সারাদিনের বিভিন্ন কাজকর্ম সেরে আপনি হয়তো রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটু পরেই বিছানায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাবেন। ঠিক সেসময়েই বুটের খটখট আওয়াজ আপনার কানে আসবে, আপনার মনে হবে ভারি বুটজোড়া পায়ে দেয়া কিছু মানুষ করিডোরে হেঁটে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড পর আপনার দরজায় টোকা পড়বে, ওপাশ থেকে দ্রুত দরজা খোলার আদেশ শুনতে পাবেন আপনি।
হয়তো ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দেবেন। ভুলক্রমে যদি খুলে দিতে কয়েক সেকেন্ড দেরি হয়, তবে আপনার দরজায় প্রচন্ড জোরে আঘাত করা হবে, সেই সাথে ওপাশ থেকে অশ্রাব্য গালিগালাজ ভেসে আসবে। আপনি শশব্যস্ত হয়ে দরজা খুলে দেবেন এবার। ক্ষণিক পরেই দেখতে পাবেন, কিছু সশস্ত্র মানুষ আপনার ঘরে ঢুকে সমস্ত জিনিসপত্র উল্টেপাল্টে দেখছে, তল্লাশি চালাচ্ছে কোনো কারণ ছাড়াই। তাদের চোখে আপনি ‘সন্দেহভাজন’ কিংবা ‘পরিচয় আড়াল করে রাখা বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মী’।
ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমের দ্বীপপুঞ্জগুলো থেকে মূল ভূখণ্ডে আসা পাপুয়ানদের প্রায়ই এ ধরনের বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়। কোনো কারণ ছাড়াই ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত পুলিশবাহিনী তাদেরকে গ্রেফতার করে, কখনও আবার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকলে গুমও করে ফেলে। কখনও কোনো কারণে যদি তারা পুলিশের কাছে সাহায্যের জন্য গিয়ে থাকে, তাহলে এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে তাদেরকে খালি হাতে ফিরে আসতে হবে। পাপুয়ানদের প্রতিটি পদক্ষেপ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে তারা, বিভিন্ন হয়রানির মাধ্যমে সবসময় তাদের উপর ভীতিকর অবস্থা জারি রাখে। ইন্দোনেশিয়ার মূল ভূখণ্ডে গিয়ে কৃষ্ণাঙ্গ পাপুয়ানদের অবস্থা দেখলে আপনার মনে হবে যেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কিছু নাগরিককে খুব পরিকল্পিতভাবে পরাধীন করে রাখা হয়েছে।
এশিয়ার দেশগুলো একসময় ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী দেশগুলোর মাধ্যমে শাসিত-শোষিত হয়েছিল। উপনিবেশবাদী দেশগুলো তাদের উপনিবেশগুলোতে স্থানীয় জনগণকে একে অপরের বিপক্ষে দাঁড় করানোর সুচতুর খেলা খেলেছে শতাব্দী ধরে। ঠিক ভারতবর্ষের দিকে তাকান। বিশ শতকের শুরু থেকে যখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে, তখনই হিন্দু-মুসলিমকে একে অপরের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল তারা। এছাড়াও প্রতিটি উপনিবেশেই তারা এমন একটি অনুগত শ্রেণী তৈরি করে, যে শ্রেণীর মানুষেরা শত অন্যায় সত্ত্বেও তাদের সমর্থন দিয়ে গেছে। আমাদের দেশের জমিদারেরা ব্রিটিশদের নিয়মিত খাজনা তো দিয়েছেই, এর পাশাপাশি সর্বহারা জনগণের যেকোনো বিদ্রোহ দমনেও ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল।
মসলার জন্য ইন্দোনেশিয়া সেই প্রাচীন আমল থেকেই বিখ্যাত। ঔপনিবেশিক যুগ শুরু হওয়ার পর থেকে এই অঞ্চলে ইউরোপীয়দের শকুনি দৃষ্টির নজর পড়তে খুব বেশি দেরি হয়নি। ডাচরা এই অঞ্চলে এসে প্রথমদিকে ব্যবসায়িক দিকে জোর দিলেও ক্রমান্বয়ে ক্ষমতার নেশা তাদের পেয়ে বসে এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কারণে ক্ষমতা করায়ত্ত্ব করতে সক্ষম হয় তারা। ইন্দোনেশিয়ার সমাজে তারা তিনটি শ্রেণী গড়ে তুলেছিল। প্রথম শ্রেণীতে ডাচরাই ছিল এবং সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতো। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল অন্যান্য বিদেশি বণিকেরা, যারা প্রায় প্রথম শ্রেণীর ডাচদের সমান সুবিধা লাভ করতো। আর তৃতীয় শ্রেণীতে ছিল ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় নাগরিকেরা, যাদেরকে একেবারে নিচু নজরে দেখত ডাচরা। ইন্দোনেশিয়ার অনেক স্থানীয় অধিবাসীকে দাস হিসেবেও ব্যবহার করত তারা।
