিক তার সঙ্গী হয়ে থাকে এটা।
এই ব্রিফকেসকে দাপ্তরিকভাবে বলা হয় ‘প্রেসিডেন্টের জরুরি থলে’। তবে এটা নিউক্লিয়ার ফুটবল বা শুধু ফুটবল নামেই বেশি জনপ্রিয়। প্রেসিডেন্টরা শপথ নেওয়ার পর থেকেই পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টদের কাছ থেকে এই ফুটবলটি গ্রহণ করে নেন।
এটি থাকার কারণ দুটি। এটা দিয়ে পারমাণবিক বোমা হামলার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের বস্তুগত নিদর্শন বোঝানো যায়। আরেকটি কারণ হচ্ছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে হঠাৎ কোনো দেশ পারমাণবিক হামলার পরিকল্পনা করে থাকলে ওই মুহূর্তে দ্রুত পাল্টা আক্রমণ করার মতো ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রেসিডেন্টের যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকে, তাহলে কাজটা সহজ হয়।
তবে সম্প্রতি ক্যাপিটল হিলে হামলা ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বিতর্কিত প্রেসিডেন্টের কারণে নিউক্লিয়ার ফুটবল নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে প্রেসিডেন্টদের এত ক্ষমতা নিয়ে।
কী আছে এই ফুটবলে?
একটা জনপ্রিয় ধারণা আছে প্রেসিডেন্টের কাছে একটা লাল বোতাম আছে, যেটাতে টিপ দিলেই আমেরিকার শত্রু দেশের ওপর পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরিত হবে। বাস্তবে বিষয়টা এত সরল নয়। প্রেসিডেন্টদের এই ফুটবলের বেশিরভাগ তথ্যই অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রক্ষা করা হয়। তাই সব তথ্য সাধারণ মানুষদের জানার সুযোগ নেই। তবে গত কয়েক দশকের সময়ের ব্যবধানে অনেক তথ্যই জানা সম্ভব হয়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আশঙ্কা ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার ওপর অতর্কিতভাবে পারমাণবিক হামলা করতে পারে। এতে আমেরিকার পারমাণবিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে তাৎক্ষণিক প্রতি-আক্রমণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্দেশ্যে আমেরিকার ৩৪ তম প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ারের প্রশাসন এই নিউক্লিয়ার ফুটবলের ধারণা নিয়ে আসে।
এই ফুটবলটি তৈরি করেন ক্যাপ্টেন অ্যাডওয়ার্ড বিচ জুনিয়র, যিনি ছিলেন একজন সাবমেরিন অফিসার। তিনি প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের নেভাল এইড হিসেবেও কাজ করেন। আইজেনহাওয়ারের পর থেকে পরবর্তী সকল প্রেসিডেন্টদের কাছে এই ব্যাগটি শান্তিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রথমবার করা হয় জন এফ কেনেডির কাছে। প্রথমবারের মতো এই ব্যাগের ছবিও দেখা যায় প্রেসিডেন্ট কেনেডির সময়েই। ১৯৬৩ সালের ১০ মে তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ম্যাসাচুসেটসের হাইয়ানিস পোর্টে গেলে এই ফুটবলকেও সাথে দেখা যায়।
এর নাম ‘ফুটবল’ কবে থেকে হলো, তার সঠিক উৎস জানা যায় না। তবে ১৯৬৫ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের রিপোর্টার বব হরটনের এক আর্টিকেলে এই শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। লেখাটি ছিল এর ২ বছর আগে কেনেডির মৃত্যু ও প্রেসিডেন্টের পারমাণবিক ক্ষমতার হস্তান্তর বিষয়ে। হরটন লেখেন, কেনেডি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর টেক্সাসের ডালাসে হাসপাতালে মৃত্যুপথযাত্রায় ছিলেন।
তখন ইরা গিয়ারহাট নামের এক আমেরিকান ওয়ারেন্ট অফিসার বাইরে লবিতে বসে একটা বাদামি চামড়ার ব্যাগ পাহাড়া দিচ্ছিলেন। একে বলা হতো ‘ফুটবল’।
২০০৫ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের আরেক আর্টিকেলে দাবি করা হয়, আমেরিকার প্রথম পারমাণবিক যুদ্ধের পরিকল্পনা বা এসআইওপির সাংকেতিক নাম ছিল ‘ড্রপকিক’। এখান থেকেই ফুটবল কথাটা এসেছে। তবে এ রকম কোনো সাংকেতিক নাম আদৌ ছিল কিনা তা নিয়েও আছে বিতর্ক। যেখান থেকেই নামটি এসে থাকুক, আমেরিকানরা একে ফুটবল বলেই ডাকে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ও যে সামরিক কর্মকর্তা এটা বহন করেন, তারাও এই নামই ব্যবহার করে থাকেন।
