পাকিস্তান কেন আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না?

ইংরেজি ভাষায় একটি বহুল প্রচলিত উপমা রয়েছে, ‘More Catholic than the Pope!’ অর্থাৎ ‘পোপের চেয়েও বেশি ক্যাথলিক!’ পোপ হচ্ছেন খ্রিস্টধর্মের অন্তর্ভুক্ত রোমান ক্যাথলিক চার্চের শীর্ষ ধর্মগুরু, কাজেই তার চাইতে বড় ক্যাথলিক হওয়া তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব নয়। বোঝাই যাচ্ছে, কেউ যদি কোনো বিষয়ে সেই বিষয়ের মূল কর্মকের (actor) চেয়ে বেশি উৎসাহ প্রদর্শন করে, তাকে উদ্দেশ্য করে এই উপমা ব্যবহার করা হয়। অনলাইনভিত্তিক প্রশ্নোত্তর প্ল্যাটফর্ম ‘কোরা’য় (Quora) একজন ব্যবহারকারী পাকিস্তান কর্তৃক আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না প্রদানের বিষয়কে এই উপমা দিয়েই বর্ণনা করেছেন।

আর্মেনিয়া দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আজারবাইজান ও তুরস্কের ঐতিহাসিক বিরোধ রয়েছে। ১৯৮৮–৯৪ সালের আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধের পর থেকে আর্মেনীয়–সমর্থিত রাষ্ট্র আর্তসাখ আন্তর্জাতিক আইনগতভাবে আজারবাইজানি ভূমি নাগর্নো–কারাবাখের বৃহদাংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে এবং এজন্য আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যবর্তী সম্পর্ক খুবই তিক্ত। অন্যদিকে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ওসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক পরিচালিত আর্মেনীয় গণহত্যার কারণে তুরস্কের সঙ্গে আর্মেনিয়ার সম্পর্কও রীতিমতো শত্রুভাবাপন্ন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজারবাইজান ও তুরস্ক উভয়েই আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে।

পাকিস্তান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বস্তুত পাকিস্তান বিশ্বের একমাত্র রাষ্ট্র, যেটি আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। অথচ পাকিস্তান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে কোনো ধরনের ঐতিহাসিক বা ভূখণ্ডগত বিরোধ নেই। সেক্ষেত্রে পাকিস্তান কেন আর্মেনিয়ার প্রতি এরকম নীতি গ্রহণ করেছে? মূলত এর পশ্চাতে পাকিস্তানের কিছু নিজস্ব হিসেবনিকেশ রয়েছে।

১৯৮৮–৯৪ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় একদল আজারবাইজানি সৈন্য। এই যুদ্ধে পাকিস্তান আজারবাইজানকে সমর্থন করে; Source: Wikimedia Commons

প্রথমত, ১৯৯১ সালে আজারবাইজানের স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই পাকিস্তান তেলসমৃদ্ধ মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্রটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করতে উদ্যোগী হয়। পাকিস্তান ছিল আজারবাইজানকে স্বীকৃতি প্রদানকারী তৃতীয় রাষ্ট্র। ১৯৯২–৯৪ সালে আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান আজারবাইজানকে সমর্থন প্রদান করে এবং কিছু কিছু সূত্রের মতে, কিছু পাকিস্তানি স্বেচ্ছাসেবক এই যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধও করে। পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে, এই যুদ্ধের সময় আর্মেনিয়া আজারবাইজানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে আজারবাইজানি ভূমি দখল করেছে এবং সেখানে জাতিগত আজারবাইজানিদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালিয়েছে। পাকিস্তানি ভাষ্যমতে, মুসলিম আজারবাইজানের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তারা আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত রয়েছে।

২০১৫ সালে পাকিস্তানি সরকারের প্রদত্ত বক্তব্য অনুযায়ী, আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখ থেকে নিজস্ব উপস্থিতি প্রত্যাহার করে নেয়ার আগপর্যন্ত পাকিস্তান আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান করবে না। শুধু তা-ই নয়, ২০২০ সালের আজারবাইজানি–আর্মেনীয় যুদ্ধ চলাকালেও পাকিস্তান আজারবাইজানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করে। তদুপরি, পাকিস্তান অল্প কয়েকটি রাষ্ট্রের মধ্যে একটি, যারা ১৯৯২ সালে সংঘটিত খোজালি হত্যাকাণ্ডকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালে নাগর্নো–কারাবাখের খোজালিতে আর্মেনীয় সৈন্যদের হাতে ২০০-৬০০ বেসামরিক আজারবাইজানি নিহত হয় এবং আজারবাইজানি সরকার এই ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ (genocide) হিসেবে অভিহিত করে।

একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে তুরস্ক, পাকিস্তান ও আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা; Source: TRT World

দ্বিতীয়ত, আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি না দেয়ার পশ্চাতে পাকিস্তানি সরকারের প্রদর্শিত একটি যুক্তি হচ্ছে, আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুসরণ করছে না। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ৪টি সিদ্ধান্তে আর্মেনিয়াকে নাগর্নো–কারাবাখ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু আর্মেনিয়া এই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এক্ষেত্রে আর্মেনিয়ার আচরণকে পাকিস্তানিরা কাশ্মিরের ক্ষেত্রে ভারতের আচরণের সঙ্গে তুলনা করে, কারণ ভারতও অনুরূপভাবে কাশ্মিরে গণভোট আয়োজনের ব্যাপারে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনা অমান্য করেছে।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দুটি প্রস্তাবনা পুরোপুরি সদৃশ নয়। কারণ কাশ্মির সংক্রান্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনায় কাশ্মিরে গণভোট আয়োজনের পূর্বশর্ত হিসেবে কাশ্মির থেকে পাকিস্তানি সৈন্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার ও ভারতীয় সৈন্য আংশিকভাবে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়েছিল। পাকিস্তান বা ভারত কেউই এই পূর্বশর্ত পালন করেনি, সুতরাং এক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রস্তাবনা কার্যকরী না হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানের নিজেরও দায় রয়েছে।

সর্বোপরি, আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান না করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একধরনের ‘সফট পাওয়ার’ অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর্মেনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করলে পাকিস্তানের কার্যত কোনো ক্ষতি হবে না, কিংবা সম্পর্ক স্থাপন করলেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না। কিন্তু ‘মুসলিম’ আজারবাইজানের পক্ষ নিয়ে আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থাকার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান একদিকে মুসলিম বিশ্বে নিজেদের ভাবমূর্তিকে সমুন্নত করার প্র‍য়াস পেয়েছে, অন্যদিকে পাকিস্তানি জনসাধারণের কাছেও নিজেদের পররাষ্ট্রনীতিকে ইসলামপন্থী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলাম ধর্মের নামে, সুতরাং পাকিস্তানিদের কাছে এই ধরনের প্রতীকী অবস্থানের যথেষ্ট মূল্য রয়েছে।

২০২০ সালের আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের প্রতি পাকিস্তানি সমর্থনের কৃতজ্ঞতা জানাতে বাকুতে অবস্থিত হায়দার আলিয়েভ সেন্টারের ওপরে পাকিস্তানি পতাকার প্রতিচ্ছবি ফেলা হয়; Source: Meydan TV

অবশ্য পাকিস্তানি সরকারের এই সিদ্ধান্তে প্রকৃতপক্ষে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের তুলনায় নিজেদের ভাবমূর্তি সৃষ্টির বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ অন্যান্য বহু বিষয়ে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রনীতি ‘মুসলিম স্বার্থ’ রক্ষা থেকে বিরত থেকেছে, কারণ সেক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরকে ঝুঁকি নিতে হতো। উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তানে পরিচালিত আক্রমণে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে এবং চীনের জিনজিয়াংয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চীনা সরকার কর্তৃক পরিচালিত নিষ্পেষণের কোনো ধরনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করা থেকে বিরত থেকেছে। এজন্য পাকিস্তান কর্তৃক আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান না করার বিষয়কে কার্যত পাকিস্তানের একটি ‘ঝুঁকিবিহীন’ ও ‘খরচবিহীন’ ভাবমূর্তি উন্নয়নের কৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে।

এসব কারণে পাকিস্তান আর্মেনিয়াকে স্বীকৃতি প্রদান থেকে বিরত থেকেছে এবং এর বিনিময়ে আজারবাইজান কাশ্মির সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অবস্থানের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন ব্যক্ত করেছে। প্রত্যুত্তরে, আর্মেনিয়া ২০১৬ সালে পাকিস্তান কর্তৃক রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’তে পর্যবেক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রচেষ্টায় ভেটো প্রদান করেছে এবং কাশ্মির সংক্রান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে।

Related Articles

Exit mobile version