ইউরোপীয় ও অন্যান্য বণিকেরা যখন চলে যায় এবং ইন্দোনেশিয়া স্বাধীনতা লাভ করে, তখন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণী শূন্য হয়ে যায়। এই ফাঁকা জায়গা দখল করতে এগিয়ে এসেছিল তুলনামূলক শ্বেতাঙ্গ ইন্দোনেশিয়ানরা। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই ইন্দোনেশিয়ায় সাদা চামড়ার আলাদা গুরুত্ব তৈরি হয়েছিল, কারণ যেহেতু ডাচরা সাদা ছিল এবং তারাই সুযোগ-সুবিধাগুলো ভোগ করত। ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিমদিকের দ্বীপপুঞ্জে কৃষ্ণাঙ্গ যারা ছিল, তাদের নাগরিক অধিকার বলতে কিছু ছিল না, দাসদের ক্ষেত্রে তাদের অনুপাত ছিল সবচেয়ে বেশি। ডাচরা ছেড়ে যাওয়ার পরও ইন্দোনেশিয়ার মূলধারার সমাজে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে পাপুয়ানরা সাধারণ ইন্দোনেশিয়ানদের তুলনায় নিম্ন পর্যায়ের এবং তারা এখনও বর্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত।
পশ্চিম পাপুয়া ইন্দোনেশিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির কারণে নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করে আসছে। পৃথিবীর আর দশটা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মতো এখানেও ইন্দোনেশিয়ান সরকার বল প্রয়োগের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করেছে প্রতিবার। ভারতের কাশ্মীর কিংবা স্পেনের কাতালোনিয়ায় যে কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার এখানেও ঠিক একই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন একটু মাথাচাড়া দিলেই শত শত সামরিক বাহিনীর সদস্যকে প্রেরণ করা হয় সেখানে। এছাড়া আন্দোলনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অন্যায়ভাবে গুম-খুনের ঘটনা তো আছেই। ইন্দোনেশিয়ায় যত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে, তার প্রায় পুরোটাই পাপুয়ানদের অঞ্চলে।
অর্থনৈতিকভাবেও পশ্চিম পাপুয়া অঞ্চল ইন্দোনেশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্বর্ণের খনি এই অঞ্চলে অবস্থিত। ইন্দোনেশিয়ায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে কখনও পশ্চিম পাপুয়া স্বাধীন হয়ে যায়, তবে অন্যান্য দ্বীপেও যে স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন শুরু হবে না, তার নিশ্চয়তা কি? এজন্য অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক– সবদিক বিবেচনা করে অন্যায় বলপ্রয়োগ করে হলেও কেন্দ্রীয় সরকার কখনই পশ্চিম পাপুয়াকে আলাদা হতে দিতে চায় না।
পশ্চিম পাপুয়ায় সবদিক থেকেই ইন্দোনেশিয়ার মূলধারা থেকে পিছিয়ে আছে। এজন্য শিক্ষার ক্ষেত্রে মেধাবী পাপুয়ানরা ইন্দোনেশিয়ার মূলধারার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়তে আসেন। কিন্তু এখানে এসে বেশিরভাগ পাপুয়ানকেই বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয়। ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা অভিযোগ করেন, পাপুয়ানরা সাধারণ ইন্দোনেশিয়ানদের চেয়ে বেশ ধীরগতির। পাপুয়ানদের গায়ের বর্ণ কালো হওয়ায় ইন্দোনেশিয়ার বর্ণবাদী সমাজ তাদেরকে গ্রহণ করে না, বরং নানাভাবে বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেয়। ধরুন, আপনি কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য আবেদন করেছেন। এখন একটি পদের জন্য আপনি ও আরেকজন সাধারণ শ্বেতাঙ্গ ইন্দোনেশিয়ান শেষ পর্যন্ত টিকে থাকলে সাধারণ ইন্দোনেশিয়ানকেই চাকরি দেয়া হবে। আপনি শুধু আপনার গায়ের বর্ণের জন্য বাদ পড়ে যাবেন। এছাড়া প্রায়ই আপনাকে উদ্দেশ্য করে বানরের ডাক শোনানো হতে পারে। কৃষ্ণাঙ্গদের হেয় করার জন্য শ্বেতাঙ্গরা বিশ্বব্যাপী এই অমানবিক কাজটি করে থাকে।
গত বছর আমেরিকার মিনিয়াপোলিসে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর যে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে, তার হাওয়া লেগেছিল ইন্দোনেশিয়াতেও। সেদেশের নাগরিকেরা স্বতস্ফূর্তভাবে আন্দোলনকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। কিন্তু নিজ দেশেই যেখানে পাপুয়ানরা যেখানে প্রতিনিয়ত ভয়াবহ প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়, তখন বাইরের আন্দোলনে সংহতি জানানোটা ঠিক কতখানি যৌক্তিক?– এই প্রশ্ন তোলেন সেদেশের মানবাধিকার কর্মীরা।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বর্ণবৈষম্যের মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ পাপুয়ানদের। শুধু গায়ের বর্ণের কারণে একটি অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষাদীক্ষাসহ সবকিছুতে সুপরিকল্পিতভাবে পিছিয়ে রাখা হচ্ছে, প্রতিবাদ করলে উল্টো অমানবিক আচরণ করা হচ্ছে– এই বিষয়গুলো নিশ্চিতভাবে একজন পাপুয়ান অধিবাসীর পক্ষে মেনে নেয়া কষ্টকর। পাপুয়ানদের প্রতি যে বৈষম্য তা শুধু ইন্দোনেশিয়ায় বিভেদই বাড়িয়ে তুলবে না, বরং চরমপন্থার উত্থানের পেছনেও বড় ভূমিকা রাখবে।