৪৫ পাউন্ড ওজনের নিউক্লিয়ার ফুটবলে চারটি জিনিস থাকে। প্রথমটি হচ্ছে ব্ল্যাক বুক। এতে থাকে প্রতি আক্রমণ করার বিভিন্ন উপায় সম্পর্কে তথ্য। আরেকটি বইয়ে থাকে বিভিন্ন গোপন স্থানের নাম। একটা ফাইলে আট থেকে দশ পৃষ্ঠার বর্ণনা থাকে, জরুরি সম্প্রচার ব্যবস্থার প্রক্রিয়া নিয়ে। আরেকটা কার্ডে গোপন সঙ্কেত লেখা থাকে। ধারণা করা হয়, ব্রিফকেসে উন্নত প্রযুক্তির যোগাযোগ মাধ্যমও থাকে। কারণ ফুটবলের কিছু ছবিতে অ্যান্টেনাও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে।
ব্ল্যাক বুকে থাকে আমেরিকার পারমাণবিক যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য। এর পূর্ব নাম ছিল SIOP (Single Integrated Operational Plan)। এতে পূর্ব অনুমোদিত আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিকল্প উপায় দেওয়া থাকে, যা জরুরি মুহূর্তে প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতে পারেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রশাসনের সময় নিউক্লিয়ার যুদ্ধের পরিকল্পনা কিছুটা সরলীকরণ করে সারাংশ আকারে লিখা হয়। এটা অনেকটা রেস্তোরাঁর খাবারের মেন্যুর মতো করে লিখা থাকে।
যে কার্ডে গোপন সঙ্কেত লেখা থাকে, সেটাকে ‘বিস্কুট’ বলে ডাকা হয়। পারমাণবিক আক্রমণের ক্ষেত্রে এই বিস্কুটের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট যদি পারমাণবিক আক্রমণ জরুরি মনে করেন, তাহলে সবার আগে তাকে ‘ফুটবল’টা খুলতে হবে। তারপর সম্ভাব্য আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। তিনি চাইলে সামরিক নেতাদের কাছ থেকে পরামর্শ নিতে পারেন, তবে সেটি বাধ্যতামূলক নয়। ‘বিস্কুট’ এর মাধ্যমে তিনি পেন্টাগনে ন্যাশনাল মিলিটারি কমান্ড সেন্টারের এক সামরিক কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করবেন। সামরিক কর্মকর্তা যখন নিশ্চিত হবেন প্রেসিডেন্টের কাছ থেকেই নির্দেশ পেয়েছেন, তখন তিনি আক্রমণের নির্দেশ দিবেন।
এর কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশ পথে স্ট্রাটেজিক বোম্বার থেকে কিংবা সাবমেরিন বা স্থলপথে মিসাইল আক্রমণ শুরু হবে। ‘বিস্কুট’ একসময় ফুটবলের ভেতরে রাখা হলেও প্রেসিডেন্টরা বর্তমানে এটা নিজেদের পকেটেই রেখে থাকেন। তবে এতে একাধিকবার উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে।
নিউক্লিয়ার ফুটবল নিয়ে বিভিন্ন উদ্বেগজনক ঘটনা
জিমি কার্টার একবার ড্রাই ক্লিনারকে দেওয়া স্যুটের মধ্যে ‘বিস্কুট’ দিয়ে দিয়েছিলেন। রোনাল্ড রিগ্যান একবার গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে তার কাপড় থেকে বিস্কুটের দখল নিয়ে নেয় এফবিআই এজেন্টরা। বিল ক্লিনটন একবার এই বিস্কুট হারিয়ে ফেলেছিলেন, যেটা কয়েক মাস পর জানা যায়।
বিস্কুটের মতো ফুটবল নিয়েও বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে। জেরাল্ড ফোর্ডের আমলে একবার ভুল করে ফুটবলটি এয়ার ফোর্স ওয়ানে ফেলে আসা হয়। রোনাল্ড রিগ্যান, জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ ও বিল ক্লিনটন বিভিন্ন সময়ে তাদের সাথে ফুটবল বহন করা মিলিটারি এইডদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনাগুলোর ফলে হয়তো বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে এত সংবেদনশীল একটি বিষয়ের দায়িত্ব যখন একক ব্যক্তির হাতে থাকে, তখন প্রতিটি দিকই খুব সতর্কতার সাথে লক্ষ্য রাখতে হয়।
নিউক্লিয়ার ফুটবল নিয়ে বিতর্ক
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় নিউক্লিয়ার ফুটবল নিয়ে অন্তত দুটি বিতর্কিত ঘটনা ঘটেছে। প্রথমটি ছিল ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চীন সফরের সময়। বেইজিংয়ে আমেরিকান কর্মকর্তাদের সাথে চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় ফুটবল নিয়ে। চীনা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা চাচ্ছিলেন না ট্রাম্পের সাথে থাকা মিলিটারি এইড ফুটবলটি নিয়ে গ্রেট হল অব পিপলে প্রবেশ করুক। এটা নিয়ে দুই পক্ষের প্রায় হাতাহাতি লেগে যাচ্ছিল। পরে অবশ্য বেইজিংয়ের পক্ষ থেকে ক্ষমা চাওয়া হয় ঘটনাটি নিয়ে।
দ্বিতীয় ঘটনাটি খুবই সাম্প্রতিক। গত ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকরা যে হামলা চালায়, তাতে ফুটবলের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তখন সেখানে থাকা ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সাথে বিকল্প নিউক্লিয়ার ফুটবলটি ছিল।
ভাইস প্রেসিডেন্টদের কাছে বিকল্প নিউক্লিয়ার ফুটবল দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয় আইজেনহাওয়ারের সময় থেকেই। আইজেনহাওয়ারের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে বিকল্প ফুটবল দেওয়া হয়। এটা করা হয় তাদের মধ্যে কেউ যদি শহরের বাইরে থাকেন, তাহলে যেন জরুরি সিদ্ধান্ত দ্রুত দিতে পারেন। আইজেনহাওয়ারের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর শঙ্কা জাগে, তিনি যদি যেকোনো সময় মারা যান, আর ওই মুহূর্তে নিক্সন হোয়াইট হাউজে না থাকেন, তাহলে সোভিয়েতরা আক্রমণ করলে পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য কোনো অভিভাবক থাকবেন না। ভাইস প্রেসিডেন্টদের কাছে বিকল্প ব্যবস্থা রাখা হয় প্রেসিডেন্টরা যদি ওই মুহূর্তে কর্মক্ষম না থাকেন, সেটা চিন্তা করেই।
তবে প্রেসিডেন্ট কেনেডি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের কাছে কোনো বিকল্প ফুটবল রাখেননি। রিচার্ড নিক্সনও প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় ভাইস প্রেসিডেন্ট স্পাইরো এগনিউকে ফুটবল দেননি। তবে বর্তমান সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্টরা নিয়মিতভাবেই নিউক্লিয়ার ফুটবলের গোপনীয় উপকরণগুলো দেখতে পান। পূর্বে তারা শুধু শহরের বাইরে গেলে ফুটবল সাথে নিয়ে গেলেও ওবামা প্রশাসনের সময় তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে সব সময়ই ফুটবলটি থাকত। ধারণা করা যায়, বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও এটি সাথে রাখেন।
ক্যাপিটল হিলে হামলাকারীরা মাইক পেন্স ও নিউক্লিয়ার ফুটবলের ১০০ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত কাছাকাছি চলে এসেছিল। এতে প্রশ্ন উঠেছিল হামলাকারীরা ফুটবল হাতে পেয়ে গেলে কোনো ক্ষতি হতে পারত কিনা। কিংবা ভাইস প্রেসিডেন্টের পারমাণবিক বোমা হামলার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা আছে কিনা।
ভাইস প্রেসিডেন্ট যদি পারমাণবিক হামলার নির্দেশ দিতে চান, তাহলে তাকে প্রেসিডেন্টের মতোই ফুটবল বা ব্রিফকেস খুলে পেন্টাগনের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। তবে এখানে যে মিলিটারি এইড সাথে থাকবেন, তিনিও খুলতে দিতে হবে। পেন্টাগনের অফিসার তখন জানবেন যে কোডটি পাঠানো হয়েছে, সেটা প্রেসিডেন্ট থেকে এসেছে, নাকি ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে এসেছে। তারা এটাও জানবেন যে, প্রেসিডেন্ট জীবিত আছেন নাকি মৃত। প্রেসিডেন্ট যদি ওই মুহূর্তে জীবিত থাকেন, তাহলে ভাইস প্রেসিডেন্টের নির্দেশ বৈধ হবে না। তাই এটা নিয়ে সম্ভবত চিন্তার কিছু নেই।
এবার আসা যাক হামলাকারীদের প্রসঙ্গে। মাইক পেন্স প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ট্রাম্পের কথা মতো টালবাহানা না করায় ট্রাম্প তারা সমালোচনা করেছিলেন। ট্রাম্পের ভক্তরা সেদিন পেন্সকে ফাঁসিতে ঝুলানোর স্লোগান দিয়ে আসছিল। তবে তারা সম্ভবত ফুটবল নেওয়ার মতো অবস্থাতে আসতেই পারত না। মাইক পেন্সের সাথে থাকা ডজনখানেক নিরাপত্তাকর্মীরা সেটা ভালোমতোই সামাল দিতে পারতেন। পেন্সের কাছ পর্যন্ত আসতে হয়তো তাদের লাশের স্তুপে পরিণত হতে হতো।
যদি পেন্সের কাছে পর্যন্ত আসতও, তারা হয়তো এর দিকে লক্ষ্য করত না। কারণ ফুটবলটি খুবই সাধারণ ব্রিফকেসের মতো দেখতে। এর তালা ভেঙে তারা যদি নির্দেশও দিত, যেটা হওয়া খুবই অস্বাভাবিক, সেক্ষেত্রেও ততক্ষণে পেন্টাগন জেনে যেত বোমা হামলার নির্দেশ আসছে অ-স্বীকৃত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে।
তবে একটা সম্ভাবনা আছে এটা রাশিয়ান বা চীনাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার। সেদিনের হামলায় রাইলি জুন উইলিয়ামস নামে পেনসিলভানিয়ার এক নারী স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ল্যাপটপ চুরি করেন। সেটা তিনি আবার তার এক রুশ বন্ধুর কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। ওই রুশ বন্ধুর আবার পরিকল্পনা ছিল ল্যাপটপটি রুশ গোয়েন্দা সংস্থা এসভিআরের (SVR) কাছে বিক্রি করে দেওয়া।
এসব কারণে ফুটবলের আকার এত সুস্পষ্ট হওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জাতীয় নিরাপত্তা ও বর্তমান যুগের কথা চিন্তা করলে এই ডিভাইসের আকার আরো ছোট করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবার খোদ নিউক্লিয়ার ফুটবলের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় হচ্ছে নিউক্লিয়ার ফুটবল শুধু আমেরিকারই আছে এমন না। আশির দশকের শুরুর দিকে আমেরিকানদের পারমাণবিক হামলার কথা চিন্তা করে রাশিয়াও ফুটবল রাখা শুরু করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন ওই সময়ের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনকে একাধিকবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই পক্ষই ফুটবল ব্যবহার করা বন্ধ করা নিয়ে।
১৯৯৪ সালে ইয়েলৎসিন যখন প্রথমবার ক্লিনটনকে প্রস্তাব দেন, তখন ক্লিনটন বলেছিলেন তিনি ভেবে দেখবেন বিষয়টা। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে ইয়েলৎসিন পুনরায় এ প্রস্তাব দিলে ক্লিনটন বাধা দিয়ে বলেন, এটা বেসামরিক জনগণের কাছে একটা প্রতীক হিসাবে কাজ করবে। তবে সব প্রেসিডেন্ট এ ফুটবল নিয়ে রোমাঞ্চিত ছিলেন না। প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন চাইতেন না কেউ তার সাথে সাথে এটা নিয়ে ঘুরে বেড়াক।
তবে প্রেসিডেন্টদের পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার অতি মানবীয় ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করেছেন আমেরিকান সিনেটররা। ম্যাসাচুসেটসের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম পেরি ইউএসএ টুডেতে এক কলামে লিখেছেন, প্রেসিডেন্টদের একক ক্ষমতা হ্রাস করা উচিত। পারমাণবিক যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সিনেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো পাগলাটে প্রেসিডেন্টদের হাতে এমন সংবেদনশীল বিষয় নিরাপদ নয় বলে মনে করছেন তারা।
তবে এটা শুধু ট্রাম্পের ক্ষেত্রেই প্রশ্ন উঠেছে এমন নয়। সত্তরের দশকে রিচার্ড নিক্সন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গিয়ে অভিশংসিত হওয়ার মুখে ছিলেন। তখন তিনি বিষাদগ্রস্ত হয়ে অ্যালকোহলে আসক্ত হয়ে পড়েন। তখন তার মন্ত্রীপরিষদের সদস্যরা আশঙ্কা করছিলেন তিনি পারমাণবিক যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ফেলতে পারেন। তবে সেরকম কিছু হয়নি।
বর্তমানে ফুটবলের দায়িত্ব আছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে। ডেমোক্রেট নেতারা সম্প্রতি বাইডেনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন আমেরিকার নিউক্লিয়ার নীতিমালা সংস্কার বিষয়ে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা যেন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর প্রেসিডেন্টদের একক কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক হয়েছে। বাইডেন এটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে এখন পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট যেখানে যাবেন, তার সাথে নিউক্লিয়ার ফুটবলটিও অনুসরণ করে যেতে থাকবে।